প্রশ্নটি করেছিলেন সাইফুর রহমান by আকবর আলী খান
Do you think the Batku (dwarf) sitting in Banga Bhavan is running your country?
প্রশ্নটি করেছিলেন আমাকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান। প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝতে হলে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বলতে হয়। ১৯৯১ সালের শেষ দিকে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে
অর্থনৈতিক পরামর্শক (Economic Minister) পদ থেকে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দেই। অর্থ বিভাগে যোগ দেয়ার দুই-তিন দিন পর অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি কোনো একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করেন এবং তাকে অপসারণ করে তার জায়গায় জ্যেষ্ঠতম উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করে ফাইল পেশ করতে পরামর্শ দেন। আমি অফিসে ফিরে আসি এবং সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সন্তুষ্ট হই যে, মন্ত্রীর অভিযোগসমূহের অনেকাংশেরই সত্যতা রয়েছে। আমি যুগ্ম সচিবকে অবিলম্বে মন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ফাইল প্রস্তুত করতে অনুরোধ করি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফাইল আমার টেবিলে চলে আসে। নথিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ পেশ করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিবর্তন সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হতো। কিন্তু এরশাদের পতনের পর সংবিধান সংশোধন করে মন্ত্রিসভাশাসিত সরকার সাংবিধানিকভাবে চালু করা হয়। সংবিধান সংশোধন হলেও তখনো কার্যবিধিমালা সংশোধিত হয়নি। সংবিধান সংশোধনের আগের পাঠে কার্যবিধিমালায় নির্দেশ ছিল যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। যেহেতু তখনো সংবিধান ও কার্যবিধিমালার মধ্যে অসংগতি ছিল, সেহেতু এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন আছে কিনা, সে সম্পর্কে ক্যাবিনেট ডিভিশনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাবিনেট বিভাগ জানায় যে, যত দিন পর্যন্ত কার্যবিধিমালা সংশোধিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিতে হবে। যুগ্ম সচিব আমাকে নথি দেখালেন। আমি সন্তুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির জন্য তৈরি করা সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। তিনি আরো লিখেছেন- পরের দিন মন্ত্রী অফিসে আসার পর তার ব্যক্তিগত সহকারী আমাকে খবর দিলেন যে, আমি যেন মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করি। আমি মন্ত্রীর কক্ষে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থমন্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি কেন রাষ্ট্রপতির জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করলাম? দেশে যে মন্ত্রিসভাশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেটা সম্পর্কে কি আমি অবগত নই? সেই প্রসঙ্গেই তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন যে, আমি কি মনে করি বঙ্গভবনে উপবিষ্ট বাঁটকু সত্যি সত্যিই দেশ পরিচালনা করছেন? আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এ কাজ করা হয়েছে বলার পর তার রাগ গিয়ে পড়লো আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর। তিনি আইন সচিবকে টেলিফোনে গালিগালাজ করলেন এবং আমাকে বললেন যে, নথি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যাবে না। আমি বললাম, আপনি লিখে দেন যে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করা হোক। তিনি লিখে দিলেন এবং তদানুসারে আবার নথি তার কাছে ফিরে গেল এবং তার ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ব্যবস্থা গৃহীত হলো।
বিভাগীয় কাজের সমাধান ঠিকই হলো, কিন্তু আমার মনে একটা বড় খটকা জেগে উঠলো। তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সম্পর্কে ভালো ছিল না। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি খর্বাকৃতির ছিলেন। কিন্তু বাঁটকু শব্দটি ব্যবহার করে অর্থমন্ত্রী শুধু খর্বাকৃতিকেই পরিহাস করেননি, এর ভেতর অর্থমন্ত্রীর রাজনৈতিক দর্শনও নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন্ত্রিসভাশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গৌণ। মন্ত্রিসভার সদস্যরা যদি দৈত্যের মতো ক্ষমতাবান হন, তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেহাত বাঁটকুর মতো।
অথচ এ অবস্থা কিন্তু সব সময় ছিল না। ১৯৭৩ সালে আমি যখন বৃত্তি নিয়ে কানাডাতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাই, তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তার সময়ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে একটি প্রশ্ন উঠেছিল, যার সঙ্গে দুর্ভাগ্যবশত আমিও জড়িয়েছিলাম।
ঘটনাটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত। তত দিনে দেশে কলাবরেটরদের শাস্তি দেয়ার জন্য আইন পাস হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকের হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। তার মতে, এসব অভিযোগ সঠিক ছিল না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য পুলিশের কর্মকর্তারা উপযুক্ত নন। কাজেই তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি নথি নিয়ে যান। সেখানে প্রস্তাব করা হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কলাবরেটর’ আইনে পুলিশ কোনো তদন্ত করবে না। এ বিষয়ে তদন্তের ভার দেয়া হবে চ্যান্সেলর কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটিকে। মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এ ফাইল স্বাক্ষরের জন্য সরাসরি গণভবনে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী সাহেবকে ডেকে পাঠান। ড. চৌধুরী ও প্রফেসর ইউসুফ আলীর সঙ্গে পরামর্শ করে বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যদের তালিকাও মৌখিকভাবে অনুমোদন করেন। তারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ সম্পর্কে নথি অবিলম্বে পেশ করার জন্য নির্দেশ দেন।
আমি তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চশিক্ষা, শিক্ষা সংস্কার, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও যুবসংক্রান্ত বিষয়ের উপ-সচিব। শিক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফিরে এসে আমাকে ডেকে পাঠান এবং অনুমোদিত কমিটির তালিকাটি আমার হাতে দিয়ে এ সম্পর্কে একটি সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন। আমি শিক্ষামন্ত্রীকে জানাই যে, এ ধরনের কমিটির আইনগত বৈধতা পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং এখন আর আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো পরামর্শের প্রয়োজন নেই। তিনি আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নথি তৈরি করতে বলেন।
আমি আমার অফিসে ফিরে আসি এবং শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে একটি বিজ্ঞপ্তির খসড়া প্রস্তুত করে টাইপিস্টকে টাইপ করার জন্য দিই। তারপর আমি আমার বক্তব্য লিখি। সেই নোটে আমি লিখি, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশক্রমে আমি এই বিজ্ঞপ্তির খসড়া পেশ করছি। তবে বিষয়টি আইনসম্মত কিনা, সে সম্পর্কে আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে এবং সেই প্রশ্নগুলোও অতি সংক্ষেপে আমি নোটে লিখি এবং সবশেষে লিখি যে, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে বিজ্ঞপ্তি অনুমোদনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানোর জন্য নথি পেশ করা হলো। আমার স্বাক্ষর করার পর শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রী কিছু না লিখে শুধু স্বাক্ষর করে ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেও ত্বরিতগতিতে রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইলটি পাঠানো হয়।
আশা করা হচ্ছিল যে রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে ফাইলটি একদিনের মধ্যে বেরিয়ে আসবে। দুই-তিন দিন পরও যখন ফাইলটি ফেরত আসে না, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চান যে, ফাইলের কী হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী আমাকে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেন। আমি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে জানান যে, তারা ফাইল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এই ফাইল স্বাক্ষর করেননি। আমি শিক্ষামন্ত্রীকে এই তথ্য জানিয়ে দেই। দিন দশেক পর হঠাৎ শিক্ষামন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে বললেন যে, রাষ্ট্রপতি তাকে ডেকেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে প্রশ্ন করেন, যে বিজ্ঞপ্তি আমার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন, সেই বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে যে নোট আছে, তা পড়েছেন কি? শিক্ষামন্ত্রী বললেন, স্যার, পড়েছি। এটি একজন উপ-সচিব লিখেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং আবেগপ্রবণ।
রাষ্ট্রপতি বললেন, মোটেও আবেগপ্রবণ নন, তার এই নোট পড়ে আমার মনেও প্রশ্ন জাগে এবং এ বিষয়ে আমি হাইকোর্ট লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়াশোনা করেছি। আমার ধারণা, তিনি যা লিখেছেন, সেটা সঠিক এবং আমি এই কমিটির অনুমোদন করতে পারবো না। আপনি মেহেরবানি করে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেবেন। ইউসুফ আলী সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, রাষ্ট্রপতি একজন সাবেক বিচারপতি এবং তিনি যদি এটা আইনসম্মত মনে না করেন, তাহলে এটা না করাই ভালো। সুতরাং ফাইলটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অস্বাক্ষরিত অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রী ফেরত নিয়ে আসেন। তিনি ফাইলটি আমার হাতে দিয়ে বললেন যে, এ বিষয়ে আর কিছু করার নেই। তিনি আরো বললেন, রাষ্ট্রপতি আপনাকে সাহসী নোট লেখার জন্য অভিনন্দন জানাতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও শেষ পর্যন্ত মর্যাদা নিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে টিকে থাকতে পারেননি। তার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রপতির পদের অবমূল্যায়ন শুরু হয়।
রাষ্ট্রপতির ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিভাজন বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিবর্তনের একটি বড় বিষয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ফ্রান্সের বুরবন সম্রাট, রাশিয়ার জার ও মোগল বাদশার সঙ্গে তুলনীয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই। তবে এই ক্ষমতা বৃদ্ধির একটি সীমা থাকা প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে Thomas Paine যথার্থই বলেছেন-
No country can be called free which is governed by an absolute power and it matters not whether it be an absolute royal power or an absolute legislative power as the consequences will be the same to the people.
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে। কিন্তু এ ক্ষমতা বাড়িয়ে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করা চলবে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন অবশ্যই থাকতে হবে। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে saparation of power বা ক্ষমতার বিভাজনের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এই নিবন্ধে সুশাসন ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। সূচনা খণ্ডের পর দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি-না, সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে নির্বাহী বিভাগের পুনর্গঠন সম্পর্কে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্নটি করেছিলেন আমাকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান। প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝতে হলে ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বলতে হয়। ১৯৯১ সালের শেষ দিকে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে
অর্থনৈতিক পরামর্শক (Economic Minister) পদ থেকে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দেই। অর্থ বিভাগে যোগ দেয়ার দুই-তিন দিন পর অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি কোনো একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে তার মতামত ব্যক্ত করেন এবং তাকে অপসারণ করে তার জায়গায় জ্যেষ্ঠতম উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করে ফাইল পেশ করতে পরামর্শ দেন। আমি অফিসে ফিরে আসি এবং সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সন্তুষ্ট হই যে, মন্ত্রীর অভিযোগসমূহের অনেকাংশেরই সত্যতা রয়েছে। আমি যুগ্ম সচিবকে অবিলম্বে মন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ফাইল প্রস্তুত করতে অনুরোধ করি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফাইল আমার টেবিলে চলে আসে। নথিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ পেশ করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পরিবর্তন সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হতো। কিন্তু এরশাদের পতনের পর সংবিধান সংশোধন করে মন্ত্রিসভাশাসিত সরকার সাংবিধানিকভাবে চালু করা হয়। সংবিধান সংশোধন হলেও তখনো কার্যবিধিমালা সংশোধিত হয়নি। সংবিধান সংশোধনের আগের পাঠে কার্যবিধিমালায় নির্দেশ ছিল যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। যেহেতু তখনো সংবিধান ও কার্যবিধিমালার মধ্যে অসংগতি ছিল, সেহেতু এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন আছে কিনা, সে সম্পর্কে ক্যাবিনেট ডিভিশনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাবিনেট বিভাগ জানায় যে, যত দিন পর্যন্ত কার্যবিধিমালা সংশোধিত না হবে, ততদিন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিতে হবে। যুগ্ম সচিব আমাকে নথি দেখালেন। আমি সন্তুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির জন্য তৈরি করা সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিই। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ে এসব কথা লিখেছেন। তিনি আরো লিখেছেন- পরের দিন মন্ত্রী অফিসে আসার পর তার ব্যক্তিগত সহকারী আমাকে খবর দিলেন যে, আমি যেন মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করি। আমি মন্ত্রীর কক্ষে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থমন্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি কেন রাষ্ট্রপতির জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করলাম? দেশে যে মন্ত্রিসভাশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেটা সম্পর্কে কি আমি অবগত নই? সেই প্রসঙ্গেই তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন যে, আমি কি মনে করি বঙ্গভবনে উপবিষ্ট বাঁটকু সত্যি সত্যিই দেশ পরিচালনা করছেন? আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এ কাজ করা হয়েছে বলার পর তার রাগ গিয়ে পড়লো আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর। তিনি আইন সচিবকে টেলিফোনে গালিগালাজ করলেন এবং আমাকে বললেন যে, নথি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যাবে না। আমি বললাম, আপনি লিখে দেন যে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করা হোক। তিনি লিখে দিলেন এবং তদানুসারে আবার নথি তার কাছে ফিরে গেল এবং তার ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ব্যবস্থা গৃহীত হলো।
বিভাগীয় কাজের সমাধান ঠিকই হলো, কিন্তু আমার মনে একটা বড় খটকা জেগে উঠলো। তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সম্পর্কে ভালো ছিল না। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি খর্বাকৃতির ছিলেন। কিন্তু বাঁটকু শব্দটি ব্যবহার করে অর্থমন্ত্রী শুধু খর্বাকৃতিকেই পরিহাস করেননি, এর ভেতর অর্থমন্ত্রীর রাজনৈতিক দর্শনও নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন্ত্রিসভাশাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গৌণ। মন্ত্রিসভার সদস্যরা যদি দৈত্যের মতো ক্ষমতাবান হন, তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেহাত বাঁটকুর মতো।
অথচ এ অবস্থা কিন্তু সব সময় ছিল না। ১৯৭৩ সালে আমি যখন বৃত্তি নিয়ে কানাডাতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাই, তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তার সময়ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে একটি প্রশ্ন উঠেছিল, যার সঙ্গে দুর্ভাগ্যবশত আমিও জড়িয়েছিলাম।
ঘটনাটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সম্পর্কিত। তত দিনে দেশে কলাবরেটরদের শাস্তি দেয়ার জন্য আইন পাস হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকের হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার বিভিন্ন অভিযোগ আসতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন তখন ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। তার মতে, এসব অভিযোগ সঠিক ছিল না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য পুলিশের কর্মকর্তারা উপযুক্ত নন। কাজেই তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি নথি নিয়ে যান। সেখানে প্রস্তাব করা হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কলাবরেটর’ আইনে পুলিশ কোনো তদন্ত করবে না। এ বিষয়ে তদন্তের ভার দেয়া হবে চ্যান্সেলর কর্তৃক নিযুক্ত একটি কমিটিকে। মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এ ফাইল স্বাক্ষরের জন্য সরাসরি গণভবনে নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী সাহেবকে ডেকে পাঠান। ড. চৌধুরী ও প্রফেসর ইউসুফ আলীর সঙ্গে পরামর্শ করে বঙ্গবন্ধু প্রস্তাবিত কমিটির সদস্যদের তালিকাও মৌখিকভাবে অনুমোদন করেন। তারপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ সম্পর্কে নথি অবিলম্বে পেশ করার জন্য নির্দেশ দেন।
আমি তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চশিক্ষা, শিক্ষা সংস্কার, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও যুবসংক্রান্ত বিষয়ের উপ-সচিব। শিক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ফিরে এসে আমাকে ডেকে পাঠান এবং অনুমোদিত কমিটির তালিকাটি আমার হাতে দিয়ে এ সম্পর্কে একটি সারসংক্ষেপ প্রস্তুত করতে নির্দেশ দেন। আমি শিক্ষামন্ত্রীকে জানাই যে, এ ধরনের কমিটির আইনগত বৈধতা পরীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এবং এখন আর আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো পরামর্শের প্রয়োজন নেই। তিনি আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নথি তৈরি করতে বলেন।
আমি আমার অফিসে ফিরে আসি এবং শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে একটি বিজ্ঞপ্তির খসড়া প্রস্তুত করে টাইপিস্টকে টাইপ করার জন্য দিই। তারপর আমি আমার বক্তব্য লিখি। সেই নোটে আমি লিখি, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশক্রমে আমি এই বিজ্ঞপ্তির খসড়া পেশ করছি। তবে বিষয়টি আইনসম্মত কিনা, সে সম্পর্কে আমার মনে প্রশ্ন রয়েছে এবং সেই প্রশ্নগুলোও অতি সংক্ষেপে আমি নোটে লিখি এবং সবশেষে লিখি যে, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে বিজ্ঞপ্তি অনুমোদনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের কাছে পাঠানোর জন্য নথি পেশ করা হলো। আমার স্বাক্ষর করার পর শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রী কিছু না লিখে শুধু স্বাক্ষর করে ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকেও ত্বরিতগতিতে রাষ্ট্রপতির কাছে ফাইলটি পাঠানো হয়।
আশা করা হচ্ছিল যে রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে ফাইলটি একদিনের মধ্যে বেরিয়ে আসবে। দুই-তিন দিন পরও যখন ফাইলটি ফেরত আসে না, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চান যে, ফাইলের কী হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী আমাকে বঙ্গভবনে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেন। আমি বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে জানান যে, তারা ফাইল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিল করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এই ফাইল স্বাক্ষর করেননি। আমি শিক্ষামন্ত্রীকে এই তথ্য জানিয়ে দেই। দিন দশেক পর হঠাৎ শিক্ষামন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে বললেন যে, রাষ্ট্রপতি তাকে ডেকেছিলেন। রাষ্ট্রপতি তাকে প্রশ্ন করেন, যে বিজ্ঞপ্তি আমার কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছেন, সেই বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে যে নোট আছে, তা পড়েছেন কি? শিক্ষামন্ত্রী বললেন, স্যার, পড়েছি। এটি একজন উপ-সচিব লিখেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং আবেগপ্রবণ।
রাষ্ট্রপতি বললেন, মোটেও আবেগপ্রবণ নন, তার এই নোট পড়ে আমার মনেও প্রশ্ন জাগে এবং এ বিষয়ে আমি হাইকোর্ট লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়াশোনা করেছি। আমার ধারণা, তিনি যা লিখেছেন, সেটা সঠিক এবং আমি এই কমিটির অনুমোদন করতে পারবো না। আপনি মেহেরবানি করে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেবেন। ইউসুফ আলী সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেন, রাষ্ট্রপতি একজন সাবেক বিচারপতি এবং তিনি যদি এটা আইনসম্মত মনে না করেন, তাহলে এটা না করাই ভালো। সুতরাং ফাইলটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অস্বাক্ষরিত অবস্থায় শিক্ষামন্ত্রী ফেরত নিয়ে আসেন। তিনি ফাইলটি আমার হাতে দিয়ে বললেন যে, এ বিষয়ে আর কিছু করার নেই। তিনি আরো বললেন, রাষ্ট্রপতি আপনাকে সাহসী নোট লেখার জন্য অভিনন্দন জানাতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। অবশ্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও শেষ পর্যন্ত মর্যাদা নিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে টিকে থাকতে পারেননি। তার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রপতির পদের অবমূল্যায়ন শুরু হয়।
রাষ্ট্রপতির ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিভাজন বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিবর্তনের একটি বড় বিষয়। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ফ্রান্সের বুরবন সম্রাট, রাশিয়ার জার ও মোগল বাদশার সঙ্গে তুলনীয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ নেই। তবে এই ক্ষমতা বৃদ্ধির একটি সীমা থাকা প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে Thomas Paine যথার্থই বলেছেন-
No country can be called free which is governed by an absolute power and it matters not whether it be an absolute royal power or an absolute legislative power as the consequences will be the same to the people.
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে। কিন্তু এ ক্ষমতা বাড়িয়ে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করা চলবে না। রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজন অবশ্যই থাকতে হবে। কাজেই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দেশে saparation of power বা ক্ষমতার বিভাজনের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এই নিবন্ধে সুশাসন ও নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এটি চারটি খণ্ডে বিভক্ত। সূচনা খণ্ডের পর দ্বিতীয় খণ্ডে বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সাংবিধানিক ক্ষমতার ভারসাম্যের ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি-না, সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষ খণ্ডে নির্বাহী বিভাগের পুনর্গঠন সম্পর্কে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
No comments