প্রয়োজন নিরপেক্ষ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন by জি. মুনীর
গত
৩০ ডিসেম্বর সারা দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। এ
নির্বাচনের ফলাফল ও ঘটনা-বিঘটনা এরই মধ্যে আমাদের কম-বেশি জানা হয়ে গেছে।
২৩৪টির মধ্যে সাতটিতে আওয়ামী প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন।
এসব পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থী কেন নির্বাচনে যাননি কিংবা তাদের প্রার্থীদের
নির্বাচন করতে দেয়া হয়নি- এরও কারণ সরেজমিন প্রতিবেদনে একটি ইংরেজি
দৈনিকের সূত্রে দেশবাসী ইতোমধ্যে জেনেছেন। অপর দিকে নানা অনিয়মের কারণে
২০টি পৌরসভায় নির্বাচনী ফল স্থগিত করতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। বাকি ২০৭টি
পৌরসভার নির্বাচনী ফলাফল আমাদের হাতে পৌঁছেছে। এ ২০৭টির মধ্যে আওয়ামী লীগ
মেয়র পদে ১৬৮টি, বিএনপি ১৯টি, জাপা একটি, জামায়াত দু’টি এবং বিদ্রোহী ও
স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৭টিতে বিজয়ী হন।
আওয়ামী লীগ যেখানে বিজয়ী হয়েছে ১৬৮টি মেয়র পদে, সেখানে বিএনপি পাবে ১৯টি- এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে এটি কী ধরনের নির্বাচন হয়েছে। অনেকের মন্তব্য, রীতিমতো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে লজ্জার মুখে ফেলে দিয়েছে। তবুও তৃপ্তির ঢেঁকুর সরকারি দলের নেতানেত্রী ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মুখে। নির্বাচন কমিশন বলেছে- এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কমিশনের কাছে প্রশ্ন করতে হয়- নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠুই হয়ে থাকে, তবে কেন ২০টি পৌরসভার নির্বাচনী ফল বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে কমিশন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হলো। অপর দিকে সরকারি দলের নেতাদের এককথা- এ নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সরকারি দলের ঘোর সমর্থক এক বুদ্ধিজীবী তো রীতিমতো তত্ত্বই দিয়ে বসেছেন- বেগম জিয়া মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির ভোট ব্যাপকভাবে কমে গেছে। কী সহজ তত্ত্বায়ন! এসব শুনে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
আমরা যদি একটু গভীরভাবে আলোচ্য পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে যাই, তবে আমাদের বিস্ময়ের মাত্রাটাই আরো শতভাগ বেড়ে যাবে। সহযোগী দৈনিক প্রথম আলো গত ৬ জানুয়ারি পৌর নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যারা এ প্রতিবেদনটি পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এবারের পৌর নির্বাচনের আসল চেহারা নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন। এই ফলাফল বিশ্লেষণ এতটাই সরল যে, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুধাবনের জন্য তেমন কোনো বিদ্যাবুদ্ধি, মেধা-মননের প্রয়োজন হবে না। সাধারণজনও তা সহজেই বোধে নিতে পারবেন।
উল্লিখিত প্রতিবেদন মতে- ভোট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১টি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। আর বিএনপি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম ভোট পেয়েছে। উল্লিখিত ৩১টি পৌরসভার ১৪টিতে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট। এগুলোসহ ২০৭টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ গড়ে ৫৩.৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর ২০৪টি পৌরসভায় বিএনপির পাওয়া ভোটের গড় হাড় ২৭.৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২৮টি পৌরসভায় বিএনপি পেয়েছে ১০ শতাংশেরও কম ভোট। নির্বাচন বিশ্লেষকেরা এ ফলকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করছেন। এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাওয়া ভোটের পরিসংখ্যান অতীতের পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করে কমিশন সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই নির্বাচনের এই ফলকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করছেন। ২০০৮ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পেয়েছিল যথাক্রমে ৪৮.০৪ ও ৩২.৫০ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালের বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭২.৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। বিএনপি ইতোমধ্যে এবারের পৌরসভার নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তথ্য-উপাত্তই বলে দিচ্ছে এ নির্বাচনে ভোটের দিন বাস্তবে কী ঘটেছে। বিশেষ বিশেষ পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী যে ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
যে ১৪টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছে, সেগুলো হলো : সন্দ্বীপ ৯৭.৮১ শতাংশ, কাজিপুর ৯৬.৮২, গফরগাঁও ৯৫.৫৭, বারইয়ারহাট ৯৫.৫১, মিরসরাই ৯৩.৪৮, রাউজান ৯০.৩৫, গৌরনদী ৯৪.৮০, মুলাদি ৯০.২৭, বানারীপাড়া ৯০.৪৬, রায়পুর ৯২.৭২, নলছিটি ৯১.৬৫, ভোলা ৯০.০০, বোরহানউদ্দিন ৯০.৪০ ও দৌলতখান ৯১.১৩ শতাংশ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এ ধরনের তথ্য প্রমাণ করে এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ ৯০ শতাংশের বেশি আর বিএনপি ৬ শতাংশেরও কম ভোট পাবে, এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা ৮০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছেন মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, চান্দিনা, দাউদকান্দি, দাগনভূঞা, দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর, রামগঞ্জ, রামগতি, মুন্সীগঞ্জ, কলাপাড়া, স্বরূপকাঠি, পাংশা, গোপালপুর ও মাধবপুরে।
ভোটের এ পরিসংখ্যান সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি বলেন, তারা এখনো সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেননি। বিশ্লেষণের পর এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে। নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজও একই ধরনের কথা বলেন।
বিএনপি ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়েছে মাত্র পাঁচটি পৌরসভায় : বগুড়ার গাবতলী, দিনাজপুর, শ্রীপুর, সৈয়দপুর ও পঞ্চগড়ে। বিএনপির প্রার্থীরা ২৪টি পৌরসভায় ভোট পেয়েছেন এক হাজারেরও কম। ১১টি পৌরসভায় বিএনপির ভোট পাঁচ শ’রও কম। ১০ শতাংশের চেয়ে কম ভোট পেয়েছে বিএনপি এমন পৌরসভার মধ্যে আছে : কেশবহাট ০.৯০, কাজিপুর ১.০৪, চৌদ্দগ্রাম ১.৬৮, গোয়ালন্দ ১.৮৮, জাজিরা ১.৯০, সন্দ্বীপ ২.১০, হাতিয়া ২.১৯, কালিয়া ২.৯২ ও করিমগঞ্জ ২.৯৭।
এ তো গেল এবারের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ। এর বাইরে নির্বাচনের দৃশ্যমান চিত্র কেমন ছিল, তা-ও দেশের মানুষ কিঞ্চিত জানতে পারে দেশের মুদ্রণ ও গণমাধ্যম সূত্রে। মোটা দাগের অভিযোগের মধ্যে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের লোকেরা প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লোকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কেন্দ্র দখল করে একতরফাভাবে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোটবাক্স ভর্তি করেছে। ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ছিনতাই করেছে। প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে, এ নিয়ে কেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলেছে। এতে আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এসব কাজে সরকারি দলের প্রার্থীর সমর্থকদের কোথাও সক্রিয় আবার কোথাও নিষ্ক্রিয় সমর্থন দিয়েছে। অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেননি কিংবা কেন্দ্রে যেতে পর্যন্ত পারেননি। নানা অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার কারণে নির্বাচন কমিশন ২০টি পৌরসভায় নির্বাচনের ফল পর্যন্ত ঘোষণা করতে পারেনি। এসব পৌরসভায় ভোটগ্রহণ কিংবা ফলাফল ঘোষণা স্থগিত করতে হয়েছে। এসব কিছুর পর সরকারি দলের মুখপাত্ররা যখন বলেন ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে এবং সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনও যদি বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তবে এটুকু নিশ্চিত বলে দেয়া যায়, এ সরকারের অধীনে এবং এই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে আর যাই হোক, সুষ্ঠু, অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়।
সরকারের বাইরে যারা আছেন, এরা সবাই বলছেন এ কথাটিই। কিন্তু সরকারপক্ষ বলছে, আগামী সব নির্বাচন হতে হবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও এর পরবর্তী প্রতিটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে না পারাÑ এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, সরকারপক্ষ এই সঙ্কটের বিষয়টিকেই অস্বীকার করে চলেছে বরাবর। সরকার বলছে, দেশে কোনো সঙ্কট নেই, অথচ বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসলে সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দেশ থেকে গণতন্ত্রকে বিদায় করে চলেছে। এ জন্য সরকারপক্ষ অবলম্বন করেছে প্রতিহিংসার রাজনীতি।
এই বাস্তবতার প্রতি স্বীকৃতি জানিয়েই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় কন্যা শেখ রেহানার স্বামী অধ্যাপক ড. শফিক সিদ্দিকী গত ৫ জানুয়ারি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনে স্পষ্ট করেই বলেছেন- প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে দেশ-সমাজকে পরিশুদ্ধ করা দরকার। দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. সিদ্দিকী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিও জানান। এর অর্থ তিনি মনে করেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। তিনি বলেছেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে দেশ ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করা দরকার। কারণ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শিল্প-সংস্কৃতির দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো- ‘বলতে খারাপ লাগে, আমাদের রাজনীতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা অপজিশন সহ্য করতে পারি না। অপজিশনে থাকলে টেনে নামাব। আমি অনুভব করি, আমাদের সবচেয়ে প্রথম দরকার নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ হওয়া। নির্বাচন কমিশন হবে ভারতের মতো শক্তিশালী। সে নির্বাচন কমিশনকে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই মেনে নেবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন দরকার। আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করব, রাস্তায় মারামারি না করে বরং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করুন। এখন দরকার ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি তেমন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে।’ ড. সিদ্দিকীর অভিমত আমরা সমর্থন করি, তবে আমাদের প্রথম কাজ হবে বর্তমান ‘মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন’কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাড়ানো। তোতাপাখির মতো সরকারপক্ষের লিপ সার্ভিস দিয়ে চলা এ নির্বাচন কমিশন ড. সিদ্দিকীর প্রত্যাশিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই নয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত বিরোধী দলবিহীন একটি সংসদ বাংলাদেশে বিরাজ করছে বলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা দাবি করছেন। বিরোধী রাজনৈতিক মহলে সরকারকে অগণতান্ত্রিক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারপক্ষ বলছে এর উল্টোটি- সরকার গণতান্ত্রিকভাবেই দেশ শাসন করছে। যা কিছু করা হচ্ছে, সবই করা হচ্ছে সাংবিধান অনুযায়ী। এতে বলা যায়, সরকারের অবস্থান ও বিরোধী মহলের অবস্থান পরস্পর দুই বিপরীত মেরুতে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
দলকানারা ছাড়া সবাই মনে করেন, সরকারপক্ষের এ দাবির পেছনে যৌক্তিকতা নেই। সরকার যদি গণতান্ত্রিক সড়ক ধরে হাঁটত, তবে আমাদের আজ কার্যত বিরোধী দলবিহীন সংসদ দেশে নানা বিতর্ক নিয়ে বিরাজ করত না। ৫ জানুয়ারির মতো ভোটারবিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এমন একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হতো না, যা একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোনো দেশের কাছেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। সে নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় কোন দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কারণ, এ নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ৫ জানুয়ারির পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্রও কারো জন্য সুখকর ছিল না। যেমনটি সুখকর নয় সদ্যসমাপ্ত পৌর নির্বাচনটিও।
সরকারের অংশ এবং একই সাথে বিরোধী দল, এমন অদ্ভুত দল হচ্ছে আমাদের জাতীয় পার্টি। সরকারের অংশ হয়েও জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের নিজে মনে করেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কার্যত বিরোধীদলবিহীন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, যদিও গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিরোধী দলের নামকরণ করা হয়েছে, তবুও এ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সরকারের কোনো প্রস্তাবে না ভোট দেয়নি। এটাকে একদলীয় সংসদ বলা যায়। জাতীয় পার্টি চাপের মুখে এ অবস্থানে এসেছে উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, এ সরকার তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়েছে। তার ভাষায়, বর্তমানে বাংলাদশে গণতন্ত্র নেই। একটার পর একটা নির্বাচন খারাপ হচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট সঙ্কুচিত করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এটা তো নিশ্চিতভাবেই স্বৈরশাসন। অপর দিকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, অবিলম্বে সরকার থেকে জাতীয় পার্টির বের হয়ে আসা উচিত। দলের প্রধান জেনারেল এরশাদও মাঝে মধ্যে বলছেন, জাতীয় পার্টি সরকার থেকে শিগগিরই বের হয়ে আসবে। কিন্তু এক অদৃশ্য সুতোর টানে তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না বা করছেন না। সে যাই হোক, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছিল। যদিও এখন দলটি বলছে, ২০১৯ সালের আগে জাতীয় নির্বাচন নয়। এ প্রসঙ্গে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, সরকার এটি বলেছিল। ১৬ কোটি মানুষ আমাদের, কিন্তু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য আছে। এখানে কেউ অন্য কিছু চায় না। কার্যকর গণতন্ত্র চায়। ড. হোসেন বলেন, পাকিস্তান আমল কিংবা বাংলাদেশ আমলে যখনই বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে, তখন কিন্তু নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আজকে একটা কথা বলা হচ্ছে, উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে সংবিধানের মূলনীতি বাদ দিয়ে তো উন্নয়ন হবে না। সংবিধানের মূলনীতির মধ্যেই আছে গণতন্ত্র।
সরকার যদি বাস্তবতা মেনে নেয়, তবে স্বীকার করতেই হবে দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়ক থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এর ফলে এখন চলছে শুধু প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিহিংসা জন্ম দেবে নতুন নতুন মাত্রার প্রতিহিংসা। তাই অসহিষ্ণু রাজনীতির পথ ছেড়ে, দমনপীড়নের পথ ছেড়ে ফিরে আসতে হবে সহনশীল তথা সহিষ্ণু রাজনীতির সড়কে। অথচ এ ক্ষেত্রে ড. সিদ্দিকীর সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমাদের এখনই দরকার ‘অ্যা ফেয়ার অ্যান্ড ফ্রি ইলেকশন’। সেই সাথে প্রয়োজন মেরুদণ্ডসর্বস্ব নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের সড়কে ফিরে আসার সুযোগ করে দিতে পারে।
আওয়ামী লীগ যেখানে বিজয়ী হয়েছে ১৬৮টি মেয়র পদে, সেখানে বিএনপি পাবে ১৯টি- এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে এটি কী ধরনের নির্বাচন হয়েছে। অনেকের মন্তব্য, রীতিমতো ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে লজ্জার মুখে ফেলে দিয়েছে। তবুও তৃপ্তির ঢেঁকুর সরকারি দলের নেতানেত্রী ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মুখে। নির্বাচন কমিশন বলেছে- এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কমিশনের কাছে প্রশ্ন করতে হয়- নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠুই হয়ে থাকে, তবে কেন ২০টি পৌরসভার নির্বাচনী ফল বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে কমিশন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হলো। অপর দিকে সরকারি দলের নেতাদের এককথা- এ নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সরকারি দলের ঘোর সমর্থক এক বুদ্ধিজীবী তো রীতিমতো তত্ত্বই দিয়ে বসেছেন- বেগম জিয়া মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় এ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির ভোট ব্যাপকভাবে কমে গেছে। কী সহজ তত্ত্বায়ন! এসব শুনে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই থাকে না।
আমরা যদি একটু গভীরভাবে আলোচ্য পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে যাই, তবে আমাদের বিস্ময়ের মাত্রাটাই আরো শতভাগ বেড়ে যাবে। সহযোগী দৈনিক প্রথম আলো গত ৬ জানুয়ারি পৌর নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যারা এ প্রতিবেদনটি পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এবারের পৌর নির্বাচনের আসল চেহারা নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন। এই ফলাফল বিশ্লেষণ এতটাই সরল যে, এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুধাবনের জন্য তেমন কোনো বিদ্যাবুদ্ধি, মেধা-মননের প্রয়োজন হবে না। সাধারণজনও তা সহজেই বোধে নিতে পারবেন।
উল্লিখিত প্রতিবেদন মতে- ভোট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ৩১টি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। আর বিএনপি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কম ভোট পেয়েছে। উল্লিখিত ৩১টি পৌরসভার ১৪টিতে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট। এগুলোসহ ২০৭টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ গড়ে ৫৩.৫৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর ২০৪টি পৌরসভায় বিএনপির পাওয়া ভোটের গড় হাড় ২৭.৬৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২৮টি পৌরসভায় বিএনপি পেয়েছে ১০ শতাংশেরও কম ভোট। নির্বাচন বিশ্লেষকেরা এ ফলকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করছেন। এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাওয়া ভোটের পরিসংখ্যান অতীতের পরিসংখ্যানের সাথে তুলনা করে কমিশন সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই নির্বাচনের এই ফলকে অবিশ্বাস্য বলে মনে করছেন। ২০০৮ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পেয়েছিল যথাক্রমে ৪৮.০৪ ও ৩২.৫০ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালের বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৭২.৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। বিএনপি ইতোমধ্যে এবারের পৌরসভার নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তথ্য-উপাত্তই বলে দিচ্ছে এ নির্বাচনে ভোটের দিন বাস্তবে কী ঘটেছে। বিশেষ বিশেষ পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী যে ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন, তা বিশ্বাস করা কঠিন।
যে ১৪টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছে, সেগুলো হলো : সন্দ্বীপ ৯৭.৮১ শতাংশ, কাজিপুর ৯৬.৮২, গফরগাঁও ৯৫.৫৭, বারইয়ারহাট ৯৫.৫১, মিরসরাই ৯৩.৪৮, রাউজান ৯০.৩৫, গৌরনদী ৯৪.৮০, মুলাদি ৯০.২৭, বানারীপাড়া ৯০.৪৬, রায়পুর ৯২.৭২, নলছিটি ৯১.৬৫, ভোলা ৯০.০০, বোরহানউদ্দিন ৯০.৪০ ও দৌলতখান ৯১.১৩ শতাংশ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, এ ধরনের তথ্য প্রমাণ করে এ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ ৯০ শতাংশের বেশি আর বিএনপি ৬ শতাংশেরও কম ভোট পাবে, এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা ৮০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি ভোট পেয়েছেন মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, রাঙ্গুনিয়া, সাতকানিয়া, চান্দিনা, দাউদকান্দি, দাগনভূঞা, দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর, রামগঞ্জ, রামগতি, মুন্সীগঞ্জ, কলাপাড়া, স্বরূপকাঠি, পাংশা, গোপালপুর ও মাধবপুরে।
ভোটের এ পরিসংখ্যান সম্পর্কে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি বলেন, তারা এখনো সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেননি। বিশ্লেষণের পর এ ব্যাপারে মন্তব্য করা যাবে। নির্বাচন কমিশনার মো: শাহনেওয়াজও একই ধরনের কথা বলেন।
বিএনপি ৫০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়েছে মাত্র পাঁচটি পৌরসভায় : বগুড়ার গাবতলী, দিনাজপুর, শ্রীপুর, সৈয়দপুর ও পঞ্চগড়ে। বিএনপির প্রার্থীরা ২৪টি পৌরসভায় ভোট পেয়েছেন এক হাজারেরও কম। ১১টি পৌরসভায় বিএনপির ভোট পাঁচ শ’রও কম। ১০ শতাংশের চেয়ে কম ভোট পেয়েছে বিএনপি এমন পৌরসভার মধ্যে আছে : কেশবহাট ০.৯০, কাজিপুর ১.০৪, চৌদ্দগ্রাম ১.৬৮, গোয়ালন্দ ১.৮৮, জাজিরা ১.৯০, সন্দ্বীপ ২.১০, হাতিয়া ২.১৯, কালিয়া ২.৯২ ও করিমগঞ্জ ২.৯৭।
এ তো গেল এবারের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ। এর বাইরে নির্বাচনের দৃশ্যমান চিত্র কেমন ছিল, তা-ও দেশের মানুষ কিঞ্চিত জানতে পারে দেশের মুদ্রণ ও গণমাধ্যম সূত্রে। মোটা দাগের অভিযোগের মধ্যে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের লোকেরা প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লোকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কেন্দ্র দখল করে একতরফাভাবে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোটবাক্স ভর্তি করেছে। ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার ছিনতাই করেছে। প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে, এ নিয়ে কেন্দ্রের বাইরে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলেছে। এতে আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন এসব কাজে সরকারি দলের প্রার্থীর সমর্থকদের কোথাও সক্রিয় আবার কোথাও নিষ্ক্রিয় সমর্থন দিয়েছে। অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেননি কিংবা কেন্দ্রে যেতে পর্যন্ত পারেননি। নানা অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার কারণে নির্বাচন কমিশন ২০টি পৌরসভায় নির্বাচনের ফল পর্যন্ত ঘোষণা করতে পারেনি। এসব পৌরসভায় ভোটগ্রহণ কিংবা ফলাফল ঘোষণা স্থগিত করতে হয়েছে। এসব কিছুর পর সরকারি দলের মুখপাত্ররা যখন বলেন ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে এবং সরকারের সাথে সুর মিলিয়ে নির্বাচন কমিশনও যদি বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, তবে এটুকু নিশ্চিত বলে দেয়া যায়, এ সরকারের অধীনে এবং এই নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে আর যাই হোক, সুষ্ঠু, অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়।
সরকারের বাইরে যারা আছেন, এরা সবাই বলছেন এ কথাটিই। কিন্তু সরকারপক্ষ বলছে, আগামী সব নির্বাচন হতে হবে শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান এবং ৫ জানুয়ারির অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও এর পরবর্তী প্রতিটি স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে না পারাÑ এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, সরকারপক্ষ এই সঙ্কটের বিষয়টিকেই অস্বীকার করে চলেছে বরাবর। সরকার বলছে, দেশে কোনো সঙ্কট নেই, অথচ বাস্তবতা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আসলে সরকার উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দেশ থেকে গণতন্ত্রকে বিদায় করে চলেছে। এ জন্য সরকারপক্ষ অবলম্বন করেছে প্রতিহিংসার রাজনীতি।
এই বাস্তবতার প্রতি স্বীকৃতি জানিয়েই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় কন্যা শেখ রেহানার স্বামী অধ্যাপক ড. শফিক সিদ্দিকী গত ৫ জানুয়ারি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনে স্পষ্ট করেই বলেছেন- প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে দেশ-সমাজকে পরিশুদ্ধ করা দরকার। দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ড. সিদ্দিকী নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবিও জানান। এর অর্থ তিনি মনে করেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নয়। তিনি বলেছেন, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে দেশ ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করা দরকার। কারণ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শিল্প-সংস্কৃতির দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো- ‘বলতে খারাপ লাগে, আমাদের রাজনীতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা অপজিশন সহ্য করতে পারি না। অপজিশনে থাকলে টেনে নামাব। আমি অনুভব করি, আমাদের সবচেয়ে প্রথম দরকার নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ হওয়া। নির্বাচন কমিশন হবে ভারতের মতো শক্তিশালী। সে নির্বাচন কমিশনকে সরকারি ও বিরোধী উভয় দলই মেনে নেবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন দরকার। আমি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুরোধ করব, রাস্তায় মারামারি না করে বরং নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করুন। এখন দরকার ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু আমরা পারিনি তেমন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে।’ ড. সিদ্দিকীর অভিমত আমরা সমর্থন করি, তবে আমাদের প্রথম কাজ হবে বর্তমান ‘মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন’কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাড়ানো। তোতাপাখির মতো সরকারপক্ষের লিপ সার্ভিস দিয়ে চলা এ নির্বাচন কমিশন ড. সিদ্দিকীর প্রত্যাশিত নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিশ্চয়ই নয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে কার্যত বিরোধী দলবিহীন একটি সংসদ বাংলাদেশে বিরাজ করছে বলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা দাবি করছেন। বিরোধী রাজনৈতিক মহলে সরকারকে অগণতান্ত্রিক হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারপক্ষ বলছে এর উল্টোটি- সরকার গণতান্ত্রিকভাবেই দেশ শাসন করছে। যা কিছু করা হচ্ছে, সবই করা হচ্ছে সাংবিধান অনুযায়ী। এতে বলা যায়, সরকারের অবস্থান ও বিরোধী মহলের অবস্থান পরস্পর দুই বিপরীত মেরুতে। তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
দলকানারা ছাড়া সবাই মনে করেন, সরকারপক্ষের এ দাবির পেছনে যৌক্তিকতা নেই। সরকার যদি গণতান্ত্রিক সড়ক ধরে হাঁটত, তবে আমাদের আজ কার্যত বিরোধী দলবিহীন সংসদ দেশে নানা বিতর্ক নিয়ে বিরাজ করত না। ৫ জানুয়ারির মতো ভোটারবিহীন প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এমন একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হতো না, যা একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোনো দেশের কাছেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়নি। সে নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় কোন দল সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। কারণ, এ নির্বাচনের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থীরাই বিজয়ী হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ৫ জানুয়ারির পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্রও কারো জন্য সুখকর ছিল না। যেমনটি সুখকর নয় সদ্যসমাপ্ত পৌর নির্বাচনটিও।
সরকারের অংশ এবং একই সাথে বিরোধী দল, এমন অদ্ভুত দল হচ্ছে আমাদের জাতীয় পার্টি। সরকারের অংশ হয়েও জাতীয় পার্টির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদের নিজে মনে করেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কার্যত বিরোধীদলবিহীন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, যদিও গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে বিরোধী দলের নামকরণ করা হয়েছে, তবুও এ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি সরকারের কোনো প্রস্তাবে না ভোট দেয়নি। এটাকে একদলীয় সংসদ বলা যায়। জাতীয় পার্টি চাপের মুখে এ অবস্থানে এসেছে উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, এ সরকার তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারিয়েছে। তার ভাষায়, বর্তমানে বাংলাদশে গণতন্ত্র নেই। একটার পর একটা নির্বাচন খারাপ হচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যথেষ্ট সঙ্কুচিত করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এটা তো নিশ্চিতভাবেই স্বৈরশাসন। অপর দিকে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, অবিলম্বে সরকার থেকে জাতীয় পার্টির বের হয়ে আসা উচিত। দলের প্রধান জেনারেল এরশাদও মাঝে মধ্যে বলছেন, জাতীয় পার্টি সরকার থেকে শিগগিরই বের হয়ে আসবে। কিন্তু এক অদৃশ্য সুতোর টানে তিনি তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না বা করছেন না। সে যাই হোক, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার কথা বলেছিল। যদিও এখন দলটি বলছে, ২০১৯ সালের আগে জাতীয় নির্বাচন নয়। এ প্রসঙ্গে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, সরকার এটি বলেছিল। ১৬ কোটি মানুষ আমাদের, কিন্তু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য আছে। এখানে কেউ অন্য কিছু চায় না। কার্যকর গণতন্ত্র চায়। ড. হোসেন বলেন, পাকিস্তান আমল কিংবা বাংলাদেশ আমলে যখনই বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে, তখন কিন্তু নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব। আজকে একটা কথা বলা হচ্ছে, উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। তাই বলে সংবিধানের মূলনীতি বাদ দিয়ে তো উন্নয়ন হবে না। সংবিধানের মূলনীতির মধ্যেই আছে গণতন্ত্র।
সরকার যদি বাস্তবতা মেনে নেয়, তবে স্বীকার করতেই হবে দেশ গণতন্ত্রের মহাসড়ক থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এর ফলে এখন চলছে শুধু প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন। এভাবে চলতে থাকলে প্রতিহিংসা জন্ম দেবে নতুন নতুন মাত্রার প্রতিহিংসা। তাই অসহিষ্ণু রাজনীতির পথ ছেড়ে, দমনপীড়নের পথ ছেড়ে ফিরে আসতে হবে সহনশীল তথা সহিষ্ণু রাজনীতির সড়কে। অথচ এ ক্ষেত্রে ড. সিদ্দিকীর সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, আমাদের এখনই দরকার ‘অ্যা ফেয়ার অ্যান্ড ফ্রি ইলেকশন’। সেই সাথে প্রয়োজন মেরুদণ্ডসর্বস্ব নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আমাদের গণতন্ত্রের সড়কে ফিরে আসার সুযোগ করে দিতে পারে।
No comments