দেশ আজ গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার
বাংলাদেশকে
নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকাকে থামিয়ে দিতে
দেশী-বিদেশী একাধিক চক্র ঐক্যবদ্ধভাবে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এদের মূল লক্ষ্য
পরিকল্পিতভাবে দেশের শিল্প-কলকারখানায় আঘাত হানা। ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস
নামানো। স্বাভাবিক জনজীবন বিঘিœত করা। দেশ এবং দেশের মানুষকে চরম
নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করা।
তাদের উদ্দেশ্য- এভাবে দাবিয়ে রেখে সরকারের মনোবল ভেঙে দেয়া। হীনস্বার্থ
চরিতার্থ করতে খবরদারির মাত্রা বাড়ানো। যে কারণে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই
চক্র ‘আইএস’ নাম দিয়ে নানাভাবে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। নিজেদের সাজানো ছকে
তৈরি করা কথিত জঙ্গি দিয়ে সন্ত্রাসবাদকে উসকে দিচ্ছে। বিশেষ উদ্দেশ্যে
সম্প্রতি এর মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও আত্মঘাতী হামলার
ঘটনা ঘটছে। যার সঙ্গে প্রকৃত আইএস চরিত্রের কোনো মিল নেই। যুগান্তরকে
এমনটিই জানিয়েছেন কয়েকজন খ্যাতনামা নিরাপত্তা বিশ্লেষক, রাজনীতি ও সুশীল
সমাজের প্রতিনিধি। অনেকে নাম প্রকাশ করে ভেতরে থাকা নানা শংকার কথা খোলাসা
করে বলতে চাননি। তবে তারা প্রত্যেককে সাম্প্রতিক এই জঙ্গি তৎপরতাকে
গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সরকারকে জাতীয়ভাবে শক্ত হাতে মোকাবেলা করার আহবান
জানিয়েছেন। বলেছেন, দোষারোপের রাজনীতি করলে ক্ষতি আরও ভয়াবহ হবে। প্রসঙ্গত,
শনিবার সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জন
নিহত হয়। আহত হয় কমপক্ষে ৫০ জন। এ হামলার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা আরও
বাড়তে পারে বলে আশংকা করা হছে। জঙ্গিবিরোধী ওই অভিযানের মধ্যে যথারীতি এই
হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এই গোষ্ঠীর
কথিত বার্তা সংস্থা ‘আমাক’ এই খবর দিয়েছে বলে জানিয়েছে অনলাইনে জঙ্গিদের
কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইট
ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।
এর আগে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ঢাকায় বিমানবন্দর আশকোনা
এলাকায় দু’দফা আত্মঘাতী হামলাসহ আরও কয়েকটি স্থানে জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলার
ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো রাখঢাক না করে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন,
দেশের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। সেই
বাধা অতিক্রম করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে বিএনপির
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রোববার যুগান্তরকে বলেন, গণতন্ত্রকে
ঠিকমতো চলতে দিলে জঙ্গিবাদ থাকবে না। তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রহীনতার কারণেই
দেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই জঙ্গি দমনে সরকারকে এখনই আলোচনায়
বসতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে এমন এক অবস্থা, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ,
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, দেশের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ। দেশের মানুষ আজ এই
জঙ্গিবাদ নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তাই এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে
সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান
চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, একাত্তরের পরাজিত
শক্তি পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় এজেন্ট বিএনপি-জামায়াতরা মিলে দেশকে
অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এরা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখে
কষ্ট পাচ্ছে। এরা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে জঙ্গি ও
সন্ত্রাসবাদের মদদ দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দেশী-বিদেশী এই শক্তি বাংলাদেশকে
একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা কখনও সফল
হবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশপ্রেমিক মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েই
ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির
কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের রোববার যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ করেই দেশে জঙ্গি
তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অনেকগুলো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, যা সত্যিই দুঃখজনক।
তিনি বলেন, এ ঘটনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে।
আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ চাপের মুখে পড়বে। সর্বত্র বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি
নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। জিএম কাদের বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে
সরকারকে সবার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। সম্মিলিতভাবে এ সমস্যা সমাধানে
চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, এটি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে এর সঙ্গে
দেশের স্বার্থ জড়িত। তাই এ ইস্যুতে দলমত নির্বিশেষে সবার সঙ্গে আলোচনায় বসে
একটি করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সাবেক নির্বাচন
কমিশনার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন রোববার
যুগান্তরকে বলেন, সারা বিশ্বেই এখন জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে
উঠেছে। বিশ্বব্যাপী জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের নামে যে ঘটনা ঘটছে, বাংলাদেশেও
তাই ঘটছে। এখানকার ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে ভুল করা হবে। ষড়যন্ত্র খুঁজলেও
ভুল করা হবে। এক পক্ষ অন্যপক্ষকে দোষারোপ করলেও ভুল করা হবে। তিনি আরও
বলেন, আগে হামলা হতো। হামলাকারীরা হামলা চালিয়ে পালিয়ে যেত। এখন তার
চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে হামলাকারী নিজেই জীবন দিচ্ছে, অন্যের জীবনও নিচ্ছে।
হামলাকারীর মানসিকতা এখন এমন যে ‘মরব যখন তখন অন্যকেও নিয়ে মরব।’ এম
সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে আমরা সবাই আতংকগ্রস্ত। কোথায় কখন
কি হবে কেউ জানে না। সংকট উত্তরণে সব দল ও নানামতের মানুষকে এক ছাতার নিচে
আনতে হবে। দেশবাসীকে সচেতন করতে হবে।
তা না করে এখনও যদি আমরা দোষারোপের
রাজনীতি করি তাহলে ভুল করা হবে। মনে রাখতে হবে, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বশেষ সিলেটের ঘটনাই তার প্রমাণ। প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে
নেমেও তাদের জীবন দিতে হয়েছে। ভবিষ্যতে এর চেয়েও যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে না,
তার নিশ্চয়তা কে দেবে?’ তিনি বলেন, এখনও সময় আছে, আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে
উত্তরণে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দলাদলি পরিহার করতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক
মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ এ বিষয়ে রোববার যুগান্তরকে বলেন, এদেশের
রাজনৈতিক পরিবেশ এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য দেশী-বিদেশী চক্র অনেক দিন
থেকেই তৎপর। এরাই মূলত জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিচ্ছে। দেশের
উন্নয়ন ও অগ্রগতির চাকাকে থমকে দিতে চায় এই চক্র। এই চক্রের লক্ষ্য জনমনে
আতংক সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দেয়া। অর্থনীতির চাকাকে রুদ্ধ করা।
অপ্রিয় হলেও সত্য, সংখ্যায় সামান্য হলেও এরা শক্তিশালী। সাম্প্রতিক ঘটনায়
তা একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘এরা যতই শক্তিশালী হোক আমার
বিশ্বাস সরকার এদের দমন করতে সক্ষম হবে। আর এদের দমন করতে চাইলে সরকারকে
অবশ্যই আক্রমণাত্মক কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আত্মরক্ষার কৌশল হিতে বিপরীত
হবে।’
No comments