‘এক আনা’র হিসাবও দিতে পারেননি মালিকরা
আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শোরুম থেকে জব্দ করা ৪৯৮ কেজি স্বর্ণের ‘এক আনা’রও হিসাব দেখাতে পারেননি এর মালিকরা। বুধবার সকালে এ জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ এবং তার দুই ভাই গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদকে পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মইনুল খান। এদিন সকালে কাকরাইল শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের অফিসে তিন ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ডিজি মইনুল খান বলেন, মৌখিক ও লিখিত জিজ্ঞাসাবাদে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি তারা। তবে নিজেদের স্বর্ণ ব্যবসা বৈধ দাবি করে দিলদার আহমেদ বলেন, ‘আমার কোনো অবৈধ স্বর্ণ নেই। সারা দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা যেভাবে ব্যবসা করেন, আমিও সেভাবে ব্যবসা করছি। আমার প্রতিষ্ঠান যদি বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে সারা দেশের স্বর্ণ ব্যবসা বন্ধ করা উচিত।’ শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, শুনানিতে উপস্থিত হয়ে জব্দকৃত স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের বৈধ কাগজপত্র দেখাতে তারা ১৫ দিনের সময় চান। ন্যায়বিচারের কথা বিবেচনা করে আমরা তাদের ছয় দিনের সময় দিয়েছি। আগামী ২৩ মে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও দলিলাদি সংগ্রহ করে তারা শুল্ক গোয়েন্দা অফিসে সশরীরে উপস্থিত হয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যাহীনভাবে মজুদ স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের বিষয়ে শুনানিতে অংশগ্রহণ করবেন। ওই তারিখে প্রয়োজনী কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হবে। মইনুল খান আরও বলেন, জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে যেসব গ্রাহক আপন জুয়েলার্সের বিভিন্ন শাখায় স্বর্ণ রিপেয়ারিং ও এক্সচেঞ্জের জন্য জমা দিয়েছেন, তাদের দাবিকৃত স্বর্ণ ফেরত দিতে রসিদসহ সোমবারের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে দিলদার বলেন, এ ধরনের স্বর্ণ ২ থেকে ৫ কেজি, সর্বোচ্চ ১০ কেজি হতে পারে। শুনানি শেষে আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কোনো অবৈধ স্বর্ণ নেই। ৪০ বছর ধরে সততার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছি। কোনো অবৈধ জিনিস (স্বর্ণ-হীরা) আমাদের দোকানে নেই। দিলদার আরও বলেন, আমাদের দোকান সার্চ করার অধিকার রয়েছে শুল্ক গোয়েন্দার। তারা আমাদের স্বর্ণ ও ডায়মন্ড জব্দ করেছে। আমরা পেপার্স (কাগজপত্র) শো করব। সময় নিয়েছি। একই সঙ্গে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব। আপন জুয়েলার্সের স্বর্ণের উৎস কী? বিক্রয়ের হিসাব মিললেও আমদানি স্বর্ণের কোনো কাগজপত্র বা হিসাব আপনাদের কাছে নেই কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের বৈধ ব্যবসা। আমাকে যদি ডার্টি মানি ও স্বর্ণ চোরাচালানের জন্য গ্রেফতার করা হয়, তাহলে কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী বাইরে থাকবে না। সবাইকে জেলে যেতে হবে। আমি যেভাবে ব্যবসা করছি, সারা দেশে সেভাবে ব্যবসা চলছে। এরপরও যদি আমার স্বর্ণের দোকান বন্ধ করা হয়,
তবে সারা দেশের সব দোকান বন্ধ করে দিতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি। ক্রেতাদের অর্ডারের স্বর্ণ ও আমদানিকৃত স্বর্ণের কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জবাবদিহিতা থাকা উচিত। আমরা এ বিষয়টি শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তারা বিষয়টি আমলে নিয়েছেন। আইনজীবীদের সঙ্গেও কথা বলেছি। জুয়েলারি সমিতির সঙ্গেও কথা বলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব। অভিযানকালে বৈধ কাগজ কেন দেখাতে পারেননি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে কেউ কি আর কাগজপত্র দেখাতে পারে? ৫ বছর ধরে কোনো স্বর্ণ আমদানি নেই। একটা ব্যবসা চললে তার নীতিমালা থাকা উচিত। তিনি বলেন, আমিও জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। নীতিমালা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা কোনো নীতিমালা করতে পারিনি। দিলদার আহমেদ বলেন, আমার যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে এ জন্য দেশবাসীর কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। প্রসঙ্গত, ব্যাখ্যাহীনভাবে মজুত রাখার দায়ে রোব ও সোমবার রাজধানীতে আপন জুয়েলার্সের গুলশান, উত্তরা, মৌচাক ও সীমান্ত স্কয়ারের পাঁচটি বিক্রয় কেন্দ্র থেকে ৪৯৮ কেজি স্বর্ণ ও ৪৩০ গ্রাম ডায়মন্ড আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা। মজুদের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বুধবার সকালে দিলদার আহমেদসহ জুয়েলার্সের সব শাখার মালিককে তলব করে শুল্ক গোয়েন্দারা। স্বর্ণ আমদানি সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে শুল্ক গোয়েন্দার চিঠি : বিমানবন্দরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জব্দকৃত স্বর্ণ নিয়মিতভাবে নিলাম এবং বাণিজ্যিকভাবে আমদানির অনুমতি সহজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরকে দেয়া চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, শুল্ক গোয়েন্দা ও অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক চোরাচালানের দায়ে আটক ও বাংলাদেশ ব্যাংকে জমাকৃত এবং পরে বাজেয়াপ্তকৃত স্বর্ণ নিলামে বিক্রির বিধান রয়েছে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনের বাজেয়াপ্তকৃত স্বর্ণের নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে এসব স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে দীর্ঘদিন ধরে জমা পড়ে রয়েছে। স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের ভেতরের কোনো উৎস থেকে বৈধ স্বর্ণ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে তাদের ব্যবসা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১০১৮ এর অনুচ্ছেদ ২৬(২২) অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্বর্ণ আমদানির স্পষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে এ আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিতে হয়। এ অনুমতি নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বৈধভাবে যে কোনো সময় এবং যে কোনো পরিমাণ স্বর্ণ আমদানি করতে পারেন। তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ ধরনের অনুমতি সহজেই পাওয়া যাচ্ছে না এবং তারা বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বিষয়ে আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে এরই মধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানিয়েছে।
No comments