হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট
২০১৮-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের অধিকার হ্রাসের বিপরীতে আইন
প্রয়োগকারী সংস্থা এবং পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্বেগজনক
তথ্য উঠে এসেছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে ২০১৭ সালের
মানবাধিকার ও অধিকার অনুশীলনের ঘটনাবলী পর্যালোচনা শেষে হিউম্যান রাইটস
ওয়াচ এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অধ্যায়ে গোপনে গ্রেফতার,
গুম-খুন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের
সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়েছে, গুরুতর
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনায় সরকার নিরাপত্তা বাহিনীকে জবাবদিহির আওতায়
আনতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া প্রতিবেদনে বিরোধী মত ও সমালোচনা দমন করতে আইনকে
অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার, সুশীল সমাজ ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা ইত্যাদি ছাড়াও
নারী অধিকার ও শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়েছে বলে
মন্তব্য করা হয়েছে। অবশ্য প্রতিবেদনে সরকারের বিস্তর সমালোচনা থাকলেও
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ প্রশংসা করা হয়েছে। কোনো দেশের নাগরিকরা যখন তাদের
প্রাপ্য অধিকার ও স্বাধীনতা পরিপূর্ণভাবে ভোগ করেন, কেবল তখনই সে দেশটির
মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ভালো বলা যায়। অস্বীকার করার উপায় নেই, ২০১৭ সালে
দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। বছরব্যাপী আইনশৃঙ্খলা
পরিস্থিতি অবনতির কারণে সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার
অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল। দেশজুড়ে অনেক মানুষ গুপ্তহত্যার শিকার হওয়া ছাড়াও
রাজনৈতিক সংঘাত, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসীদের হামলা ও হত্যাসহ
নানা ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া প্রচুর নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তবে
মানবাধিকারের প্রধান দুটি অধ্যায়ের একটি অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক ও
সাংস্কৃতিক অধিকারের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেশে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে।
এর
মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যু হার ও দারিদ্র্য
হ্রাস পাওয়াসহ ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, দেশের
হিজড়া জনগোষ্ঠীকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানসহ অধিকার ও সুরক্ষা
বিষয়ক বেশকিছু আইন প্রণয়নের কথা বলা যায়। প্রশ্ন হল, সরকার হিউম্যান রাইটস
ওয়াচের প্রতিবেদন কতটা আমলে নেবে বা গুরুত্ব দেবে? গণতন্ত্রের উন্নয়ন,
মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং
সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। এ
পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি, কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে সরকারের উচিত
প্রতিবেদনে সন্নিবেশিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া। দেশে সাংবিধানিকভাবে
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু থাকলেও বাস্তবে গণতন্ত্রের প্রকৃত চর্চা
দৃশ্যমান নয়। দুঃখজনক হল, এ থেকে উত্তরণের যে প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রে তারও
ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। জাতীয় সংসদে কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই। সংসদে
শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকারের ভুলক্রটিগুলো চিহ্নিত করার মতো কেউ
থাকে না। এ সুযোগে অপরাধী ও সমাজবিরোধীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দুষ্টের দমন,
শিষ্টের প্রতিপালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে রাষ্ট্রের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা
ব্যবস্থা বিনষ্ট হতে বাধ্য। দেশে এরকম অবস্থা যাতে সৃষ্টি না হয়, এজন্য
সরকারকে অবশ্যই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র,
স্বাধীনতা ও সুশাসন নিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে যে সন্দেহ ও সংশয়
তৈরি হয়েছে, সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা নিরসনের
কাজটি শুরু করা যেতে পারে। ২০১৮ সালকে ঘিরে দেশের মানুষের উচ্চাশা ও উন্নয়ন
প্রত্যাশা যাতে হতাশায় পর্যবসিত না হয়- এ ব্যাপারে সরকার মনোযোগী হবে,
এটাই প্রত্যাশা।
No comments