ঝুঁকিতে ২১,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ by এম এম মাসুদ
দেশের
অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখার অন্যতম খাত আবাসনশিল্পে মন্দাভাব কাটছেই না।
সম্ভাবনার এ খাতটি ডুবছে বিভিন্ন সংকটে। পাশাপাশি আবাসনের সহযোগী ২৬৯টি
শিল্পেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে হুমকিতে পড়েছে ১২ হাজার ১৮৫টি অবিক্রীত
ফ্ল্যাটের ২১ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ । আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল
এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও সংশ্লিষ্ট
সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, উচ্চসুদের ব্যাংকঋণ নিয়ে
বিপাকে এ শিল্পের ব্যবসায়ীরা। সহজশর্তে স্বল্পসুদে ঋণ না পাওয়ায় ক্রেতাদের
আগ্রহ কম। ফ্ল্যাট ও জমির রেজিস্ট্রেশন ব্যয় বেশি হওয়ায় বাড়ছে হতাশা। সব
মিলিয়ে বর্তমানে দেশের আবাসন ব্যবসার পরিস্থিতি নাজুক পর্যায়ে রয়েছে বলে
মনে করেন তারা। রিহ্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ লিয়াকত আলী বলেন,
ব্যাংকিং খাতের অসহযোগিতাই আবাসন খাতের প্রধান সংকট। এ খাতে ঋণ দেয়ার
ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি নেই। এর পরও ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় না। দেশের স্বল্প আয়ের
মানুষের সিঙ্গেল ডিজিট হারে ঋণ দেয়া হলে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াবে। আবাসন
খাতের উন্নয়নের সঙ্গে জিডিপির সম্পর্কও রয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, দেশের আবাসন খাতে গত ৩০ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে এ পরিবর্তন ছিল উল্লেখযোগ্য।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা নগরীর ৭০ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের ৬৫ শতাংশ বাড়িভাড়ায় ব্যয় করেন। বছর দশেক আগে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ থেকে ২০ ভাগের মধ্যে। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০-৪৫ ভাগে। জমির স্বল্পতা, আইনি জটিলতা, দুর্বল পরিকল্পনা, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি নীতিগত সমর্থনের অভাবে এখানে অপরিকল্পিত নগরায়ণও বাড়ছে। সংকুচিত হচ্ছে নগরবাসীর সুবিধা। অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আবাসন খাত নিয়ে একটা সমন্বিত প্রক্রিয়া দরকার। ব্যাংকঋণের সুদ কমাতে সমন্বিত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সবার ভূমিকা নিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। কেননা এভাবে আবাসন খাত চলতে পারে না। এ খাতের বিকাশ হলে অর্থনীতি বাড়বে।
রিহ্যাবের তথ্য মতে, বর্তমানে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ১২ হাজার ১৮৫টি ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের আনুমানিক বাজারমূল্য ৮ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আবাসনশিল্পের এ বিশাল বিনিয়োগ ফলপ্রসূ করতে হলে সরকারকে নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এর মধ্যে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে, অতিরিক্ত চার্জ দূর করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলটি আবার চালু করা ও সরকারের কাছে রিহ্যাবের ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের যে দাবি, তা ক্রেতাদের এক অঙ্কের সুদে দীর্ঘ মেয়াদে দিতে হবে। পাশাপাশি আবাসন প্রকল্পে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগের প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুততর করতে হবে। তাহলে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
যত সমস্যা: নকশা অনুমোদনে বিড়ম্বনা, অতিরিক্ত নিবন্ধন ফি, ক্রেতাপর্যায়ে ঋণসুবিধার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংকট লেগেই আছে এ খাতে। রিহ্যাব জানিয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় আবাসন কোম্পানিগুলো প্রতি বছর যেখানে প্রায় ১০ হাজার ফ্ল্যাট ও ৫ হাজার প্লট হস্তান্তর করেছে, সেখানে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে হস্তান্তর করেছে মাত্র ৫ হাজার ৬৩৩টি। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফি ৮ গুণ করা হয়েছে। প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি আগে ছিল ২৫০ টাকা, বর্তমানে তা ২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে একটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন করতেই এলাকাভেদে ৩-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন আরও ফিকে হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে উৎসে আয়কর বৃদ্ধি করায় বর্তমানে নিবন্ধন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। অথচ ভারতে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি মাত্র ৬ শতাংশ। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় এই ফি ১ থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ।
রিহ্যাবের সহসভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, কেউ কিনতে এলেই বুঝতে পারবে, আগের চেয়ে এখন কত কম দামে অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। তবুও ক্রেতাদের সাড়া মিলছে না।
অর্থায়ন সমস্যা: মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য ঋণের জোগান দিতে ২০০৭ সালের ১৮ জুলাই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তহবিলে ৮০০ কোটি টাকা দেয় সরকার। সুদের হার ছিল ৯%। আবাসন খাতকে ‘অনুৎপাদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০ সালে এ তহবিলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন গ্রাহকদের বাড়ি নির্মাণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১২% এবং এর বাইরের এলাকায় ১০% হার সুদে ঋণ দেয়। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সংস্থাটি বর্তমানে খুব বেশি ঋণ দিতে পারছে না।
ব্যাংকঋণের সুদ চড়া: বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণই আবাসন খাতের মূল ভরসা। কিন্তু আবাসন ঋণে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১২ থেকে সাড়ে ১৯%। কিন্তু বিভিন্ন চার্জ ও ফি মিলিয়ে এ হার বাস্তবে ১৬ থেকে ২২% পর্যন্ত হয়ে যায়।
রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, সমস্যা সমাধানে ক্রেতাদের জন্য একটি ‘ফান্ড’ গঠন করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তহবিল চালুর দাবি জানান সংগঠনের সভাপতি।
রিহ্যাবে দাখিলী অভিযোগ নিষ্পত্তি: গ্রাহক ও আবাসন মালিকদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সংগঠনটির মেডিয়েশন অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস স্ট্যান্ডিং কমিটি নামে একটি সেল রয়েছে। যার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মো. আনোয়ারুজ্জামান। যেখানে গ্রাহক ও মালিকদের বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। এক তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৮ই আগস্ট পর্যন্ত সংগঠনটিতে অভিযোগ পড়ে ১৫৮৮টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৮১৭টি। সমাধানের অপেক্ষায় ৩১১টি। এর মধ্যে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জবাব আসার অপেক্ষায় ৯১টি। আপস সমঝোতার প্রক্রিয়াধীন ১৫০টি। প্রতিক্রিয়া না পাওয়ায় তাগাদার পর্যায়ে ৭০টি। এ ছাড়া অভিযোগ বাদ হয়েছে ৪৬০টি। এর মধ্যে ৮ সদস্য ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব হতে বহিষ্কৃত হওয়ায় অভিযোগ বাদ হয়েছে ২৭৬টি। ২০১৩ ও ২০১৪ সালের বার্ষিক চাঁদা খেলাপির কারণে কয়েকটি ডেভেলপার কোম্পানির ১৫১টি অভিযোগ বাদ পড়েছে। এ ছাড়া আদালতে বিচারাধীন থাকার কারণে অভিযোগ বাদ পড়েছে ৩৩টি।
বিভিন্ন দেশে সুদ হার: দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় গৃহঋণের সুদের হার গড়পড়তা ৬%। দেশটির ব্যাংকগুলো ৪.৩৯-৪.৬৫% হার সুদে গ্রাহকদের গৃহঋণের অফার দিচ্ছে। জাপানে ২-৩% সুদে আবাসনঋণ পাওয়া যায়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ঋণের সুদ হার ১০%-এর নিচে। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দেশজ উৎপাদনে অবদানের দিক থেকে বাংলাদেশের আবাসন খাত ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের জিডিপিতে আবাসন খাত ৬.৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৮.৭ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে।
আবাসনে কর্মসংস্থান: কর্মসংস্থানের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দেশের আবাসন খাত। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ আবাসন খাতে নিয়োজিত আছেন। শুধু নির্মাণ শ্রমিক নন, দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের দিক থেকেও এ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, আবাসন কোম্পানিগুলোতে ২০ হাজার নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপক, ১০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, ৩ হাজার স্নাতক প্রকৌশলী এবং প্রায় ৫০০ স্থপতি নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া এতে নির্ভর করছে ছোট-বড় ২৬৯টি শিল্প খাত। এসব খাতে ২ হাজারেরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
রাজস্ব: এ খাত থেকে সরকার প্রতি বছর সরাসরি প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে। সিমেন্ট ও রডশিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত আবাসন-ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্যসংখ্যা ১,২২৮। আবাসন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিল্প খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকা। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো গত ২০ বছরে ১ লাখ ৬৪ হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেছে বলে জানিয়েছে রিহ্যাব।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘নির্মাণ’ এবং ‘রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্য ব্যবসা’ শিরোনামের দুটি পৃথক খাতকে হিসাবে নেয়। এ দুটি খাতেই সিংহভাগ কৃতিত্ব বেসরকারি খাতের। দুই খাত মিলিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপিতে অংশীদারি ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। আগের ৪ বছরেও জিডিপিতে আবাসন খাত একই হারে অবদান রেখেছে।
জানা গেছে, দেশের আবাসন খাতে গত ৩০ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে এ পরিবর্তন ছিল উল্লেখযোগ্য।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা নগরীর ৭০ শতাংশ মানুষ তাদের আয়ের ৬৫ শতাংশ বাড়িভাড়ায় ব্যয় করেন। বছর দশেক আগে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির হার ছিল ১৫ থেকে ২০ ভাগের মধ্যে। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৪০-৪৫ ভাগে। জমির স্বল্পতা, আইনি জটিলতা, দুর্বল পরিকল্পনা, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সর্বোপরি নীতিগত সমর্থনের অভাবে এখানে অপরিকল্পিত নগরায়ণও বাড়ছে। সংকুচিত হচ্ছে নগরবাসীর সুবিধা। অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আবাসন খাত নিয়ে একটা সমন্বিত প্রক্রিয়া দরকার। ব্যাংকঋণের সুদ কমাতে সমন্বিত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সবার ভূমিকা নিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। কেননা এভাবে আবাসন খাত চলতে পারে না। এ খাতের বিকাশ হলে অর্থনীতি বাড়বে।
রিহ্যাবের তথ্য মতে, বর্তমানে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর ১২ হাজার ১৮৫টি ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। এসব ফ্ল্যাটের আনুমানিক বাজারমূল্য ৮ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আবাসনশিল্পের এ বিশাল বিনিয়োগ ফলপ্রসূ করতে হলে সরকারকে নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এর মধ্যে ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে, অতিরিক্ত চার্জ দূর করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন তহবিলটি আবার চালু করা ও সরকারের কাছে রিহ্যাবের ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের যে দাবি, তা ক্রেতাদের এক অঙ্কের সুদে দীর্ঘ মেয়াদে দিতে হবে। পাশাপাশি আবাসন প্রকল্পে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগের প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুততর করতে হবে। তাহলে আবাসন খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
যত সমস্যা: নকশা অনুমোদনে বিড়ম্বনা, অতিরিক্ত নিবন্ধন ফি, ক্রেতাপর্যায়ে ঋণসুবিধার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংকট লেগেই আছে এ খাতে। রিহ্যাব জানিয়েছে, স্বাভাবিক অবস্থায় আবাসন কোম্পানিগুলো প্রতি বছর যেখানে প্রায় ১০ হাজার ফ্ল্যাট ও ৫ হাজার প্লট হস্তান্তর করেছে, সেখানে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে হস্তান্তর করেছে মাত্র ৫ হাজার ৬৩৩টি। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, ফ্ল্যাট নিবন্ধন ফি ৮ গুণ করা হয়েছে। প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি আগে ছিল ২৫০ টাকা, বর্তমানে তা ২ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে একটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন করতেই এলাকাভেদে ৩-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন আরও ফিকে হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে উৎসে আয়কর বৃদ্ধি করায় বর্তমানে নিবন্ধন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশ। অথচ ভারতে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি মাত্র ৬ শতাংশ। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও শ্রীলঙ্কায় এই ফি ১ থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ।
রিহ্যাবের সহসভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, কেউ কিনতে এলেই বুঝতে পারবে, আগের চেয়ে এখন কত কম দামে অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। তবুও ক্রেতাদের সাড়া মিলছে না।
অর্থায়ন সমস্যা: মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের আবাসন চাহিদা পূরণের জন্য ঋণের জোগান দিতে ২০০৭ সালের ১৮ জুলাই পুনঃঅর্থায়ন তহবিল চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এ তহবিলে ৮০০ কোটি টাকা দেয় সরকার। সুদের হার ছিল ৯%। আবাসন খাতকে ‘অনুৎপাদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০ সালে এ তহবিলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন গ্রাহকদের বাড়ি নির্মাণের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১২% এবং এর বাইরের এলাকায় ১০% হার সুদে ঋণ দেয়। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সংস্থাটি বর্তমানে খুব বেশি ঋণ দিতে পারছে না।
ব্যাংকঋণের সুদ চড়া: বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণই আবাসন খাতের মূল ভরসা। কিন্তু আবাসন ঋণে ব্যাংকগুলোর ঘোষিত সুদের হার ১২ থেকে সাড়ে ১৯%। কিন্তু বিভিন্ন চার্জ ও ফি মিলিয়ে এ হার বাস্তবে ১৬ থেকে ২২% পর্যন্ত হয়ে যায়।
রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন জানান, সমস্যা সমাধানে ক্রেতাদের জন্য একটি ‘ফান্ড’ গঠন করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ তহবিল চালুর দাবি জানান সংগঠনের সভাপতি।
রিহ্যাবে দাখিলী অভিযোগ নিষ্পত্তি: গ্রাহক ও আবাসন মালিকদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সংগঠনটির মেডিয়েশন অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস স্ট্যান্ডিং কমিটি নামে একটি সেল রয়েছে। যার চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মো. আনোয়ারুজ্জামান। যেখানে গ্রাহক ও মালিকদের বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়। এক তথ্যে দেখা গেছে, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৮ই আগস্ট পর্যন্ত সংগঠনটিতে অভিযোগ পড়ে ১৫৮৮টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৮১৭টি। সমাধানের অপেক্ষায় ৩১১টি। এর মধ্যে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জবাব আসার অপেক্ষায় ৯১টি। আপস সমঝোতার প্রক্রিয়াধীন ১৫০টি। প্রতিক্রিয়া না পাওয়ায় তাগাদার পর্যায়ে ৭০টি। এ ছাড়া অভিযোগ বাদ হয়েছে ৪৬০টি। এর মধ্যে ৮ সদস্য ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব হতে বহিষ্কৃত হওয়ায় অভিযোগ বাদ হয়েছে ২৭৬টি। ২০১৩ ও ২০১৪ সালের বার্ষিক চাঁদা খেলাপির কারণে কয়েকটি ডেভেলপার কোম্পানির ১৫১টি অভিযোগ বাদ পড়েছে। এ ছাড়া আদালতে বিচারাধীন থাকার কারণে অভিযোগ বাদ পড়েছে ৩৩টি।
বিভিন্ন দেশে সুদ হার: দেখা গেছে, মালয়েশিয়ায় গৃহঋণের সুদের হার গড়পড়তা ৬%। দেশটির ব্যাংকগুলো ৪.৩৯-৪.৬৫% হার সুদে গ্রাহকদের গৃহঋণের অফার দিচ্ছে। জাপানে ২-৩% সুদে আবাসনঋণ পাওয়া যায়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ঋণের সুদ হার ১০%-এর নিচে। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দেশজ উৎপাদনে অবদানের দিক থেকে বাংলাদেশের আবাসন খাত ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের জিডিপিতে আবাসন খাত ৬.৩ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৮.৭ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে।
আবাসনে কর্মসংস্থান: কর্মসংস্থানের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে দেশের আবাসন খাত। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ আবাসন খাতে নিয়োজিত আছেন। শুধু নির্মাণ শ্রমিক নন, দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের দিক থেকেও এ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম।
রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, আবাসন কোম্পানিগুলোতে ২০ হাজার নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপক, ১০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, ৩ হাজার স্নাতক প্রকৌশলী এবং প্রায় ৫০০ স্থপতি নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া এতে নির্ভর করছে ছোট-বড় ২৬৯টি শিল্প খাত। এসব খাতে ২ হাজারেরও বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
রাজস্ব: এ খাত থেকে সরকার প্রতি বছর সরাসরি প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাচ্ছে। সিমেন্ট ও রডশিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত আবাসন-ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সদস্যসংখ্যা ১,২২৮। আবাসন ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শিল্প খাতে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকা। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো গত ২০ বছরে ১ লাখ ৬৪ হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেছে বলে জানিয়েছে রিহ্যাব।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ‘নির্মাণ’ এবং ‘রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্য ব্যবসা’ শিরোনামের দুটি পৃথক খাতকে হিসাবে নেয়। এ দুটি খাতেই সিংহভাগ কৃতিত্ব বেসরকারি খাতের। দুই খাত মিলিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে জিডিপিতে অংশীদারি ছিল ১৪ শতাংশের বেশি। আগের ৪ বছরেও জিডিপিতে আবাসন খাত একই হারে অবদান রেখেছে।
No comments