সংকটে গলদার পোনা উৎপাদন
দেশে
গলদা চিংড়ির পোনা সরবরাহের জন্য নিয়োজিত হ্যাচারির উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে
কমে যাচ্ছে। অনেক হ্যাচারির উৎপাদন দুই থেকে তিন বছর ধরে বন্ধ। সরকারের
হ্যাচারির উৎপাদনও একেবারেই কম। ফলে গলদার পোনার চাহিদা ও জোগানের মধ্যে
বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে। চাহিদা মেটাতে প্রাকৃতিক উৎস ও ভারত থেকে
বেআইনিভাবে আসা পোনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন চাষিরা। এসব পোনায় নানা রকম
ভেজাল থাকে। সঠিক সময়ে পাওয়াও যায় না। সব মিলিয়ে রপ্তানিমুখী গলদা চাষের
গোড়াতেই বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। সমস্যা সমাধান না হলে গলদা চাষ হুমকির
মধ্যে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। খুলনার মৎস্য কর্মকর্তা ও
হ্যাচারির মালিকেরা জানান, দেশে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে গলদার চাষ
হয়। প্রতি হেক্টরে ২০ থেকে ২৫ হাজার পোনা (পিএল বা পোস্ট লার্ভা) ছাড়তে হয়।
ফলে বছরে একবার চাষেই কমপক্ষে ১৩০ কোটি পোনা দরকার। বছরে অন্তত দুই দফায়
চাষ করলেও পোনার চাহিদা ২৬০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। মানভেদে প্রতিটি পোনার দাম ২
থেকে ৪ টাকা। সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ২০১৬ সালে ১৭টি সরকারি
হ্যাচারিতে ৫৫ লাখ গলদা পোনা উৎপাদিত হয়েছে। সে বছর বেসরকারি ১৯টি হ্যাচারি
৪ কোটি ১০ লাখ পোনা উৎপাদন করেছে। গত বছরের হিসাব তাদের কাছে নেই। অবশ্য
বেসরকারি সংস্থা উইনরক ইন্টারন্যাশনালের সেফটি প্রকল্পের জরিপ অনুযায়ী,
গলদা পোনা উৎপাদনের ৮০টি হ্যাচারির মধ্যে ৩৭টিই খুলনা বিভাগে। ১৭টি
চট্টগ্রাম বিভাগে। গত বছর খুলনার ৩টি হ্যাচারি উৎপাদনে গেলেও শেষ পর্যন্ত
কেউ সফল হয়নি। তবে বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনার ৬ টি, চট্টগ্রাম ও
কক্সবাজারের ২ টি, গোপালগঞ্জের ১টি ও বগুড়ার ১টি হ্যাচারি ২ কোটি ৬৭ লাখ
পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। জানতে চাইলে বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘হ্যাচারিগুলো
গলদার পোনা উৎপাদনে কেন ব্যর্থ হচ্ছে সেটি খুঁজতে আমরা তিন বছর ধরে গবেষণা
করছি। তবে এখনো সমস্যার মূলে পৌঁছাতে পারিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি আমরা
গুরুত্বসহকারে নিয়েছি এবং সরকারের ওপর মহলে জানিয়েছি।’ সাধারণত শীতের শেষ
দিকে হ্যাচারিগুলোতে গলদা পোনা উৎপাদন শুরু হয়। জানুয়ারিতে হ্যাচারিগুলোয়
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ধুম লেগে যায়।
তবে খুলনা-বাগেরহাট সড়কের পাশে দেড়
একর জমির ওপর বাগেরহাট গলদা চিংড়ি হ্যাচারি নামের প্রতিষ্ঠানে গত ৬
জানুয়ারি গিয়ে দেখা গেল কোনো প্রস্তুতি নেই। সুনসান নীরবতা। ভেতরের
চৌবাচ্চায় ধুলাবালি জমেছে। হ্যাচারির কর্মকর্তা স্বরূপ দাস বললেন, তিন বছর
ধরে পোনা উৎপাদন হচ্ছে না। পোনা উৎপাদনের সব ব্যবস্থা করার পরও দেখা যাচ্ছে
নির্ধারিত সময়ের আগেই সব পোনা মারা যাচ্ছে। গতবার হ্যাচারির ২৮ ট্যাংকের
মধ্যে ১৪ টিতে পোনা উৎপাদন শুরু হয়েছিল। তবে পোনা না হওয়ায় ৬-৭ লাখ টাকা
লোকসান হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ ২০১৪ সালে ১০ থেকে ১২ লাখ পোনা উৎপাদন
হয়েছিল। তারপর কেন হচ্ছে না কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বাগেরহাটের শ্রীঘাটের
ফুলবাড়ী এলাকায় ব্র্যাকের গলদা চিংড়ি হ্যাচারি-২-এ গিয়ে একই চিত্র দেখা
গেল। চলতি মৌসুমে তারা গলদার পোনা উৎপাদনে যাবে না। কারণ গত বছর ৩৫ দিন
চেষ্টা করে তাদের ৭০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ২০১৬ সালে ৩৫ লাখ গলদার পোনা
উৎপাদন করা হয়েছিল। বর্তমানে লোকসান কমাতে হ্যাচারির পাশের পুকুরে
তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। মূল হ্যাচারি অলস পড়ে আছে। জানতে
চাইলে ব্র্যাক ফিশারিজের বাগেরহাটের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘কেন
গলদার পোনা উৎপাদন হচ্ছে না, সেটি আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি। সরকারের
বিষয়টি শিগগিরই খুঁজে বের করা দরকার। কারণ নদীর পোনার ওপর ভরসা করা যায় না।
কোনো এক বছর পোনা না পাওয়া গেলে চিংড়ি চাষের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে।’
খুলনার ডুমুরিয়ায় অবস্থিত খুলনা গলদা চিংড়ি হ্যাচারিতে বর্তমানে তেলাপিয়ার
পোনা উৎপাদন ও মুরগি পালন হচ্ছে। কারণ তিন বছর ধরে গলদার পোনা হচ্ছে না।
হ্যাচারির উদ্যোক্তা বিমল মিত্র বলেন, পোনা উৎপাদন না হওয়ায় প্রতিবছর ১০
থেকে ১৫ লাখ টাকা করে লোকসান হচ্ছে। কারণ প্রক্রিয়াটি শুরু করতে গেলেই মা
চিংড়ি কিনতে হয়। অন্য জায়গা থেকে লবণ পানি আনতে হয়। ট্যাংকের পানির
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও অক্সিজেনের জন্য মেশিন চালাতে হয়। খাবারের পেছনেও
প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। বাগেরহাটের ফকিরহাটের হিটলার গোলদার এক যুগের বেশি
সময় ধরে গলদা চিংড়ি চাষ করছেন। তিনি বললেন, ‘পোনার সংকট প্রকট আকার ধারণ
করেছে। নদীর পোনাই আমাদের ভরসা। তবে সব বছর সময়মতো পোনা পাওয়া যায় না। ফলে
উৎপাদন ব্যাহত হয়। অন্যদিকে বাজারে গলদার দামও পড়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে
পাততাড়ি গোটাতে হবে।’ জানতে চাইলে উইনরক ইন্টারন্যাশনালের গলদা বিশেষজ্ঞ
সুকুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সাল থেকে হ্যাচারিতে লার্ভা মারা
যাওয়া উপসর্গের প্রাদুর্ভাব ঘটে। হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হয়। গত
দুই-তিন বছরে সেটি মারাত্মক আকার নিয়েছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি
সংস্থা বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে পরীক্ষা করিয়েছে। বিশ্বের কয়েকটি
বিশ্ববিদ্যালয়ে লার্ভা ও মা চিংড়ি পরীক্ষা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে,
ভাইরাসের কারণে লার্ভা মারা যাচ্ছে। তবে সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে আরও
পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। নির্দিষ্ট কিছু রোগজীবাণুমুক্ত (এসপিএফ) বাগদা
চিংড়ির পোনার জন্য কক্সবাজারে একটি হ্যাচারি হয়েছে। এতে ভালো ফল মিলছে।
খুলনায় আরেকটি নির্মাণাধীন আছে। একইভাবে গলদার জন্য এসপিএফ হ্যাচারির
অনুমোদন দিতে পারে সরকার। এ জন্য থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠানের
সহায়তা নেওয়া যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন সুকুমার বিশ্বাস। মৎস্য
অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিত্যরঞ্জন বিশ্বাস প্রথম আলোকে
বলেন, পোনা উৎপাদনের জন্য রোগমুক্ত মা গলদা প্রয়োজন। তবে হ্যাচারিগুলো নদী
থেকে মা গলদা সংগ্রহ করে। আর নদীগুলো দূষণের কারণে মা গলদা রোগাক্রান্ত
হচ্ছে। এ ছাড়া হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন প্রক্রিয়াটি স্বাস্থ্যসম্মত করতে
হবে। তিনি আরও বলেন, এসপিএফ পদ্ধতিতে পোনা উৎপাদনের একটি নীতিমালা আছে।
কোনো হ্যাচারি প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও নীতিমালা মেনে আবেদন করে তাহলে
অনুমতি না দেওয়ার কোনো কারণ নেই।
No comments