কুতুব মিনারে এক প্রহর
সূর্যটা
তখন ঠিক মাথার ওপরে। শীতকাল হওয়ায় তেমন তেজ নেই। গাড়ি থেকে নেমে গেলাম
কুতুব মিনার গেটের কাছে। টিকিট কাউন্টারের সামনে দীর্ঘ লাইন। ভিড় ঠেলে সবার
সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনে। টিকিটমূল্য ৩০ রুপি। একটি স্কুলের সব
ছাত্রছাত্রী এসেছে কুতুব মিনার দেখতে। তাই প্রবেশপথেও ভিড়। ছাত্রছাত্রীদের
সাথে কোনোমতে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। ঢুকতেই নজর কাড়ল সুউচ্চ কুতুব মিনার, সারি
সারি ফুলের বাগান আর আশপাশের পুরনো ইমারতগুলো। অদ্ভুত সব সুন্দরের ছড়াছড়ি
সবখানে। আনন্দে সবাই ছুটাছুটি করছে। কেউ তুলছে সেলফি। নগর সম্রাট দিল্লির
মুসলিম ঐতিহ্যগুলো দেখার জন্যে অনেক দিন অপেক্ষায় ছিলাম। আজ চোখের সামনে
ঐতিহাসিক সে স্থাপত্যগুলো দেখে মুহূর্তেই মনটা খুশিতে ভরে উঠল। কদমে কদমে
চলে এলাম মিনারের একেবারে কাছে। মিনারটি কাছ থেকে অনেক বিশাল আকারে ধরা দেয়
চোখে। লোহার রেলিং দিয়ে চারপাশটা ঘেরা। সুন্দর সুন্দর কারুকার্য দিয়ে
মোড়ানো পুরো মিনার। কালিমা ও হাদিস-কুরআর ডিজাইন করে লিখা রয়েছে সর্বোচ্চ
চূড়া পর্যন্ত। পুরো মিনারটাই লাল ইটের তৈরি। এটি এত মজবুত যে আশপাশের কিছু
দালান খসে পড়লেও আজ অবধি মিনারের কিছুই হয়নি। সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে
বহু শতাব্দী ধরে। মিনারের সামনে একটা শিলালিপি। পড়ে নিলাম এর নির্মাণ
ইতিহাস। আগের পড়া ইতিহাসটুকুও হাতড়ে বেড়ালাম মনের দুয়ারে। আবছা আবছা মনে
পড়তে লাগল। তখন ১১৯২ সাল। সুলতান মুহাম্মদ ঘুরীর সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক
চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করে নেন। বিজয়স্তম্ভ ও
নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যে তিনি আফগানিস্তানের জাম মিনারের অনুকরণে
কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু করেন।
কেউ মনে করেন, খাজা কুতুবউদ্দিন নামে
একজন সুফি সাধকের স্মৃতিকে মনে রেখে এটি নির্মাণ করা হয়। কুতুবুদ্দিন
আইবেকের আমলে কেবল এর নিচতলাটিই নির্মিত হয়। তার উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিস আরো
কয়েকতলা নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক নির্মাণ করেন পঞ্চম ও সর্বশেষ
তলাটি। পুরো মিনারের উচ্চতা ৭২.৫ মিটার। তখনকার আমলে এটিই ছিল ভারতের
সর্বোচ্চ টাওয়ার। মিনারের অভ্যন্তরে ওপরে উঠার সিঁড়ি রয়েছে ৩৭৯টি। নিচের
দিকে মিনারের আয়তন ১৪.৩ মিটার ও ওপর দিকে ব্যাস ২.৭৫ মিটার। পাঁচতলা
বিশিষ্ট মিনারের প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি বা ঝুলন্ত বারান্দা। ভেতরে
যাওয়ার পথটি বন্ধ। প্রবেশপথের পাশেই রয়েছে পুরোনো একটি মসজিদ। নাম কুওয়াতুল
ইসলাম মসজিদ। মসজিদের আজানের জন্যে একসময় মিনারটি ব্যবহৃত হতো। মিনারের
বামপাশ দিয়ে রয়েছে আরেকটি গেট। সেখানে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল সৌন্দর্যের এক
ঝলক। সবুজে ছাওয়া বিশাল পপ্রন্তর। নাম না জানা অসংখ্য ছোট ছোট গাছ মাথা
উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার ছায়ায় বসে কতক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এখান থেকে
মিনারটি অদ্ভুত সুন্দর দেখা যায়। মনে হয় যেনো আকাশ ছুঁয়েছে মিনরটি। মাঠের
একদিকে একটুখানি উঁচু জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে মিনারটি পেছনে রেখে ছবি তুলে
নিলাম কয়েকটি। পেছনের দিকটায় রয়েছে আরো কয়েকটি দালান, কিন্তু সবগুলোরই এখন
ভগ্নদশা। তবুও তাতে অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলাম। হয়তো একসময়কার প্রতাপশালী
রাজারা এখানে বিচরণ করেছেন বলেই এতো আকর্ষণ জেগেছিলো মনে। এক জায়গায় দেখলাম
ছোট্ট একটি সুন্দর সেতু। দৌড়ে গিয়ে চড়লাম তাতে। নিচে একসময় কলকল ধ্বনিতে
পানি প্রবাহিত হলেও বর্তমানে পানির নাম-নিশানা নেই। কুতুব মিনারের পুরো
কমপ্লেক্সটাই বিশাল দালান আর ছোট ছোট গেটে ভরা। সুন্দর এ স্থাপত্যগুলো দেখে
যেনো শেষ হচ্ছিল না। প্রায় ১০০ একর জমির ওপর স্থাপিত এ কমপ্লেক্সে রয়েছে
কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আলাই মিনার, আলাই গেট, সুলতান ইলতুৎমিশ, সুলতান
গিয়াস উদ্দিন বলবন, সুলতান আলাউদ্দিন খলজী ও ইমাম জামিনের সমাধি ও লৌহ
পিলার। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় কুতুব মিনার কমপ্লেক্স
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এটি দিল্লির পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম দর্শনীয় ও
আকর্ষণীয় স্থান। ২০০৬ সালে দেশ-বিদেশের প্রায় তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষ কুতুব
মিনার পরিদর্শন করেন যেখানে একই সময়ে তাজমহল পরিদর্শন করেন দুই কোটি ৫০
লাখ পর্যটক। সুতরাং এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ সহজেই অনুমান করা যায়।
চারপাশের এলাকাটা ঘুরে ফের এলাম মিনারের সামনে। যাওয়ার আগে আরেকবার
ভালোভাবে দেখে নিলাম মিনারটা। সূর্যটা ক্রমেই পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ছে।
ক্ষিধেও পেয়েছে বেশ। দেরি না করে তাই বেরিয়ে এলাম ঐতিহাসিক কুতুব মিনার
থেকে।
ইউপি, ভারত
ইউপি, ভারত
No comments