প্রজন্মের রিলে রেসের বর্তমান জায়গাটা সুখকর নয়
পরিবেশ-অর্থনীতির পণ্ডিতরা পরিবেশের সমস্যা কেন সৃষ্টি হয়, তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মার্কিন দার্শনিক জন রল্সের একটি ধারণা ব্যবহার করে থাকেন। খুব ছোট কথায় ধারণাটি হল ‘Veil of ignorance’ বা ‘অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠন’। অর্থাৎ অজ্ঞানতার পর্দার আড়ালে থাকা। এ দার্শনিক মানব সৃষ্টির একটি কাল্পনিক অবস্থার কথা বলেছেন। এ ধারণা অনুযায়ী, পৃথিবীতে যে মানুষ আসবে তাদের যদি সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে প্রেরণের আগে স্বর্গে রেখে বলতেন- তোমাদের আমি পৃথিবীতে কখন পাঠাব তা এখন বলব না; পৃথিবীতে আসার সময় সম্পর্কে অজ্ঞানতার অন্ধকারে থেকে তোমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করে নাও পৃথিবীতে আমি তোমাদের জন্য যে নেয়ামত রেখেছি সেটা কীভাবে ভোগ করবে; তোমরা ঠিক করে নাও এ ভোগের পরিমাণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সুষম হবে, না অসম হবে- তাহলে, যেহেতু তারা জানে না কে কখন পৃথিবীতে আসবে সেহেতু তারা সিদ্ধান্ত নিল প্রত্যেক প্রজন্মই সুষমভাবে সৃষ্টিকর্তার দেয়া নেয়ামত ভোগ করবে। যদি তাদের মধ্যে জানা থাকত কারা আগে আসবে এবং কারা পরে আসবে, তাহলে যারা আগে আসবে, তারাই পৃথিবীর সমুদয় সম্পদের ওপর নিজেদের ভোগের অধিকার রয়েছে বলে দাবি করত। এর ফলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তেমন কিছুই জুটত না। তারা চরম দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাস্তবতা হল পৃথিবীতে আসার আগে অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের মধ্যে মানবকুলের সমঝোতামূলক কোনো বৈঠক হয়নি।পরিবেশ-অর্থনীতিবিদরা যে বিষয়টির ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হল, টেকসই উন্নয়ন বা Sustainable development. টেকসই উন্নয়নের মূল কথা হল, কোনো প্রজন্ম এমনভাবে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করবে না, যার ফলে পরবর্তী প্রজন্মগুলো সম্পদের অভাবে অনুন্নত জীবনযাত্রা মেনে নিতে বাধ্য হয়। আমরা প্রায়ই নির্দিষ্ট কোনো কালের সামাজিক সাম্যের কথা বলি; কিন্তু সাম্যের বিষয়টি কোনো একটি কাল বা প্রজন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
এক প্রজন্মের সঙ্গে অন্য প্রজন্মের সমতাও সাম্য বিচারের অন্তর্গত। একেই বলা হয়, আন্তঃপ্রজন্ম সমতা। পৃথিবীতে যে প্রজন্ম সুযোগ পায়, তাদের মধ্যে প্রাপ্ত সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এর ফলে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এ যাত্রায় জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। কারণ মানুষের স্বার্থপরতা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বিবেচনার অভাব। তবে এক প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থের বিষয়টি একেবারেই বিবেচনায় নেয় না, এটিও সর্বাংশে সত্য নয়। আমরা তো সমাজেই দেখি, কীভাবে পিতা-মাতা সন্তানদের জন্য সম্পদ রেখে যায় কিংবা তাদের জীবনের সুখ-শান্তি নিশ্চিত করার জন্য অন্য কোনো ধরনের সম্পদ দিতে না পারলেও অন্তত লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এক ধরনের দায়বোধ কাজ করে। এই দায়বোধের নৈতিকতা যদি না থাকত, তাহলে হয়তো আমাদের এই গ্রহ মানবকুলের জন্য অনেক আগেই অবাসযোগ্য হয়ে যেত। তারপরও বিপদ কেটে যায়নি। কারণ এ কলামেই কয়েক দিন আগে আমি লিখেছিলাম, পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা ৭০০ কোটি। এই জনসংখ্যা যখন আগামীতে ৯০০ কোটিতে পৌঁছাবে তখন আমাদের এই গ্রহের পক্ষে ৯০০ কোটি মানুষের বোঝা বহন করার মতো ক্ষমতা থাকবে না। একেই পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা Carrying capacity বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর যারা খুব ভরসা রাখেন তারা এতেও শংকিত নন। কোনো একটা সমাধান এসে যাবে বলে তারা আশাবাদী। জন রল্স দর্শন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং নীতিবিজ্ঞানের ওপর বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। যে গ্রন্থের জন্য তিনি সর্বাধিক খ্যাতি পেয়েছেন, সেটি হল A Theory of Justice. আমার কাছে মনে হয়েছে, তার অজ্ঞানতার অবগুণ্ঠনের ধারণাটি ব্যাপক তাৎপর্যমণ্ডিত। অতি সম্প্রতি একটি নামকরা রেস্তোরাঁয় দুই নারী ধর্ষণের ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশবাসীর বিবেককে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। আমাদের সমাজে পাপাচার কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছে তা এ ঘটনা থেকে অত্যন্ত উলঙ্গভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এর নিন্দা করার ভাষা আমি খুঁজে পাই না। শুধু এ ঘটনাই নয়, সারা দেশে শিশু, তরুণী ও নারী ধর্ষণের ঘটনা খুব বেড়ে গেছে। যারা এ ধরনের পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে তাদের সম্পর্কে অনেক কথাই বলা যায়। যেমন, তারা রিপুর তাড়নায় জর্জরিত, বিকারগ্রস্থ, নীতিনৈতিকতাহীন, পাপীষ্ঠ, অর্থবিত্তের দম্ভে অন্ধ, প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত,
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, ধর্মীয় বিধিনিষেধ সম্পর্কে অসচেতন, বর্বর স্ফূর্তির মোহের কাছে পরাজিত, সর্বোপরি দুর্বৃত্তায়িত সমাজের পাপাচারকে জীবনের সবকিছু বলে গ্রহণ করা পশুতুল্য। কেউ বলবেন, দেশে আইনের শাসন নেই বলেই এমনটি হচ্ছে। কেউ বলবেন মহৎ কোনো আদর্শের হাতছানি কিংবা মহৎ মানুষের দৃষ্টান্ত সামনে নেই বলে এমনটি হচ্ছে। আবার কেউ বলবেন, সমাজ থেকে আদর্শবাদিতা হারিয়ে গেছে বলে এমনটি হচ্ছে। এসব বক্তব্যকে একেবাবেই নাকচ করে দেয়া যায় না। এদের পিতাকে যখন সন্তানের অপকর্ম সম্পর্কে জানানো হল, তখন তার তাচ্ছিল্যের উক্তিটি ছিল, তরুণ বয়সী ছেলেপেলেরা এমনটি করতেই পারে। তাতে এমন কী হয়েছে? যেখানে সন্তানের এমন ন্যক্কারজনক অপরাধের জন্য পিতার লজ্জায় মাথা হেঁট হওয়ার কথা ছিল, সেখানে তার দম্ভোক্তি এতই বিসদৃশ যে, কোনো যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। পিতা যদি সত্যিকার অর্থে অনুতপ্ত হতেন তাহলে সেটা হতো আত্মহননেরই নামান্তর। আত্মহনন সমর্থনযোগ্য বা আইনানুগ কোনো বিষয় নয়। সমাজের কাছে মুখ দেখানোর শক্তি হারিয়ে ফেললে সেটা আত্মহননের চেয়ে কম কিছু হতো না। সংবাদপত্রে পড়লাম অভিযুক্তদের একজনের দৈনিক পকেট খরচ ছিল দুই লাখ টাকা। এত টাকা একজন মানুষ আমাদের মতো সমাজে কিসে ব্যয় করতে পারে তা-ও ভেবে পাই না। শুনেছি ক্যাসিনোতে গেলে মানুষ এভাবে টাকা খরচ করে। ঢাকা শহরে কোনো ক্যাসিনো আছে বলে আমার জানা নেই। যখন টাকার জোরেও অপরাধের বিষয়টি ঢেকে রাখা গেল না, তখন সব মহলের টনক নড়তে শুরু করেছে। গণমাধ্যমের চাপে পুলিশও তৎপর হয়েছে। তৎপর হয়েছে শুল্ক গোযেন্দা অধিদফতর। একটি দৈনিকে শিরোনাম হয়েছে, আপন জুয়েলার্সের পাঁচ বিক্রয় কেন্দ্রে অভিযান, একটি সিলগালা : ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠি : আসামিরা অভিযোগ স্বীকার করেননি : হোটেল রেইনট্রিতে অভিযান। এসব পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত থেকে মনে হচ্ছে গোয়েন্দারা শুধু ধর্ষণসংক্রান্ত তথ্যই সংগ্রহ করছে না, তারা কিছুটা হলেও এর মূলে যাওয়ার চেষ্টা করছে, অর্থাৎ এর সঙ্গে দুর্বৃত্তায়িত পুঁজির কোন সংযোগ আছে কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়িত পুঁজি অনেক দিন থেকেই একটি সামাজিক উপদ্রবে পরিণত হয়েছে।
এখন এ ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে এ সমাজের অনেক অপরাধের মূলে দুর্বৃত্তায়িত পুঁজির সংযোগ থাকতে পারে। এখন যদি এ পুঁজির সব ডেরায় অভিযান চলে, তাহলে আমাদের উন্নয়নের অনেক দাবিই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে যেতে পারে। এতক্ষণ পর্যন্ত যে বিশ্লেষণ হাজির করা হল, তা আট-দশ জনের বিশ্লেষণের সঙ্গে খুব একটা তফাৎ হবে না। জন রল্স অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে ভালো কিছু হতে পারে বলে আশা করেছিলেন। বিশেষ করে টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে। মানুষ যদি ভবিতব্য সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে থাকে, তাহলে অনেক বিপদাপদ জুটবে বলে অন্তত এই ঘটনা থেকে আঁচ অনুমান করা যায়। যারা ধর্ষণের মতো অপরাধটি করেছে বলে অভিযুক্ত হবে বলে মনে হয়, তারা আদতেই ভাবতে পারেনি আর কোন কোন অপরাধ লোকচক্ষুর আড়াল থেকে সামনে চলে আসবে। ঘটনাটি দেখে মনে হচ্ছে সেই পুরনো সামাজিক প্রবাদটির কথা, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। ধনৈশ্বর্য আমাদের চোখের সামনে এমন এক কালো পর্দা জুড়ে দেয়, যার ফলে আমরা এ থেকে উদ্ভূত বিপদগুলো সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞানতার মধ্যে থেকে যাই। দেশে আইনের শাসনের দরকার আছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসানেরও প্রয়োজন আছে। তবে একদিকে যেমন সুবিচার-ন্যায়বিচার থাকতেই হবে, অন্যদিকে সেই রকম বিচারেরই শক্তি বহুগুণ বেশি, যে বিচার, যে শাসন ব্যক্তি নিজের ওপরই করে। রিপুর তাড়নার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বিবেকের শক্তি যখন প্রবল হয়, তখনই সত্যিকার অর্থে একটি সমাজ অপরাধ ও ব্যভিচার থেকে মুক্ত হতে পারে। সমাজনায়কদের কর্তব্য হবে, মানুষের ভেতরকার সেই শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করা, যে বুদ্ধি সব ধরনের অশুভ বুদ্ধিকে পরাস্ত করতে সক্ষম। আমরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতরা অনেক সময় ধর্মগ্রন্থ কিংবা ধর্ম প্রচারকদের কাহিনী পড়তে অনীহা বোধ করি; কিন্তু এগুলোর মধ্যেও নৈতিকতার মান উন্নত করার অনেক শিক্ষা আছে।
সম্প্রতি বিখ্যাত ধর্মবেত্তা ইবনে কাসিরের লেখা Stories of the Prophets পড়ছিলাম। এটি আল আজহার থেকে শেখ মোহাম্মদ মুস্তফা জামিয়া ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এই গ্রন্থে অনেক পয়গম্বরের কাহিনী আছে। আছে লুত (আ.)-এর গল্প। লুত (আ.) সডম নগরীতে বসবাস করতেন। নগরীটি সব ধরনের পাপাচারে পরিপূর্ণ ছিল। সেখানে ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যার মতো দুষ্কর্ম ঘটত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ছিল এই নগরীর বাসিন্দাদের মধ্যে বিকৃত যৌনাচার। শেষ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা এ নগরীটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। রক্ষা পেয়েছিল তার ডাকে সাড়া দেয়া তার স্ত্রী বাদে পরিবারের সদস্যরা। কারণ তার স্ত্রীও তার সংশোধনের ডাকে সাড়া দেয়নি। এ কাহিনীতে সৃষ্টিকর্তার অলৌকিক ক্ষমতার দৃষ্টান্ত আছে। বর্তমান দুনিয়ায় যখন ভয়াবহ ভূমিকম্প কিংবা জলোচ্ছ্বাস হয়, তখন আধুনিক শিক্ষিত মানুষ একে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ না বলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের তর্কে প্রবেশ না করেও আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশে যেভাবে সামাজিক অপরাধপ্রবণতা বেড়ে চলেছে, তা থেকে বিশাল সামাজিক বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার বিপদ নাকচ করা যায় না। এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রিপুর তাড়নার ওপর প্রত্যেকটি মানুষের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অর্জন। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হলে এ ক্ষমতা আমরা অর্জন করতে পারব, সেটাই সব শুভবুদ্ধির মানুষের বিবেচনার বিষয় হোক। বর্তমান পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন নৈতিকতাবোধ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ। প্রয়োজন বিজ্ঞানের সঙ্গে নৈতিকতার সম্মিলন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
No comments