শিক্ষার্থীদের টাকায় ভোগবিলাস
খেলাধুলা খাতে শিক্ষার্থীদের দেয়া ফির অর্থ নানাভাবে লুটপাট হচ্ছে। বছরে আয়োজন করা দুটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আড়ালেই চলে এসব। গরিব ছাত্রছাত্রীর দেয়া টাকা কিছু কর্মকর্তার ভোগবিলাসে চলে যাচ্ছে। যুগান্তরের অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। শিক্ষার্থীদের অর্থ হরিলুট হলেও এ খাতে তাদের ওপর ফি আগের চেয়ে প্রায় ৬৭ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক এবং জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এসএম ওয়াহিদুজ্জামান যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, ‘এই খাতে ব্যয়ের আগে বাজেট নির্ধারণ হয়। প্রতিবছর একটি ফার্ম আয়-ব্যয় অডিট করে। অডিটে অস্বাভাবিক ব্যয় বা কোনো আপত্তি নেই। আসলে ছাত্রছাত্রীদের অর্থ অপচয় বা লুটপাটের কোনো সুযোগ নেই।’ মাউশি’র অধীনে গঠিত ক্রীড়া সমিতি ‘গ্রীষ্মকালীন’ ও ‘শীতকালীন’ নামে দুটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সারা দেশে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী শিক্ষার্থী বা প্রতিষ্ঠানকে জাতীয় পর্যায়ে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন খেলার সরঞ্জামও দেয়া হয় চ্যাম্পিয়নসহ সেরা তিন প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু পুরস্কারের মান নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন আছে। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠান প্রধানরা এ অভিযোগ করেন। তবে ভয়ে কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। আবার যাদের জন্য এই আয়োজন সেসব শিক্ষার্থীকে কোনো হোটেলে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয় না। গরম বা শীতের মধ্যে মশার কাপড় খেয়ে কোনো স্কুল বা মাদ্রাসায় দুটি বেঞ্চ একত্র করে প্রতিযোগিতাস্থলে রাত কাটে শিক্ষার্থীদের। তাদের খাবারেরও ঠিক থাকে না। এসব কারণে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনাও আছে। অথচ কর্মকর্তারা বেশ আরাম-আয়েশে থাকেন। শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্য বরাদ্দকৃত টাকায় বিলাসবহুল হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউস বা সার্কিট হাউসে হয় তাদের থাকার স্থান। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য প্রীতি সম্মেলনের আয়োজন করা হলেও মূলত তা কর্মকর্তাদের ভোজ উৎসবে পরিণত হয়। ঢাকার বাইরে এক একটি প্রতিযোগিতা হলেও তাতে ঢাকা থেকে কর্মকর্তারা অতিথি হয়ে যান। ফেরার সময়ে নিয়ে আসেন বিশেষ সম্মানীর খাম। আবার প্রতিযোগিতাস্থলে না গেলেও পরবর্তীতে তালিকাভুক্ত কোনো কর্মকর্তার কাছে সম্মানীর টাকা পৌঁছে দেয়ার অভিযোগও আছে। নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিক্ষা বোর্ডের কয়েক সিনিয়র কর্মকর্তা এবং প্রধান শিক্ষক যুগান্তরকে জানান, যখন যে অঞ্চলে জাতীয় পর্যায়ের খেলা হয়, সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রতিযোগিতার সার্বিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে অতিথি ও স্বেচ্ছাসেবক যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থে সম্মানী দেয়া-নেয়ার জন্যই অপ্রয়োজনে অনেককে দাওয়াত করে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া অর্থের একটি বড় অংশ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্তুষ্টির কাজে খরচ করা হয়। এ প্রসঙ্গে মাউশি মহাপরিচালক বলেন, যেসব কর্মকর্তার প্রতিযোগিতা উৎসবে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকে কেবল তারাই গিয়ে থাকেন। অপ্রয়োজনে কাউকে দাওয়াত দেয়া হয় না। আবার অনুষ্ঠানে না যাওয়া কাউকে সম্মানী দেয়ার কথাও নয়। এমনটি ঘটলে অডিট রিপোর্টে ধরা পড়ত। জানা গেছে, সমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষ হওয়ার দুই মাস আগে ৩৩ লাখ টাকায় একটি মাইক্রোবাস কেনা হয়। অথচ এই সমিতির আগে থেকে আরেকটি মাইক্রোবাস আছে। এ কারণে নতুন কেনা মাইক্রোবাসের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়টাকে ভোগবিলাস হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ব্যাপারে মাউশি সহকারী পরিচালক ও ক্রীড়া সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হলে যাতায়াতে গাড়ির দরকার। তাই আগের গাড়িটি ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় নতুন গাড়িটি কেনা হয়েছে। সমিতির বিদায়ী অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের ওপর সম্প্রতি একটি বেসরকারি ফার্ম দিয়ে অডিট করানো হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে দেখা যায়, ৪৫তম গ্রীষ্মকালীন প্রতিযোগিতায় ৩৩ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। ৪৬তম শীতকালীন খেলায় ব্যয় হয়েছে ৫৭ লাখ টাকা। শীতকালীন খেলায় বাজেটের চেয়েও প্রায় ৬৩ হাজার টাকা বেশি ব্যয় করা হয়। মোট ১৭ খাতে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার ৬০৯ টাকা খরচ করা হয়েছে। এসব খাতে বরাদ্দের (বাজেট) চেয়েও ৯ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বেশি খরচ করা হয়। ২৫ লাখ টাকার মাইক্রোবাস কেনার কথা ছিল। কিন্তু আরও ৮ লাখ ১৪ হাজার টাকা বেশি খরচ করা হয় এ খাতে। ব্যয় বাজেটে ‘আনুষঙ্গিক ও অপ্রত্যাশিত ব্যয়’ নামে অদ্ভুত একটা খাত আছে। এ খাতে অনিয়মের শেষ নেই বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। তথ্যানুসন্ধানে এর বিস্তর প্রমাণ মিলেছে। এ প্রসঙ্গে সমিতির সভাপতি ড. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, সম্মানী আর বাসস্থান ব্যক্তির পদমর্যাদা অনুযায়ী হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের পেছনে ব্যয় তাদের অবস্থান অনুযায়ী হয়ে থাকে, অনুরূপভাবে কর্মকর্তাদের ব্যয়ও হয়। এ কারণে ব্যয়ের অংকের পার্থক্য বড় মনে হয়। এই ব্যয় বাস্তবসম্মত। জানা গেছে, সমিতির একটি এফডিআর আছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তাতে ১ কোটি ৮ লাখ ৫ হাজার ছিল। গত বছরের ডিসেম্বরে সুদসহ তা ১ কোটি ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৭৫ টাকায় দাঁড়ায়। এর থেকে প্রায় ৭ লাখ ২২ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। বাকিটা ফের এফডিআর করা হয়। কিন্তু উত্তোলনকৃত টাকা কোথায় ব্যয় হয়েছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কেউ কথা বলতে চাননি। প্রসঙ্গত, প্রতিবছর নবম ও একাদশ শ্রেণীতে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা বোর্ডগুলোতে রেজিস্ট্রেশন করার সময়ে ক্রীড়া ফি পরিশোধ করে। প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩০ টাকা করে নেয়া হয়। তবে গত ১০ জুলাই এক বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফি ৫০ টাকা করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুমোদনে শিগগিরই মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হবে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেও ৩শ’ টাকা করে অধিভুক্তি ফি হিসেবে নেয়া হয়। এই দুই খাতে গেল অর্থবছরে দশ শিক্ষা বোর্ড থেকে ক্রীড়া সমিতি ১ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার ৮১৭ টাকা নিয়েছে। অপরদিকে বোর্ডগুলো দুই খাতে ৫ কোটি টাকা আদায় করে। জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মাহাবুবুর রহমান ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম ছায়েফউল্যা যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থী এবং প্রতিষ্ঠান থেকে যে ফি আদায় করা হয় তা ৫ ভাগ করে উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত পাঠানো হয়। ক্রীড়া ফি বাবদ প্রাপ্ত মোট অর্থের আরও এক ভাগ (২৫ শতাংশ) প্রত্যেক বোর্ড রেখে দেয়। বাকি অর্থকে একশ’ ভাগ ধরে এর ২৫ শতাংশ জাতীয় পর্যায়ে ব্যয়ের জন্য সমিতিকে দেয়া হয়। এদিকে আগামী ২৩ জুলাই ৪৬তম গ্রীষ্মকালীন জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে। ওইদিন স্কুল-মাদ্রাসা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা হবে। পর্যায়ক্রমে উপজেলা/থানা, জেলা, উপ-অঞ্চল (সারাদেশ ৯ ভাগ), অঞ্চল শেষে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা হবে। এর জন্য ইতিমধ্যে ৪০ লাখ ৭২ হাজার ৩২০ টাকা বাজেট করা হয়েছে। এতেও লুটপাট হতে পারে এমন বিশাল ব্যয়-প্রস্তাব দেখা গেছে।
No comments