খালেদার ৭ দফা: বিএনপি উগ্রপন্থায় বিশ্বাস করে না
বিএনপি
কোন ধরনের উগ্রপন্থায় বিশ্বাস করে না বলে মন্তব্য করেছেন দলটির চেয়ারপারসন
খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে চলমান সঙ্কট মোকাবিলায় জরুরিভাবে জাতীয় সংলাপের
আহবান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো দলের মুখপাত্র ড.
আসাদুজ্জামান রিপন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, সরকারকে উপলব্ধি
করতে হবে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণ। সরকার নিজেই এই সঙ্কট সৃষ্টি
করেছে যা ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে অবাধ-নিরপেক্ষ ও সকল
দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা
বাতিলের পর থেকেই দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের সূচনা। এ সঙ্কট উত্তরণে সরকারকে
সময় থাকতেই এর উপায় বের করতে হবে। আমাদের দল মনে করে, একটি নিরপেক্ষ
সরকারের অধীনে অনতিবিলম্বে একটি নির্বাচনের আয়োজন এখন জরুরি। বিএনপি একটি
গণতন্ত্র পন্থার দল। আমাদের দল কোনভাবেই কোন ধরনের উগ্রপন্থাকে সমর্থন করে
না। সকল ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু
সরকার দেশে-বিদেশে বিএনপি’র মতো একটি রাজনৈতিক দলকে সন্ত্রাসী চরিত্রের
কালিমা লেপনের যে অপপ্রয়াস চালাচ্ছে- তা দেশে বিদেশে কোন গ্রহণযোগ্যতা
পায়নি এবং পাবেও না। বরং সরকারের ফ্যাসিবাদী রূপই আরও বেশি করে স্পষ্ট হয়ে
উঠছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, দেশ ক্রমাগত গভীর সঙ্কটের দিকে এগুচ্ছে।
আমাদের কাছে দেশের স্বার্থ বড়, জনগণের স্বার্থকেই আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে
থাকি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি।
সর্বদলীয় বৈঠকের কথাও বলেছি। আমি আন্তরিকভাবে বারবার জাতীয় সংকট মোকাবিলায়
জরুরিভাবে জাতীয় সংলাপের আহবান জানিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও
সত্য যে, সরকার আমাদের সে দাবির প্রতি এখন পর্যন্ত কর্ণপাত করেননি। খালেদা
জিয়া বলেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হওয়ার পর সরকার প্রধান অচিরেই আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেয়ার
প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। এরপর দেশে আজ এক সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী শাসন
ব্যবস্থায় বিপর্যস্ত। যার ফলশ্রুতিতে শাসকদলের ক্ষমতা-নির্ভর দম্ভ
উল্লাসিকতা আর প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে মিলে মিশে একনায়কতান্ত্রিক আচরণে
মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তিনি বলেন, সবাই এখন উপলব্ধি করতে পারছেন,
এমনি ধরনের একটি পরিস্থিতিতে দেশ আজ গভীর সংকটেও নিপতিত। এখানে সাধারণ
মানুষের নিরাপত্তা নেই, এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দু’জন সদস্য মাত্র ১৩
দিনের ব্যবধানে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছেন। অতি সম্প্রতি দু’জন বিদেশীর
দুঃখজনক ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর একজন প্রকাশকও হত্যাকাণ্ডের শিকার
হয়েছেন। আমি এসব ঘটনায় নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। দোষীদের
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করি। খালেদা জিয়া বলেন, ঘরে বাইরে এখন কেউই
নিরাপদ বোধ করছেন না। চারদিকে আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ গোটা জাতিকে গ্রাস
করেছে; যেন সামনে ঘোর অন্ধকার। অথচ সরকার অবনতিশীল আইন পরিস্থিতির
উন্নতিকল্পে উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের
ধরপাকড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা
ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যিনি দীর্ঘদিন কারাগারে থেকে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে
বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফেরার পর, তাকে পুনরায় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ায় আমি
বিস্মিত। এমন একজন অসুস্থ রাজনীতিককে কারাগারে পাঠানো-সরকারের চরম অমানবিক
ও অসহিঞ্চু দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। ইতিমধ্যে আমাদের দলের
পক্ষ থেকে তার অসুস্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ তিনি
চিকিৎসাধীন ছিলেন। চলতি মাসের ২৪ তারিখ বিদেশী ডাক্তারের পরামর্শে তার আরও
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটিও নির্ধারিত ছিল। কারাগারে
মির্জা আলমগীরের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটাই স্বাভাবিক। সরকার জেনে-বুঝে একজন
অসুস্থ মানুষকে পুনরায় কারাগারে পাঠানোর মধ্য দিয়ে তার জীবনের ঝুঁকি বাড়িয়ে
তুলেছে। তিনি বলেন, আদালতে হাজিরা দিতে গেলে বুধবার দলের স্থায়ী কমিটির
সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কেও কারাগারে পাঠানো হয়েছে। দলের শীর্ষস্থানীয়
নেতৃবৃন্দকে এভাবে একের পর এক কারাগারে বন্দি রাখার মধ্য দিয়ে সরকারের
দূরভিসন্ধি রয়েছে। আমরা যখন সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে কাউন্সিল করে
দলকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি, তার পরপরই সারা দেশে দলের নেতা-কর্মীদের
বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সরকারের এ ধরনের দমন-নিপীড়ন
থেকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারাও বাদ পড়ছেন না। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন,
বিএনপি’র হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলা, চার্জশিট, কারাজীবন আর সরকারের
দমননীতির শিকারে পরিণত হয়েছেন। জনগণের ভোটাধিকার বঞ্চিত করে পাতানো তথাকথিত
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার জনগণের কাঁধের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে
বসেছে। তারা তাদের অপশাসনকে প্রলম্বিত করার আকাঙ্ক্ষায় দেশে এক অরাজক
পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতি দেশ-জনগণ-গণতন্ত্রের জন্য অশনি
সঙ্কেত। হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির চর্চা করে সরকার দেশের সকল বিরুদ্ধমতকে দমনে
আজ বেপরোয়া। খালেদা জিয়া বলেন, শুধু বিএনপিই নয় নাগরিক সমাজ, অন্যান্য
প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধেও ক্ষুব্ধ সরকার। এমনকি সরকারি
রোষানলের বাইরে গণমাধ্যমও নয়। যারাই সরকারের অপশাসন, দুঃশাসন, দুর্নীতির
সমালোচনা করছে- সরকার তাদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী
বলেন, আমাদের সবার কতগুলো মৌলিক বিষয়ে আজ ঐকমত্য হওয়া আশু প্রয়োজন। তা হলো-
জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া, গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া, সকল
পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থায় স্বাধীন বিবেচনাবোধে কাজ করতে উৎসাহিত করা,
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে বাধা না দেয়া, দলীয়করণকৃত
প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া, বর্তমান
ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবাহী নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে
পুনর্গঠন করা এবং রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তারকৃত সকল রাজবন্দিদের
মুক্তি দেয়া ও মিথ্যা মামলা তুলে নিয়ে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে
ফিরিয়ে দেয়া। এভাবেই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল্যবোধকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত
করতে পারি। এ ধরনের অসহিঞ্চু মনোভাবের কারণে তারা ইতিমধ্যেই আরও বেশি করে
জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যা সরকার মোটেই উপলব্ধি করতে পারছেন না। আমাদের এই
দাবিসমূহ কোন দলীয় দাবি নয়, জনগণেরও। বিএনপি চেয়ারপারসন প্রতিশ্রুতি দিয়ে
বলেন, আমি এর আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছি-ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে আমরা কোন
হিংসাশ্রয়ী-অসহিষ্ণু রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেবো না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী,
প্রশাসন, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম, নির্বাচন কমিশনসহ রাষ্ট্রের সকল
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দলীয় রাজনীতির প্রভাবের বাইরে কাজ করতে পারবে। আমি
অনতিবিলম্বে দলের অসুস্থ ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর,
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, গয়েশ্বর
চন্দ্র রায়, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত
মেয়র প্রফেসর এমএ মান্নান, সাংবাদিক শওকত মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব আমান
উল্লাহ আমান, রুহুল কবীর রিজভী, সাবেক এমপি ডা. দেওয়ান সালাউদ্দিন বাবু,
জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটির নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক
চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ, কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সিনিয়র
সহ-সভাপতি শরিফুল আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক
যথাক্রমে হাফিজুর রহমান মোল্লা কচি ও জহিরুল হক খোকনসহ দলের ও অঙ্গসংগঠনের
বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রেপ্তারকৃত কর্মী ও নেতৃবৃন্দের আশু মুক্তি দাবি করছি।
এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারেরও দাবি জানাচ্ছি।
আমরা আশা করবো- সরকার শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে দেশের এই ক্রান্তিকালে সঙ্কট
উত্তরণে গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রকে সংকোচন না করে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব
থেকে সরে আসবে। দেশ ও জাতির স্বার্থেই একটি জাতীয় সংলাপের সূচনার পরিবেশকে
উন্মুক্ত করবে।
No comments