ঢাকা সিটি মেয়র নির্বাচন স্থগিত প্রসঙ্গে
ঢাকা
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অনুষ্ঠেয় নির্বাচন আদালতের আদেশে স্থগিত করা
হয়েছে। এভাবে আদালত কর্তৃক নির্বাচন স্থগিতের আদেশকে লঘুভাবে নেয়ার কিছু
নেই। কারণ এই আদেশের কারণে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মতো একটি সংস্থা
নির্বাচিত মেয়রের পরিবর্তে অন্যদের দ্বারা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরিচালিত
হওয়া এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নাকচ করারই নামান্তর। ‘‘জাতীয়
নির্বাচনের আগে ঢাকার ভোট অনিশ্চিত’ শীর্ষক একটি রিপোর্টে যুগান্তর
পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকার দুই সিটি
নির্বাচনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, আদালতের নির্দেশে নির্বাচন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে আপিল করার
ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। এমনকি তফসিল ঘোষণার
আগেই বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধানের ত্রুটি চিহ্নিত করে তা সংশোধনের সুপারিশ
করা হলেও আমলে নেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি) বা স্থানীয় সরকার বিভাগ। তখন আরও
বলা হয়েছিল, এ জটিলতা রেখে তফসিল ঘোষণা করা হলে রিট হতে পারে, স্থগিত হয়ে
যেতে পারে নির্বাচনও। শুধু তাই নয়, কমিশনের এক সভার কার্যপত্রে আইনগত
জটিলতার বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো প্রয়োজনীয়
পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। উল্টো ইসির পক্ষ থেকে ‘রহস্যজনকভাবে’ বারবার বলা হচ্ছে
কোনো জটিলতা তারা দেখছেন না।
এমন পরিস্থিতিতে এ নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে
ইসি ও সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।’’ (যুগান্তর,
১৯.০১.২০১৮)। আদালতের নির্দেশে নির্বাচন স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে আপিল করার
ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না বলে উপরোক্ত রিপোর্টটিতে যা
বলা হয়েছে তার কারণ এ ব্যাপারে আপিল করার কোনো ইচ্ছাই সরকারের নেই। শুধু
তাই নয়, নির্বাচন স্থগিতের ব্যবস্থা যেভাবে করা হয়েছে তার থেকে স্পষ্টভাবেই
বোঝা যায় যে, এক্ষেত্রে সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ
করেই নির্বাচন বন্ধ রাখার পরিকল্পনা কার্যকর করেছে। আদালতের নির্দেশের পরই
বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তারা
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল! এই ‘শ্রদ্ধাশীলতা’ কোথায় ছিল প্রধান বিচারপতি
কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সময়? আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে তারা
প্রধান বিচারপতির রায়কে মেনে নিতে অস্বীকার করে কেন তাকে নানাভাবে হেনস্থা ও
অপমান করলেন? এর থেকে কি বোঝার অসুবিধা আছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের মতলব
যে রায়ের দ্বারা সিদ্ধ হয় সেই রায়ের প্রতি তারা ‘শ্রদ্ধাশীল’ এবং যে রায়ে
তাদের স্বার্থে ও আঁতে ঘা লাগে তা যতই যুক্তিসঙ্গত ও ন্যায্য হোক, তার
প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার প্রয়োজন তাদের নেই! উপরন্তু এভাবে স্বার্থসিদ্ধির
ক্ষেত্রে দেশের প্রধান বিচারপতিকে পর্যন্ত অপমান করতেও তারা কোনো অসুবিধা
বোধ করেন না! ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নিয়ে আওয়ামী লীগ অনেক খেলা তাদের
শাসনকালে দেখিয়েছে। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর
ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় নতুন নির্বাচনের কথা ছিল। কিন্তু
সেই নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে কোনো নির্বাচন তারা দেয়নি। শুধু তাই নয়,
এজন্য বিএনপির নির্বাচিত মেয়রকে তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও তারা
বহাল রেখেছিল। পরে তারা কোনোমতেই নির্বাচনে জয়লাভের সম্ভাবনা না দেখে ঢাকা
সিটি কর্পোরেশনকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রশাসক বসিয়ে
পূর্ববর্তী নির্বাচনের আগে পর্যন্ত কাজ চালিয়ে এসেছিল। সে নির্বাচনেও তারা
কারচুপি করছিল। কিন্তু এখন পরিণতি এমন দাঁড়িয়েছে যে কারচুপি করেও ঢাকা
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনে তাদের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
পরাজয়ের এই আশঙ্কা স্পষ্টভাবে দেখেই তারা খুব আগে থেকে নির্বাচন হতে না
দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। সেই সঙ্গে নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া ইত্যাদির মহড়াও
তারা দিয়েছিল! এ সবই ছিল জনগণকে প্রতারিত করে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে
নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করা।
তাদের এই কার্যকলাপের কারণ, ঢাকা সিটি
নির্বাচনে পরাজিত হলে আগামী সাধারণ নির্বাচনের ওপর তার বড় রকম প্রভাব পড়বে
এবং তাদের পরাজয়ের আশঙ্কা আরও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ এখন যতই
চেষ্টা করুক, জাতীয় নির্বাচনের মুখে তারা যতই জনগণকে প্রতারিত করার চেষ্টা
করুক, পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, তারা নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কাউকেই
আর ‘প্রতারণা’ করতে পারার মতো অবস্থায় নেই! এ উপলব্ধি যে তাদের একেবারে নেই
তা নয়। উপরন্তু পরাজয়ের আশঙ্কাতেই তারা এখন সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত। সিটি
কর্পোরেশনে পরাজিত হওয়ার ষোল আনা নিশ্চিত হয়েই যে তারা এই নির্বাচন বন্ধের
জন্য পরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এটা এতই স্পষ্ট যে, এ নিয়ে কারও
সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা যাই হোক, যে কোনো বিরোধী সমালোচনা
মোকাবেলার উদ্দেশ্যে তারা বিরোধী পক্ষের সবাইকেই বিএনপির লোক বা তাদের দরদী
বলে আখ্যায়িত করতে অসুবিধা বোধ করে না। এর কারণ তাদের চিন্তা-চেতনার
ক্ষুদ্রতা ও সামান্যতা। দেশের ভূমি বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় না থাকা।
চুরি-দুর্নীতি-সন্ত্রাসের মাধ্যমে শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত জনগণের
ক্ষোভ ও বিরোধিতার মুখে তারা সব বিরোধিতাকে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত করে
পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য সফল
হওয়ার নয়। কারণ তাদের ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি-সন্ত্রাসের ফায়দা বিএনপি জনগণের
জন্য কিছু না করেই ইতিমধ্যে পেয়ে বসে আছে, যেমনভাবে ক্ষমতাসীন দলের
বিরুদ্ধে বিরোধী দল পেয়ে থাকে। কাজেই বিএনপির ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে, তাকে
নন্দঘোষ বানিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সম্ভাবনা আওয়ামী লীগের নেই
বললেই চলে। তাদের এমন অবস্থা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়েও ছিল।
এ কারণেই তারা নানারকম ফন্দি-ফিকির করে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে
নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের জোরে এক ভুয়া নির্বাচন করে ক্ষমতায় ফিরে এসেছিল।
এবার কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক আগের মতো নেই। কাজেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো
নির্বাচন করার চেষ্টা যদি আওয়ামী লীগ করে তাহলে দেশে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির
সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগ পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থেকে ‘উন্নয়নের’ নামে
যেভাবে লুটপাট, সন্ত্রাস, জনগণের পকেটমারি করেছে তাতে তারা এখন দেশের সমগ্র
জনগণ থেকেই বিচ্ছিন্ন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ এবং ভারতের
সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে বিগত নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির চেষ্টা যদি আওয়ামী
লীগ করে, তাহলে তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবেলা করে টিকে থাকা তাদের
পক্ষে সম্ভব হওয়ার নয়। বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতির দিকে
তাকিয়ে, জনগণের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিষয় বিবেচনা করে সুষ্ঠু ও
নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তার বশবর্তী
আওয়ামী লীগের পক্ষে এমনটি যে সম্ভব হবে তা মনে করার কারণ নেই। এ
পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ যদি তাদের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের
পুনরাবৃত্তির চেষ্টা করে, তাহলে তার থেকে উদ্ভূত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির
মোকাবেলা তাদের নিজেদেরকেই করতে হবে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments