রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেন মায়া by আফ্রাসিয়াব খটক
পাকিস্তানের
গণতন্ত্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেটা নতুন নয়। কিন্তু সম্প্রতি
রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্র নির্বাচিত সরকারকে মারাত্মকভাবে অস্থিতিশীল করার
পর এখন আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের পথে বাধার সৃষ্টি করছে, এতে পরিস্থিতি আরও
খারাপ হয়েছে। আর এটাও এখন উন্মুক্ত রহস্য যে গত চার বছরে গোঁড়া রাজনীতিক ও
ধর্মীয় চরমপন্থীরা আগ্রাসী ও কিঞ্চিৎ সহিংস যে অবস্থান ধর্মঘট করেছে, তার
পেছনে রাষ্ট্রের ভেতরের রাষ্ট্রের হাত ছিল। ক্ষমতাসীন মন্ত্রীরা রাষ্ট্রীয়
গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কয়েক ব্যক্তির নাম করেছেন, ২০১৪ সালের দীর্ঘস্থায়ী
অবস্থান ধর্মঘটের পেছনে যাঁদের হাত ছিল। এরপর ২০১৪ সালে উচ্চ বিচারালয়ের
ঊর্ধ্বতন বিচারকেরা উন্মুক্ত আদালতে ফয়জাবাদের সাম্প্রতিক সহিংস অবস্থান
ধর্মঘটের ব্যাপারে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যাতে অনেক কিছু বোঝা যায়। উভয়
ক্ষেত্রেই নিরাপত্তামহল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তা অস্বীকার করা হয়নি।
ব্যাপারটা হলো, নিরাপত্তামহল বরং নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে দেওয়া এবং ‘কৌশলগত
কারণে’ সাধারণ নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। এই
অ্যাজেন্ডার উদ্দেশ্য দুটি। প্রথমত, এতে সফল হলে আসন্ন সিনেট নির্বাচনের
সূচি পরিবর্তন করা যাবে, যেখানে পিএমএলএন আবারও উচ্চকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা
পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের
সুযোগ সৃষ্টি হবে, পছন্দমতো টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে যা গঠন করা যাবে।
রাজনৈতিক সরকার না থাকার মানে হলো, রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিরাপত্তামহলের
পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। পাকিস্তানি সংবিধানের ২৪তম সংশোধনী
সিনেটে বাতিল করতে পর্দার পেছনে অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, যেখানে বিরোধীরা
সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংসদে এই বিল ইতিমধ্যে পাস হয়ে গিয়েছিল, যেখানে নওয়াজ শরিফের
দল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা প্রতিহত করা গেলে সাম্প্রতিক শুমারির ভিত্তিতে আসন
পুনর্বিন্যাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন
অনিবার্যভাবে পিছিয়ে যেত, আর তার দায় গিয়ে পড়ত সংসদের ঘাড়ে। রাষ্ট্রের
ভেতরের রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিরোধী দলের অনেক সুবিধাবাদী রাজনীতিক
সিনেটে এই বিল আটকে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ওই দলের বোধসম্পন্ন
ব্যক্তিদের পক্ষে বিলটি শেষমেশ পাস হয়েছে। তবে খেলা এখনই শেষ হয়ে যায়নি,
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার খেলা এখনো জারি আছে। বেলুচিস্তানের
মুখ্যমন্ত্রীর ওপর চাপ দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র চলছে, তাতে এটা স্পষ্ট।
কোয়েটা
থেকে যে প্রতিবেদন আসছে, তাতে জানা যায় যে এই সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনায়
যুক্ত না হলে তাঁর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হবে। রাজনৈতিক
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেলুচিস্তানের সংসদ ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্র সফল হলে এরপর
পাখতুনখাওয়ার সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে, এরপর কোপ পড়বে সিন্ধের সংসদের ওপর। এতে
নওয়াজের ঘাঁটি পাঞ্জাব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের
আরেকটি দল মনে করে, এই আগাম সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রচারণা দুটি কারণে সফল হবে
না। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলো অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে কায়মনোবাক্যে
এটি মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, সাধারণ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে
গেলে তাতে যেমন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি ক্ষমতাসীন
দলও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এত কিছুর পরও
নিজের লক্ষ্যে অটল ছিলেন এবং শত চাপের মুখেও আত্মসমর্পণ করেননি। পরিণামে
তিনি শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তাঁর ভোটব্যাংক অক্ষত
আছে এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হচ্ছে। তাঁর দলের সংসদীয় ফোরামে
একতা এবং সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য সফরের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা গেছে।
সম্প্রতি ইসলামাবাদের এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা
বলেছেন। লিখিত ভাষণে তিনি সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে পাকিস্তান-মার্কিন
জোটের গুরুত্বের ওপর আলোকপাত করেছেন, তেমনি অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদের
প্রসঙ্গে পাকিস্তান শিথিল নীতি গ্রহণ করেছে, তা থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। এ
ব্যাপারে সামরিক ও রাজনৈতিক মহলের মধ্যে যে বিভাজন আছে, সে সম্পর্কে তিনি
পরিষ্কারভাবে বলেছেন। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা
বৈঠকের খবর উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডন পত্রিকার কাছে ফাঁস করে দেওয়ার জন্য
সেনাবাহিনী তাঁর সরকারকে দায়ী করে—এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ওই বিভাজনের
প্রসঙ্গ টেনেছেন। সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযান প্রসঙ্গে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে
‘নিজের ঘর ঠিক রাখার’ নীতির ওপর জোর দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের কিছু মন্ত্রী
সন্ত্রাসবাদের প্রসঙ্গে নিরাপত্তামহলের বুলি তোতা পাখির মতো আওড়ে যাচ্ছেন,
এই সামরিক মহল যা অস্বীকার করে থাকে। কিন্তু নওয়াজ শরিফ পরিষ্কারভাবে
ইঙ্গিত দিয়েছেন, দেশটির মূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার
প্রতি রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার অবসান চায়। একই সঙ্গে তারা অন্য দেশের
অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তারা বিশ্বাস করে, নীতিতে এ
ধরনের পরিবর্তন এলে দেশটির নৈতিক বল বাড়বে, এ ধরনের শক্ত অবস্থান নেওয়ার
ক্ষেত্রে যা পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করে থাকে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
ব্যাপার হলো, পাকিস্তান এতে বিচ্ছিন্নতা এড়াতে পারবে। সন্ত্রাসবাদ ও
চরমপন্থার ব্যাপারে ভুল নীতি নেওয়ার কারণে পাকিস্তান একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে
পড়েছিল। ক্ষমতাকাঠামোর পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে, নওয়াজ শরিফের
নেতৃত্বাধীন পিএমএল-এনের ব্যাপক গণভিত্তি আছে। সেটা যদি হয়, তাহলে তারা
আসন্ন নির্বাচনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে কেন? বাস্তবতা হলো, জুলফিকার আলী
ভুট্টোর পর এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতা নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন ও
রাজনৈতিক কারসাজির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, যাঁর বিপুল জনসমর্থন আছে। তবে
ভুট্টোর মতো তাঁরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু ভুট্টোর মতো তিনিও
অসাংবিধানিক কারসাজির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস সঞ্চয় করেছেন। তবে ভুট্টোর
তুলনায় তাঁর কিছু সুবিধাও আছে। ২১ শতকে ক্ষমতাকাঠামো নিয়ন্ত্রণের সীমা আছে
গণমাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে। পাঞ্জাবে নওয়াজ শরিফের
শক্তিশালী ভিত আছে। এখন তাঁরা যদি পাঞ্জাব–শাসিত ক্ষমতাকাঠামোকে নিয়ন্ত্রণে
আনতে পারেন, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা টেকসই হবে।
পাকিস্তানের দ্য নেশন ডট কম থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
পাকিস্তানের দ্য নেশন ডট কম থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের আঞ্চলিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
No comments