ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে পদে পদে দুর্নীতি
কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ভবন নির্মাণে নিম্নমানের ইট ব্যবহার এবং বালি ও সিমেন্টের পরিমাণে গরমিলের কারণে অনেক অংশের পলেস্তারা খসে পড়ছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি প্রকল্প। সাত দফা বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। মানসম্পন্ন না হওয়ায় নির্মাণকাজ শেষ হওয়া আবাসিক ভবনগুলোর দরজা-জানালার পাল্লা বেঁকে গেছে, ভেঙে পড়েছে আবাসিক ভবনগুলোর লোহার গেটও। এ কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে ওইসব ভবনে উঠতে ভয় পাচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ ছাড়া সামান্য ঝড়ে কারাগার এলাকার বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ছে। এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে গত সপ্তাহে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আখতার হোসেন যুগান্তরকে জানান, এ কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিনিধি আছেন। গত বছরের ২৯ জুলাই এ কারাগারে নাজিমউদ্দিন রোডের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বন্দিদের স্থানান্তর করা হয়।
আর ওই বছরই আগস্টে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে দেয়া কারা অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ‘৩৬ ধরনের ত্রুটি’ রয়েছে এ কারাগারে। সম্প্রতি কারাগার এলাকা ঘুরে ও সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, চিহ্নিত সেসব ত্রুটির অনেকগুলোই এখনও রয়ে গেছে। এ পর্যন্ত কারাগার নির্মাণে যত ধরনের কাজ হয়েছে কোনোটিই মানসম্মতভাবে শেষ হয়নি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে শুধু দুর্নীতিই নয়, ২০০৬ সালে অনুমোদিত এ প্রকল্প ৪০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। মেয়াদ সাত দফা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত। এর মধ্যে তিনবার ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৩ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবটি এখন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) আছে। সরেজমিন কারাগারের অফিসার্স কোয়ার্টারগুলোতে দেখা যায়, ২০টি আবাসিক ভবনের যে চারটি বড় লোহার গেট (মূল গেট) রয়েছে, তার সবই ভাঙা। কারারক্ষী ব্যারাকের বাথরুমগুলোও নাজুক। কারারক্ষীরা জানান, সামান্য বৃষ্টিতেই সিঁড়ি দিয়ে ছাদের পানি গড়িয়ে পড়ে। এতে ছয় তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোর নষ্ট হচ্ছে। দেখা যায়, ব্যারাকের অনেকগুলো জানালার গ্রিল ভেঙে গেছে। খসে পড়েছে দেয়ালের পলেস্তারা। নির্মাণ ত্রুটি ও নিম্নমানের উপকরণের কারণে এ অবস্থা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এক কারা কর্মকর্তা জানান। জানা যায়, কারাগার এলাকায় ২৬০টি বৈদ্যুতিক খুঁটি রয়েছে। এক বছর যেতে না যেতেই এসব খুঁটিতে জং ধরেছে, কোনো কোনোটি হেলে পড়ছে। নিম্নমানের হওয়ায় গত ৩ এপ্রিলের সামান্য ঝড়ে ভেঙে পড়ে ৭টি খুঁটি।
অল্পের জন্যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ওইদিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কারা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। এতে কারা কর্তৃপক্ষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে। এর আগেও তিনটি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ে। বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যমান সব খুঁটি বদলিয়ে মানসম্মত খুঁটি স্থাপনের জন্য গত ৪ এপ্রিল প্রকল্প পরিচালককে চিঠি দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের পক্ষ থেকে সচিত্র প্রতিবেদন দেয়া হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু ভেঙে যাওয়া খুঁটিগুলোর জায়গায় একই ধরনের আরও ৭টি খুঁটি স্থাপন করে গণপূর্ত অধিদফতর। বিষয়টিকে জোড়াতালির কাজ উল্লেখ করে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। কারা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পেছনের অংশে সীমানাপ্রাচীর থাকলেও সামনের অংশে তা নেই। কেবল খুঁটি গেড়ে রাখা হয়েছে। খুঁটির ওপরের দিকে কাঁটাতার থাকলেও নিচের দিকে একেবারে ফাঁকা। যেখান দিয়ে অনায়াসে ভেতরে প্রবেশ করা ও বাইরে বের হওয়া যায়। অস্থায়ী চেকপোস্টে কড়াকড়ি থাকলেও ফাঁকা জায়গা দিয়ে মানুষজন ঢুকে পড়ছে কারাগারের আঙিনায়। এতে কারাগারের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়া একাধিক প্রতিবেদনে কারা অধিদফতর উল্লেখ করেছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন ডেপুটি জেলার জানান, ১৯৪ একর জায়গায় নির্মিত কারাগারের অর্ধেক অংশেই সীমানাপ্রাচীর নেই। সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করতে প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে বারবার চিঠি দেয়া হচ্ছে। প্রতি মাসে দেয়া হচ্ছে তাগাদাপত্র। কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার জাহাঙ্গীর কবির যুগান্তরকে বলেন, নবনির্মিত কোয়ার্টারগুলোতে বড় ধরনের নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে। ত্রুটিজনিত কারণে যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দেয়ালগুলোতে যে ইট দেয়া হয়েছে সেগুলো মানসম্মত নয়। আবাসিক ভবনগুলোতে সিমেন্ট দিয়ে পানির ট্যাংক তৈরি করা হয়েছে। ট্যাংকগুলোর কোনো ঢাকনা নেই। এখনই ভবনগুলোর জানালা-দরজা ঠিকমতো লাগানো যাচ্ছে না। কিছু কিছু দরজা বাঁকা হয়ে গেছে। তাই ওইসব ভবন বুঝে নিচ্ছে না কারা কর্তৃপক্ষ। জাহাঙ্গীর কবির আরও জানান, ভবন নির্মাণের কাজ শেষ হলেও সেখানে সিভিল ওয়্যারিং ও ইলেকট্রিক ওয়্যারিংয়ের কাজ এখনও বাকি। সম্পন্ন করা হয়নি ফিটিং, টাইলস ও প্লাস্টারের কাজ। তিনি আরও বলেন, সীমানাপ্রাচীর না থাকায় কারা কর্তৃপক্ষ ভীষণ উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত অধিদফতর এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে) বারবার চিঠি এবং তাগাদাপত্র দেয়া হচ্ছে। কারা সদর দফতরের বাজেট অফিসার মোবারক আলী যুগান্তরকে বলেন, ভবনগুলোতে ইট ব্যবহার করা হয়েছে খুবই নিম্নমানের। এগুলোর মান ৩-৪ নম্বরের। পলেস্তারার কাজে বড় ধরনের ফাঁকি দেয়া হয়েছে। সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (এআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার, ২০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল এবং কারা প্রশিক্ষণ একাডেমি এখনও হয়নি। প্রকল্পের অধীনে থাকা অন্য যেসব স্থাপনা এখনও নির্মাণ হয়নি সেসবের মধ্যে আছে- দুটি কারারক্ষী ব্যারাক (একটি পুরুষ ও অন্যটি মহিলা), সীমানাপ্রাচীর, মানসম্পন্ন স্কুল (উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত), অফিসার্স ক্লাব, আরপি গেট, সেন্টার টাওয়ার, ভুগর্ভস্থ জলাধার, সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য মিলনায়তন, কারাগারের বাইরে সুবিধাজনক স্থানে পুকুর খনন, প্যারেড মাঠ, দর্শক গ্যালারি, দর্শনার্থীদের জন্যে ওয়েটিং রুম, গাড়ি রাখার গ্যারেজ দুটি প্রভৃতি। অথচ কারাগার স্থানান্তরের আগেই এখানে এসব নির্মাণ হওয়ার কথা ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কারা-১) শিরীন রুবী যুগান্তরকে জানান, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে নিম্নমানের কাজ এবং অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠিত কমিটির সদস্যরা এখনও তদন্তকাজ শুরু করেননি। তবে নিজেদের মধ্যে মিটিং করেছেন। তিনি জানান, কারাগারের নানা সমস্যা সমাধানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত বৈঠক হচ্ছে। মঙ্গলবারও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মহিবুল হকের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কারা কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদফতর এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। মঙ্গলবারের বৈঠকে কারাগারের সীমানাপ্রাচীরের কাজ দ্রুত শেষ করার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে মহিবুল হক জানান, কারাগার নির্মাণের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষ যখন যে ধরনের অভিযোগ দিচ্ছে সেগুলো আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক শামসুল আলম বলেন, ‘আমি মাত্র ছয় মাস আগে প্রকল্পের দায়িত্ব নিয়েছি। যেসব ত্রুটি ধরা পড়ছে সেসব আমার সময়ে হয়নি। অতীতের যেসব ত্রুটি ধরা পড়ছে আমি সেসবও ঠিক করে দিচ্ছি।’ তিনি জানান, তার আগে আরও চারজন প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব পালন করেছেন। কারাগার নির্মাণে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা জানতে চাইলে সাবেক প্রকল্প পরিচালক আবদুল হক বলেন, ‘এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সবই করেছে গণপূর্ত অধিদফতর। প্রকল্প পরিচালকদের এখানে তেমন কোনো ক্ষমতা নেই।’ সাবেক প্রকল্প পরিচালক স্মৃতি রানী ঘরামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, তার স্বামী গুরুতর অসুস্থ। তিনি নিজেও অসুস্থ। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করার মতো মানসিক অবস্থায় নেই তিনি। পাবলিক ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট হিসেবে অন্যান্য সরকারি স্থাপনা নির্মাণের মতো কেন্দ্রীয় কারাগারটিও নির্মাণ করে দিচ্ছে গণপূর্ত অধিদফতর। ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে সবই করছে গণপূর্ত অধিদফতর।
এ ক্ষেত্রে পূর্ত অধিদফতরের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করছে কারা কর্তৃপক্ষ। বকশীবাজারে অবস্থিত কারা সদর দফতরের বাজেট শাখা থেকে অর্থ ছাড় করা হয়। গণপূর্ত অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী উজির আলী যুগান্তরকে বলেন, গণপূর্তের পক্ষ থেকে যেসব আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়েছে সেগুলোর মান খুবই ভালো। তিনি দাবি করেন, আবাসিক ভবনগুলোর জন্য যেসব গেট নির্মাণ করা হয়েছে সেসবের কোনোটিই ভেঙে পড়েনি। গেটগুলো সাধারণত আটকানো হয় না। সব সময় খোলাই থাকে। এ কারণে মনে হয়, গেটগুলো ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, বড় ঝড়ের কারণে বৈদ্যুতিক খুঁটিগুলো ভেঙে পড়েছিল। খুঁটিগুলোর মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সিডিউল অনুযায়ীই খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আবাসিক ভবনগুলো বুঝে না নিয়ে অনেক কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী সেসব ব্যবহার করছেন। ব্যবহারের কারণে অনেককিছু নষ্ট হচ্ছে। এর দায় পূর্ত অধিদফতর বা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের না। তারপরও কারা কর্তৃপক্ষ যখন যে ধরনের সমস্যার কথা বলছে সেসব সমস্যা দ্রুত সমাধান করে দেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্মাণকাজের সময় শ্রমিকরা কিছু ভুল করে থাকতে পারে। তবে বড় ধরনের কোনো ত্রুটি নেই। নিম্নমানের ইট ও উপকরণ ব্যবহার করা হয়নি। কারাগারে প্রশাসনিক ভবন, হাই সিকিউরিটি সেল ও চারটি আবাসিক ভবনসহ বেশকিছু স্থাপনা তৈরি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খান অ্যান্ড সামস। এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল কাশেম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যেসব কাজ করা হয়েছে সেগুলোর মান খুবই ভালো। ড্রয়িং, ডিজাইন ও গণপূর্তের ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ কেন আবাসিক ভবনগুলো বুঝে নিচ্ছে না তা কারা কর্তৃপক্ষ ও গণপূর্ত অধিদফতরের ব্যাপার। এখানে আমাদের বলার কিছু নেই।’
No comments