যেখানে শিশুর রক্তে ঘোরে অর্থনীতির চাকা
মিয়ানমারের ১৪ বছরের শিশু সান মিন হতিক। সে কাজ করত একটি ইস্পাত কারখানায়। কয়েক সপ্তাহ হলো সে আর কাজ করছে না। আসলে কাজ করতে পারছে না। কারণ, কারখানা দুর্ঘটনায় তার একটি হাতের দুটি আঙুল কাটা পড়েছে। ওই হাতের অন্য আঙুলগুলো রক্ষা করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকেরা। সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পরও মেলেনি বড় অঙ্কের কোনো ক্ষতিপূরণ। বরং সানের মা-বাবার হাতে খুবই সামান্য অর্থ ধরিয়ে দিয়ে এ দুর্ঘটনা ধামাচাপা দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। শুধু সান নয়, মিয়ানমারের বহু শিশুর জীবনের গল্প এমন কষ্ট আর বেদনার। দেশটিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। শিশুশ্রমের দিক থেকে খারাপ অবস্থায় থাকা দেশের তালিকায় মিয়ানমারের অবস্থা ওপরের দিকে। এখানে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রতি পাঁচজনে একজন শিশুশ্রমে নিয়োজিত। এই শিশুশ্রমিকদের বেশির ভাগের পরিবার চলে তাদের উপার্জনের অর্থে। কলকারখানা, দোকান ও গৃহপরিচারক হিসেবে কাজ করে এসব শিশুশ্রমিক। সানের দেখা মিলল দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের কাছে হামাবি উপশহরে। এখানে দ্রুতগতিতে বৈদেশিক মালিকানাধীন কলকারখানার প্রসার ঘটছে, যা অর্থনীতির গতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। এর ওপর ভিত্তি করে দেশটি সামনের বছরগুলোতে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্ন দেখছে। এএফপির সঙ্গে আলাপকালে সান বলল, ‘আমি যা করতে চাই, তা করতে পারছি না। আমার ভীষণ মন খারাপ। আমি চাই, আমার পরিবার ভালোভাবে বাঁচুক। প্রয়োজনীয় খাবারটুকু খেতে পারুক। অন্যরা যেমন পোশাক পরে, তেমন পোশাক পরতে পারুক।’ সানের মা তিন তিন তায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সান যে ইস্পাত কারখানায় কাজ করত, সেটা চীনের মালিকানাধীন। দুর্ঘটনার পর তাদের ১ হাজার ৮০০ ডলার দেওয়া হয় ক্ষতিপূরণ বাবদ। সানের মা-বাবা ওই অর্থটা নিয়েছেন, কারণ সেটা দিয়ে তার চিকিৎসা করাচ্ছেন।
এ ছাড়া বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোট ছোট দুটি সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অর্থটা না নেওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো উপায় ছিল না। অর্থটা নেওয়ার সময় কতটা কষ্ট হয়েছে, সে বিষয়ে সানের মা বলেন, ‘আমরা যখন ক্ষতিপূরণের অর্থটা নিচ্ছিলাম, তখন বারবার মনে হচ্ছিল যে এই অর্থ দিয়ে তারা আমাদের ছেলের হাতটা কিনে নিয়েছে আর সেটা দুর্ঘটনায় কেটে ফেলেছে।’ বিষয়টি জানার জন্য এএফপির সাংবাদিকেরা ওই ইস্পাত কারখানায় যাওয়ার চেষ্টা করলেও সফল হননি। কর্তৃপক্ষের একজনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। কারখানা কর্তৃপক্ষ সান উইন নামের স্থানীয় এক শ্রমিকনেতার সহায়তায় সানের দুর্ঘটনার বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে সমঝোতা করে। জানতে চাইলে এই শ্রমিকনেতা বলেন, ‘সবাই কঠিন অবস্থার মধ্যে আছে। পেটে খিদে নিয়ে বাচ্চাদের কাজে না পাঠানোর মতো অবস্থা কারও নেই।’ মিয়ানমারের আইন অনুযায়ী, ১৪ বছর বয়স থেকে কেউ চাইলে কাজ করতে পারবে। তবে দিনে চার ঘণ্টার বেশি না এবং ভারী কোনো কলকারখানায় কাজ করা যাবে না। তবে দেশটির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারে প্রতি চারজনে একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর ফলে এই আইন মানা সম্ভব হয় না। শিশুরা চার ঘণ্টার বেশি সময়ই কাজ করে। আর বেশি বয়স দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে কারখানায় কাজ নেয়। তবে মিয়ানমারের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সংগঠন এ ধরনের শিশুশ্রমের কথা অস্বীকার করেছে।
No comments