সন্ত্রাসবাদের পাল্টা আঘাত বন্ধ করতে হবে by জেফরি ডি স্যাকস
এই যে বেসামরিক মানুষের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হচ্ছে, তা সে সিনাই উপদ্বীপে রুশ বিমান ভূপাতিত করে ২২৪ জন বেসামরিক নাগরিক, প্যারিস হামলায় ১৩০ জন নির্দোষ মানুষ বা আঙ্কারায় বোমা মেরে ১০২ জন শান্তিকর্মীকে হত্যা করা হোক—এ সবই আসলে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হন্তারকের ভূমিকা পালন করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস), তাদের থামাতে হবে। তবে এই লড়াইয়ে সফল হতে হলে জিহাদিদের এই নির্মম নেটওয়ার্কের মূল সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার জ্ঞান থাকতে হবে। যে পরিস্থিতিতে ইসলামিক স্টেটের বিকাশ ঘটছে, তা সৃষ্টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট অবদান রয়েছে, কথাটা স্বীকার করা বেদনাদায়ক হলেও সত্য। মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক মার্কিন ও ইউরোপীয় নীতিতে পরিবর্তন এলেই কেবল সন্ত্রাসবাদের অধিকতর বিস্তার ঠেকানো যাবে।
সাম্প্রতিক এই হামলাগুলোকে ‘অপ্রত্যাশিত সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এটা আসলে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, হর্ন অব আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ায় মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রকাশ্য ও গোপন সামরিক অভিযানের এক ভীতিকর ও অপ্রত্যাশিত ফলাফল, যার মাধ্যমে তারা সেখানে পশ্চিমের অনুগত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছে। এসব সামরিক অভিযানের কারণে শুধু এসব অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও সেখানকার মানুষকে অনেক ভুগতেই হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
মানুষকে কখনো ওসামা বিন লাদেন, আল-কায়েদা বা ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের প্রকৃত ইতিহাস জানানো হয়নি। পশ্চিম এই কাজ শুরু করেছে সেই ১৯৭৯ সালে, সে সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সিআইএ সুন্নি তরুণদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সিআইএ বিভিন্ন জায়গা থেকেই মুসলমানদের দলভুক্ত (ইউরোপসহ) করে মুজাহিদীন গঠন করেছে, এটি ছিল এক বহুজাতিক সুন্নি যোদ্ধা দল।
এদের সহায়তা করার জন্য সহকারী অর্থদাতা হিসেবে এক ধনী সৌদি পরিবারের সন্তান বিন লাদেনকে আনা হয়েছিল। এটাই ছিল সিআইএর অভিযানের বৈশিষ্ট্য: ধনী সৌদি পরিবারের মাধ্যমে এবং স্থানীয় চোরাকারবার ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন করা। ইসলামের ভূমিকে (দার আল-ইসলাম) বাইরের মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য সিআইএ হাজার হাজার তরুণকে নিয়ে এক কট্টর যোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলেছিল, যে তরুণেরা নিজ বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। এই প্রথম বাহিনী ও তাদের আদর্শই আজ পর্যন্ত সুন্নি জিহাদি বিদ্রোহের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করছে, আইএসসহ। জিহাদিদের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিন্তু আজ সেই ‘কাফেরের’ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ (বিশেষ করে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) ও রাশিয়াও আছে।
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, তখন মুজাহিদীনদের একটি অংশ আল-কায়েদায় পরিণত হয়, যার অর্থ হচ্ছে ভিত্তি। অর্থাৎ বিন লাদেন ও সিআইএ আফগানিস্তানে মুজাহিদীনদের জন্য যে সামরিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ ভিত্তি গড়ে তুলেছিল, সেটা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা প্রত্যাহারের পর আল-কায়েদার অর্থ পরিবর্তিত হয়, তখন তার অর্থ দাঁড়ায় জিহাদি তৎপরতার সাংগঠনিক ভিত্তি, সুনির্দিষ্ট সামরিক ঘাঁটি নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে সিআইএর গোপন অভিযানের রাশ টেনে ধরতে হবে। সিআইএকে দিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির এক দীর্ঘ ও বিয়োগান্ত ব্যর্থতার ইতিহাস রয়েছে ১৯৯০ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত শুরু হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র দার আল-ইসলামে বিশেষ করে সৌদি আরবে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। যে জিহাদিদের সৃষ্টিতে সিআইএ এত কিছু করল, সেই জিহাদিরা মার্কিনদের এই অতিরিক্ত সামরিক উপস্থিতিকে জিহাদের মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করল। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে যে উসকানিবিহীন যুদ্ধ শুরু করে, তার কারণেই সব দৈত্য-দানব যেন বোতল ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধটা যে শুধু সিআইএর ভুল তথ্যের ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল তা-ই নয়, এর মাধ্যমে তারা শিয়া নেতৃত্বাধীন মার্কিনপন্থী একটি সরকারও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ কারণে সুন্নি জিহাদি ও ইরাকিরা খেপে যায়, যারা হাতে অস্ত্র নিতে একরকম প্রস্তুত ছিল। আরও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে উৎখাত করে হত্যা করেছে, আবার ওদিকে মিসরের সেনাপ্রধানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির নির্বাচিত মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে উৎখাত করেছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ২০১১ সালে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে সহিংসতা চালালে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, তুরস্ক ও অন্যান্য আঞ্চলিক মিত্ররা সেখানে এক সামরিক বিদ্রোহ সৃষ্টিতে সহায়তা করে, যে কারণে দেশটি বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার এক অগ্নিগর্ভে পতিত হয়েছে।
এসব অভিযানের মাধ্যমে বৈধ সরকার গঠনের চেষ্টা বারবার ও বিপর্যয়করভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ের স্থিতিশীলতাও আনা সম্ভব হয়নি। এর বিপরীতে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার নির্বাচিত, যদিও কর্তৃত্বপরায়ণ, সরকারকে উৎখাত করা এবং সুদানসহ আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে পশ্চিম নিজেই বৈরিতার মুখে পড়েছে। এই গোলযোগের কারণেই আইএস সিরিয়া, ইরাক ও উত্তর আফ্রিকার একটি অংশ দখল করে শাসন চালাতে পারছে।
আইএস ও অন্যান্য সহিংস জিহাদিদের পরাজিত করতে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে সিআইএর গোপন অভিযানের রাশ টেনে ধরতে হবে। সিআইএকে দিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির এক দীর্ঘ ও বিয়োগান্ত ব্যর্থতার ইতিহাস রয়েছে, যদিও গোপনীয়তার নামে এর সবই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। সিআইএকে দিয়ে গোপনে হাঙ্গামা সৃষ্টি করা বন্ধ করা গেলে অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হবে, যে কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে পশ্চিমবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয় ও সন্ত্রাসবাদ পরিপুষ্ট হয়।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্যদের উচিত হবে, অবিলম্বে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ মিটিয়ে ফেলা এবং সিরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাঠামো তৈরি করা। তারা সবাই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে, ফলে তাদের আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তা ছাড়া, আইএসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান সফল করতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন ও বৈধতা প্রয়োজন হবে।
জাতিসংঘের কাঠামোর মধ্যে যা থাকতে হবে সেগুলো হলো: বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে, যেখানে সৌদি আরব, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই বিদ্রোহ চলুক; সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি, আইএসের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বৈধতাপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর অভিযান; আর সিরিয়ায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক উত্তরণ, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নয়।
শেষ কথা হলো, টেকসই উন্নয়নের মধ্যেই আসলে এই দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দাওয়াই রয়েছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য শুধু যুদ্ধবিধ্বস্তই নয়, ক্রমেই গভীর হওয়া উন্নয়ন ব্যর্থতার কারণেও অঞ্চলটি জর্জরিত, তার সঙ্গে আছে সুপেয় পানির স্বল্পতা, মরুকরণ, বিপুলসংখ্যক তরুণের কর্মহীনতা, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি।
সিআইএ ও পশ্চিমা-সমর্থিত যুদ্ধ সমাধান আনতে পারবে না। এর বিপরীতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকতর স্থিতিশীল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
সাম্প্রতিক এই হামলাগুলোকে ‘অপ্রত্যাশিত সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এটা আসলে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, হর্ন অব আফ্রিকা এবং মধ্য এশিয়ায় মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রকাশ্য ও গোপন সামরিক অভিযানের এক ভীতিকর ও অপ্রত্যাশিত ফলাফল, যার মাধ্যমে তারা সেখানে পশ্চিমের অনুগত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চেয়েছে। এসব সামরিক অভিযানের কারণে শুধু এসব অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও সেখানকার মানুষকে অনেক ভুগতেই হয়নি, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
মানুষকে কখনো ওসামা বিন লাদেন, আল-কায়েদা বা ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থানের প্রকৃত ইতিহাস জানানো হয়নি। পশ্চিম এই কাজ শুরু করেছে সেই ১৯৭৯ সালে, সে সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সিআইএ সুন্নি তরুণদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। সিআইএ বিভিন্ন জায়গা থেকেই মুসলমানদের দলভুক্ত (ইউরোপসহ) করে মুজাহিদীন গঠন করেছে, এটি ছিল এক বহুজাতিক সুন্নি যোদ্ধা দল।
এদের সহায়তা করার জন্য সহকারী অর্থদাতা হিসেবে এক ধনী সৌদি পরিবারের সন্তান বিন লাদেনকে আনা হয়েছিল। এটাই ছিল সিআইএর অভিযানের বৈশিষ্ট্য: ধনী সৌদি পরিবারের মাধ্যমে এবং স্থানীয় চোরাকারবার ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের অর্থায়ন করা। ইসলামের ভূমিকে (দার আল-ইসলাম) বাইরের মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করার জন্য সিআইএ হাজার হাজার তরুণকে নিয়ে এক কট্টর যোদ্ধা বাহিনী গড়ে তুলেছিল, যে তরুণেরা নিজ বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছিল। এই প্রথম বাহিনী ও তাদের আদর্শই আজ পর্যন্ত সুন্নি জিহাদি বিদ্রোহের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করছে, আইএসসহ। জিহাদিদের মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, কিন্তু আজ সেই ‘কাফেরের’ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ (বিশেষ করে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) ও রাশিয়াও আছে।
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, তখন মুজাহিদীনদের একটি অংশ আল-কায়েদায় পরিণত হয়, যার অর্থ হচ্ছে ভিত্তি। অর্থাৎ বিন লাদেন ও সিআইএ আফগানিস্তানে মুজাহিদীনদের জন্য যে সামরিক সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণ ভিত্তি গড়ে তুলেছিল, সেটা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনা প্রত্যাহারের পর আল-কায়েদার অর্থ পরিবর্তিত হয়, তখন তার অর্থ দাঁড়ায় জিহাদি তৎপরতার সাংগঠনিক ভিত্তি, সুনির্দিষ্ট সামরিক ঘাঁটি নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে সিআইএর গোপন অভিযানের রাশ টেনে ধরতে হবে। সিআইএকে দিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির এক দীর্ঘ ও বিয়োগান্ত ব্যর্থতার ইতিহাস রয়েছে ১৯৯০ সালের প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত শুরু হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র দার আল-ইসলামে বিশেষ করে সৌদি আরবে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে। যে জিহাদিদের সৃষ্টিতে সিআইএ এত কিছু করল, সেই জিহাদিরা মার্কিনদের এই অতিরিক্ত সামরিক উপস্থিতিকে জিহাদের মূল আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করল। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে যে উসকানিবিহীন যুদ্ধ শুরু করে, তার কারণেই সব দৈত্য-দানব যেন বোতল ভেঙে বেরিয়ে পড়ে। এই যুদ্ধটা যে শুধু সিআইএর ভুল তথ্যের ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল তা-ই নয়, এর মাধ্যমে তারা শিয়া নেতৃত্বাধীন মার্কিনপন্থী একটি সরকারও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ কারণে সুন্নি জিহাদি ও ইরাকিরা খেপে যায়, যারা হাতে অস্ত্র নিতে একরকম প্রস্তুত ছিল। আরও সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার আল-গাদ্দাফিকে উৎখাত করে হত্যা করেছে, আবার ওদিকে মিসরের সেনাপ্রধানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির নির্বাচিত মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে উৎখাত করেছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ২০১১ সালে এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে সহিংসতা চালালে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, তুরস্ক ও অন্যান্য আঞ্চলিক মিত্ররা সেখানে এক সামরিক বিদ্রোহ সৃষ্টিতে সহায়তা করে, যে কারণে দেশটি বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার এক অগ্নিগর্ভে পতিত হয়েছে।
এসব অভিযানের মাধ্যমে বৈধ সরকার গঠনের চেষ্টা বারবার ও বিপর্যয়করভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ের স্থিতিশীলতাও আনা সম্ভব হয়নি। এর বিপরীতে ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার নির্বাচিত, যদিও কর্তৃত্বপরায়ণ, সরকারকে উৎখাত করা এবং সুদানসহ আফ্রিকার অন্যান্য অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে পশ্চিম নিজেই বৈরিতার মুখে পড়েছে। এই গোলযোগের কারণেই আইএস সিরিয়া, ইরাক ও উত্তর আফ্রিকার একটি অংশ দখল করে শাসন চালাতে পারছে।
আইএস ও অন্যান্য সহিংস জিহাদিদের পরাজিত করতে তিনটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে সিআইএর গোপন অভিযানের রাশ টেনে ধরতে হবে। সিআইএকে দিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির এক দীর্ঘ ও বিয়োগান্ত ব্যর্থতার ইতিহাস রয়েছে, যদিও গোপনীয়তার নামে এর সবই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে। সিআইএকে দিয়ে গোপনে হাঙ্গামা সৃষ্টি করা বন্ধ করা গেলে অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা রোধ করা সম্ভব হবে, যে কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে পশ্চিমবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হয় ও সন্ত্রাসবাদ পরিপুষ্ট হয়।
দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্য স্থায়ী সদস্যদের উচিত হবে, অবিলম্বে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ মিটিয়ে ফেলা এবং সিরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য কাঠামো তৈরি করা। তারা সবাই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে, ফলে তাদের আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তা ছাড়া, আইএসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান সফল করতে হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন ও বৈধতা প্রয়োজন হবে।
জাতিসংঘের কাঠামোর মধ্যে যা থাকতে হবে সেগুলো হলো: বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে, যেখানে সৌদি আরব, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এই বিদ্রোহ চলুক; সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি, আইএসের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের বৈধতাপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর অভিযান; আর সিরিয়ায় জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাজনৈতিক উত্তরণ, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নয়।
শেষ কথা হলো, টেকসই উন্নয়নের মধ্যেই আসলে এই দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দাওয়াই রয়েছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য শুধু যুদ্ধবিধ্বস্তই নয়, ক্রমেই গভীর হওয়া উন্নয়ন ব্যর্থতার কারণেও অঞ্চলটি জর্জরিত, তার সঙ্গে আছে সুপেয় পানির স্বল্পতা, মরুকরণ, বিপুলসংখ্যক তরুণের কর্মহীনতা, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি।
সিআইএ ও পশ্চিমা-সমর্থিত যুদ্ধ সমাধান আনতে পারবে না। এর বিপরীতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অবকাঠামো প্রভৃতি খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকতর স্থিতিশীল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
No comments