পরি by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

শিরিন কী করে জানত যে আমার এ রকমই কিছু একটা হবে? কী করে আগেভাগে বুঝে নিল একটা রুজিরোজগারের চেষ্টায় শহরে গেলে কাজের কাজ কতটা হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা তো নেই-ই, বরং কোনো না কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হবে আমার?
বলতে গেলে আমার পরিবারে সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা জানা মানুষ আমিই। টেনেটুনে বিএ পাস করেছি। জমি-জিরেত, চাষ-বাস, গঞ্জের হাটে একটা মুদির দোকান চালিয়ে যে পরিবারটি মোটের ওপর ভালোই চলে যাচ্ছে, সেই পরিবারের একমাত্র শিক্ষিত ছেলেটি শহরে গেলে করে-কম্মে খেতে পারবে না, এই ধারণা বাড়ির লোকজনের কেন হলো, এই কথাটা মাথায় ঢোকে না আমার। আমি একটু বোকাসোকা ধরনের, এমনকি ভালো মানুষও—পরিবারের লোকজনের এই ধারণা। আমার আব্বা যত দিন বেঁচে ছিলেন, তিনিও বিশ্বাস করতেন এ কথা, বলতেনও কথায় কথায়। সে কথায় হয়তো সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল, কিন্তু আমার এই সর্বনাশটাও তো করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনিই। খুব রাগ-অভিমান হয়, বড় দুই ভাই ক-অক্ষর গোমাংস, সে তুলনায় আমি মোটের ওপর স্কুল পাস দিলাম, কলেজে ভর্তি হলাম, কিন্তু আব্বার কাছে আস্থার জায়গাটা পেলাম না। আর উচ্চমাধ্যমিকের বেড়াটা যখন পেরিয়ে গেলাম, তখন তো তিনি ছিলেন না। তবে আম্মা আর বড় দুই ভাই-ভাবি খুব খুশি, বংশের মুখ উজ্জ্বল করার কথাও কে জানি বলেছিল। রোখ চেপে বসেছিল মাথায়। গ্রাম থেকে একটু দূরে একটা কলেজে গিয়ে বিএ পড়তে গিয়েছিলাম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৃতীয় শ্রেণিতে বিএ পাস করে যখন বাড়িতে ফিরেছি, তখন এই দিিগ্বজয়ের সংবাদে যেন উচ্ছ্বসিত হয়েছিল পুরো বাড়ি, এমনকি আশপাশের পাড়া পর্যন্ত। কিন্তু আমি যে একজন বোকা টাইপের ভালো মানুষ এবং বিষয়বুদ্ধির অভাবে আমার সে ধরনের উন্নতি হওয়ার সুযোগ বিশেষ নেই, এ ব্যাপারে মোটামুটি একমত ছিল সবাই। বরং গঞ্জের হাটটার ক্রেতাসমাগম ক্রমেই বাড়ছে, আর আমাদের চাল-ডাল-নুনের দোকানটার অবস্থাও বেশ জমজমাট, তার পাশেই একটা বইপত্র, খাতা-কলম আর মেয়েদের প্রসাধনসামগ্রীর দোকান করার ব্যাপারে আমাকে উদ্বুদ্ধ করতে লাগল আমার দুই ভাই। খুব মনঃকষ্ট পেয়েছিলাম। অবশেষে ক্লাস সিক্সের রুলটানা খাতা আর মেয়েদের ত্বক ফরসা করার ক্রিম বিক্রি করে শেষ হয়ে যাবে একজন বিএ পাস যুবকের সব সম্ভাবনা!
আমার মনঃকষ্টের ব্যাপারটা বুঝে শহরে গিয়ে নাইট শিফটে আইন কলেজে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছিলেন আমার স্বপন মামা। নিজে তিনি পেশায় উকিল, বললেন, ‘ল-কলেজে ভর্তি অইয়া যা, দিনের বেলা কয়েকটা দিন কোর্টবিল্ডিংয়ে ঘোরাঘুরি কর আমার লগে...তারপর দেখা যাক, কিছু একটা অইয়া যাইব...।’ আমিও ভেবেছিলাম, দেখা যাক। সবাই আমার সম্পর্কে কী ভাবে আর আমি আসলে কী—এটা প্রমাণ করার একটা দায় নিয়েছিলাম নিজের কাঁধে। কিন্তু শিরিন, আমার বড় ভাবির ছোট বোন, ভ্রু নাচিয়ে দুচোখে শয়তানি হাসি খেলিয়ে বলেছিল, ‘বেহুদা শহরে যাইতাছ আকবর ভাই, তুমি সোজা মানুষ, ওইহানে তোমার অইব না কিছু...।’
‘ক্যান অইব না ক্যান, আমি লেহাপড়া শিখি নাই?’
‘আরে লেহাপড়া দিয়া সব অয় না। উল্টা শহরে কুনো চাল্লু মাইয়ার হাতে পড়লে জীবনডা ছ্যাড়াবেড়া...।’ মেজাজটা বিগড়ে গিয়েছিল, খেঁকিয়ে উঠে বলেছি, ‘কিয়ের সাথে কী, পান্তা ভাতে ঘি, আমি যাইতাছি কোরিয়ারের লাইগা...শহরের মাইয়ার লগে এইডার সম্পর্ক কী?’
বাচাল মেয়েটা তবু ছাড়ে না, বলল, ‘তোমার তো মাশাল্লাহ টমেটোর লাহান চেহারা, সিনেমায় কত দেখছ না গ্রামের পোলা শহরের মাইয়া, আবার শহরের পোলা গ্রামের মাইয়া...।’ দেখেছি অনেক দেখেছি। আমি পূরবী সিনেমা হলে মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমা দেখতে যাই। তাতে শিরিনের বর্ণনামতো শহর-গ্রামের প্রেমের সম্পর্কও দেখেছি। এই শিরিনই তো কতবার আমার কাছে আবদার করেছে তাকে একবার সিনেমা হলে নিয়ে যেতে, নিইনি। সে ঘরে বসে টেলিভিশনেই দেখে। আমি গায়ে-পড়া মেয়েটার ঠাট্টার জবাবে শিক্ষিত মানুষের মতো গাম্ভীর্যে বলেছিলাম, ‘সবকিছু নিয়ে ফাইজলামি কইরো না শিরিন, সিনেমা আর বাস্তব জীবন এক জিনিস না।’ ‘স্বপন মামারও একটা মাইয়া আছে কলেজে পড়ে, হেব্বি সুন্দরী, এট্টু সাবধানে থাইকো।’—বলে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে হেসে শিরিন সরে পড়েছিল সামনে থেকে। না, স্বপন মামার মেয়ের প্রেমে পড়িনি আমি। আমার ব্যাপারটা আরও জটিল। স্বপন মামার বাসাতেই থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে লজিং মাস্টারের দায়িত্ব পেলাম। তাঁর বিচ্ছু টাইপের ক্লাস সিক্সের ছেলে দীপনকে পড়াই, রাতে বঙ্গবন্ধু ল টেম্পলে নিজে পড়তে যাই, আর সকালের দিকে যাই কোর্টবিল্ডিংয়ে। স্বপন মামার কলেজপড়ুয়া মেয়েটা শিরিনের বর্ণনামতো তত সুন্দরী না হলেও স্মার্ট। হাঁটুর ওপর স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়ায় ঘরে। তবে আমার দিকে কখনো আলাদা করে তাকায়নি। সামনাসামনি দু-একবার পড়েছে, তাতে তার চেহারায় উটকো লোকটাকে নিয়ে তেমন বিরক্তি যেমন দেখা যায়নি, আবার বাড়তি একটু মনোযোগের ব্যাপারও নেই। মেয়েটার নাম ঝুম্পা, সে প্রায় সারা দিন কানে হেডফোন লাগিয়ে রাখে আর লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে। শিরিনবর্ণিত আমার ‘টমেটোর লাহান চেহারা’ যে তাকে মোটেও বিচলিত করেনি, এটা বুঝতে পেরে আমার মনে সামান্য একটু উপেক্ষার বোধ জেগেছে বটে, তবে স্বস্তিও পেয়েছি।কোর্টবিল্ডিংয়ে কাজ তেমন নেই, স্বপন মামার ফাইলপত্র গুছিয়ে রাখি, তিনি আদালতে যাওয়ার সময় পেছনে হাঁটি। মনে মনে ভাবি, কখন স্বপন মামার মতো সাদা শার্ট-প্যান্টের ওপর কালো কোর্ট পরে এজলাসে গিয়ে দাঁড়াতে পারব। আসল কাজ শিখতে আরও বহুদিন সময় যে লেগে যাবে, সেটা বেশ বুঝতে পারি। চট্টগ্রামের কোর্টবিল্ডিংটা পাহাড়ের ওপর। কেউ বলে, কাছারির পাহাড়, কেউ বলে পরির পাহাড়।
একসময় যখন এই পাহাড়ে কোর্টবিল্ডিংটা হয়নি, কিংবা হলেও এত লোকজনের আনাগোনা ছিল না, তখন নাকি পরিরা নেমে আসত এই পাহাড়ে, তাই পরির পাহাড়। লোকজন এ কথা বিশ্বাস করে কি না জানি না, কিন্তু মুখে মুখে গল্পটা বেশ চালু আছে। নতুন কোনো লোককে এই গল্প বিশ্বাস করাতে অনেকে প্রবীণ লোকজনকে সাক্ষী রাখে। বছর বিশ-পঁচিশ আগেও এই প্রবীণদের অনেকে দূর থেকে পরিদের দেখেছে স্বচক্ষে। গায়ে পরির বাতাস লেগে পাগল হয়ে বাকি জীবন কাটিয়েছে এমন লোকও নাকি ছিল অনেক। এই পাহাড়ে এখন অজস্র মানুষের আনাগোনা। মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের কত অভিযোগ! মামলা-মোকদ্দমার শেষ নেই, কত বিচার হচ্ছে প্রতিদিন, অবিচারও হচ্ছে আকছার। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, উকিল-ব্যারিস্টার, চোর-বাটপার, দালাল—নানা কিসিমের মানুষের ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলে নিজের যেন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না। পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠে গেলে লাল ইটের দালান। দালানের আদল দেখলেই বোঝা যায় ব্রিটিশ আমলে তৈরি। আশপাশে অবশ্য নতুন ভবনও তৈরি হয়েছে অনেক।
সেই পাহাড়ের চড়াই বেয়ে হেঁটে ওঠার সময় একদিন প্রথম দেখেছিলাম তাকে। ভিড়-কোলাহলের মধ্যে বেমানান, ব্যস্ততাহীন নিরুদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। এত সুন্দর মুখ, দেখলে বুকের ভেতর কেন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ইহজীবনে এমন সুন্দর মুখ আমি দেখিনি। শ্যামলা মেয়ে একটু সাজগোজ করেছে, মুখে পাউডার, চোখে কাজল, ঠোঁটে রং, পিঠ ছাপিয়ে প্রায় কোমরে নেমে আসা সাপের মতো একটা লম্বা বেণি, তার আগায় একগোছা বেলি ফুল। ব্যস্ত-সমস্ত মানুষের সময় নেই, তারা তেমন ফিরেও তাকায় না। কিন্তু আমি থমকে যাই, আরেকবার ফিরে তাকাতেই হয়। দৃষ্টিবিনিময় হতেই কালো মেঘ দুফালি করে বিজলি চমকাল যেন সেই চোখে, ঠোঁটে চাপা একটু হাসি। আমি বোকা মানুষ, বোকার মতো কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকি। তারপর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সরে আসি, ধীর-পায়ে পাহাড়ের চড়াই বেয়ে উঠতে থাকি আদালত ভবনের দিকে। বড় একটা শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। আসা-যাওয়ার পথে আমার মতো কতশত মানুষ তাকে দেখেছে। কেউ মনে রাখেনি। কিন্তু আমাকেই শুধু রাতে ঘুমছাড়া করে রাখল মেয়েটি। চোখ বুজলে তার ঠোঁট-চাপা হাসি মনে পড়ে, মাথায় বাজপড়া মানুষের মতো নিঃসাড় হয়ে থাকি আমি, তার চুলের বেণি আমার কপালে দু-ভ্রুর মাঝখানে সাপের ফণা দোলায়। কোর্টবিল্ডিংয়ের পাহাড়ে কী কাজ তার জানি না, আরও দু-একবার দেখেছি, সেই শিমুলগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আড়চোখে একবার তাকিয়ে আমি দ্রুত সরে গেছি। কিন্তু মাথা থেকে তো সরাতে পারি না, রাতে ঘুম হয় না বলে দিনের কাজকর্মে মন বসাতে পারি না। ছাত্রকে পাঠদান আর আইন কলেজে নিজের পাঠগ্রহণ—সব কাজই এলোমেলো হয়ে যায়। আমার এ অবস্থার কথা জানাব যে এমন কাউকেও তো পাই না। শিরিন থাকলে নাহয় বুদ্ধিমতী মেয়েটার সঙ্গে আলাপ-পরামর্শ করা যেত। সেদিন হনহন করে উঠে যাচ্ছিলাম আদালত ভবনের দিকে। সেই একই শিমুলগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। ঝলমলে শাড়ি-ব্লাউজ পরেছে প্রায় নব-বিবাহিতা নারীর মতো। পা আটকে গেল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল আরও একটি মেয়ে। তবে আমার চোখ থেকে তখন এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লোকারণ্যই হারিয়ে গেছে, পাশের মেয়েটাকে আলাদা করে লক্ষ করার সময় কোথায়। দৃষ্টি বিনিময় হলো, আর তার চোখে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। দৃষ্টি ফেরাতে পারি না। এবার ঠোঁট-চাপা হাসিটা একটু বিস্তৃত হলো। অবশেষে আমাকে হাত তুলে ডাকল। বেদেনীর ইশারাকে যেমন অনুসরণ করে সাপ, সেভাবেই যেন সুরসুর করে পৌঁছে গেলাম শিমুলগাছের নিচে। কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াতেই বলল, ‘যাইবেন?’
গলাটা কর্কশ, তার মুখশ্রীর সঙ্গে বেমানান।
বললাম, ‘কোথায়?’
‘আরে মিয়া, যাইবেন কি না কন?’
প্রায় ধমকের সুরে এই প্রশ্ন শুনে কোথায় যাব, কেন যাব—এসব নিয়ে কৌতূহল প্রকাশের সাহস হারিয়ে ফেলেছি, বললাম, ‘যাব।’
পাশের দাঁড়ানো মেয়েটাকে বলল, ‘তুই থাক, আমি আসতাছি।’
সে ইঙ্গিতে হাসল।
গন্তব্য জানি না, আমি পিছু নিলাম। কোর্টবিল্ডিং থেকে হেঁটে লালদীঘির পাড় এলাকায় একটি হোটেলের ভেতর ঢুকে রিসেপশন কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বলল, ‘চাবি দ্যান...।’
রিসেপশনের লোকটা নিশ্চয় পূর্বপরিচিত, আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে একটা চাবি দিয়ে বলল, ‘দোতলা, ২১৯ নম্বর...।’
অপরিচ্ছন্ন আলো-অন্ধকার ছোট একটি ঘর। একটি সিঙ্গেল খাট, একপাশে টেবিলের সঙ্গে একটি চেয়ার, এক কোণে একটি টেলিভিশনও আছে।
সুইচ টিপে ঘরের আলো জ্বালিয়ে মেয়েটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘সাত শ টাকা দ্যান।’
আমি একটু অবাক হয়ে তাকাতেই বলল, ‘রুম ভাড়া দুই শ টাকা, আমার পাঁচ শ।’
বুঝে না বুঝে বাধ্য ছেলের মতো আমি গুনে গুনে ওর হাতে সাত শ টাকা তুলে দিলাম। টাকাটা নিয়ে অদ্ভুত করে হাসল। তারপর একটানে পরনের শাড়িটা খুলে ছুড়ে দিল খাটের ওপর। শাড়ি-সায়া পরা মেয়েটার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছি না। কেমন বিভ্রান্ত বোধ করলাম। আমি বোকা মানুষ, কিন্তু এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো যেন। বললাম, ‘না না, আমি এই জন্য আসি নাই...।’
বিস্ফারিত চোখ, বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তাইলে কী কামে আসছেন? আমার লগে আপনের কামডা কী?’
‘না, আমি মানে...।’
‘আমি মানে কী? আমার লগে লাভ-মেরিজ করতে আসছেন? কোথ্থাইকা জানি আসে এইসব মাল। হালার দিনডা বরবাদ গেল আইজ...।’
গজগজ করতে করতে খাট থেকে তুলে শাড়িটা জড়িয়ে নিতে শুরু করল শরীরে।
খুবই বিব্রত কণ্ঠে বললাম, ‘তুমার নাম কী?’
‘আমার নাম দিয়া আপনের কাম কী? আমার নাম পরি।’
‘পরি!’—চমকে উঠি আমি। পরির পাহাড়ে শিমুলগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে, তার নাম পরি!
‘আপনের কী নাম?’—গলায় তখনো প্রচণ্ড বিরক্তি।
‘আকবর।’
‘আকবর!’—এবার হেসে ফেলল পরি, রসিকতার সুরেই বলল, ‘তো বাদশা আকবর, আমার কাছে আপনার কী দরকার কন তো?’
কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে, আমার কী দরকারের কথা জানাব পরিকে। আমি মনে মনে নানা কথা আওড়াই, কিন্তু কোনো কথাই জুতসই মনে হয় না। এই নিরুপায় অবস্থায় হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে বলে বসি, ‘আমি তোমারে, মানে...তোমারে ভালোবাসি।’—কী করে যে এ কথা বেরিয়ে গেল আমারই মুখ দিয়ে!
এবার হাঁ হয়ে গেল পরির মুখ। ওকে এ রকম বিহ্বল অবস্থায় দেখে সাহস বেড়ে গেল যেন, মুখের ওপর বলে ফেললাম, ‘তোমারে বিয়া করতে চাই আমি।’
নিজেকে সামলে নিয়েছে ততক্ষণে। এবার কাচভাঙা শব্দে ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল পরি, ধপ করে বসে পড়ল খাটের ওপর, ‘এত্ত বড় দুনিয়ায় আপনে আর মাইয়া মানুষ খুঁইজা পাইলেন না বাদশা আকবর। গেরাম থিকা নতুন আসছেন মনে অয়। যান বাইত যান, গিয়া বড় ভাবির ছোট বইনরে বিয়া কইরা সুখে-শান্তিতে দিন কাটান গিয়া...দুনিয়ায় ভালোবাসার কুনো অভাব নাই।’
আশ্চর্য! ভাবির বোনের কথা বলল কেন? পরি কী করে জানল আমার বড় ভাবির বোন শিরিন আমার প্রতি দুর্বল।
‘ভাবির বইনের কথা বললা ক্যান?’
‘ক্যান আবার, গেরামে খালাতো বইন, তালতো বইনের লগেই তো যত ভাব-ভালোবাসা। শেফালী ঘোষের গান শোনেন নাই—“অ পরানের তালতো ভাই...”।’
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি পরির দিকে।
পাঁচ শ টাকা ফেরত দিয়ে পরি বলল, ‘নেন, আপনার ট্যাকা ফিরায়া দিলাম, হোটেলের ভাড়া দুই শ ট্যাকা কিন্তু দেওন লাগব।’
‘ট্যাকা আমার লাগব না, তুমি রাইখা দাও।’
‘কাজ-কাম ছাড়া টাকা লই না আমি, আমাগোর কুনো নীতি নাই মনে করছেন?’
টাকা ফিরিয়ে নিই। কেন জানি দুচোখ ভিজে আসে আমার। দেখে করুণা হলো পরির, কাছে এসে আমার মাথাটা টেনে নিল বুকের কাছে। সস্তা দামের পাউডার আর ঘামের গন্ধটা আমাকে কী এক ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। বেশ কিছুটা সময় মুখ ডুবিয়ে রাখি পরির বুকে।
পরি বলল, ‘আমরা বাজারি মাইয়া বাদশা আকবর, আমার কাছে ভালোবাসা আছেনি পাগল? যাও বাড়ি ফিইরা যাও, তুমার কথা কইলাম আমার অনেক দিন মনে থাকব।’
আমি করুণ চোখে তাকিয়ে থাকি পরির দিকে। সে আনমনে বিড়বিড় করে, ‘এই বাজারে আল্লা কত পাগলের দেহা পাই!’
দুই. আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন আমার সফল হওয়ার নয়—এ কথা বুঝতে পেরে শহরের পাট চুকিয়ে আবার ফিরে এসেছি গ্রামের বাড়িতে। আমার উলাঝুলা চেহারা দেখে শিরিন বলেছে, ‘কইছিলাম না ছ্যাড়াবেড়া অইয়া যাইব। তোমারে আমার চেয়ে বেশি আর চিনছে কে?’
আমাকে এতই যখন চেনে শিরিন, ভাবলাম তাকেই বিয়ে করি। এ কথা বাড়িতে জানাতেই ভাই-ভাবি সবাই খুশি। শিরিন তো লজ্জায়-আনন্দে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে কেঁদেই ফেলে। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আমি বাজারে মনিহারি দোকান খোলার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। শিরিনকে পরির সব কথা খুলে বলেছি। সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে, বলে, ‘কইছিলাম না ধরা খাইবা তুমি।’
কত কথা বলেছি, কিন্তু এত যে বোকা মানুষ আমি, তা-ও একটা কথা গোপন রাখতে পেরেছি। কাউকে বলিনি, এমনকি শিরিনকেও না যে, সস্তা পাউডার আর ঘামের গন্ধটা নাকে লেগে আছে আমার। কেউ জানে না, একা একা খালপাড়ে বসে পরির কাছে ফোন করি আমি। কোনো দিন ফোন ধরেই পরি বলে, ‘এহন না পরে, ঘরে এহন কাস্টমার আছে।’ আবার কোনো দিন বলে, ‘সারা দিন শিমুলগাছের তলায় দাঁড়ায়া আছি, কাস্টমারের দেহা নাই। তুমি কেমুন আছ বাদশা আকবর?’
বুকের ভেতর বর্ষার ভরা খালের খলবল জলের শব্দ শুনতে পাই তখন। আমি আকুল হয়ে বলি, ‘তুমার জন্য বড় মন পোড়ে, পরি।’ পরি বলে, ‘মনের হিসাব তো আমি বুঝি না বাদশা আকবর, শরীর ছাড়া আমার আর কিছু নাই।’ পরি আমার আম্মা, ভাই-ভাবির কথা জানতে চায়, শিরিনের কথাও জানতে চায়। আমি সব বলি। কিন্তু পরি বলে না। তার বাবা-মার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘জানি না।’ ঘর-বাড়ি কোথায়, তার ঠিকানাও নাকি জানে না। তাহলে পরি কোথা থেকে এল?
এককালে কোর্টবিল্ডিংয়ের জনবিরল পাহাড়ে পরিরা নেমে আসত। আকাশে উজ্জ্বল আলো ফুটে ওঠার আগে, অথবা খুব ভোরে; হয়তো গাছে গাছে যখন সূর্যাস্তের লাল আভা ছড়িয়ে পড়ত, সেই শেষ বিকেলে। আমার কেন জানি মনে হয়, সেই পরিদের কেউ একজন ভুলে তার ছোট্ট শিশুটিকে ফেলে রেখে গিয়েছিল। সেই পরিই এখন বড় হয়ে কাস্টমারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে শিমুলগাছের ছায়ায়।

No comments

Powered by Blogger.