চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়
রোহিঙ্গাদের
রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার গত নভেম্বরে যে চুক্তি সই
করেছে, জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়
প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি মনে করে, চুক্তিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব
রোহিঙ্গা ফেরানোর সুযোগ না রাখা, প্রত্যাবাসন শুরুর অপর্যাপ্ত সময়সীমা,
রোহিঙ্গাদের আদি আবাসের কাছে ফেরানোর অধিকারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা
চুক্তির বাস্তবায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক
সূত্রগুলো গত শুক্রবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ইউএনএইচসিআর
বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তি নিয়ে এক বিশ্লেষণে ওই অভিমত দিয়েছে। গত ডিসেম্বরে
সংস্থাটি ওই বিশ্লেষণ তুলে ধরে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, প্রত্যাবাসন
চুক্তির দুর্বলতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অন্তত চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে
ইউএনএইচসিআর। এগুলো হচ্ছে যারা ২০১৬ সালের অক্টোবরের আগে বাংলাদেশে এসেছে
তাদের বিষয়টি চুক্তিতে উল্লেখ নেই; নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও টেকসই উপায়ে
প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য ২৩ জানুয়ারি থেকে সময়সীমা নির্ধারণ বাস্তবসম্মত নয়;
রোহিঙ্গাদের আদি বাসস্থানে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে তাদের অধিকার
ক্ষুণ্ন করা হয়েছে এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার যুক্ততাও স্পষ্ট নয়।
গতকাল শনিবার রোহিঙ্গা পরিস্থিতির হালনাগাদ পরিস্থিতিসংক্রান্ত সাপ্তাহিক
পর্যালোচনায় ইউএনএইচসিআর বলছে, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকার
নিশ্চিত হওয়ার মতো ইতিবাচক অগ্রগতি না হওয়া পর্যন্ত রাখাইনে ফিরতে রাজি নয়
রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসন নিয়ে যেসব রোহিঙ্গার সঙ্গে তারা কথা বলেছে, তাদের
বেশির ভাগই রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব অগ্রগতি দেখতে চায়।
প্রত্যাবাসন চুক্তি নিয়ে ইউএনএইচসিআরের ওই বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে
বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা উদ্ধৃত হয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তাঁরা
বলেছেন, সংস্থাটির সব অভিমতই যে সঠিক, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
এবারের চুক্তিতে যদি সীমাবদ্ধতা থেকেও থাকে এতে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায়
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার দিকটি বাংলাদেশ অনেক
জোরালোভাবে তুলে ধরতে পেরেছে। বিভিন্ন পর্যায়ের চুক্তি সইসহ সরকারি
পর্যায়ের প্রস্তুতির প্রক্রিয়াগুলো শেষ হলেই জাতিসংঘকে যুক্ত করা হবে।
ফলে
সামগ্রিকভাবে চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কাজে লাগানোর ওপর
জাতিসংঘের নজর দেওয়াটাই সমীচীন হবে। চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে বাংলাদেশের
ওপর বাড়তি চাপ দেওয়াটা অযৌক্তিক। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়কে নিয়েও এ সমস্যার সুরাহার কথা বলছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সমস্যার
টেকসই সমাধান করতে হলে ইউএনএইচসিআরকে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ততার ওপর বেশি
মনোযোগ দেওয়া উচিত। ইউএনএইচসিআর তাদের বিশ্লেষণে চুক্তি নিয়ে দুর্বলতা তুলে
ধরার পাশাপাশি সাতটি সুপারিশ দিয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর যারা এসেছে
তাদের পাশাপাশি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া সব রোহিঙ্গার ফেরার ওপর ইউএনএইচসিআর
জোর দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যখনই এসে থাকুক না কেন, রাখাইনে স্বেচ্ছায় ফিরে
যেতে আগ্রহী সবার ফেরার জন্য দুই দেশের সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ
দিয়েছে সংস্থাটি। যেকোনো প্রত্যাবাসনে স্বেচ্ছায় ফেরার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে
ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফেরার পথ তৈরি করে দিতে তাদের
মাঝে আস্থা সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য প্রত্যাবাসন শুরুর আগে
প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাখাইনের পরিবেশ কেমন, সেটা দেখে আসার সুযোগ দেওয়া
উচিত। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন টেকসই করতে নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দিয়েছে
ইউএনএইচসিআর। এ নিয়ে সংস্থাটির সুপারিশ, রোহিঙ্গারা যাতে ধাপে ধাপে রাখাইনে
ফিরতে পারে, এ জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখা উচিত। ফিরে যাওয়ার পর
রোহিঙ্গারা যাতে সহিংসতা ও হুমকির শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা; নিজেদের
ইচ্ছা অনুযায়ী ফেরার অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী
আবাসে থাকার সময়টা যাতে যৌক্তিক হয়; রাখাইনে তাদের অবাধে চলাফেরা, কাজের
অধিকারসহ সব ধরনের সুযোগ নিশ্চিতের পাশাপাশি এখন যে বিধিনিষেধ আছে তা দূর
করা; ফেরার পর রাখাইনে তাদের ‘সন্ত্রাসী তৎপরতা’ কিংবা ‘অপরাধমূলক তৎপরতা’র
অভিযোগে যাতে বিচার না হয় এবং রোহিঙ্গাদের ফেরার পর পরিস্থিতি কেমন হয়, তা
দেখতে রাখাইনে ইউএনএইচসিআরের অবারিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা। চুক্তিটা
যেহেতু রোহিঙ্গাদের জন্য, তাই এতে তাদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে ধাপে ধাপে
প্রত্যাবাসনের পরামর্শ ইউএনএইচসিআরের। তাই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থাটি
প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টির জন্য এবং পুরো
প্রক্রিয়ায় সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর যুক্ততার কথা বলেছে।
রোহিঙ্গাদের ফেরানোর ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে তাদের পরিচয়
নিশ্চিত করা। এ কাজটি বাস্তবতার নিরিখে করা উচিত। এ জন্য ইউএনএইচসিআর
বলেছে, বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপকতর তথ্যের
ভিত্তিতে মিয়ানমারের অধিবাসী হওয়ার বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া যায়। এ
ক্ষেত্রে ইউএনএইচসিআর পরিবারভিত্তিক যে জরিপ চালিয়েছে, সেটিকেও বিবেচনায়
নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন টেকসই করার ক্ষেত্রে
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার এই বিশ্লেষণকে ইতিবাচক মনে করেন। গতকাল
সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ যখন মিয়ানমারের
সঙ্গে আলোচনায় বসবে, তখন বিষয়টি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে
জাতিসংঘের অবস্থানটা তুলে ধরতে পারবে। ফলে এটি বাংলাদেশের অবস্থানকে
শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গাদের ফেরানোটা নিশ্চিত করার স্বার্থে মিয়ানমারের
ওপর আন্তর্জাতিক চাপ যত থাকবে, ততই মঙ্গল।
No comments