মৃত্যুশিবিরে ভালোবাসার ফুল
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের এক মৃত্যুশিবির পোল্যান্ডের আউশভিৎস। সেখানে সে
সময় হাজার হাজার মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। সারা ইউরোপ
থেকে মানুষকে ধরে এনে এই ক্যাম্পেই রাখা হতো। যাঁদের এই ক্যাম্পে রাখা হতো,
তাঁরা মৃত্যুর জন্য শুধু দিন গুনতেন। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আউশভিৎস
দখল করে নেওয়ার পর এই বিভীষিকার অবসান ঘটে। সে সময় ওই শিবিরে যাঁরা ছিলেন,
তাঁদের একটাই চিন্তা—কীভাবে বেঁচে থাকা যায়। এখানে প্রেম কেবল নিজের প্রতি।
তবে এমন নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও শিবিরের ভেতরে যে হৃদয়ের কোণে কারও প্রতি
প্রেম তৈরি হতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছেন লালে সোকোলভ নামের এক বন্দী।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে জানানো হয়, স্লোভাকিয়ার লালে সোকোলভের জন্ম
১৯১৬ সালে। ২০০৬ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি আউশভিৎস শিবিরের
প্রেমের সেই গল্পটি হেথার মরিস নামের একজনকে জানিয়েছেন। হেথার মরিস তিন বছর
ধরে তাঁর সেই গল্প রেকর্ড করেন। সম্প্রতি লালের প্রেমকাহিনি নিয়ে ‘দ্য
ট্যাটুইস্ট অব আউশভিৎস’ নামে একটি বই লিখেছেন হেথার মরিস। প্রতিবেদনে বলা
হয়, আউশভিৎস ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া মানুষের পরিচয় আর নামে থাকত না। নামের
বদলে তাঁদের হাতে একটি নম্বর এঁকে দেওয়া হতো। ওই নম্বরই হতো তাঁদের পরিচয়।
আর বন্দীদের হাতে ট্যাটু করে নম্বর এঁকে দিতেন আরেক বন্দী লালে। লালের
নম্বর ছিল ৩২৪০৭। ১৯৪২ সালের এপ্রিলে মাত্র ২৬ বছর বয়সে নাৎসিরা লালেকে ধরে
ওই শিবিরে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁর নম্বর ছিল ৩২৪০৭। সে সময় তাঁকে
নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতে হতো।
একসময় তাঁর টাইফয়েড হলে আরেক বন্দী ফরাসি
ট্যাটুশিল্পী পাপেন লালের দেখভাল করতেন। তিনিই তাঁকে ট্যাটু আঁকা
শিখিয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন কী করে ক্যাম্পের ভেতর মাথা নিচু করে মুখে কুলুপ
এঁটে থাকতে হয়। পাপেন একদিন নিখোঁজ হয়ে যান। কী হয়েছিল—তাঁর এ খবর লালে
কোনো দিন পাননি। লালে স্লোভাকিয়া, জার্মানি, রাশিয়া, ফরাসি ও হাঙ্গেরির
ভাষা জানতেন। এ কারণেই পাপেনের পর তিনিই হয়ে ওঠেন মৃত্যুশিবিরের প্রধান
ট্যাটুশিল্পী। এতে অন্য বন্দীদের চেয়ে একটু বেশি সুযোগ-সুবিধা পেতেন তিনি।
একটি কক্ষে একা থাকতেন, অতিরিক্ত রেশন পেতেন। পরের দুই বছর তিনি শত শত
বন্দীর হাতে ট্যাটু করে নম্বর এঁকে দিয়েছিলেন। যাঁদের হাতে ট্যাটু করা হতো,
তাঁদের দিয়ে নানা কাজ করানো হতো। আর ক্যাম্পে আসার পরও যাঁদের হাতে ট্যাটু
আঁকানো হতো না, তাঁদের সরাসরি গ্যাস চেম্বারে পাঠানো হতো। হেথার মরিস
বলেন, লালে নাৎসিদের কাজ করলেও কখনোই নিজেকে তাঁদের সহযোগী মনে করতেন না।
শুধু জীবন বাঁচানোর খাতিরেই তিনি এসব করতেন। ১৯৪২ সালে জুলাই মাসে লালেকে
একটি নম্বর দেওয়া হয়। এক নারীর হাতে এঁকে দিতে হবে। ওই নম্বরটি ছিল ৩৪৯০২।
এত দিন শুধু পুরুষদের হাতে ট্যাটু এঁকে দিতেন তিনি। এবার তরুণীর হাতে
ট্যাটু আঁকতে হবে ভেবে বিব্রত হন তিনি। কিন্তু পাপেনের শেখানো সেই
কথা—‘এখানে বাঁচতে হলে যা বলবে, সব মুখ বুজে করে যেতে হবে।’ এরপর যখন
ট্যাটু আঁকার জন্য ওই তরুণীর বাঁ হাত ধরে চোখের দিকে তাকিয়েছিলেন, তখনই
তাঁর হৃদয়ে কিছু একটা ঘটে গিয়েছিল। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওই তরুণীর
নাম গিটা। তিনি নারীদের ক্যাম্প বির্কেনাউতে থাকেন। পরে লালে তাঁর
ব্যক্তিগত এসএস গার্ডের মাধ্যমে গোপনে গিটাকে চিঠি লিখতে শুরু করেন। নিজের
রেশন থেকে গিটার জন্য খাবার পাঠাতেন তিনি। এ ছাড়া একটি ভালো কাজ জুটিয়ে
দেওয়ারও আশা দিয়েছিলেন। তবে গিটা ছাড়াও আরও অনেক বন্দীকে সাহায্য করতেন
লালে। ১৯৪৫ সালে রাশিয়ার বাহিনী যখন আউশভিৎসে অভিযান চালাতে শুরু করে, তখন
সেখান থেকে বাছাই করে কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয়। বাছাই হয়ে গিটা ও লালে ওই
ক্যাম্প থেকে চলে যান। পরে তাঁদের কেউই আর কারও খবর জানতেন না। জানতেন না
কেউ কারও পুরো নামও। চেকস্লোভাকিয়ার ক্রোমপাচি শহরে বাড়ি ফিরে লালে শোনেন,
এক মাস আগেই নাৎসিরা তাঁর মা-বাবাকে হত্যা করেছে। এরপর থেকে তাঁর কেবল
গিটার কথা মনে হতে থাকে। শিবির থেকে মুক্তি পেয়ে বন্দীরা ব্রাটিস্লাভার
রেলস্টেশন দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এ কারণে তিনি ওই রেলস্টেশনে দিনের পর দিন
গিটার জন্য অপেক্ষা করতেন। এই ঘটনা শুনে স্টেশনমাস্টার তাঁকে স্থানীয়
রেডক্রস ক্যাম্পে যাওয়ার পরামর্শ দেন। একদিন রেডক্রস ক্যাম্পে যাওয়ার সময়
এক তরুণী সামনে গিয়ে তাঁর পথরোধ করেন।
তাঁর উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকাতেই
আবার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে লালের। এ যে সেই গিটা, যাঁকে তিনি খুঁজে
বেড়াচ্ছিলেন। দেখা হওয়ার পর পুরোনো সেই সম্পর্ক আরও গভীর হলো দুজনের। বুকের
ভেতর জমে থাকা প্রেমের প্রকাশ ঘটল। ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে বিয়ে করেন তাঁরা।
বিয়ের পর নামের শেষাংশ সোকোলভ পরিবর্তন করে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত
চেকস্লোভাকিয়ায় বাস করতে থাকেন লালে-গিটা দম্পতি। লালে কাপড়ের ব্যবসা শুরু
করেন। ইসরায়েলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে অর্থ সংগ্রহ পাঠিয়েছিলেন
তিনি। বিষয়টি সরকার জানার পর তাঁকে আটক করা হয়। মুক্তির পর চেকস্লোভাকিয়া
ছাড়েন তাঁরা। ভিয়েনা ও প্যারিস হয়ে কৌশলে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকে পড়েন। সেখানে
আবারও কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন লালে। আর গিটা করতেন কাপড়ের নকশার কাজ। ১৯৬১
সালে গ্যারি নামের এক ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে
দেন তাঁরা। ২০০৩ সালে মৃত্যুর আগে গিটা কয়েকবার ইউরোপে গিয়েছিলেন। কিন্তু
লালে আর কখনোই অস্ট্রেলিয়া ছাড়েননি। প্রতিবেদনে বলা হয়, লালে ও গিটার এই
প্রেমের গল্প কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতেন না। এমনকি তাঁদের
ছেলে গ্যারিও অনেক বছর এই ঘটনা জানতেন না। জানতেন না তাঁর বাবা-মা কীভাবে
মৃত্যুশিবির থেকে ফিরে এসেছিলেন। গিটার মৃত্যুর পর লালে তাঁদের এই গল্প
কাউকে বলতে চেয়েছিলেন। তাঁর ছেলে গ্যারি বন্ধুদের সহযোগিতায় হেথার মরিসকে
পেয়ে যান। তিন বছর ধরে লালের কাছে এই গল্প শোনেন হেথার। বিভিন্ন জাদুঘরে
গিয়ে তাঁর বলা কথার সপক্ষে নথিপত্রও জোগাড় করেন তিনি। সম্প্রতি লেখা ‘দ্য
ট্যাটুইস্ট অব আউশভিৎস’ বইয়ে লালে ও গিটার এই প্রেমকাহিনির বিবরণ দিয়েছেন
হেথার।
No comments