ক্ষমতা কারও কম নয় সমঝোতা করে চলতে হবে
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গ- আইন, বিচার ও শাসন বিভাগকে একে অপরের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে চলতে হবে। তা না করে এ অর্গানগুলো একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকলে কোনো রাষ্ট্রই সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে না। এ বিষয়টিতে সবাইকে সচেতন থাকার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’ শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস-২০১৭’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তিনি বিচারপ্রার্থীদের প্রতি আরও মানবিক হওয়ার জন্য বিচারক ও আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু আইন করে আর অবকাঠামো সুবিধা বাড়িয়ে বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি কমানো সম্ভব নয়। আমাদের বিচারক এবং আইনজীবীদের আরও মানবিক এবং জনগণের প্রতি সেবার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সংসদ আইন প্রণয়ন করে, তা প্রয়োগ করে বিচার বিভাগ। আর তা কার্যকর করার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের। ক্ষমতা কোনো বিভাগেরই কম নয়। কিন্তু কেউ এককভাবে চলতে পারে না।
সবাই মিলে সমঝোতা রেখেই চলতে হয়।’ শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ যদি মনে করেন যে, না, ‘এখানে আমার ক্ষমতা, আমিই সবটুকু প্রয়োগ করে ফেলব...’, কিন্তু সেই প্রয়োগটা করবে কে? তার জন্য তো কাউকে লাগবে। কাজেই এ কথাটা কেউ যেন ভুলে না যায়, আমি সেটুকুই বলব।” বাসস ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমরা নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আমরা এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই, যেখানে ধনী-দরিদ্রের কোনো বৈষম্য থাকবে না এবং জনগণ সংবিধানের মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগ করে নিজেরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন।’ বিচার বিভাগের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বাংলাদেশে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই আন্তরিক।’ আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বক্তৃতা করেন। শেখ হাসিনা তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমের বিস্তার ঘটিয়ে এটিকে স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু অর্থের অভাবে কেউ বিচার পাবে না, তা হতে পারে না।’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো, আবাসন সমস্যা দূরীকরণ তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করার প্রসঙ্গও উপস্থাপন করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরপরই জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (এমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ২০০৯ পাসের মাধ্যমে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের কাজটিকে স্থায়ী রূপ দিই।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও মামলা জট বিচার বিভাগের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় অধস্তন আদালতে দীর্ঘদিন বিচারক নিয়োগ বন্ধ থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অধস্তন আদালতে ৫৮৬ জন বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ৩৫০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নতুন নতুন আদালত ও ট্রাইব্যুনাল স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ৫৪০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মামলাজট নিরসন ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা দূর করতে সরকার আইনি সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচারাধীন মামলাসমূহ বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির পাশাপাশি দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কাজ চলছে। শেখ হাসিনা বলেন, জ্বালানি সেক্টরে একজন জেলা জজসহ সাত সদস্যের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং জ্বালানি সেক্টরের সব বিরোধ প্রচলিত আদালতের পরিবর্তে এ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার বিচার বিভাগে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার চালু করেছে। এতে বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করার লক্ষ্যে আমরা ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ পাস করি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সরকারি আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আমরা সরকার গঠন করে এ আইনকে গতিশীল করি। এ সংক্রান্ত আরও আইন ও বিধি প্রণয়ন করি। দুস্থ, অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থী জনগণ এর সুফল ভোগ করছে। জনগণের অধিকার রক্ষায় আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে সংবিধানে সুবিচার ও সাম্যের বাণীকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেন। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে যথাযথ গুরুত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু নিজে ভুক্তভোগী ছিলেন বলেই সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে মানবাধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করেন। সরকারপ্রধান বলেন, বিনা দোষে এবং বিনা বিচারে বঙ্গবন্ধুকে বছরের পর বছর জেলখানার নির্জন সেলে একাকী বন্দি করে রাখা হয়েছিল। বিচারের নামে প্রহসনও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়লে আমরা জানতে পারি কী দুঃসহ দুঃখকষ্ট তাকে সহ্য করতে হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর বিচারকাজ চলত। এ সময় শেখ হাসিনা সংবিধান থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিকের আইনগত সহায়তা লাভের অধিকার রয়েছে। আমরা একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও আধুনিক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রম এ বৈষম্য দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে বলে আমি মনে করি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ জনগণ সরকারি অর্থ ব্যয়ে আইনগত সহায়তা পাচ্ছেন। এ ছাড়া এসিডদগ্ধ নারী-পুরুষ, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, প্রতিবন্ধী, পাচারকৃত নারী বা শিশু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠীর জনগণও এ আইনগত সহায়তা পেয়ে থাকেন। শেখ হাসিনা বলেন, প্রত্যেক চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আইনগত সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে। দাগি আসামিদের আদালতে আনা-নেয়ার পৃথক যানবাহন থাকবে। কারাগার থেকেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করারও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
No comments