গেল বছরটি ছিল ব্যাংক কেলেঙ্কারির
দেশের
সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়েছে বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা
সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয়
ভট্টাচার্য বলেছেন, ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে দেশের অর্থনীতির যে সুযোগ
ও সম্ভাবনা ছিল, তা পুরোপুরি ব্যবহার করা যায়নি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার
দুর্বলতার বড় প্রকাশ হিসেবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের
নেতৃত্বের বড় ঘাটতিকে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ঘাটতি তিন জায়গায়। যেমন
সংস্কারের উদ্যমের অভাব, সমন্বয় করতে না পারা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায়
দুর্বলতা। তিনি বলেন, ২০১৭ সাল দেশে ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর হিসেবে
চিহ্নিত হয়ে থাকবে। চলতি ২০১৮ সালেও ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলোর কোনো নিরসন
হবে বলে মনে হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি দিয়ে বোঝা যায় সংস্কারের
বিষয়ে সরকারের মনোভাব কেমন ছিল। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনায়
সিপিডি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। সাধারণত
নতুন বছরের শুরুতে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সিপিডি নিয়মিত পর্যালোচনা করে থাকে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সিপিডির পক্ষে পর্যালোচনা তুলে
ধরেন সংস্থাটির গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। উপস্থাপনা শেষে বিভিন্ন
বিষয় নিয়ে কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান,
নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এবং গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম
মোয়াজ্জেম।
দুর্বলতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের
এবারের পর্যালোচনায় তিনটি বিশেষ দিকে সিপিডির নজর ছিল, যার মধ্যে একটি ব্যাংক খাত। অন্য দুটি হলো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া ও বন্যা। ব্যাংক খাত ও অন্যান্য সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় নীতিগত সংস্কারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের চাপ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যম দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতো অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। যদিও আগে এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় নেতৃত্ব দিত। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্বল ছিল। আমরা দেখেছি, অর্থনীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয় দেখাতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে ওপর থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে, যা অর্থনীতির জন্য যুক্তিযুক্ত না হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় সেগুলোকে কার্যকর করেছে।’ এই বক্তব্যের পর প্রশ্ন ছিল, সিপিডি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখছে কি না। এর জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যক্তির পরিবর্তনের কথা তিনি বলেননি। এটা সমাধানও নয়। ব্যবস্থাপনা ও নীতি উদ্যোগের মনোভঙ্গি এবং সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া পরিবর্তন না হলে ব্যক্তির পরিবর্তন বড় বিষয় নয়। এর আগে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ব্যাংক খাত, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বৈষম্য ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন। ২০১৭ সালে ব্যাংক খাতে কী কী হয়েছে, তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্যাংকে অপরিশোধিত ঋণ বেড়েছে, সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে, অপরিশোধিত ঋণে গুটিকয়েকের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে, জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যক্তি খাতের ব্যাংকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিকানার বদল হয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া নতুন ব্যাংক কার্যকর হতে পারেনি এবং এখন দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এগুলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার উল্টো ব্যাংকিং আইন সংশোধন করে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে।
চাপের মুখে অর্থনীতি
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। চাপের মুখে পড়েছে। এটা সামাল দিতে আমরা যে সংস্কারের কথা বলেছিলাম, তা সামনের দিকে এগোয়নি, বরং পেছনের দিকে গেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্যাংকিং খাত।’ প্রবৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রায় এক দশক ধরে একটি শোভন প্রবৃদ্ধির হার রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির পেছনে যে অন্ধকার রয়েছে, সেটি হলো দেশে সেই তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সেই হারে দারিদ্র্য কমছে না, বরং দারিদ্র্য কমার হার কমেছে। সবচেয়ে বড় হলো বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য শুধু আয় ও ভোগের নয়, সবচেয়ে বেশি বৈষম্য বেড়েছে সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, এটার কারণও স্পষ্ট। সেটা হলো ব্যাংকের ঋণের টাকা ফেরত না আসা, বড় বড় প্রকল্পের ভেতর থেকে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ ভিন্ন দিকে পরিচালন করা এবং দেশের ভেতরে যে ধরনের প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া হচ্ছে, তার মাধ্যমেও বৈষম্য বাড়ছে। দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমরা আগে প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে চিন্তিত থাকতাম। এখন গুণমান নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। প্রবৃদ্ধির হার যে পরিমাণ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসার কথা, তা হচ্ছে না। এটা নিয়ে চিন্তা এ জন্য যে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে বৈষম্য বাড়লে তা একসময় প্রবৃদ্ধির হারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’ অনুষ্ঠানে সিপিডির লিখিত বিশ্লেষণে একটি অনুচ্ছেদ ছিল ‘দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্যে নতুন প্রবণতা’। এতে খানা আয়-ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখানো হয়, দেশের জনসংখ্যার একেবারে দরিদ্র ৫ শতাংশের মধ্যে একটি খানার মাসিক গড় আয় ২০০৫ সালে ছিল ১ হাজার ১০৯ টাকা, যা ২০১৬ সালে কমে ৭৩৩ টাকায় নেমেছে। বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। সিপিডি বলছে, এ প্রবণতার মানে হলো ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। অন্যদিকে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। বিশ্লেষণ তুলে ধরে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ধনীদের আয় বেশি হারে বাড়লে সম্পদবৈষম্যও বেড়ে যায়।
অর্থনীতির যত চ্যালেঞ্জ
সিপিডির পর্যালোচনায় অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, আয়কর বদলে আমদানি শুল্ক আদায়ে নির্ভরতা, সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নেওয়া, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও তার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা, চালসহ কিছু পণ্যের চড়া দাম, সরকারের খাদ্য মজুত কম থাকা, আমদানিতে বাড়তি চাপ, অপর্যাপ্ত প্রবাসী আয়, আমদানি বৃদ্ধি ইত্যাদি। সিপিডি বলছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চাপের মুখে পড়েছে। সামগ্রিক বিষয়ে সিপিডির পরামর্শ হলো, কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধিতে নজর দেওয়া, ধনীদের কাছ থেকে আরও কর আদায়, কর ও শুল্ক ফাঁকি রোধ করা, দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ, ব্যাংকের রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদের হার বাড়ানো, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতির হার বাড়ানো, ভোগ্য ও বিলাসী পণ্যের ঋণপত্রের মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া, ঋণপত্রের বিপরীতে অর্থ ফেরতের সময়সীমা কমিয়ে দেওয়া, মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা ইত্যাদি।
নির্বাচনের বছর রক্ষণশীল থাকুন
সিপিডি মনে করছে, নির্বাচনের বছর আর্থিক খাতে সংস্কারের বিষয়গুলো খুব এগোবে না। তবে তারা চায়, আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে এ বিষয় উঠে আসুক। পাশাপাশি সিপিডির পক্ষ থেকে নির্বাচনের বছর রক্ষণশীল আর্থিক ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার আগের চেয়ে দুর্বলতর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে। সরকারের উচিত নির্বাচনের আগে ঋণের প্রবাহকে কিছুটা হলেও স্তিমিত করা, টাকার বিনিময় হার সক্রিয় ব্যবস্থাপনায় রাখা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, আয়করের মতো প্রত্যক্ষ করের প্রবাহ বাড়ানো। লক্ষ রাখতে হবে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি যেন বেড়ে না যায়। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা ছিল, সেখানে ২০১৭ সালের শেষে কিছু দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের বছর সরকারের জনতুষ্টিমূলক প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা থাকে। সংস্কারের উদ্যোগ থাকে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। তিনি বলেন, দুর্বলতা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক ঝুঁকিগুলো মিলে গেলে তা অর্থনীতির অগ্রগতিকে পিছিয়ে দেবে। তাই সংযত থাকাই ভালো।
দুর্বলতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের
এবারের পর্যালোচনায় তিনটি বিশেষ দিকে সিপিডির নজর ছিল, যার মধ্যে একটি ব্যাংক খাত। অন্য দুটি হলো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া ও বন্যা। ব্যাংক খাত ও অন্যান্য সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় নীতিগত সংস্কারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের চাপ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার উদ্যম দেখাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি), বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতো অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। যদিও আগে এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় নেতৃত্ব দিত। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্বল ছিল। আমরা দেখেছি, অর্থনীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয় দেখাতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে ওপর থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে, যা অর্থনীতির জন্য যুক্তিযুক্ত না হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় সেগুলোকে কার্যকর করেছে।’ এই বক্তব্যের পর প্রশ্ন ছিল, সিপিডি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখছে কি না। এর জবাবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যক্তির পরিবর্তনের কথা তিনি বলেননি। এটা সমাধানও নয়। ব্যবস্থাপনা ও নীতি উদ্যোগের মনোভঙ্গি এবং সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া পরিবর্তন না হলে ব্যক্তির পরিবর্তন বড় বিষয় নয়। এর আগে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ব্যাংক খাত, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, বৈষম্য ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন। ২০১৭ সালে ব্যাংক খাতে কী কী হয়েছে, তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ব্যাংকে অপরিশোধিত ঋণ বেড়েছে, সঞ্চিতির ঘাটতি বেড়েছে, অপরিশোধিত ঋণে গুটিকয়েকের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে, জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে, বিভিন্ন ব্যক্তি খাতের ব্যাংকে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মালিকানার বদল হয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া নতুন ব্যাংক কার্যকর হতে পারেনি এবং এখন দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, এগুলোর ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষেধক ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার উল্টো ব্যাংকিং আইন সংশোধন করে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর সুযোগ দিচ্ছে।
চাপের মুখে অর্থনীতি
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ কিছুটা দুর্বল হয়ে গেছে। চাপের মুখে পড়েছে। এটা সামাল দিতে আমরা যে সংস্কারের কথা বলেছিলাম, তা সামনের দিকে এগোয়নি, বরং পেছনের দিকে গেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্যাংকিং খাত।’ প্রবৃদ্ধি নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রায় এক দশক ধরে একটি শোভন প্রবৃদ্ধির হার রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু এই প্রবৃদ্ধির পেছনে যে অন্ধকার রয়েছে, সেটি হলো দেশে সেই তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সেই হারে দারিদ্র্য কমছে না, বরং দারিদ্র্য কমার হার কমেছে। সবচেয়ে বড় হলো বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য শুধু আয় ও ভোগের নয়, সবচেয়ে বেশি বৈষম্য বেড়েছে সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, এটার কারণও স্পষ্ট। সেটা হলো ব্যাংকের ঋণের টাকা ফেরত না আসা, বড় বড় প্রকল্পের ভেতর থেকে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্থ ভিন্ন দিকে পরিচালন করা এবং দেশের ভেতরে যে ধরনের প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া হচ্ছে, তার মাধ্যমেও বৈষম্য বাড়ছে। দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমরা আগে প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে চিন্তিত থাকতাম। এখন গুণমান নিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। প্রবৃদ্ধির হার যে পরিমাণ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসার কথা, তা হচ্ছে না। এটা নিয়ে চিন্তা এ জন্য যে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলে বৈষম্য বাড়লে তা একসময় প্রবৃদ্ধির হারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’ অনুষ্ঠানে সিপিডির লিখিত বিশ্লেষণে একটি অনুচ্ছেদ ছিল ‘দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্যে নতুন প্রবণতা’। এতে খানা আয়-ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখানো হয়, দেশের জনসংখ্যার একেবারে দরিদ্র ৫ শতাংশের মধ্যে একটি খানার মাসিক গড় আয় ২০০৫ সালে ছিল ১ হাজার ১০৯ টাকা, যা ২০১৬ সালে কমে ৭৩৩ টাকায় নেমেছে। বিপরীতে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। সিপিডি বলছে, এ প্রবণতার মানে হলো ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। অন্যদিকে দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হচ্ছে। বিশ্লেষণ তুলে ধরে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ধনীদের আয় বেশি হারে বাড়লে সম্পদবৈষম্যও বেড়ে যায়।
অর্থনীতির যত চ্যালেঞ্জ
সিপিডির পর্যালোচনায় অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধির ধীরগতি, আয়কর বদলে আমদানি শুল্ক আদায়ে নির্ভরতা, সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি ঋণ নেওয়া, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও তার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা, চালসহ কিছু পণ্যের চড়া দাম, সরকারের খাদ্য মজুত কম থাকা, আমদানিতে বাড়তি চাপ, অপর্যাপ্ত প্রবাসী আয়, আমদানি বৃদ্ধি ইত্যাদি। সিপিডি বলছে, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চাপের মুখে পড়েছে। সামগ্রিক বিষয়ে সিপিডির পরামর্শ হলো, কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধিতে নজর দেওয়া, ধনীদের কাছ থেকে আরও কর আদায়, কর ও শুল্ক ফাঁকি রোধ করা, দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সম্প্রসারণ, ব্যাংকের রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদের হার বাড়ানো, খেলাপি ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতির হার বাড়ানো, ভোগ্য ও বিলাসী পণ্যের ঋণপত্রের মার্জিন বাড়িয়ে দেওয়া, ঋণপত্রের বিপরীতে অর্থ ফেরতের সময়সীমা কমিয়ে দেওয়া, মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা ইত্যাদি।
নির্বাচনের বছর রক্ষণশীল থাকুন
সিপিডি মনে করছে, নির্বাচনের বছর আর্থিক খাতে সংস্কারের বিষয়গুলো খুব এগোবে না। তবে তারা চায়, আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে এ বিষয় উঠে আসুক। পাশাপাশি সিপিডির পক্ষ থেকে নির্বাচনের বছর রক্ষণশীল আর্থিক ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকার আগের চেয়ে দুর্বলতর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে। সরকারের উচিত নির্বাচনের আগে ঋণের প্রবাহকে কিছুটা হলেও স্তিমিত করা, টাকার বিনিময় হার সক্রিয় ব্যবস্থাপনায় রাখা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা, আয়করের মতো প্রত্যক্ষ করের প্রবাহ বাড়ানো। লক্ষ রাখতে হবে বৈদেশিক লেনদেনে ঘাটতি যেন বেড়ে না যায়। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা ছিল, সেখানে ২০১৭ সালের শেষে কিছু দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। নির্বাচনের বছর সরকারের জনতুষ্টিমূলক প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা থাকে। সংস্কারের উদ্যোগ থাকে না। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হলে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে। তিনি বলেন, দুর্বলতা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক ঝুঁকিগুলো মিলে গেলে তা অর্থনীতির অগ্রগতিকে পিছিয়ে দেবে। তাই সংযত থাকাই ভালো।
No comments