অপ্রকৃতিস্থ সমাজের আবির্ভাবের পথ মুক্ত by আলমগীর মহিউদ্দিন
ফরাসি
সংসদ সদস্য ও অর্থনীতিবিদ ক্লদ ফ্রেডারিক বাসতিয়াত তার সমকালীন
আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্যটি করলেও তিনি বাস্তবতার
নিরিখে একটি সর্বজনীন সর্বকালের সত্য উচ্চারণ করেছিলেন। সমাজের একদল মানুষ
উচ্চাকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত হয়ে যদি ক্ষমতা হরণ করে তবে বেশির ভাগ সময়েই দেখা
যায়, তারা রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন করছে। জনগণকে নিষ্পেষণ করছে এবং সামাজিক
অনাচার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাসতিয়াত সত্যই বলেছেন, এরা ক্ষমতায় গিয়ে এমন আইন
প্রণয়ন করে এবং প্রশাসন এমনভাবে চালায় যেখানে কেবল তারাই লাভবান হয়।
প্রতিবাদী বা বিরোধীরা কোনো উচ্চবাচ্য করতে পারে না অথবা তাদের সেসব
অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়। এমনও প্রায়ই দেখা যায়, এমন ক্ষমতাবানেরা তাদের
প্রতিপক্ষের সব ভালো কাজ ও কথাকে প্রবল প্রচারের মাধ্যমে খারাপ ও বিকৃত বলে
প্রচার করছে। বাসতিয়াত মূলত এ গোষ্ঠীর আর্থিক অনাচারের ওপর জোর দিয়েছিলেন এ
কথা বলে যে, এটাই সব অন্যায়ের মূল। বাসতিয়াত তাঁর বিখ্যাত বই ‘দি ল’ লেখেন
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। ফরাসি পার্লামেন্টে সদস্য হিসেবে তিনি দেখেছেন আইনের
ব্যবহার এবং অপব্যবহার। তিনি ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়েছেন আইনের এই
অপব্যবহারের দরুণ। তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন এর ব্যবহারের জন্যও। কারণ এই আইন
ব্যবহার করেই অমানবিক এবং জনবিরোধী কর্মকাণ্ডগুলোও সম্পাদন করে এক ক্ষুদ্র
গোষ্ঠী।
তিনি লিখেছেন, "Legal plunder can be committed in an infinite number of ways, because, there are an infinite number of plans for organizing it : Tariffs, protection, bonuses, subsidies, incentives, the progressive income tax, free education, the right of employment, the right to profit, the right to wages, the right to relief, the right to the tools of production, interest free credit etc etc. And the aggregate to all these plans, in respect to what they have in common, legal plunder, that goes under the name of socialism."
উদ্ধৃতিটা একটু বড় হলেও, বর্তমান অবস্থার চিত্র এত চমৎকার অন্যত্র পাওয়া কঠিন। ভালো ভালো কথা বলে কেমন করে আইন দিয়ে লুণ্ঠন করা হচ্ছে, তা বাসতিয়াত দেখিয়েছেন।
আইন নিয়ে আইনজ্ঞ বাসতিয়াতের আরেকটি মন্তব্য আরো শক্ত অথচ খুব পরিচিত। তিনি বলেছেন, "ometimes the law defends plunder and participates in it, sometimes the law places the whole apparatus of judges, police, prisons and gendarmes at the services of the plunderers, and treats the victim- when he defends himself-as criminal."
এখন খবরের কাগজের পাতায় এবং মুখে মুখে প্রায়ই শোনা যায় বিচারপ্রত্যাশীদের হা হুতাশ। আর শোনা যায় অপরাধীদের হুঙ্কার, অবাধ বিচরণ। বাসতিয়াত ১৬৯ বছরের আগের অবস্থা বর্ণনা করলেও চিত্রটি এখন কতই না পরিচিত। রাজনৈতিক মঞ্চে, খবরের কাগজে এবং ঘরোয়া আলোচনায় এ কখাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে। এমনকি এটাও বলছে, আদালত নির্দেশের ছকে চলে। বিচারপ্রার্থীরা বিচার চাইতে এলে অপরাধীর সারিতে পড়ে যাচ্ছে। আইন অপরাধীকে সাজা না দিয়ে নির্যাতিতদের শাস্তি দিচ্ছে। ভাবটা এমন, কেন তুমি প্রতিবাদ করছ, নালিশ করছ? এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে অপপ্রচার। মানুষ যখন একটু স্বস্তির বাতাসের জন্য কথা বলছে, তখনই তাদের ওপর খড়গ থেমে আসছে। তারা মিছিল করে প্রতিবাদ করতে পারবে না, সমাবেশ করা হবে নিষিদ্ধ। এ অবস্থাকে বাসতিয়াত এমনভাবে বর্ণনা করেছেন- "They would be shepherds on us, their sheep" জনগণ ভেড়া এবং তারা হলো মেষপালক। এই অবাধ ব্যক্তিগত সুবিধাভোগের জন্য ছোট্ট গোষ্ঠীটি কখনো ক্ষমতা থেকে সরতে চায় না। এরা প্রায়ই ক্ষমতা এবং সম্পদ কুক্ষিগত রাখতে দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়ে তারস্বরে প্রচার করে, কোনো দুর্নীতি নেই। এ জন্যই তারা মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ করে যেন তাদের কর্মকাণ্ড কখনো সাধারণের গোচরে না আসে। আইন যেন নিজেকেই ধ্বংস করছে।
বাসতিয়াত ‘দি ল’ বইটি লিখেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে (১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে)। তখন তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণের জন্য এই বইটি লিখেছিলেন। তার প্রধান বার্তা ছিল, ‘প্রায় সব বিপ্লব অবশেষে বিপ্লবকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে, জনগণের কথা ভুলে যায়। আর্থিক ক্ষমতার অপব্যবহার দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।’ রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট জন ডাবলু হোয়াইট হেড এই অবস্থার নাম দিয়েছেন ‘ফিনানসিয়াল টিরানি’ (আর্থিক নিপীড়ন)। কারণ এই ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান গোষ্ঠী রাষ্ট্র ও জনকল্যাণের কথা বলে ট্যাক্স, চাঁদাসহ আর্থিক নানা বাধা-নিষেধ আরোপ করে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের স্বার্থেই। দেখা গেছে, এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘গণতন্ত্রের বাহক এবং ধারকে’র লেবাস পরে এ কর্মটি করে থাকে। সমস্যা হয় তখনই যখন অন্য কোনো গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করে এবং ভাগ চায়। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এ দুই গোষ্ঠীই ধর্মের বিরোধিতা করে নানাভাবে। এর মূল কারণ নৈতিকতা। ধর্ম নৈতিকতা শিক্ষা দেয় এবং জীবনধারণের অন্যতম ভিত্তি নির্ধারণ করে দেয়। সেকুলারিজমসহ অন্য কোনো মতবাদে নৈতিকতার স্থান নেই কিংবা থাকেলও তা অনেক নিচে। সেখানে নৈতিকতা তথাকথিত আইন বা নিয়মভিত্তিক; হৃদয় বা মনোবৃত্তিক নয়। ফলে অবিচার-অনাচার সেখানে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সহজেই করা যায়। তবে এ গোষ্ঠী ধর্মকেও ব্যবহার করে সুকৌশলে এবং জনগণ এখানেই ফেঁসে যায়। কারণ তারাও ধার্মিকের লেবাস পরে থাকে।
বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী রাউল নারোল তার সাড়া জাগানো ‘দি মোরাল কোড’ বইতে মানুষের আচরণ ও কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে নৈতিকতা কতখানি কাজ করে, তার বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি ‘নৈতিক জাল’ (মোরাল নেট) বলে একটি অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, এটা মানসিক বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই জালই মানুষের মন-আধ্যাত্মিক-সামাজিক প্রয়োজনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং জোগান দিয়ে থাকে। যখন এটার অভাব ঘটে তখনই মানসিক অশান্তি থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অশান্তি সৃষ্টি হতে থাকে। ঠিক একই কথা বলেছেন এরিক ফ্রম তার ‘দি সেইন সোসাইটি’ বইতে। তিনি বলেছেন, ‘আজকের দুনিয়াতে সবকিছুই বাজারজাত করা হচ্ছে, এমনকি মানসিকতাকেও। এটা করতে গিয়ে ‘নতুন নতুন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন করে প্রশ্নের সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে জীবনযাত্রার প্রয়োজনগুলোকে (এক্সিসটেনশিয়াল নিডস) বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে পরিচয়, মূল এবং অধিবাসী হওয়া নিয়ে। এমনকি, মানসিক সুস্থতা নিয়ে। অর্থাৎ কোনো সমাজ বা সংস্থার সাথে জড়িত থাকলে এ প্রচারগোষ্ঠী মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। প্রগতিশীলের নামে প্রচলিত সব ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে চায়।
তাই বিশ্বব্যাপী চলছে সামাজিক অস্থিরতা, এরিক মন্তব্য করেছেন। এ সবের মূলে আছে করপোরেশন এবং মুনাফালোভীরা যারা রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের প্রয়োজনে জোগান দিতে সবাইকে বাধ্য করছে; কখনো প্রত্যক্ষভাবে বা কখনো তাদের অজান্তে। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল ও তাদের সংগঠনগুলোকে প্রধানত ব্যবহার করা হচ্ছে এই সাংস্কৃতিক যাত্রার অঙ্গ হিসেবে। কিন্তু কেউই বুঝতে পারছে না, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এরিক ফ্রম মন্তব্য করেছেন, ‘এ অবস্থা ধারণ করে অপ্রকৃতিস্থ সমাজের’ (ইনসেইন সোসাইটি) সৃষ্টি হয়েছে। জালটি এমনভাবে বিছানো যেন কেউ এটা ছিন্ন করতে না পারে। ‘অতীতে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমনভাবে মানুষকে শৃঙ্খলিত করতে পারেনি। ফলে সমাজ নির্বীর্য, নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে; অশুভ শক্তিগুলো চেপে বসেছে এবং মানুষ অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।’ John F Schumaker তার প্রবন্ধ ‘ডিমরালাইজ মাইন্ড’-এ বলেছেন, যদি এখনই এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা না করা হয় তবে বিশ্বব্যাপী এক মহাধ্বংসের সূত্রপাত হতে পারে। আর এরিক বলেছেন, ‘গণতন্ত্র বর্তমানের অবয়বে অপ্রকৃতিস্থ সংস্কৃতির অভিভাবক হয়ে অবস্থান করছে।’ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সেই মহাবিপর্যয় হবে অবশ্যম্ভাবী।
তিনি লিখেছেন, "Legal plunder can be committed in an infinite number of ways, because, there are an infinite number of plans for organizing it : Tariffs, protection, bonuses, subsidies, incentives, the progressive income tax, free education, the right of employment, the right to profit, the right to wages, the right to relief, the right to the tools of production, interest free credit etc etc. And the aggregate to all these plans, in respect to what they have in common, legal plunder, that goes under the name of socialism."
উদ্ধৃতিটা একটু বড় হলেও, বর্তমান অবস্থার চিত্র এত চমৎকার অন্যত্র পাওয়া কঠিন। ভালো ভালো কথা বলে কেমন করে আইন দিয়ে লুণ্ঠন করা হচ্ছে, তা বাসতিয়াত দেখিয়েছেন।
আইন নিয়ে আইনজ্ঞ বাসতিয়াতের আরেকটি মন্তব্য আরো শক্ত অথচ খুব পরিচিত। তিনি বলেছেন, "ometimes the law defends plunder and participates in it, sometimes the law places the whole apparatus of judges, police, prisons and gendarmes at the services of the plunderers, and treats the victim- when he defends himself-as criminal."
এখন খবরের কাগজের পাতায় এবং মুখে মুখে প্রায়ই শোনা যায় বিচারপ্রত্যাশীদের হা হুতাশ। আর শোনা যায় অপরাধীদের হুঙ্কার, অবাধ বিচরণ। বাসতিয়াত ১৬৯ বছরের আগের অবস্থা বর্ণনা করলেও চিত্রটি এখন কতই না পরিচিত। রাজনৈতিক মঞ্চে, খবরের কাগজে এবং ঘরোয়া আলোচনায় এ কখাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে। এমনকি এটাও বলছে, আদালত নির্দেশের ছকে চলে। বিচারপ্রার্থীরা বিচার চাইতে এলে অপরাধীর সারিতে পড়ে যাচ্ছে। আইন অপরাধীকে সাজা না দিয়ে নির্যাতিতদের শাস্তি দিচ্ছে। ভাবটা এমন, কেন তুমি প্রতিবাদ করছ, নালিশ করছ? এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে অপপ্রচার। মানুষ যখন একটু স্বস্তির বাতাসের জন্য কথা বলছে, তখনই তাদের ওপর খড়গ থেমে আসছে। তারা মিছিল করে প্রতিবাদ করতে পারবে না, সমাবেশ করা হবে নিষিদ্ধ। এ অবস্থাকে বাসতিয়াত এমনভাবে বর্ণনা করেছেন- "They would be shepherds on us, their sheep" জনগণ ভেড়া এবং তারা হলো মেষপালক। এই অবাধ ব্যক্তিগত সুবিধাভোগের জন্য ছোট্ট গোষ্ঠীটি কখনো ক্ষমতা থেকে সরতে চায় না। এরা প্রায়ই ক্ষমতা এবং সম্পদ কুক্ষিগত রাখতে দুর্নীতির প্রশ্রয় দিয়ে তারস্বরে প্রচার করে, কোনো দুর্নীতি নেই। এ জন্যই তারা মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ করে যেন তাদের কর্মকাণ্ড কখনো সাধারণের গোচরে না আসে। আইন যেন নিজেকেই ধ্বংস করছে।
বাসতিয়াত ‘দি ল’ বইটি লিখেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে (১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে)। তখন তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণের জন্য এই বইটি লিখেছিলেন। তার প্রধান বার্তা ছিল, ‘প্রায় সব বিপ্লব অবশেষে বিপ্লবকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে, জনগণের কথা ভুলে যায়। আর্থিক ক্ষমতার অপব্যবহার দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।’ রাদারফোর্ড ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট জন ডাবলু হোয়াইট হেড এই অবস্থার নাম দিয়েছেন ‘ফিনানসিয়াল টিরানি’ (আর্থিক নিপীড়ন)। কারণ এই ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান গোষ্ঠী রাষ্ট্র ও জনকল্যাণের কথা বলে ট্যাক্স, চাঁদাসহ আর্থিক নানা বাধা-নিষেধ আরোপ করে, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের স্বার্থেই। দেখা গেছে, এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘গণতন্ত্রের বাহক এবং ধারকে’র লেবাস পরে এ কর্মটি করে থাকে। সমস্যা হয় তখনই যখন অন্য কোনো গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করে এবং ভাগ চায়। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এ দুই গোষ্ঠীই ধর্মের বিরোধিতা করে নানাভাবে। এর মূল কারণ নৈতিকতা। ধর্ম নৈতিকতা শিক্ষা দেয় এবং জীবনধারণের অন্যতম ভিত্তি নির্ধারণ করে দেয়। সেকুলারিজমসহ অন্য কোনো মতবাদে নৈতিকতার স্থান নেই কিংবা থাকেলও তা অনেক নিচে। সেখানে নৈতিকতা তথাকথিত আইন বা নিয়মভিত্তিক; হৃদয় বা মনোবৃত্তিক নয়। ফলে অবিচার-অনাচার সেখানে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সহজেই করা যায়। তবে এ গোষ্ঠী ধর্মকেও ব্যবহার করে সুকৌশলে এবং জনগণ এখানেই ফেঁসে যায়। কারণ তারাও ধার্মিকের লেবাস পরে থাকে।
বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী রাউল নারোল তার সাড়া জাগানো ‘দি মোরাল কোড’ বইতে মানুষের আচরণ ও কর্মকাণ্ডের নিয়ন্ত্রণে নৈতিকতা কতখানি কাজ করে, তার বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি ‘নৈতিক জাল’ (মোরাল নেট) বলে একটি অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, এটা মানসিক বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই জালই মানুষের মন-আধ্যাত্মিক-সামাজিক প্রয়োজনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং জোগান দিয়ে থাকে। যখন এটার অভাব ঘটে তখনই মানসিক অশান্তি থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অশান্তি সৃষ্টি হতে থাকে। ঠিক একই কথা বলেছেন এরিক ফ্রম তার ‘দি সেইন সোসাইটি’ বইতে। তিনি বলেছেন, ‘আজকের দুনিয়াতে সবকিছুই বাজারজাত করা হচ্ছে, এমনকি মানসিকতাকেও। এটা করতে গিয়ে ‘নতুন নতুন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নতুন করে প্রশ্নের সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলে জীবনযাত্রার প্রয়োজনগুলোকে (এক্সিসটেনশিয়াল নিডস) বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে পরিচয়, মূল এবং অধিবাসী হওয়া নিয়ে। এমনকি, মানসিক সুস্থতা নিয়ে। অর্থাৎ কোনো সমাজ বা সংস্থার সাথে জড়িত থাকলে এ প্রচারগোষ্ঠী মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। প্রগতিশীলের নামে প্রচলিত সব ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে চায়।
তাই বিশ্বব্যাপী চলছে সামাজিক অস্থিরতা, এরিক মন্তব্য করেছেন। এ সবের মূলে আছে করপোরেশন এবং মুনাফালোভীরা যারা রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের প্রয়োজনে জোগান দিতে সবাইকে বাধ্য করছে; কখনো প্রত্যক্ষভাবে বা কখনো তাদের অজান্তে। রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল ও তাদের সংগঠনগুলোকে প্রধানত ব্যবহার করা হচ্ছে এই সাংস্কৃতিক যাত্রার অঙ্গ হিসেবে। কিন্তু কেউই বুঝতে পারছে না, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এরিক ফ্রম মন্তব্য করেছেন, ‘এ অবস্থা ধারণ করে অপ্রকৃতিস্থ সমাজের’ (ইনসেইন সোসাইটি) সৃষ্টি হয়েছে। জালটি এমনভাবে বিছানো যেন কেউ এটা ছিন্ন করতে না পারে। ‘অতীতে কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমনভাবে মানুষকে শৃঙ্খলিত করতে পারেনি। ফলে সমাজ নির্বীর্য, নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়েছে; অশুভ শক্তিগুলো চেপে বসেছে এবং মানুষ অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।’ John F Schumaker তার প্রবন্ধ ‘ডিমরালাইজ মাইন্ড’-এ বলেছেন, যদি এখনই এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা না করা হয় তবে বিশ্বব্যাপী এক মহাধ্বংসের সূত্রপাত হতে পারে। আর এরিক বলেছেন, ‘গণতন্ত্র বর্তমানের অবয়বে অপ্রকৃতিস্থ সংস্কৃতির অভিভাবক হয়ে অবস্থান করছে।’ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সেই মহাবিপর্যয় হবে অবশ্যম্ভাবী।
No comments