কেন পাঠানকোট ভিন্ন by গৌতম দাস
পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ভারতের পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে ছয় জঙ্গী হামলা সামলাতে চারদিন |
পাকিস্তান-ভারত
সীমান্তের কোলঘেঁষে ভারতের পাঞ্জাব অংশের সামরিক বিমানঘাঁটির শহর
পাঠানকোট। প্রায় ২০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের পুরো পাঠানকোট বিমানঘাঁটি এলাকা,
একে কেন্দ্র করেই শহর। গত ২ জানুয়ারি থেকে পরের তিন দিন মিডিয়া এবং সামরিক
ও সরকারি প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত ও শিরোনাম করে রেখেছিল ছয় ব্যক্তি। ভারতীয়
ভাষ্যে এরা ‘জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী’। ভারতের দাবি এরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত
কাশ্মির থেকে এসে প্রথমে পাঠানকোট শহরে পরে একেবারে বিমানঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ
করে আক্রমণ চালিয়েছিল। শেষে ভারতের হাতে নিজেরা পাল্টা আক্রমণের শিকার হয়ে
সবাই মারা যায়। তবে এতে মোট সাত ভারতীয় মারা যায়, যাদের মধ্যে একজন লে.
কর্নেল পদমর্যাদার।
প্রথমত কারা এরা? পরিচয় কী? প্রথম চার-পাঁচ দিন অনুমান করে ভারতীয় মিডিয়া ভাষ্যে বলা হচ্ছিল, এরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কোন সীমান্ত আর কারা তা এতে নির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছিল না। এ বিষয়ে সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি ভারতীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগের যে বর্ণনা পাকিস্তানকে দেয় তাতে সুনির্দিষ্ট করে পাকিস্তানি তিন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা থাকলেও কোন এলাকা দিয়ে এরা অনুপ্রবেশ করেছিল সুনির্দিষ্টভাবে তার উল্লেখ এখনো কোথাও নেই।
ঘটনার মূল স্টোরিটা অর্থাৎ কী হয়েছিল, কিভাবে ঘটনাটা ঘটেছিল মোটাদাগে ও সারকথায় সে বর্ণনাটা হলো, হামলার আগের দিন তারা গুরুদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বিনাবাধায় পাঠানকোটে প্রবেশ করে । এরপর আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো গাড়িতে করে তারা শহরে প্রবেশ করে। এরপর পাঞ্জাব পুলিশের এক এসপির গাড়ি তারা ছিনতাই করে। গাড়িতে থাকা এসপি ও তার এক সহকারীকে ছেড়ে দিলেও তৃতীয়জন এসপির বন্ধুকে হত্যা করে। সেই গাড়িতে করে বিমানঘাঁটি পর্যন্ত যায়, এসপির ফোন থেকে পাকিস্তানের কয়েকটা নম্বরে ফোন করে। এরপর বিমানঘাঁটিতে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি হামলা চালায়। ওপরে যে বর্ণনাটা দেয়া হলো, এটা ভারত সরকারের ভাষ্য নয় অর্থাৎ ঘটনা সংশ্লিষ্টদের স্টেটমেন্ট নিয়ে তা যাচাই করে খাড়া করা কোনো সরকারি ভাষ্য নয়। এই বর্ণনায় বহু ফাঁকফোকর আছে। ভারতের মিডিয়াই সে বিষয়ে সোচ্চার। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো গাড়ি ছিনতাইয়ের পরও প্রশাসন এসপির অভিযোগকে হালকা করে নিয়েছিল, এটা যে পরে পাঠানকোটে হামলার সাথে সম্পর্কিত তা মনে করা বা ভেবে দেখা হয়নি। পাঠানকোটের ঘটনার ভেতরে এ রকম অসংখ্য নিরাপত্তাবিষয়ক ব্যর্থতা ও ত্রুটিতে পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, ভারতের ভাষায় ‘জঙ্গিরা’ বিমানঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ করেছে এটা জানার পর মোকাবেলার জন্য পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কোন বাহিনীকে দিয়ে এটা মোকাবেলা করা হবে এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দেভালের নেতৃত্বের কমিটি নাকানিচুবানি ও হিমশিম অবস্থায় পড়েছিল। বিমানঘাঁটির আশপাশে আরো পাঁচটা আর্মি ক্যান্টনমেন্ট অবস্থিত হলেও তাদের কাউকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। না দেয়া হয় দিল্লিতে অন্তত ১০০ কিমি দূরে থাকা কমান্ডো বাহিনীকে। এরপর আবার ভারতের আর্মি নাকি কমান্ডো বাহিনীর অফিসার কার নেতৃত্বে কে থাকবে এবং সঠিক যোগ্যতার বাহিনী বেছে নেয়া হয়েছে কি না এ নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ করা হয়। যেটা হামলা-উত্তর পরিস্থিতিতে আর্মি বনাম কমান্ডো শুধু নয়, ভারতের বিভিন্ন বাহিনী পরস্পর পরস্পরের সাথে দায় ঠেলাঠেলির বিশাল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
একটা ছোট তথ্যের দিক হলো, হামলাকারীরা সংখ্যায় চারজন ধরে নিয়ে প্রতিরোধ ও দমনব্যবস্থা সাজানো হয়েছিল। কারণ চারজন ছিনতাইকারী এসপির গাড়ি নিয়ে পালিয়েছিল। ফলে অপারেশন শেষ ঘোষণা করা হয় ওই চারজনের লাশ পাওয়ার পর। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার গোলাগুলির ঘটনায় জানা যায় যে, তাদের আরো সঙ্গী তখনো আছে। পরে আরো অপারেশন শেষে আরো দু’জনের লাশ পাওয়া যায়। এভাবে প্রতিটা পর্যায়ে সামরিক অথবা বেসামরিক তৎপরতার মধ্যে অদক্ষতা, অপেশাদারিত্বের ছাপ দেখা যায়। সর্বশেষ গতকালের রিপোর্ট হলো, সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে থাকা ভারতীয় বিএসএফ তাদের বসের কাছে এক তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেছে এই বলে যে, তাদের দায়িত্বে থাকা কোনো এলাকা দিয়েই জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করেনি, তারা তদন্ত করে দেখেছে। ফলে জঙ্গিদের প্রবেশ আর্মির অধীনন্থ কোনো এলাকা হতে পারে। অর্থাৎ প্রচ্ছন্নে বলা হয় বিএসএফের দোষ-দায় নেই। এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। সামগ্রিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষায় থাকা নানা বাহিনী খুবই আমলাতান্ত্রিক অর্থে অদক্ষ, এমন অভিযোগের কথা শোনা যেত। এখন একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা হতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ অপারেশনাল বিজনেস রুলে কাজ ভাগ, কমান্ড ভাগ ও সব কিছুর সমন্বয়ের দিক থেকে বিশাল ব্যর্থতা রয়েছে। এ দিক থেকে এখানে তা চরম নাদানির পরিচয় বহন করে। আর ঠিক এটাই দেখাতে চেয়েছিল হামলাকারীরা।
হামলা শেষে দায় স্বীকার করে পাকিস্তান-কাশ্মির থেকে সংগৃহীত বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে, হামলা করেছে ‘ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল’। এটা অনেকগুলো সশস্ত্র গ্রুপের সমন্বয় সংগঠন; বিশেষত গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক বিবাদ মিটানোর উদ্দেশ্য থেকে এর জন্ম। কিন্তু ভারতে হামলার দিক থেকে এই ‘কাউন্সিল’ যে শুধু এই প্রথম তাই নয়, এর আগে ‘কাউন্সিল’ সীমান্ত পেরিয়ে অপারেশন করে না বা করতে চায় না, এই নীতি মেনে চলত। আর এর বরখেলাপ কেউ করলে তেমন অনেক সদস্য ‘কাউন্সিল’ এর আগে বের করে দিয়েছে, এমন রেকর্ড আছে। এখন কাউন্সিল নিজেই ভারতে এমন অপারেশন করার কথা না। ফলে এরা আসলেই তা করেছে কি না এই বিতর্ক উঠেছে। ফলে ভারতও এমন মনে করে যে, জয়শ মোহাম্মদ এই কাজ করে কোনো কারণে জিহাদ কাউন্সিলের নামে চালাচ্ছে, বলে মিডিয়া অনুমান করে রিপোর্ট লিখছে। কিন্তু এসব দিকের চেয়ে বড় একটা বিষয় হলো, দায় স্বীকার করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কাশ্মিরকেন্দ্রিক সশস্ত্র দলগুলো যে পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া নিজেরাই ভারতের যেকোনো সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশ ও অপারেশন চালানোর সামর্থ্য রাখে সেটা দেখানোই নাকি এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল। কথা হয়তো ফেলনা নয়। এ ছাড়া চার-ছয়জন ‘জঙ্গির’ হামলা সামলাতে ১০৭ জন কমান্ডো পাঠানো হয়েছিল এ বিষয়টাকেও এর পয়েন্ট মনে করা যায়। তবে স্বভাবতই এসব কথাবার্তা ভারতের কোনো বাহিনী বা গোয়েন্দা বিভাগের ভালো লাগার কারণ নেই। আবার তাদের নাস্তানাবুদ সমন্বয়হীনতাও প্রকাশ্য বলে এটা তাদের পক্ষে কথা বলছে না।
কাশ্মির ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক বিতর্ক এবং দুই অবস্থান হলো, ভারত মনে করে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে ভারতের পার্মানেন্ট অংশ ধরে নিয়ে বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব শেষ করা হোক। এটা হলো সারকথা, তবে মনের কথা বাইরে বলার মতো কথা নয়। ফলে আবার ‘পুরো কাশ্মির ভারতের’ এই দাবি কৌশলগতভাবে ভারত ছেড়ে দেয়নি, জারি রেখেছে। তবে সাধারণভাবে কাশ্মির ইস্যু নিয়ে কারো সাথে কোনো আলাপের কিছু নেই বলে ভারত বিশ্বাস করে। কিন্তু মুখে তা উল্লেখ না করে বরং ইস্যুটা ফেলে রাখলেই সম্ভবত এক সময় ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভারতের পার্মানেন্ট অংশ ধরে সমাধান এসে যেতে পারে আশা করে। আর এর বিপরীতে পাকিস্তানের অবস্থান হলো, কাশ্মিরকে ইস্যু মেনে ভারতকে কথা বলাতে হবে। কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। কাশ্মির স্বাধীন করে আনলে তো এরা পাকিস্তানে যোগ দেবে এই নীতিতে এগোনো। গ্রুপগুলোর মাধ্যমে ভারতকে চাপ দেয়ার সুযোগ নেয়া।
এভাবেই চলছিল। কিন্তু এ ধরনের এই স্টেলমেট পরিস্থিতির ভেতর নতুন ফ্যাক্টর হাজির হয়, সম্ভাব্য আইএসের উপস্থিতি। এতে ভারতের চাহিদা ও কামনা হলো, ভারত-পাকিস্তান (পারলে বাংলাদেশসহ) সবাই মিলে আইএস বিরোধী সব ধরনের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের এক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে। আমেরিকার অবস্থানও এটাই। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের অবস্থান প্রায় একই, তবে একটা বাড়তি দিক ছাড়া। তা হলো কাশ্মির ইস্যুকেও এর ভেতরে সাথে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে অন্তত কৌশলগতভাবে মোদির ভারত পাকিস্তানের সাথে সায় দিয়েছে। প্যারিসে নওয়াজ-মোদি আলাপ, ব্যাংককে নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক, পাকিস্তানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক এবং সর্বশেষ মোদির আচমকা পাকিস্তান সফর, এগুলো ভারতের এই সায় দেয়া উদ্যোগের কারণেই হতে পেরেছে। সামনের ১৪ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এরই ফলোআপ বৈঠক হওয়ার কথা। ওদিকে নওয়াজ ও আর্মি প্রশাসন দু’পক্ষের সাথেই ভারত ডিল করতে চায়, এনগেজ হতে চায়, ভারতের এই ইচ্ছাও পূরণ হয়েছে। কারণ বর্তমান পাকিস্থানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সেনাপ্রধান রাহিলের ঘনিষ্ঠ এক সাবেক জেনারেল। ফলে সঠিকভাবেই মোদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথেও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে, মনে করা যেতে পারে। কেবল নওয়াজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, সামরিক স্টাবলিশমেন্টের সমর্থন এর পেছনে আছে তা মোদি ধরে নিয়েছেন।
পাকিস্তানের সাথে মোদির এই অবস্থানের বিষয়ে ভারতীয় কংগ্রেসের অবস্থান শুধু শীতল বা রক্ষণশীল নয় বরং মারাত্মক নেতিবাচক। যেন কংগ্রেস পাকিস্তানের সাথে ভারতের কোনো সম্পর্কেরই বিরোধী। অজুহাত হলো, এগুলো করে কিছুই হয় না কারণ পাকিস্তান বিশ্বস্ত নয়। আসলে এগুলো কংগ্রেসের সরকারের আমলে বিজেপির অবস্থানের মতোই- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলে মুসলমান বিদ্বেষী ড্রাম পিটিয়ে অবস্থান নিয়ে লোক ক্ষেপিয়ে ভোটের বাক্সে তা যতটা কাজে লাগানো যায়, এটাই ভারতের যেকোনো বিরোধী দলের উপযুক্ত অবস্থান মনে করত বিজেপি। আজ কংগ্রেস একই অবস্থান অনুসরণ করছে।
তাই পাঠানকোট হামলা কংগ্রেস নিজের জন্য বিরাট পড়ে পাওয়া সুযোগ এসেছে বলে দেখছে। আগে বাজপেয়ীর সরকারের আমলে তার বাস-কূটনীতিতে লাহোর গমনের পর পরই কার্গিল যুদ্ধ হয়েছিল। অর্থাৎ তুকতাকের বিশ্বাস মতো যেন বাজপেয়ি নিজেই কার্গিল যুদ্ধ ডেকে এনেছিল। অতএব মোদির নওয়াজের জন্মদিনে পাকিস্তান সফরই পাঠানকোট হামলা মোদি ডেকে আনল, এই ছিল কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া। আর মোদির জন্য এমন মন্তব্য ততটাই অসহযোগিতা আর বিরূপ পরিস্থিতির। কিন্তু তবু মোদি ও তার সরকার ধৈর্য ধরা ঠিক মনে করেছিল। পাঠানকোট হামলার জন্য মোদি সরকার পাকিস্তানকে দায়ী করেনি, অভিযুক্ত করে এখনো কোনো বিবৃতি দেয়নি। নওয়াজ সরকারও এই হামলার ব্যাপারে মোদি সরকারকে সহযোগিতা করবে বলে দু’বার ফোন করে আশ্বস্ত করেছে বলে ভারতীয় মিডিয়ার খবর। পাঠানকোট হামলার পর এ ক্ষেত্রে আমাদের আগের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে ভিন্নতর দিক এগুলোই। এগুলো কি আইএস ইস্যুতে ভারতের সিরিয়াস কমিটেড অবস্থানের প্রতিফলন? মোদি-নওয়াজের সহযোগিতা যে আপাত পথ আছে বলে মনে হচ্ছে, এটা কত দূর টিকবে? সময়ই তা বলবে!
goutamdas1958@hotmail.com
প্রথমত কারা এরা? পরিচয় কী? প্রথম চার-পাঁচ দিন অনুমান করে ভারতীয় মিডিয়া ভাষ্যে বলা হচ্ছিল, এরা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির থেকে সীমান্ত পেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কোন সীমান্ত আর কারা তা এতে নির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছিল না। এ বিষয়ে সর্বশেষ গত ৮ জানুয়ারি ভারতীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগের যে বর্ণনা পাকিস্তানকে দেয় তাতে সুনির্দিষ্ট করে পাকিস্তানি তিন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা থাকলেও কোন এলাকা দিয়ে এরা অনুপ্রবেশ করেছিল সুনির্দিষ্টভাবে তার উল্লেখ এখনো কোথাও নেই।
ঘটনার মূল স্টোরিটা অর্থাৎ কী হয়েছিল, কিভাবে ঘটনাটা ঘটেছিল মোটাদাগে ও সারকথায় সে বর্ণনাটা হলো, হামলার আগের দিন তারা গুরুদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বিনাবাধায় পাঠানকোটে প্রবেশ করে । এরপর আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো গাড়িতে করে তারা শহরে প্রবেশ করে। এরপর পাঞ্জাব পুলিশের এক এসপির গাড়ি তারা ছিনতাই করে। গাড়িতে থাকা এসপি ও তার এক সহকারীকে ছেড়ে দিলেও তৃতীয়জন এসপির বন্ধুকে হত্যা করে। সেই গাড়িতে করে বিমানঘাঁটি পর্যন্ত যায়, এসপির ফোন থেকে পাকিস্তানের কয়েকটা নম্বরে ফোন করে। এরপর বিমানঘাঁটিতে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি হামলা চালায়। ওপরে যে বর্ণনাটা দেয়া হলো, এটা ভারত সরকারের ভাষ্য নয় অর্থাৎ ঘটনা সংশ্লিষ্টদের স্টেটমেন্ট নিয়ে তা যাচাই করে খাড়া করা কোনো সরকারি ভাষ্য নয়। এই বর্ণনায় বহু ফাঁকফোকর আছে। ভারতের মিডিয়াই সে বিষয়ে সোচ্চার। কিন্তু যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো গাড়ি ছিনতাইয়ের পরও প্রশাসন এসপির অভিযোগকে হালকা করে নিয়েছিল, এটা যে পরে পাঠানকোটে হামলার সাথে সম্পর্কিত তা মনে করা বা ভেবে দেখা হয়নি। পাঠানকোটের ঘটনার ভেতরে এ রকম অসংখ্য নিরাপত্তাবিষয়ক ব্যর্থতা ও ত্রুটিতে পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, ভারতের ভাষায় ‘জঙ্গিরা’ বিমানঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ করেছে এটা জানার পর মোকাবেলার জন্য পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কোন বাহিনীকে দিয়ে এটা মোকাবেলা করা হবে এই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দেভালের নেতৃত্বের কমিটি নাকানিচুবানি ও হিমশিম অবস্থায় পড়েছিল। বিমানঘাঁটির আশপাশে আরো পাঁচটা আর্মি ক্যান্টনমেন্ট অবস্থিত হলেও তাদের কাউকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। না দেয়া হয় দিল্লিতে অন্তত ১০০ কিমি দূরে থাকা কমান্ডো বাহিনীকে। এরপর আবার ভারতের আর্মি নাকি কমান্ডো বাহিনীর অফিসার কার নেতৃত্বে কে থাকবে এবং সঠিক যোগ্যতার বাহিনী বেছে নেয়া হয়েছে কি না এ নিয়েও সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে অযথা সময়ক্ষেপণ করা হয়। যেটা হামলা-উত্তর পরিস্থিতিতে আর্মি বনাম কমান্ডো শুধু নয়, ভারতের বিভিন্ন বাহিনী পরস্পর পরস্পরের সাথে দায় ঠেলাঠেলির বিশাল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
একটা ছোট তথ্যের দিক হলো, হামলাকারীরা সংখ্যায় চারজন ধরে নিয়ে প্রতিরোধ ও দমনব্যবস্থা সাজানো হয়েছিল। কারণ চারজন ছিনতাইকারী এসপির গাড়ি নিয়ে পালিয়েছিল। ফলে অপারেশন শেষ ঘোষণা করা হয় ওই চারজনের লাশ পাওয়ার পর। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার গোলাগুলির ঘটনায় জানা যায় যে, তাদের আরো সঙ্গী তখনো আছে। পরে আরো অপারেশন শেষে আরো দু’জনের লাশ পাওয়া যায়। এভাবে প্রতিটা পর্যায়ে সামরিক অথবা বেসামরিক তৎপরতার মধ্যে অদক্ষতা, অপেশাদারিত্বের ছাপ দেখা যায়। সর্বশেষ গতকালের রিপোর্ট হলো, সীমান্ত পাহারার দায়িত্বে থাকা ভারতীয় বিএসএফ তাদের বসের কাছে এক তদন্ত রিপোর্ট পেশ করেছে এই বলে যে, তাদের দায়িত্বে থাকা কোনো এলাকা দিয়েই জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করেনি, তারা তদন্ত করে দেখেছে। ফলে জঙ্গিদের প্রবেশ আর্মির অধীনন্থ কোনো এলাকা হতে পারে। অর্থাৎ প্রচ্ছন্নে বলা হয় বিএসএফের দোষ-দায় নেই। এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। সামগ্রিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষায় থাকা নানা বাহিনী খুবই আমলাতান্ত্রিক অর্থে অদক্ষ, এমন অভিযোগের কথা শোনা যেত। এখন একে অপরের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা হতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ অপারেশনাল বিজনেস রুলে কাজ ভাগ, কমান্ড ভাগ ও সব কিছুর সমন্বয়ের দিক থেকে বিশাল ব্যর্থতা রয়েছে। এ দিক থেকে এখানে তা চরম নাদানির পরিচয় বহন করে। আর ঠিক এটাই দেখাতে চেয়েছিল হামলাকারীরা।
হামলা শেষে দায় স্বীকার করে পাকিস্তান-কাশ্মির থেকে সংগৃহীত বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে, হামলা করেছে ‘ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল’। এটা অনেকগুলো সশস্ত্র গ্রুপের সমন্বয় সংগঠন; বিশেষত গ্রুপগুলোর অভ্যন্তরীণ পারস্পরিক বিবাদ মিটানোর উদ্দেশ্য থেকে এর জন্ম। কিন্তু ভারতে হামলার দিক থেকে এই ‘কাউন্সিল’ যে শুধু এই প্রথম তাই নয়, এর আগে ‘কাউন্সিল’ সীমান্ত পেরিয়ে অপারেশন করে না বা করতে চায় না, এই নীতি মেনে চলত। আর এর বরখেলাপ কেউ করলে তেমন অনেক সদস্য ‘কাউন্সিল’ এর আগে বের করে দিয়েছে, এমন রেকর্ড আছে। এখন কাউন্সিল নিজেই ভারতে এমন অপারেশন করার কথা না। ফলে এরা আসলেই তা করেছে কি না এই বিতর্ক উঠেছে। ফলে ভারতও এমন মনে করে যে, জয়শ মোহাম্মদ এই কাজ করে কোনো কারণে জিহাদ কাউন্সিলের নামে চালাচ্ছে, বলে মিডিয়া অনুমান করে রিপোর্ট লিখছে। কিন্তু এসব দিকের চেয়ে বড় একটা বিষয় হলো, দায় স্বীকার করা বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কাশ্মিরকেন্দ্রিক সশস্ত্র দলগুলো যে পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছা ও সহযোগিতা ছাড়া নিজেরাই ভারতের যেকোনো সামরিক ঘাঁটিতে প্রবেশ ও অপারেশন চালানোর সামর্থ্য রাখে সেটা দেখানোই নাকি এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল। কথা হয়তো ফেলনা নয়। এ ছাড়া চার-ছয়জন ‘জঙ্গির’ হামলা সামলাতে ১০৭ জন কমান্ডো পাঠানো হয়েছিল এ বিষয়টাকেও এর পয়েন্ট মনে করা যায়। তবে স্বভাবতই এসব কথাবার্তা ভারতের কোনো বাহিনী বা গোয়েন্দা বিভাগের ভালো লাগার কারণ নেই। আবার তাদের নাস্তানাবুদ সমন্বয়হীনতাও প্রকাশ্য বলে এটা তাদের পক্ষে কথা বলছে না।
কাশ্মির ইস্যুতে ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক বিতর্ক এবং দুই অবস্থান হলো, ভারত মনে করে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরকে ভারতের পার্মানেন্ট অংশ ধরে নিয়ে বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব শেষ করা হোক। এটা হলো সারকথা, তবে মনের কথা বাইরে বলার মতো কথা নয়। ফলে আবার ‘পুরো কাশ্মির ভারতের’ এই দাবি কৌশলগতভাবে ভারত ছেড়ে দেয়নি, জারি রেখেছে। তবে সাধারণভাবে কাশ্মির ইস্যু নিয়ে কারো সাথে কোনো আলাপের কিছু নেই বলে ভারত বিশ্বাস করে। কিন্তু মুখে তা উল্লেখ না করে বরং ইস্যুটা ফেলে রাখলেই সম্ভবত এক সময় ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ভারতের পার্মানেন্ট অংশ ধরে সমাধান এসে যেতে পারে আশা করে। আর এর বিপরীতে পাকিস্তানের অবস্থান হলো, কাশ্মিরকে ইস্যু মেনে ভারতকে কথা বলাতে হবে। কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। কাশ্মির স্বাধীন করে আনলে তো এরা পাকিস্তানে যোগ দেবে এই নীতিতে এগোনো। গ্রুপগুলোর মাধ্যমে ভারতকে চাপ দেয়ার সুযোগ নেয়া।
এভাবেই চলছিল। কিন্তু এ ধরনের এই স্টেলমেট পরিস্থিতির ভেতর নতুন ফ্যাক্টর হাজির হয়, সম্ভাব্য আইএসের উপস্থিতি। এতে ভারতের চাহিদা ও কামনা হলো, ভারত-পাকিস্তান (পারলে বাংলাদেশসহ) সবাই মিলে আইএস বিরোধী সব ধরনের সহযোগিতা ও সমন্বয়ের এক প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে। আমেরিকার অবস্থানও এটাই। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের অবস্থান প্রায় একই, তবে একটা বাড়তি দিক ছাড়া। তা হলো কাশ্মির ইস্যুকেও এর ভেতরে সাথে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে অন্তত কৌশলগতভাবে মোদির ভারত পাকিস্তানের সাথে সায় দিয়েছে। প্যারিসে নওয়াজ-মোদি আলাপ, ব্যাংককে নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক, পাকিস্তানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক এবং সর্বশেষ মোদির আচমকা পাকিস্তান সফর, এগুলো ভারতের এই সায় দেয়া উদ্যোগের কারণেই হতে পেরেছে। সামনের ১৪ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে এরই ফলোআপ বৈঠক হওয়ার কথা। ওদিকে নওয়াজ ও আর্মি প্রশাসন দু’পক্ষের সাথেই ভারত ডিল করতে চায়, এনগেজ হতে চায়, ভারতের এই ইচ্ছাও পূরণ হয়েছে। কারণ বর্তমান পাকিস্থানের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সেনাপ্রধান রাহিলের ঘনিষ্ঠ এক সাবেক জেনারেল। ফলে সঠিকভাবেই মোদি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাথেও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে, মনে করা যেতে পারে। কেবল নওয়াজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, সামরিক স্টাবলিশমেন্টের সমর্থন এর পেছনে আছে তা মোদি ধরে নিয়েছেন।
পাকিস্তানের সাথে মোদির এই অবস্থানের বিষয়ে ভারতীয় কংগ্রেসের অবস্থান শুধু শীতল বা রক্ষণশীল নয় বরং মারাত্মক নেতিবাচক। যেন কংগ্রেস পাকিস্তানের সাথে ভারতের কোনো সম্পর্কেরই বিরোধী। অজুহাত হলো, এগুলো করে কিছুই হয় না কারণ পাকিস্তান বিশ্বস্ত নয়। আসলে এগুলো কংগ্রেসের সরকারের আমলে বিজেপির অবস্থানের মতোই- পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বলে মুসলমান বিদ্বেষী ড্রাম পিটিয়ে অবস্থান নিয়ে লোক ক্ষেপিয়ে ভোটের বাক্সে তা যতটা কাজে লাগানো যায়, এটাই ভারতের যেকোনো বিরোধী দলের উপযুক্ত অবস্থান মনে করত বিজেপি। আজ কংগ্রেস একই অবস্থান অনুসরণ করছে।
তাই পাঠানকোট হামলা কংগ্রেস নিজের জন্য বিরাট পড়ে পাওয়া সুযোগ এসেছে বলে দেখছে। আগে বাজপেয়ীর সরকারের আমলে তার বাস-কূটনীতিতে লাহোর গমনের পর পরই কার্গিল যুদ্ধ হয়েছিল। অর্থাৎ তুকতাকের বিশ্বাস মতো যেন বাজপেয়ি নিজেই কার্গিল যুদ্ধ ডেকে এনেছিল। অতএব মোদির নওয়াজের জন্মদিনে পাকিস্তান সফরই পাঠানকোট হামলা মোদি ডেকে আনল, এই ছিল কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া। আর মোদির জন্য এমন মন্তব্য ততটাই অসহযোগিতা আর বিরূপ পরিস্থিতির। কিন্তু তবু মোদি ও তার সরকার ধৈর্য ধরা ঠিক মনে করেছিল। পাঠানকোট হামলার জন্য মোদি সরকার পাকিস্তানকে দায়ী করেনি, অভিযুক্ত করে এখনো কোনো বিবৃতি দেয়নি। নওয়াজ সরকারও এই হামলার ব্যাপারে মোদি সরকারকে সহযোগিতা করবে বলে দু’বার ফোন করে আশ্বস্ত করেছে বলে ভারতীয় মিডিয়ার খবর। পাঠানকোট হামলার পর এ ক্ষেত্রে আমাদের আগের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে ভিন্নতর দিক এগুলোই। এগুলো কি আইএস ইস্যুতে ভারতের সিরিয়াস কমিটেড অবস্থানের প্রতিফলন? মোদি-নওয়াজের সহযোগিতা যে আপাত পথ আছে বলে মনে হচ্ছে, এটা কত দূর টিকবে? সময়ই তা বলবে!
goutamdas1958@hotmail.com
No comments