জমি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জমজমাট আসর ওসির!
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার গুরুদায়িত্ব যার কাঁধে, সেই ওসি (থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করছেন জমি কেনাবেচা ও বিরোধ নিষ্পত্তির ‘জমজমাট বাণিজ্য’। থানার ভেতরে নিজের রুমে চেয়ার পেতে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তার নেতৃত্বে সালিশ বৈঠকের নামে এ আসর বসছে। এ আসরে স্থানীয় জমির দালাল ও জমিসংক্রান্ত মামলায় পারদর্শীরা যোগ দেয়। মূলত তিনি এ চক্রটিকে ব্যবহার করেই দীর্ঘদিন ধরে কোনো রাখঢাক না করেই এ ‘বাণিজ্য’ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতক্ষণ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উত্তরখান থানার ওসি শেখ সিরাজুল হকের কথাই বলা হচ্ছিল। পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব না মেলায় ওসির এমন কাণ্ডে অনেকেই ক্ষুব্ধ। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে এর সত্যতাও পাওয়া গেছে। রাজধানীর উত্তরখান থানা সংলগ্ন এলাকার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই ওসির কক্ষে সালিশ বসে। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আর এসব সালিশ বৈঠকের সবই জমি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে।
এলাকায় জনপ্রতিনিধি থাকলেও জমিসংক্রান্ত বিরোধের অধিকাংশই নিষ্পত্তি হয় ওসির মধ্যস্থতায়। তবে এ জন্য স্থানীয় জমি মালিকদের গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। এর ভাগবাটোয়ারা করে নেন ওসি সিরাজুল হক ও তার চক্রের সদস্যরা। গত কয়েকদিন ধরে চলা যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হয়ে আসে। কথিত এসব সালিশ বৈঠকের নামে ওসি সিরাজুল হক এবং তার চক্রের সদস্যরা মাসে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া ছাড়াও প্রায় ১৫টি মাদক স্পট এবং ইঞ্জিনচালিত অবৈধ অটোরিকশা থেকে লাখ লাখ টাকা মাসোয়ার আদায় করছে। এসব অপকর্ম নিয়ে কেউ যাতে মুখ খুলতে না পারে সে জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা ছাড়াও জামায়াত-শিবিরের নেতাদেরও হাতে রাখছেন ওসি সিরাজুল হক। এমনকি তারই আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জামায়াতের উত্তরখান থানার আমীর আলমগীর মোহাম্মদ ইউসুফ এলাকায় বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানি গড়ে তুলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও মাসে সিরাজুল হকের নামে মোটা অঙ্কের টাকা আসে। জানা যায়, ওসি সিরাজুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি চক্র নানা ছল-ছুতোয় স্থানীয় জমি মালিকদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি করে। আর এ চক্রটির মূল হোতা হাজী শামীম আহসান, জালাল ও জাকির। স্থানীয়দের কাছে এরা সবাই ভূমিদস্যু নামে পরিচিত। এদের কাজই হল উত্তরখান এলাকায় নিজ জমিতে কেউ বাড়ি করতে গেলেই নানা অজুহাতে বিরোধ সৃষ্টি করা। এর পর বিরোধ মীমাংসার নামে চক্রটি ওসির শরণাপন্ন হয়। আর এ সুযোগটিই লুফে নেন ওসি সিরাজুল। মীমাংসার নামে দিনের পর দিন ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত জমির মালিককে ধার্য করে দেন মোটা অঙ্কের টাকা। ওসির কথা না শুনলে চক্রের সদস্যদের দিয়ে পরে দেওয়ানি মামলা করিয়ে হয়রানি করা হয়।
এদিকে দেওয়ানি মামলা দায়েরের পর নিয়মানুযায়ী আদালত থানা পুলিশকে প্রাথমিক তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। সে সময় হয়রানি করার পুরো সুযোগটি নেন ওসি সিরাজুল। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে থানার কোনো গুরুতর ফৌজদারি মামলায় আসামি হিসেবে নাম ঢুকিয়ে দেয়ার হুমকিও দেয়া হয়। যুগান্তরের পক্ষ থেকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৫/২০১৭ নম্বরের পিটিশন মামলার অনুসন্ধান করতে গিয়ে এর সত্যতাও পাওয়া যায়। হাজী শামীম আহসান ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারায় মামলাটি করেন। ঢাকার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ওই মামলার তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য উত্তরখান থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। আর এ সুযোগটি নেন ওসি সিরাজুল হক। চাহিদামতো টাকা না পেয়ে ওসির নির্দেশে তদন্তকারী কর্তকর্তা এএসআই মো. মোশাররফ হোসেন প্রকৃত জমির মালিক শাহ জামালের বিপক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কেননা জবরদখলকারী হাজী শামীম আহসান হচ্ছেন ওসি সিরাজুল হকের ঘনিষ্ঠ ওই চক্রের প্রধান। গত ১১ মে জমিসংক্রান্ত আরেকটি বিরোধের জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষ হলে ওসি পক্ষ নেন জবরদখলকারীদের। জমি দখল করতে গিয়ে যাদের মারধর করা হয়েছিল তাদের মামলা না নিয়ে ওসি দখলকারী চক্রটির পক্ষ নেন। ওসি দখলকারীদের পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করেন। মামলা নম্বর-১০,
তারিখ ১১/৫/১৭। পরে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের চাপে তিনি প্রকৃত জমি মালিকদের পক্ষে করা আরেকটি অভিযোগ কাউন্টার মামলা হিসেবে রেকর্ড করেন। এভাবেই ওসি সিরাজুল হকের কারণে বছরের পর বছর হয়রানির শিকার হচ্ছেন উত্তরখানের স্থানীয় নিরীহ বাসিন্দারা। ওসি সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে এ ধরনের শত শত অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তরখানের বাসিন্দারা। এ ছাড়া থানার শাহ কবীর মাজার সংলগ্ন স্পট এবং থানা গলিসহ অন্তত ১৫টি মাদকের স্পট থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ব্যবসায়ী কালা মানিক ও তার ছেলে সজিব, চম্পা রানীসহ অন্তত ২৫ জন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে ওসি সিরাজুল হকের। অন্যদিকে আবদুল্লাহপুর থেকে আাটিপাড়া হয়ে মাঝুখানব্রিজ পর্যন্ত ইঞ্জিনচালিত প্রায় হাজার খানেক অবৈধ অটোরিকশা থেকেও মাসে প্রায় লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ এই ওসির বিরুদ্ধে। জানা গেছে, প্রায় তিন বছর আগে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে উত্তরখান থানায় যোগ দেন সিরাজুল হক। দেড় বছর আগে তিনি ওসি হিসেবে ওই থানায় নিয়োগ পান। জন্মস্থান ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা হলেও তিনি পরিচয় দেন গোপালগঞ্জের।
আর এ পরিচয়ে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই উত্তরখান থানার ওসি পদে থেকে দু’হাতে টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন। সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অপরাধী-মাদক কারবারিদের গ্রেফতারের মতো গুরুদায়িত্ব যার ওপর সেই ওসি তার নির্ধারিত দায়িত্ব পালন না করে অপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি সিরাজুল হক। বুধবার সন্ধ্যায় মোবাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, এসব মিথ্যা কথা। তিনি দাবি করেন, একটি চক্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এসব রটাচ্ছে। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে না পেরে এলাকায় আাইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। হাজী ওসমান আহসানকে চেনেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে তিনি কয়েকবার থানায় এসেছিলেন। এ সূত্রেই তাকে চিনি, এর বেশি কিছু নয়। মাদক স্পট ও অবৈধ অটোরিকশা থেকে তিনি এবং তার থানার পুলিশ কোনো টাকা নেন না বলেও তিনি দাবি করেন।
No comments