মধ্যপ্রাচ্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বে by আশরাফ হায়দার চৌধুরী
ফ্রান্সের
রাজধানী প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা আর তুরস্কের আকাশে রুশ যুদ্ধবিমান
ভূপাতিত করার ঘটনার পর গোটা বিশ্ব যেন হঠাৎ করে যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছে।
প্যারিসে হামলার জন্য ফ্রান্স আইএসকে দায়ী করে এই ঘটনাকে তাদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য বলে মন্তব্য করেছে। অন্য দিকে তুরস্ক কর্তৃক রুশ
যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার ঘটনাকে রাশিয়া তাদের পিঠে ছুরিকাঘাত করার সমতুল্য
বলে মন্তব্য করেছে। এই ঘটনার বদলা নিতে রাশিয়া তুরস্কে পারমাণবিক হামলা
চালাতে প্রস্তুত বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির শীর্ষপর্যায়ের রাজনীতিবিদ
ভøাদিমির ঝিরিনোভস্কি। প্রয়োজনে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরকে নিশ্চিহ্ন করে
দেয়ার জন্য তিনি পুতিনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জবাবে রাশিয়াকে ‘আগুন
নিয়ে না খেলার’ পরামর্শ দিয়েছে তুরস্ক। রাশিয়ার ডানপন্থী দল লিবারেল
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ঝিরিনোভস্কি এই
মুহূর্তে তুরস্ককে রাশিয়ার এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন,
পারমাণবিক হামলা চালিয়ে খুব সহজেই ইস্তাম্বুল নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যাবে। তার
মতে, ইস্তাম্বুল প্রণালীতে একটি পারমাণবিক বোমা ফেললেই এমন বন্যার সৃষ্টি
হবে, যাতে ৯০ লাখ মানুষের শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। ঝিরিনোভস্কি এমন এক
সময়ে এ কথা বললেন, যখন দুই দেশের মধ্যে তুমুল বাগযুদ্ধ চলছে।
রাশিয়ার এতটা ‘অগ্নিশর্মা’ হওয়ার কারণ, এর আগে তাদের জঙ্গি বিমানগুলো বহুবার ন্যাটো দেশগুলোর আকাশসীমা লঙ্ঘন করলেও কেউ সেগুলো ভূপাতিত করার সাহস দেখায়নি। তুরস্কই প্রথম এমনটা করল। এখন রাশিয়ার ‘রক্তচক্ষু’ দেখে ন্যাটোকে জরুরি বৈঠক ডাকতে বলেছে তুরস্ক। ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল স্টোলেনবার্গ তুরস্ককে আশ্বস্ত করে বলেছেন, জোটের সব ক’টি দেশই তাদের পাশে আছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু দিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব। এতে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। আর এই অবস্থা খুব শিগগিরই স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না; বরং আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই মূলত পৃথিবী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, অন্য পক্ষে রাশিয়া। ৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বের একমাত্র ‘মোড়ল’ বনে যায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায় আবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে সিরিয়াকে ঘিরে এখন বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যাদের সাথে আছে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটো জোট। অন্য দিকে রাশিয়া, ইরান। আরেক পরাশক্তি চীন এখন পর্যন্ত মধ্যপন্থায় আছে। তবে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, তাতে চীনের পক্ষে বেশি দিন মধ্যপন্থায় অবস্থান করা সম্ভব হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে তুরস্কের আকাশে রুশ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার ঘটনা বিশ্বকে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে অনেকে মন্তব্য করা শুরু করেছেন। মূলত সিরিয়ায় আইএস দমনের নামে সেখানে একযোগে হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়া। এই হামলায় কোনো সমন্বয় নেই। ন্যাটো জোটভুক্তরা চাইছে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন। অন্য দিকে রাশিয়া ও ইরান কাজ করছে আসাদ সরকারের পক্ষে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা আইএস দমনের নামে আসাদ সরকারের বিরোধীদের ওপর বোমা ফেলছে। তবে যে পক্ষ যেখানেই বোমা ফেলুক হামলার সময় কিন্তু উভয় পক্ষের যুদ্ধ বিমানগুলোই কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা আর মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ওই ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর রেশ কিন্তু ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে।
তুরস্কে রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার চার দিনের মাথায় গত শনিবার (২৮ নভেম্বর) তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট পুতিন ইতোমধ্যে এসংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেছেন। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে তুরস্কের পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে তুরস্কে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৩০ লাখের বেশি ছিল রুশ পর্যটক।
দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে চলতে থাকা তীব্র টানাপড়েনের মধ্যে প্যারিসে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে দুই নেতার মুখোমুখি হওয়ার কথা। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, বিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় তুরস্ক ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তিনি এরদোগানের সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না। অন্য দিকে রাশিয়ার ক্ষমা চাওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, ‘ওই ঘটনায় তিনি ব্যথিত। এমনটা না ঘটলেই ভালো হতো।’
সন্ত্রাসবাদের বিস্তারে, অর্থনৈতিক মন্দা আর শরণার্থীর স্রোতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অবস্থা এখন এমনিতেই নাজুক। তার ওপর যদি নতুন করে যুদ্ধে জড়াতে হয় তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
তবে রুশ বিমান ধ্বংস করা এবং প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরিণাম যে বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা, শরণার্থী সঙ্কট, সীমানাবিহীন ইউরোপ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নÑ এসব প্রতিটি ক্ষেত্রেই ওই ঘটনাগুলোর প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলায় হিমসিম খাচ্ছে ইউরোপ। এই অবস্থায় প্যারিসে হামলার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে। শরণার্থীদের সাথে ‘আইএস জঙ্গীরা’ ইউরোপে প্রবেশ করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা শুরু করেছেন। প্যারিস হামলার পর ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন খাত। এ ছাড়া বড়দিনকে সামনে রেখে বিভিন্ন পণ্যের বাজারে মন্দাভাব দেখা দিতে পারে। আর সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলার জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব তো অর্থনীতিতে অবশ্যই পড়বে।
প্যারিসে হামলায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘নির্দয় যুদ্ধ’ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদ। টুইন টাওয়ারে হামলার পরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারপরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধের নামে ইরাক ও আফগানিস্তানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে তারা। কিন্তু এর বিনিময়ে কী পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ের মিত্ররাই আজ বলছেÑ ইরাকে অভিযান চালানো ভুল ছিল, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধই সন্ত্রাসকে উসকে দিয়েছে, আইএসের উত্থানের জন্য দায়ী ইরাক অভিযানÑ ইত্যাদি ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট একজন প্রার্থী বার্নি সেন্ডার্স বলেছেন, আইএসের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। ইরাকে আগ্রাসী হামলার ফলেই আলকায়েদা ও আইএসের সৃষ্টি হয়েছে।
এখন প্যারিসে হামলার বদলা নিতে ফ্রান্স যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো মাথা গরম করে আইএস নির্মূল অভিযানে নামে, তাহলে এর পরিণতি কী হবে তা ভেবে দেখতে হবে। ফ্রান্স ইতোমধ্যে আইএসকে বিনাশ করতে ‘বৈশ্বিক মহাজোট’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনও একই কথা বলেছে। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সকে সব ধরনের সহায়তা দিতে নিজেদের নৌবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে রাশিয়া। আর এ লড়াইয়ে সর্বাত্মক সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে ইইউ। অর্থাৎ আইএস ও আলকায়েদার বিরুদ্ধে এবার আটঘাট বেঁধেই নামবে ইউরোপ। কিন্তু এতে কি বন্ধ হবে সন্ত্রাস? বিশ্বে কি শান্তি আসবে? পরাশক্তিগুলোকে বুঝতে হবে, আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা যেমন অপরাধ, তেমনি ড্রোন হামলা চালিয়ে বাছবিচারহীন হত্যাও নিকৃষ্ট অপরাধ। প্রতিশোধ আর জিঘাংসা নতুন জিঘাংসা আর নৃশংসতার জন্ম দেয়। যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধ থামানো যায় না।
রাশিয়ার এতটা ‘অগ্নিশর্মা’ হওয়ার কারণ, এর আগে তাদের জঙ্গি বিমানগুলো বহুবার ন্যাটো দেশগুলোর আকাশসীমা লঙ্ঘন করলেও কেউ সেগুলো ভূপাতিত করার সাহস দেখায়নি। তুরস্কই প্রথম এমনটা করল। এখন রাশিয়ার ‘রক্তচক্ষু’ দেখে ন্যাটোকে জরুরি বৈঠক ডাকতে বলেছে তুরস্ক। ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল স্টোলেনবার্গ তুরস্ককে আশ্বস্ত করে বলেছেন, জোটের সব ক’টি দেশই তাদের পাশে আছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু দিন ধরেই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব। এতে মধ্যপ্রাচ্যের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। আর এই অবস্থা খুব শিগগিরই স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না; বরং আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলেই মনে হচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই মূলত পৃথিবী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, অন্য পক্ষে রাশিয়া। ৯০ দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর বিশ্বের একমাত্র ‘মোড়ল’ বনে যায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনায় আবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা এই অবস্থার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে সিরিয়াকে ঘিরে এখন বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক ভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যাদের সাথে আছে ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ ন্যাটো জোট। অন্য দিকে রাশিয়া, ইরান। আরেক পরাশক্তি চীন এখন পর্যন্ত মধ্যপন্থায় আছে। তবে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, তাতে চীনের পক্ষে বেশি দিন মধ্যপন্থায় অবস্থান করা সম্ভব হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে তুরস্কের আকাশে রুশ যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার ঘটনা বিশ্বকে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের’ দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে অনেকে মন্তব্য করা শুরু করেছেন। মূলত সিরিয়ায় আইএস দমনের নামে সেখানে একযোগে হামলা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও রাশিয়া। এই হামলায় কোনো সমন্বয় নেই। ন্যাটো জোটভুক্তরা চাইছে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন। অন্য দিকে রাশিয়া ও ইরান কাজ করছে আসাদ সরকারের পক্ষে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা আইএস দমনের নামে আসাদ সরকারের বিরোধীদের ওপর বোমা ফেলছে। তবে যে পক্ষ যেখানেই বোমা ফেলুক হামলার সময় কিন্তু উভয় পক্ষের যুদ্ধ বিমানগুলোই কাছাকাছি এসে যাচ্ছে। এতে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা আর মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে ওই ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর রেশ কিন্তু ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে।
তুরস্কে রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়ার চার দিনের মাথায় গত শনিবার (২৮ নভেম্বর) তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট পুতিন ইতোমধ্যে এসংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করেছেন। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত তুরস্কের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে তুরস্কের পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে তুরস্কে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৩০ লাখের বেশি ছিল রুশ পর্যটক।
দুই দেশের মধ্যে বর্তমানে চলতে থাকা তীব্র টানাপড়েনের মধ্যে প্যারিসে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে দুই নেতার মুখোমুখি হওয়ার কথা। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, বিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় তুরস্ক ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত তিনি এরদোগানের সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না। অন্য দিকে রাশিয়ার ক্ষমা চাওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেব এরদোগান বলেছেন, ‘ওই ঘটনায় তিনি ব্যথিত। এমনটা না ঘটলেই ভালো হতো।’
সন্ত্রাসবাদের বিস্তারে, অর্থনৈতিক মন্দা আর শরণার্থীর স্রোতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অবস্থা এখন এমনিতেই নাজুক। তার ওপর যদি নতুন করে যুদ্ধে জড়াতে হয় তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।
তবে রুশ বিমান ধ্বংস করা এবং প্যারিসে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পরিণাম যে বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা, শরণার্থী সঙ্কট, সীমানাবিহীন ইউরোপ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নÑ এসব প্রতিটি ক্ষেত্রেই ওই ঘটনাগুলোর প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কট মোকাবেলায় হিমসিম খাচ্ছে ইউরোপ। এই অবস্থায় প্যারিসে হামলার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলবে। শরণার্থীদের সাথে ‘আইএস জঙ্গীরা’ ইউরোপে প্রবেশ করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা শুরু করেছেন। প্যারিস হামলার পর ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পর্যটন খাত। এ ছাড়া বড়দিনকে সামনে রেখে বিভিন্ন পণ্যের বাজারে মন্দাভাব দেখা দিতে পারে। আর সন্ত্রাসী হামলা মোকাবেলার জন্য সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির প্রভাব তো অর্থনীতিতে অবশ্যই পড়বে।
প্যারিসে হামলায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ‘নির্দয় যুদ্ধ’ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাদ। টুইন টাওয়ারে হামলার পরও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারপরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুদ্ধের নামে ইরাক ও আফগানিস্তানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে তারা। কিন্তু এর বিনিময়ে কী পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে সময়ের মিত্ররাই আজ বলছেÑ ইরাকে অভিযান চালানো ভুল ছিল, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধই সন্ত্রাসকে উসকে দিয়েছে, আইএসের উত্থানের জন্য দায়ী ইরাক অভিযানÑ ইত্যাদি ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট একজন প্রার্থী বার্নি সেন্ডার্স বলেছেন, আইএসের উত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত আছে। ইরাকে আগ্রাসী হামলার ফলেই আলকায়েদা ও আইএসের সৃষ্টি হয়েছে।
এখন প্যারিসে হামলার বদলা নিতে ফ্রান্স যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো মাথা গরম করে আইএস নির্মূল অভিযানে নামে, তাহলে এর পরিণতি কী হবে তা ভেবে দেখতে হবে। ফ্রান্স ইতোমধ্যে আইএসকে বিনাশ করতে ‘বৈশ্বিক মহাজোট’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনও একই কথা বলেছে। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্সকে সব ধরনের সহায়তা দিতে নিজেদের নৌবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে রাশিয়া। আর এ লড়াইয়ে সর্বাত্মক সামরিক সহযোগিতার বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে ইইউ। অর্থাৎ আইএস ও আলকায়েদার বিরুদ্ধে এবার আটঘাট বেঁধেই নামবে ইউরোপ। কিন্তু এতে কি বন্ধ হবে সন্ত্রাস? বিশ্বে কি শান্তি আসবে? পরাশক্তিগুলোকে বুঝতে হবে, আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা যেমন অপরাধ, তেমনি ড্রোন হামলা চালিয়ে বাছবিচারহীন হত্যাও নিকৃষ্ট অপরাধ। প্রতিশোধ আর জিঘাংসা নতুন জিঘাংসা আর নৃশংসতার জন্ম দেয়। যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধ থামানো যায় না।
No comments