নারায়ণগঞ্জ এখন আর সন্ত্রাসের জনপদ নয়
প্রথম আলো: আগে আপনি ছিলেন নির্দলীয় মেয়র, এবার হয়েছেন দলীয় মেয়র। একই সঙ্গে দলের নেতাও। মেয়রের কাজে নিশ্চয়ই এর প্রভাব পড়ছে।
সেলিনা হায়াৎ আইভী: মেয়র হিসেবে এই চেয়ারে যখন বসি, তখন আমি নির্দলীয়। আমি যদিও দলের কর্মী। কিন্তু যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, আর যাঁরা দেননি, সবারই সেবা করছি। নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলাম।
প্রথম আলো: নির্দলীয় থাকার সময় যে স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পেরেছেন, দলীয় মেয়র হয়ে সেটি পারছেন কি?
আইভী: দল-মতের বাইরে গিয়ে আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছি। আমাকে কখনো কেউ চাপ দেয়নি। নিরপেক্ষভাবে আমি মেয়রের দায়িত্ব পালন করছি।
প্রথম আলো: দলীয় মেয়র হওয়ার আগে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতার ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন?
আইভী: ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে অস্ট্রেলিয়া সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের একজন নারী মেয়র আসছেন।’ আমি তো দলের বাইরে ছিলাম না। তবে সিটি করপোরেশন হওয়ার পরে অনেক প্রকল্প জমা দিতে দেরি হয়েছে, তাই টাকা পেতেও দেরি হয়েছে।
প্রথম আলো: ২০১১ সালে তো আপনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি। আপনার বাবার ক্ষেত্রেও এ রকম হয়েছিল। এ নিয়ে কোনো মনোবেদনা?
আইভী :আমার বাবা আলী আহম্মদ চুনকা জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘জানি তুই পাস করবি।’ ওই সময় তাঁরা তিনজন নির্বাচন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজনকে প্রার্থী হতে বলেছিলেন। মানাতে পারেননি। নির্বাচনে বাবা জয়ী হন। ২০১১ সালেও প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছেন একক প্রার্থী দিতে, কিন্তু আমি পদ ছাড়তে চাইনি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানও ছাড়েননি। নির্বাচনটি আমি শামীম ওসমানের সঙ্গেই করতে চেয়েছিলাম। কেবল নারায়ণগঞ্জবাসী নয়, সারা দেশের মানুষ ওই নির্বাচন উপভোগ করেছিল। তাঁর কারণেই নির্বাচনটি কালারফুল (বর্ণাঢ্য) হয়েছিল। এবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে নৌকা দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জবাসী নৌকার মর্যাদা রেখেছে।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত। আপনি একসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এই শহরে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মতো কিশোর নিহত হয়েছে। সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে।
আইভী: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমি এখনো সোচ্চার। তবে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। এখন আর সন্ত্রাসের নগরী নেই। ছয়-সাত বছরে নারায়ণগঞ্জ নেতিবাচক ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠেছে। আগে যারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাত, তারা এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তবে গুম, হত্যার চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মাদকের বিস্তার।
প্রথম আলো: মাদকের বিস্তার রোধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করছেন না কেন?
আইভী: মেয়র একা এটা করতে পারবে না। পাড়ায়-মহল্লায় জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। আর সিটি করপোরেশন তো অনেক কাজ হাতে নিয়েছে। ২৭টি খাল, ৩০টি পুকুর পুনরুদ্ধারের কাজ হচ্ছে। এখানে পাঁচজন সাংসদ আছেন। তাঁদেরও মাদক নির্মূলে কাজ করতে হবে। প্রশাসন কঠোর হলে শহরে মাদক ঢুকতে পারবে না।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে প্রশাসন কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে?
আইভী: অনেক সময় প্রতিকার চাইতে গেলে প্রশাসনের লোকজন বলেন ‘ওপরের চাপ আছে’। আমরা এটা শুনতে চাই না। ইদানীং প্রশাসনও আগের চেয়ে সক্রিয় মনে হচ্ছে।
প্রথম আলো: নির্বাচনে আপনার কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল। কতটা কাজ হয়েছে?
আইভী: গত এক বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। আরও অনেক প্রকল্প চলমান আছে। নয়তলা নগর ভবন হচ্ছে। হাতিরঝিলের আদলে লেক করছি। প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে শহরের মাঝখানে খোলা জায়গা করে দিয়েছি। সিদ্ধিরগঞ্জে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের কাজ হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা থেকে ধলেশ্বরী পর্যন্ত বাবুরাইল খাল আমরা সংযোগ করে দিচ্ছি। সিদ্ধিরগঞ্জ লেকের বিষয়েও ১৫০ কোটি টাকার দরপত্র ডাকা হচ্ছে। মাঠের কাজ হচ্ছে। খাল খনন হচ্ছে।
প্রথম আলো: এমন কোনো পরিকল্পনা নিয়েছেন, যেটা টাকার কারণে পারছেন না?
আইভী: আমরা সুইমিং পুল করছি। শেখ রাসেলের নামে নভোথিয়েটার করতে চাইছি। এগুলোর জন্য টাকা দরকার।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে ভালো মানের কোনো আবাসিক হোটেল নেই?
আইভী: পাঁচতারাবিশিষ্ট হোটেলের চিন্তা আমরা করছি না। আগে আমাদের স্কুল, মাঠ—এগুলো করতে হবে। এখানে অনেক ব্যবসায়ী আছেন। ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জে বিনিয়োগ করছেন। আমি তাঁদের অনুরোধ করব, তাঁরা যাতে ভালো হোটেল নির্মাণ করেন। তবে বিদেশের মতো ডরমিটরি করার চিন্তা আমাদের আছে।
প্রথম আলো: নগরবাসীর বড় সমস্যা অপ্রশস্ত সড়ক, যানজট।
আইভী :যানজট নিরসনের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আছে। তারপরও আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি। আমাদের সঙ্গে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জে গণপরিবহন চালুর চিন্তা করছি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সহযোগিতা করতে চাইছে। নদীর পাড় দিয়ে রাস্তার পরিকল্পনা আছে। বিকল্প সড়ক বের করার চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো: হকার সমস্যা নিয়ে আপনি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন।
আইভী: হকাররা রাস্তায় থাকুক, আমি তা চাই না। ২০০৭ সালে ৬০০ হকারকে জায়গা দিয়েছিলাম হকার্স মার্কেটে। রাস্তায় জনগণ হাঁটবে আর হকাররা মার্কেটে থাকবে। নারায়ণগঞ্জে রাজউকের জায়গা আছে। সেখানে হকারদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে।
প্রথম আলো: প্রথম মেয়াদে আপনার প্রতিশ্রুতি ছিল শীতলক্ষ্যা সেতু করার।
আইভী: এটা এখনই সম্ভব হবে না। তবে চেষ্টা করছি। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনিও খুব আন্তরিক। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আপনি কী করেছেন?
আইভী: বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১৫১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ২৩ একর জায়গার মধ্যে ১০ একর জায়গায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ফতুল্লায় কমপোস্ট প্ল্যান্ট আছে, সার তৈরি হচ্ছে।
প্রথম আলো: শহরের ভেতরের রেললাইন সরানোর পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। আপনি কোন পক্ষে?
আইভী: বিশ্বের উন্নত দেশে রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল এক জায়গায় থাকে। রেললাইন সরানো ঠিক হবে কি না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া উচিত। এখানে কারও জেদ ধরে বসে থাকা উচিত নয়। আমি আধুনিকায়নের পক্ষে। ২০-৩০ বছর পরের কথা চিন্তা করে কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আপনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে কি?
আইভী: স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর মধ্যে একমাত্র নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনই প্রথম ৫০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। পাশের জেলাগুলোকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। সার্কুলার রোড হচ্ছে।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা তো খুবই সীমিত। এটি বাড়ানো দরকার মনে করছেন কি?
আইভী: ক্ষমতা বাড়ানো-কমানোর কথা না-ই বললাম। তবে সিটি গভর্নমেন্ট হওয়া উচিত। এতে কাজ করতে সুবিধা হবে। একজন মেয়র চাইলেই অনেক কাজ এখন করতে পারেন না। অনেক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়।
প্রথম আলো: এটা তো নীতি-নির্ধারণী ব্যাপার। মেয়র হানিফই প্রথম বলেছিলেন। কিন্তু তারপর তো আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতায় এল। কিন্তু বাস্তবায়ন হলো না।
আইভী: দেখুন, আওয়ামী লীগের ইশতেহারেই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা আছে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, নারীর ক্ষমতায়ন করা—এগুলো বর্তমান সরকারই করেছে। দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকারকে দুর্বল করে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। সরাসরি নির্বাচন, মেয়রদের ক্ষমতা বাড়ানো—এগুলো এই সরকারের প্রচেষ্টার ফলে হয়েছে। আশা করি, এই কাজটাও আস্তে আস্তে হবে।
প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন দলের হলে মেয়ররা সুবিধা পান, বিরোধী দলের হলে বৈরিতার মুখোমুখি হন?
আইভী: এগুলো মূলত স্থানীয় সমস্যার কারণে হয়েছে। সরকার নিজে কখনো মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা করেনি। জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের কারণে এসব সমস্যা দেখা দেয়।
প্রথম আলো: গাজীপুরে তো উচ্চ আদালত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন?
আইভী: খোঁজ নিয়ে দেখুন, সরকার মামলা করেনি। স্থানীয় সমস্যার কারণে হয়েছে। একসময় আমিও এসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। টাকা দেওয়া হয়নি। কাজেই অন্য কেউ এ রকম সমস্যায় পড়লে আমি প্রতিবাদ করব। এখন আমরা সব মেয়র এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। একে অন্যের সুখে-দুঃখে আছি। স্থানীয় সরকারকে আরও ক্ষমতা দেওয়া দরকার।
প্রথম আলো: শহরে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আইভী: এ ব্যাপারে রাজউকের কাজ করা উচিত।
প্রথম আলো: নগরবাসীর কাছ থেকে পুরো কর আদায় করতে পারছেন না কেন?
আইভী: কর আদায়ের হার ৩২ শতাংশ। এটাকে বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের টিম কাজ করছে। কর আদায়কে আরও গতিশীল করতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমি নিজে বের হব।
প্রথম আলো: ঢাকায় সড়কগুলোতে এলইডি বাতি হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জে কিছু সড়কে বাতিই নেই।
আইভী: এটা ঠিক যে কিছু কিছু সড়কে বাতি নেই। তবে অন্ধকারে গা ছমছম করে, তা-ও না। এখানে বিদ্যুতের ভোল্টেজ খুব ওঠানামা করে। এ কারণে বাতি নষ্ট হয়ে যায়। ঝড়-বৃষ্টিতেও বাতি নষ্ট হয়ে যায়। ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। পুরো শহরে এলইডি বাতি লাগানো হবে।
প্রথম আলো: সাত খুনের বিচার হয়েছে, কিন্তু ত্বকী হত্যার এখনো বিচার হলো না। আপনি একসময় বিচারের দাবিতে মাঠে ছিলেন।
আইভী: আমি এখনো ত্বকী মঞ্চের সক্রিয় কর্মী। নীতি থেকে সরব না। এখনো ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বিকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। আমার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে মামলা আছে। আমার ভাই-ভাগনেকে জেল খাটতে হয়েছে। তারপরও বলব, সাত খুনের বিচারের মতো ত্বকী, চঞ্চল, আশিক, মিঠু হত্যারও বিচার হবে।
প্রথম আলো: ক্ষমতাসীনদের কেউ জড়িত আছে বলেই কি ত্বকী হত্যার বিচার হচ্ছে না?
আইভী: হত্যা হত্যাই। এ ব্যাপারে কেউ ছাড় পাবে না। সময় শেষ হয়ে যায়নি। বিচার হবে।
প্রথম আলো :অভিযোগ আছে, আপনি এখন আর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তেমন কথা বলছেন না। তার কারণ কি সন্ত্রাসের গডফাদারদের সঙ্গে আপসরফা?
আইভী: কেউ যদি এটা মনে করে থাকেন, সেটি আমার প্রতি অবিচার হবে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপসরফার প্রশ্নই ওঠে না। দলের ভেতরেও কেউ অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করেছি। এই সৎসাহস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছি। নারায়ণগঞ্জ আগের নেতিবাচক অবস্থান থেকে অনেক ইতিবাচক অবস্থানে চলে এসেছে। তবে একজন খারাপ লোক যদি জনগণের কাতারে আসতে চায়, তাহলে সেটার প্রশংসাই করা উচিত। আমার কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই।
প্রথম আলো: যারা একসময় আপনাকে প্রতিহত করতে চেয়েছে, তাদের হঠাৎ নমনীয় হওয়ার কারণ কী? এটা কি ছাড় দেওয়া?
আইভী :অবশ্যই ছাড় দেওয়া নয়। জনগণের শক্তি ও ক্ষমতা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এত কিছু করার পরও কি তারা জনগণকে ২০১৬–তে (মেয়র নির্বাচন) আটকাতে পেরেছে? হয়তো তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে, জনমতের বাইরে যাওয়া ঠিক হয়নি। জনগণ আমার পাশে আছে বলেই আজ আমি এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আইভী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
সেলিনা হায়াৎ আইভী: মেয়র হিসেবে এই চেয়ারে যখন বসি, তখন আমি নির্দলীয়। আমি যদিও দলের কর্মী। কিন্তু যাঁরা আমাকে ভোট দিয়েছেন, আর যাঁরা দেননি, সবারই সেবা করছি। নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলাম।
প্রথম আলো: নির্দলীয় থাকার সময় যে স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পেরেছেন, দলীয় মেয়র হয়ে সেটি পারছেন কি?
আইভী: দল-মতের বাইরে গিয়ে আমি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছি। আমাকে কখনো কেউ চাপ দেয়নি। নিরপেক্ষভাবে আমি মেয়রের দায়িত্ব পালন করছি।
প্রথম আলো: দলীয় মেয়র হওয়ার আগে সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতার ঘাটতি ছিল বলে মনে করেন?
আইভী: ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে অস্ট্রেলিয়া সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমাদের একজন নারী মেয়র আসছেন।’ আমি তো দলের বাইরে ছিলাম না। তবে সিটি করপোরেশন হওয়ার পরে অনেক প্রকল্প জমা দিতে দেরি হয়েছে, তাই টাকা পেতেও দেরি হয়েছে।
প্রথম আলো: ২০১১ সালে তো আপনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাননি। আপনার বাবার ক্ষেত্রেও এ রকম হয়েছিল। এ নিয়ে কোনো মনোবেদনা?
আইভী :আমার বাবা আলী আহম্মদ চুনকা জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, ‘জানি তুই পাস করবি।’ ওই সময় তাঁরা তিনজন নির্বাচন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজনকে প্রার্থী হতে বলেছিলেন। মানাতে পারেননি। নির্বাচনে বাবা জয়ী হন। ২০১১ সালেও প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছেন একক প্রার্থী দিতে, কিন্তু আমি পদ ছাড়তে চাইনি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী শামীম ওসমানও ছাড়েননি। নির্বাচনটি আমি শামীম ওসমানের সঙ্গেই করতে চেয়েছিলাম। কেবল নারায়ণগঞ্জবাসী নয়, সারা দেশের মানুষ ওই নির্বাচন উপভোগ করেছিল। তাঁর কারণেই নির্বাচনটি কালারফুল (বর্ণাঢ্য) হয়েছিল। এবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে নৌকা দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জবাসী নৌকার মর্যাদা রেখেছে।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জ সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে পরিচিত। আপনি একসময় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এই শহরে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর মতো কিশোর নিহত হয়েছে। সাত খুনের ঘটনা ঘটেছে।
আইভী: সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমি এখনো সোচ্চার। তবে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। এখন আর সন্ত্রাসের নগরী নেই। ছয়-সাত বছরে নারায়ণগঞ্জ নেতিবাচক ভাবমূর্তি কাটিয়ে উঠেছে। আগে যারা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাত, তারা এখন অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তবে গুম, হত্যার চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে মাদকের বিস্তার।
প্রথম আলো: মাদকের বিস্তার রোধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করছেন না কেন?
আইভী: মেয়র একা এটা করতে পারবে না। পাড়ায়-মহল্লায় জনগণকে সংগঠিত করতে হবে। রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। আর সিটি করপোরেশন তো অনেক কাজ হাতে নিয়েছে। ২৭টি খাল, ৩০টি পুকুর পুনরুদ্ধারের কাজ হচ্ছে। এখানে পাঁচজন সাংসদ আছেন। তাঁদেরও মাদক নির্মূলে কাজ করতে হবে। প্রশাসন কঠোর হলে শহরে মাদক ঢুকতে পারবে না।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে প্রশাসন কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে?
আইভী: অনেক সময় প্রতিকার চাইতে গেলে প্রশাসনের লোকজন বলেন ‘ওপরের চাপ আছে’। আমরা এটা শুনতে চাই না। ইদানীং প্রশাসনও আগের চেয়ে সক্রিয় মনে হচ্ছে।
প্রথম আলো: নির্বাচনে আপনার কিছু প্রতিশ্রুতি ছিল। কতটা কাজ হয়েছে?
আইভী: গত এক বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার কাজ হয়েছে। আরও অনেক প্রকল্প চলমান আছে। নয়তলা নগর ভবন হচ্ছে। হাতিরঝিলের আদলে লেক করছি। প্রায় ৫০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে শহরের মাঝখানে খোলা জায়গা করে দিয়েছি। সিদ্ধিরগঞ্জে ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে লেকের কাজ হচ্ছে। শীতলক্ষ্যা থেকে ধলেশ্বরী পর্যন্ত বাবুরাইল খাল আমরা সংযোগ করে দিচ্ছি। সিদ্ধিরগঞ্জ লেকের বিষয়েও ১৫০ কোটি টাকার দরপত্র ডাকা হচ্ছে। মাঠের কাজ হচ্ছে। খাল খনন হচ্ছে।
প্রথম আলো: এমন কোনো পরিকল্পনা নিয়েছেন, যেটা টাকার কারণে পারছেন না?
আইভী: আমরা সুইমিং পুল করছি। শেখ রাসেলের নামে নভোথিয়েটার করতে চাইছি। এগুলোর জন্য টাকা দরকার।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে ভালো মানের কোনো আবাসিক হোটেল নেই?
আইভী: পাঁচতারাবিশিষ্ট হোটেলের চিন্তা আমরা করছি না। আগে আমাদের স্কুল, মাঠ—এগুলো করতে হবে। এখানে অনেক ব্যবসায়ী আছেন। ঢাকার অনেক ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জে বিনিয়োগ করছেন। আমি তাঁদের অনুরোধ করব, তাঁরা যাতে ভালো হোটেল নির্মাণ করেন। তবে বিদেশের মতো ডরমিটরি করার চিন্তা আমাদের আছে।
প্রথম আলো: নগরবাসীর বড় সমস্যা অপ্রশস্ত সড়ক, যানজট।
আইভী :যানজট নিরসনের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আছে। তারপরও আমরা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছি। আমাদের সঙ্গে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন কাজ করছে। নারায়ণগঞ্জে গণপরিবহন চালুর চিন্তা করছি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সহযোগিতা করতে চাইছে। নদীর পাড় দিয়ে রাস্তার পরিকল্পনা আছে। বিকল্প সড়ক বের করার চেষ্টা করছি।
প্রথম আলো: হকার সমস্যা নিয়ে আপনি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছেন।
আইভী: হকাররা রাস্তায় থাকুক, আমি তা চাই না। ২০০৭ সালে ৬০০ হকারকে জায়গা দিয়েছিলাম হকার্স মার্কেটে। রাস্তায় জনগণ হাঁটবে আর হকাররা মার্কেটে থাকবে। নারায়ণগঞ্জে রাজউকের জায়গা আছে। সেখানে হকারদের পুনর্বাসন করা যেতে পারে।
প্রথম আলো: প্রথম মেয়াদে আপনার প্রতিশ্রুতি ছিল শীতলক্ষ্যা সেতু করার।
আইভী: এটা এখনই সম্ভব হবে না। তবে চেষ্টা করছি। স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনিও খুব আন্তরিক। প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আপনি কী করেছেন?
আইভী: বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ১৫১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়েছে। ছয় মাসের মধ্যে এর সুফল পাওয়া যাবে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ২৩ একর জায়গার মধ্যে ১০ একর জায়গায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ফতুল্লায় কমপোস্ট প্ল্যান্ট আছে, সার তৈরি হচ্ছে।
প্রথম আলো: শহরের ভেতরের রেললাইন সরানোর পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। আপনি কোন পক্ষে?
আইভী: বিশ্বের উন্নত দেশে রেলস্টেশন, বাসস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল এক জায়গায় থাকে। রেললাইন সরানো ঠিক হবে কি না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত নেওয়া উচিত। এখানে কারও জেদ ধরে বসে থাকা উচিত নয়। আমি আধুনিকায়নের পক্ষে। ২০-৩০ বছর পরের কথা চিন্তা করে কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো: নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আপনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে কি?
আইভী: স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর মধ্যে একমাত্র নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনই প্রথম ৫০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। পাশের জেলাগুলোকে সম্পৃক্ত করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। সার্কুলার রোড হচ্ছে।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা তো খুবই সীমিত। এটি বাড়ানো দরকার মনে করছেন কি?
আইভী: ক্ষমতা বাড়ানো-কমানোর কথা না-ই বললাম। তবে সিটি গভর্নমেন্ট হওয়া উচিত। এতে কাজ করতে সুবিধা হবে। একজন মেয়র চাইলেই অনেক কাজ এখন করতে পারেন না। অনেক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়।
প্রথম আলো: এটা তো নীতি-নির্ধারণী ব্যাপার। মেয়র হানিফই প্রথম বলেছিলেন। কিন্তু তারপর তো আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতায় এল। কিন্তু বাস্তবায়ন হলো না।
আইভী: দেখুন, আওয়ামী লীগের ইশতেহারেই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা আছে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, নারীর ক্ষমতায়ন করা—এগুলো বর্তমান সরকারই করেছে। দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকারকে দুর্বল করে রাখার একটা প্রবণতা ছিল। সরাসরি নির্বাচন, মেয়রদের ক্ষমতা বাড়ানো—এগুলো এই সরকারের প্রচেষ্টার ফলে হয়েছে। আশা করি, এই কাজটাও আস্তে আস্তে হবে।
প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন দলের হলে মেয়ররা সুবিধা পান, বিরোধী দলের হলে বৈরিতার মুখোমুখি হন?
আইভী: এগুলো মূলত স্থানীয় সমস্যার কারণে হয়েছে। সরকার নিজে কখনো মেয়রের বিরুদ্ধে মামলা করেনি। জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্বের কারণে এসব সমস্যা দেখা দেয়।
প্রথম আলো: গাজীপুরে তো উচ্চ আদালত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন?
আইভী: খোঁজ নিয়ে দেখুন, সরকার মামলা করেনি। স্থানীয় সমস্যার কারণে হয়েছে। একসময় আমিও এসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। টাকা দেওয়া হয়নি। কাজেই অন্য কেউ এ রকম সমস্যায় পড়লে আমি প্রতিবাদ করব। এখন আমরা সব মেয়র এক হয়ে কাজ করে যাচ্ছি। একে অন্যের সুখে-দুঃখে আছি। স্থানীয় সরকারকে আরও ক্ষমতা দেওয়া দরকার।
প্রথম আলো: শহরে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
আইভী: এ ব্যাপারে রাজউকের কাজ করা উচিত।
প্রথম আলো: নগরবাসীর কাছ থেকে পুরো কর আদায় করতে পারছেন না কেন?
আইভী: কর আদায়ের হার ৩২ শতাংশ। এটাকে বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের টিম কাজ করছে। কর আদায়কে আরও গতিশীল করতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আমি নিজে বের হব।
প্রথম আলো: ঢাকায় সড়কগুলোতে এলইডি বাতি হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জে কিছু সড়কে বাতিই নেই।
আইভী: এটা ঠিক যে কিছু কিছু সড়কে বাতি নেই। তবে অন্ধকারে গা ছমছম করে, তা-ও না। এখানে বিদ্যুতের ভোল্টেজ খুব ওঠানামা করে। এ কারণে বাতি নষ্ট হয়ে যায়। ঝড়-বৃষ্টিতেও বাতি নষ্ট হয়ে যায়। ৫০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। পুরো শহরে এলইডি বাতি লাগানো হবে।
প্রথম আলো: সাত খুনের বিচার হয়েছে, কিন্তু ত্বকী হত্যার এখনো বিচার হলো না। আপনি একসময় বিচারের দাবিতে মাঠে ছিলেন।
আইভী: আমি এখনো ত্বকী মঞ্চের সক্রিয় কর্মী। নীতি থেকে সরব না। এখনো ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বিকে নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। আমার আত্মীয়দের বিরুদ্ধে মামলা আছে। আমার ভাই-ভাগনেকে জেল খাটতে হয়েছে। তারপরও বলব, সাত খুনের বিচারের মতো ত্বকী, চঞ্চল, আশিক, মিঠু হত্যারও বিচার হবে।
প্রথম আলো: ক্ষমতাসীনদের কেউ জড়িত আছে বলেই কি ত্বকী হত্যার বিচার হচ্ছে না?
আইভী: হত্যা হত্যাই। এ ব্যাপারে কেউ ছাড় পাবে না। সময় শেষ হয়ে যায়নি। বিচার হবে।
প্রথম আলো :অভিযোগ আছে, আপনি এখন আর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তেমন কথা বলছেন না। তার কারণ কি সন্ত্রাসের গডফাদারদের সঙ্গে আপসরফা?
আইভী: কেউ যদি এটা মনে করে থাকেন, সেটি আমার প্রতি অবিচার হবে। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপসরফার প্রশ্নই ওঠে না। দলের ভেতরেও কেউ অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করেছি। এই সৎসাহস মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছি। নারায়ণগঞ্জ আগের নেতিবাচক অবস্থান থেকে অনেক ইতিবাচক অবস্থানে চলে এসেছে। তবে একজন খারাপ লোক যদি জনগণের কাতারে আসতে চায়, তাহলে সেটার প্রশংসাই করা উচিত। আমার কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই।
প্রথম আলো: যারা একসময় আপনাকে প্রতিহত করতে চেয়েছে, তাদের হঠাৎ নমনীয় হওয়ার কারণ কী? এটা কি ছাড় দেওয়া?
আইভী :অবশ্যই ছাড় দেওয়া নয়। জনগণের শক্তি ও ক্ষমতা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এত কিছু করার পরও কি তারা জনগণকে ২০১৬–তে (মেয়র নির্বাচন) আটকাতে পেরেছে? হয়তো তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে, জনমতের বাইরে যাওয়া ঠিক হয়নি। জনগণ আমার পাশে আছে বলেই আজ আমি এই অবস্থানে আসতে পেরেছি।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আইভী: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
No comments