এরশাদের জোটে সাড়া নেই
জাতীয় পার্টি ছাড়া নামসর্বস্ব ৫৭ দলের। সংখ্যার দিক থেকে এটি দেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক জোট। যদিও ঘোষিত এই জোটে জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশ ইসলামিক ফ্রন্ট ছাড়া অন্য ৫৬টি দলের নিবন্ধন নেই। এই জোট নিয়ে এরশাদসহ জাতীয় পার্টির নেতারা বড় ধরনের চমকের কথা শোনালেও গত ১০ দিনে দৃশ্যমান কিছু করতে পারেনি তারা। অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে এরশাদ এই জোটের নাম ঘোষণা করলেও দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে এই জোট কোনো কভারেজ পায়নি। আগামী নির্বাচনে বর্তমান মতাসীন মহাজোটকে পরাজিত করে মতায় আসার স্বপ্নের কথা বলা হলেও মানুষের মধ্যে কোনো আলোচনায় পর্যন্ত আসেনি এই জোট। বরং এরশাদের জোট ঘোষণার পর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা জনমনে বেশ ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। খালেদা জিয়ার এই ঘোষণা দেশ-বিদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। দেশের মানুষকে আগামী দিনের রাজনীতি নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিএনপির ভিশন। এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে ভিশন ২০৩০। এরশাদের জোটে নামসর্বস্ব দলের সংখ্যা দেখে সমালোচকরা বলছেন, দেশের রাজনীতিতে নানা কারণে আলোচিত এরশাদ অবশেষে আসম আবদুর রবের দেখানো পথেই হাঁটছেন। ১৯৮৮ সালে এরশাদের শাসনামলে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অন্যান্য দল নির্বাচন বর্জনের মুখে জাসদের আসম আবদুর রবের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ৭২ দলীয় সম্মিলিত বিরোধী দল-কপ। সেই নির্বাচনে একাধিক আসনে নির্বাচিত আসম আবদুর রব সংসদে বিরোধী দলের নেতাও নির্বাচিত হন। অনেকেই এখন আসম রবের তৎকালীন ভূমিকার সাথে জাতীয় পার্টির মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
তখন আসম রব ছিলেন বিরোধী দলে, আর এখন জাতীয় পার্টি আরেক ধাপ এগিয়ে একসাথে বিরোধী দলে আছে আবার সরকারের মন্ত্রিসভায়ও। অবশ্য জাতীয় পার্টি সত্যিকার বিরোধী দল কি না-তা নিয়েও নানা কথা রয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিকে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখতেই মূলত এই জোট। সরকারের ইঙ্গিতেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ভোট ব্যাংকে হামলা চালাতেই নামসর্বস্ব ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়, যা ভবিষ্যতে হালে পানি পাবে না বলেও মনে করছেন তারা। এরশাদের নেতৃত্বে সরকারের এই মহাপরিকল্পনা কতটা সফল হবে, তা এখন দেখার বিষয়। প্রসঙ্গত, গত ৭ মে জাপা চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ জাতীয় প্রেস কাবে দু’টি দল ও দু’টি পৃথক জোটের সমন্বয়ে ইউএনএর ঘোষণা দেন। যাতে নিবন্ধিত দল দু’টির মধ্যে রয়েছে জাপা ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। এর বাইরে থাকা দু’টি জোট ‘জাতীয় ইসলামী মহাজোট’ ও ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)’। জাতীয় ইসলামী মহাজোটে ৩৪ এবং ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট (বিএনএ)’র ২২টি দল মিলে এই দু’টি জোটে দলের সংখ্যা ৫৬। এর সাথে জাপা ও ইসলামী ফ্রন্ট মিলে এরশাদের নেতৃত্বাধীন নতুন জোটে দলের সংখ্যা ৫৮টি। নতুন এই জোটের ঘোষণা দিয়ে এরশাদ বলেন, স্বাধীনতার চেতনা এবং ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলো এই জোটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। আমাদের অঙ্গীকার আছে এই জোটে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির জায়গা হবে না। এরশাদ বলেন, ইউনাইটেড ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স তিনটি মৌলিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী মূল্যবোধ তথা সব ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি সমান মর্যাদা প্রদর্শন।
স্বাধীনতার চেতনা এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনবোধ নিশ্চিত করা। জোটগতভাবে জাতীয় ও সবপর্যায়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণ, সরকার গঠন এবং দেশের উন্নয়নে কাজ করা এ জোটের উদ্দেশ্য। এর আগে এরশাদ ২০০১ সালের নির্বাচনে ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট গড়ে ভোটে অংশ নিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে বাতিল হওয়া সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। বিএনপির বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আলাদাভাবে অংশ নিলেও জাতীয় পার্টি পরে সরকারে যোগ দেয়। প্রাথমিকভাবে জাতীয় পার্টি ছাড়াও নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল ইসলামিক ফ্রন্ট, মাসখানেক আগে ৩৪টি ইসলামপন্থী সংগঠন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করা ‘জাতীয় ইসলামী মহাজোট’ এবং ২০১৫ সালে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করা ৩১ সংগঠনের মধ্য থেকে নাজমুল হুদাকে বাদ দিয়ে ২২টি দল নিয়ে ‘বাংলাদেশ জাতীয় জোট’ রয়েছে এরশাদের এই নতুন জোটে। এই জোটে যুক্তফ্রন্ট নামের ১৫ দলীয় জোটের থাকার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের আপত্তির মুখে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তা ছাড়া আরো যারা আসার কথা ছিলÑ এখন তারাও পিছিয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার এরশাদের জোটে না এসে সরাসরি মতাসীন মহাজোটের অংশ হতে চাইছেন। এ ব্যাপারে কয়েকটি ইসলামী দল আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সাথে বৈঠকও করেছেন। ফলে এরশাদের বড় আকারে জোট করার হাঁক-ডাক এখন অনেকটাই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে। এ দিকে এরশাদ বলেছেন, জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’-ইউএনএর কার্যক্রম রাজধানীর পাশাপাশি বিভাগ থেকে একেবারে জেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর অংশ হিসেবে আসন্ন রোজার ঈদের পর প্রথমে প্রতিটি বিভাগে জোটের কর্মিসমাবেশ করা হবে। এরপর রাজধানীতে মহাসমাবেশের মাধ্যমে বড় আকারে শোডাউনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য সোমবার প্রথম বৈঠকে জোটের শীর্ষ নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জাপা মহাসচিব ও জোটের মুখপাত্র রুহুল আমিন হাওলাদার জানান, ঈদের পর পর্যায়ক্রমে বিভাগ, জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌরসভায় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সামনে আরো চমক আছে, অপো করুন,
আমাদের জোটের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আরো কয়েকটি দল যুক্ত হবে। এতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটের শরিক দলও রয়েছে। জোট নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে কারো কারো অস্বস্তি সম্পর্কে ইউএনএর মুখপাত্র বলেন, ছোট ছোট দলগুলোর সমন্বয়ে এই জোট, সবার তো সব কিছু ভালো লাগার কথা নয়, কারো কারো গাত্রদাহ হতেই পারে। পছন্দ অপছন্দ থাকা গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতির মধ্যেই পড়ে। তবে আমরা মনে করি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এটা পছন্দ করেছে। এর মাধ্যমে জাপা সমাদৃত হয়েছে। তিনি বলেন, ছোট ছোট এই দলগুলো এতদিন উপেতি ছিল। সুযোগ পায়নি বলে তাদের মধ্য থেকে কেউ এমপি-মন্ত্রী বা বড় নেতা হতে পারেননি। তবে দীর্ঘ রাজনীতিতে তাদেরও ুদ্র ুদ্র অবদান আছে। এরশাদ তাদের সবাইকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে এসেছেন। এই জোটের গুরুত্ব আছে কী নেই, তা আগামী নির্বাচনেই প্রমাণ হবে। ইউএনএর অন্যতম শরিক জোট বিএনএর প্রধান ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান সেকান্দার আলী মনি বলেন ‘জোটে মোট ৫৮টি দল। এ কথা সত্য জোটের অনেকেরই নিবন্ধন নেই। কিন্তু এই জোটে এমন অনেক দল রয়েছেÑ যাদের সাংগঠনিক শক্তি নিবন্ধিত অনেক দলের চেয়েও বেশি। জাতীয় পার্টির সূত্র জানায়, এ বছরের ৩০ মার্চ জাতীয় প্রেস কাবে তাদের নেতৃত্বাধীন জোটে সে সময় ৩৪টি দল অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। নতুন করে লেবার পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান সেকান্দার আলী মনির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় জোট- বিএনএর ২২টি রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিক সালাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় যুক্তফ্রন্টও ৭ মে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়ার কথা ছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যোগ দেয়নি। বর্তমানে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জোটের দলগুলো হলোÑ গণইসলামিক জোট, পিপলস জাস্টিস পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ইসলামিক লিবারেল পার্টি, জাতীয় শরিয়া আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ, বাংলাদেশ জনতা পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী জনকল্যাণ পার্টি, ইউনাইটেড ইসলামিক লীগ, জমিয়তে মুসলিমিন বাংলাদেশ, ন্যাপ-ভাসানী, খেলাফত সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি, ইসলামী গণ-আন্দোলন, জাতীয় ইসলামি আন্দোলন, জমিয়তুল ওলামা পার্টি, জাতীয় ইসলামিক মুভমেন্ট, খেলাফত আন্দোলন বাংলাদেশ, ইনসানিয়াত পার্টি, খেলাফত বাস্তবায়ন পার্টি, ইসলামি আক্বিদা সংরণ পার্টি, ইসলামি সংরণ পার্টি, মুসলিম জনতা পার্টি, খেদমতে খালক পার্টি, ওলামা মাশায়েখ সমন্বয় পরিষদ, ইউনাইটেড ইসলামিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ইসলামি পার্টি, ইসলামি সমাজ কল্যাণ আন্দোলন, বাংলাদেশ ইত্তেহাদুল মুসলিমিন, বাংলাদেশ খলাফাতুল উম্মাহ, বাংলাদেশ আক্বিমুদ্দিন মজলিস, সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট পার্টি, জমিয়তুল হেদায়াহ মুভমেন্ট। এই দলগুলোর মধ্যে একটিরও নিবন্ধন নেই। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় জোট- বিএনএ চেয়ারম্যান সেকান্দার আলী মনি বলেন, বিএনএ জোট এইচএম এরশাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ।
জাতীয় পার্টি ছাড়া আমাদের জোটের অন্যকোনো দলের নিবন্ধন নেই। তিনি বলেন, তাতে কী হয়েছে, আমাদের রাজপথের কর্মীবাহিনী আছে। নির্বাচনী মাঠ গরম করার মতো শক্তি সামর্থ্যও আছে আমাদের। অন্য দিকে ১৫টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট জোটের শরিক দলগুলো হচ্ছেÑ কৃষক শ্রমিক পার্টি কেএসপি, আঞ্জুমানে তরিকতে সাজ্জাদী, নতুনধারা গণতান্ত্রিক পার্টি- এনজিপি, বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক পার্টি বিডিপি, সম্মিলিত নাগরিক পার্টি, বাঙালি জনতার পার্টি বিজেপি, বাংলাদেশ জনকল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি বিজিপি, জাতীয় গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা পার্টি, বাঙালি জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি, বিশ্বশান্তি মুক্তির গণপরিষদ, বঙ্গপার্টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক ওলামা পার্টি, প্রগ্রেসিভ পার্টি ও জাতীয় গণতান্ত্রিক মুক্তি পার্টি। এই জোটেরও কোনো দলের নিবন্ধন নেই। এ দিকে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জোটে শুরু থেকেই প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, মাওলানা আব্দুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোট এবং বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলেও তারা মজলিসে শূরার বৈঠকের কথা বলে অপারগতা প্রকাশ করে। যদিও এ বিষয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা সব দলের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী। তবে এখনি কোনো জোটে যাবো কি না তা নির্ভর করছে আমাদের দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম মজলিসে শূরার সদস্যদের মতামতের ওপর। শূরার বৈঠকের পরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো যাবে। তবে আপাতত শূরার বৈঠকের সম্ভাবনা নেই বলেও তিনি জানান।
No comments