উপস্থিতি প্রমাণে জালিয়াতি
ফিঙ্গারপ্রিন্ট জালিয়াতির মাধ্যমে অফিসে উপস্থিতির প্রমাণ দেখানোর মতো ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে বিমানে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট তিন মাস ধরে অফিসেই আসেনি। কিন্তু জালিয়াতির মাধ্যমে মেশিনে উপস্থিতি দেখিয়ে তারা বেতন-ভাতা নিয়েছে। একই ভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে বেতন-ভাতার পাশাপাশি ওভারটাইমও নিয়েছেন সিন্ডিকেট সদস্যরা। ৪ ঘণ্টা ডিউটি করে তারা ৮ ঘণ্টার বেতন নিয়েছেন। বুধবার সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে এ ভয়াবহ জালিয়াতি আবিষ্কার করে বিমান প্রশাসন। এতে সিবিএ নেতাসহ ১২ জনকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ১২ জনের মধ্যে ১০ জনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। বাকি দু’জনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। এ ১০ জনই বিমান শ্রমিক লীগের প্রভাবশালী সিবিএ নেতা বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিমানের মুখপাত্র ও জেনারেল ম্যানেজার (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ বলেন, বিষয়টি তার জানা নেই। সিবিএ’র পক্ষ থেকে একটি টেলেক্স বার্তা দেয়া হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু ওই বার্তায় কী আছে সেটা তিনি জানতে পারেননি বলে জানান। এদিকে নেতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার জরুরি আইন অমান্য করে সিবিএ’র পক্ষ থেকে কর্মচারীদের কাজ না করার হুমকি দেয়া হয়েছে। সিবিএ সভাপতি মসিকুর রহমান শ্রমিক-কর্মচারীদের উদ্দেশে এ টেলেক্স বার্তা পাঠান। জানা গেছে, এর পর পরই বিমানের বিভিন্ন শাখায় প্রভাব পড়তে শুরু করে। বিশেষ করে কাস্টমার সার্ভিস, গ্রাউন্ড সার্ভিস ও কার্গো শাখার শ্রমিক-কর্মচারীরা কাজ বন্ধ করে দেন। এতে জনবল স্বল্পতায় দুপুরের পর বিমানের বেশ কয়েকটি ফ্লাইট বিলম্বে ঢাকা ছেড়েছে। একই সঙ্গে যেসব ফ্লাইট শাহজালালে অবতরণ করেছে সেগুলোর লাগেজ হ্যান্ডেলিংয়েও ধীরগতি দেখা গেছে। ফলে যাত্রীদের লাগেজ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ঘটনায় মহিলা ও শিশু যাত্রীরা মারাত্মক ভোগান্তির মুখে পড়েন। ঢাকার পাশাপাশি বিমানের সব আন্তর্জাতিক স্টেশন ও দেশের ৬ বিমানবন্দরেও এর প্রভাব পড়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে সিবিএ সভাপতি মসিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, টেলেক্সের মাধ্যমে কোনো শ্রমিক-কর্মচারীকে কাজ বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়নি। ওই বার্তায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বিমান ম্যানেজমেন্টের অবৈধ ও বেআইনি নির্দেশ না মানতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, বিমানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অগোচরে কিছু বিভাগ নানা ধরনের অফিস সার্কুলার জারি করে- যা আইনের পরিপন্থী। এ অবস্থায় তিনি শ্রমিক-কর্মচারীদের আইন মেনে অফিসে আসা ও ত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, টেলেক্সে উল্লেখ করা হয়েছে কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা বিমানের শ্রমিক-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত কাজে লাগাচ্ছেন। অফিস টাইমে ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়ার জন্য তারা নানারকম বেআইনি আদেশ দিয়ে থাকেন। কোনো শ্রমিক-কর্মচারী বিশেষ করে সিবিএ নেতাকর্মীরা যাতে তাদের শীর্ষ কর্তাদের এসব বেআইনি নির্দেশ না মানে টেলেক্স বার্তায় তা জানিয়ে দেয়া হয়। বিমান প্রশাসন শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা গোপন সংবাদে জানতে পেরেছেন বিমানের কাস্টমার সার্ভিস, গ্রাউন্ড সার্ভিস ও কার্গো শাখার বিপুলসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও সিবিএ নেতা দীর্ঘদিন ধরে অফিসে না এলেও মাস শেষে হাজিরা খাতায় নাম উঠছে। মাসে শত শত ঘণ্টা ওভারটাইমও করছেন। এ অভিযোগের পর বুধবার কাস্টমার সার্ভিস ও ট্রাফিক বিভাগের সিসিটিভির ফুটেজ পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা গেছে ৬-৭ জন সিবিএ কর্মী ও ক্যাজুয়াল কর্মচারী প্রায়ই অফিসে প্রবেশ ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় নিজের কার্ডের পাশাপাশি আরও ১০-১২টি করে আইডি কার্ড পাঞ্চ করছেন। এরপর তাদের চিহ্নিত করে সব আইডি কার্ড কেড়ে নেয়া হয়। আর স্থায়ী কর্মচারীদের মধ্যে জুনিয়র অ্যাকাউন্টস অফিসার বেলাল হোসেন ও ট্রাফিস বিভাগের কর্মকর্তা নাসির উদ্দিনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়।
অভিযোগ আছে, বাকি ১০ কর্মচারীর সবাই সিবিএ নেতা হওয়ায় ভয়ে কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস পায়নি। বিষয়টি বিমানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের জানানো হলেও তারা সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, বিমান ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত ছিল যদি কোনো কর্মচারী ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করে তাহলে তিনি ৮ ঘণ্টার বেতন-ভাতা পাবেন। সেক্ষেত্রে ওই কর্মীর পক্ষে তার মনোনীত তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ৪ ঘণ্টা পরে ওই কার্ড পাঞ্চ করে আউট হতে পারবেন। প্রশাসন শাখার একটি সূত্রে জানা গেছে, তারা ট্রাফিক বিভাগের ফরেন ক্যারিয়ার ইউনিটের একটি টেবিলের ড্রয়ারে ৬০টির বেশি আইডি কার্ড পেয়েছেন। জানা গেছে, এ কার্ডধারী কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে বিমানে অনুপস্থিত। কিন্তু তাদের পক্ষে একটি সিন্ডিকেট প্রতিদিন আইডি কার্ডগুলো পাঞ্চ করে অফিসে প্রবেশ করত এবং একইভাবে কার্ড পাঞ্চ করে অফিস থেকে বের হতো। ওই কর্মকর্তার মতে, যেহেতু বিমানের অফিস আদেশে বলা আছে ৪ ঘণ্টা ওভারটাইম করলে ৮ ঘণ্টার বেতন পাওয়া যাবে সে কারণে এসব কার্ড ওভারটাইমে বেশি ব্যবহৃত হতো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি বছর বিমানে ওভারটাইমের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। শুধু এ খাতে প্রতি বছর গড়ে ৩৮ থেকে ৪২ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ বিমানে এখন জনবল আছে ৪ হাজারের বেশি। সম্প্রতি আরও ৫শ’য়ের বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারপরও কাজের সময় কোনো কর্মচারী পাওয়া যায় না। যার কারণে বাধ্য হয়ে কর্মচারীদের ওভারটাইম দিতে হচ্ছে ম্যানেজমেন্টকে। দেখা গেছে, একজন কর্মচারীর গড়ে প্রতি ঘণ্টার বেতন ৮০ টাকা হলেও ওই কর্মচারী প্রতি ঘণ্টার জন্য ওভারটাইম পাচ্ছেন ১৬০ টাকা। এ কারণে বেশির ভাগ কর্মচারী দিনের নির্ধারিত কাজের চেয়ে ওভারটাইম পেতে বেশি আগ্রহী। আগে ওভারটাইমের জন্য দক্ষ কর্মীদের কাজে লাগানো হলেও এখন সিবিএ মনোনীত কর্মীদের বাধ্য হয়ে ওভারটাইম দিতে হয়। অভিযোগ আছে, এ অবৈধ ওভারটাইম বন্ধ করা ও কাজে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিমান ম্যানেজেমন্ট ২০১২ সালে সংস্থার বিভিন্ন দফতরে ৩০টি বায়োমেট্রিক্স অ্যাটেনডেন্স সিস্টেম (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন) লাগিয়েছিল। কিন্তু কর্মচারীরা সেসময় মেশিনগুলো ভাংচুর করে বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। কয়েকটি মেশিন অকার্যকর করার জন্য সুপার গ্লু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর আন্দোলনের মুখে ম্যানেজেমেন্ট এ বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্স মেশিন চালু করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত বিমানের সিবিএ কর্মকাণ্ডের ওপর জরুরি অবস্থা জারি করে (অ্যাসেনশিয়াল সার্ভিস ঘোষণা) কিছু দিন আগে বিমানে আবারও ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেশিন বসানো হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, বিমানের শ্রমিক সংগঠনগুলো প্রায়শই এ জরুরি আদেশ মানছে না। আর এজন্য কর্তৃপক্ষও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
No comments