ভারত: অসহিষ্ণুতার দুই রূপ by হাসান ফেরদৌস
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশেষে মুখ খুলেছেন। দুই সপ্তাহ আগে রাজধানী
নয়াদিল্লির কাছে বিসারা গ্রামে মোহাম্মদ ইকলাখ নামের এক মুসলমান উন্মত্ত
জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। তাঁর ‘অপরাধ’, গোপনে তিনি গরুর মাংস
খেয়েছিলেন, তাঁর রেফ্রিজারেটরে মাংসের কিছুটা তুলেও রাখা হয়েছিল। (পরে
অবশ্য জানা গেছে, গরুর মাংস নয়, খাসির মাংস ছিল তাঁর ঘরে)। সারা দেশে এ
নিয়ে তোলপাড়, কিন্তু মোদি এ নিয়ে রা’টি করেননি।
এমনিতে মোদির মুখে কথার খই ফোটে। ইকলাখ নিহত হওয়ার পরে আট দিন হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেননি। দেশ-বিদেশের হরেক মানুষের কাছে তিনি ব্যক্তিগত টুইটার বার্তা পাঠিয়েছেন। লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, চীনের জাতীয় দিবসেও উষ্ণ অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি। শুধু ভুলে গেলেন উন্মত্ত জনতার হাতে এক অসহায় ভারতীয় নাগরিকের হত্যার নিন্দা করতে।
বিহারে নির্বাচনী সভায় গিয়ে তিনি অবশেষে তাঁর নীরবতা ভেঙেছেন। আট দিন পরে বলা সে কথায় এই হত্যাকাণ্ডের কোনো নিন্দা নয়, এমনকি এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য পর্যন্ত নয়। তার বদলে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ভেদাভেদ ভুলে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে আবেদন করেন, মোদি সে কথার পুনরাবৃত্তি করেন। অনুমান করি, গো-মাংস ভক্ষণ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের সমালোচনা করে বিহারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগে নিজের সমর্থকদের নিরাশ করতে চাননি মোদি। বিহারের মতো অনগ্রসর রাজ্যে ধর্ম রাজনীতির একটি বড় অস্ত্র। মোদি সে অস্ত্র এই মোক্ষম সময়ে ব্যবহার করবেন না, তা কী করে হয়?
মোদি ও তাঁর দল যে বিহারের নির্বাচনে গো-মাংসের বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়, সে কথার প্রমাণ এসেছে বিহারে বিজেপির অন্যতম নেতা জোশি মোদির কাছ থেকে। তিনি সোজাসুজি বলেছেন, কারা গো-মাংসের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে, বিহারের নির্বাচনে সে প্রশ্নের ফয়সালা হবে। ‘রাজ্যের মানুষকেই ঠিক করতে হবে তারা গো-মাংস নিষিদ্ধ করার পক্ষে না বিপক্ষে।’
গো-মাংস নিয়ে ভারতে এর আগেও দাঙ্গা হয়েছে। এবারের দাঙ্গা তার চেয়ে খুব ভিন্ন কিছু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফায়দা নেওয়ার চেষ্টায় মৌলবাদীরা দাঙ্গা থামানোর বদলে তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ইকলাখের হত্যাকাণ্ডকে একটি দুর্ঘটনা বলে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ—তিনি এমন দাবিও করেছেন। আরেক মন্ত্রী যারা গো-মাংস ছাড়তে অক্ষম, তাদের পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একজন মন্ত্রী এমন কথাও বলেছেন, মোহাম্মদ ইকলাখের হত্যা মোটেই সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। গ্রামের লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গো-হত্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাঁর এ কথার একটাই অর্থ, খুন হয়েছে, বেশ হয়েছে।
ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ তুলেছেন সে দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা। দেশের প্রধান লেখক, কবিরা সরকারি পুরস্কার ও খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে একের পর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটে চলেছে, তাতে শঙ্কিত হয়েছেন ভারতের বুদ্ধিজীবীরা। তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে হিন্দু-মুসলমান বিয়েতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ধর্মান্তরিত হয়েছেন, এমন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় আক্রান্ত হয়েছে। নয়নতারা শেহগাল ও শশী দেশপান্ডের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক অভিযোগ করেছেন, এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনায় উসকানি দিয়ে অথবা নীরব থেকে দেশের কেন্দ্রীয় নেতারা হিন্দুত্ববাদীদের উৎসাহিত করছেন। এঁদের কেউ কেউ খোলামেলাভাবেই অভিযোগ করেছেন, সাম্প্রদায়িকতায় প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মোদি ভারতীয় জীবনে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নানাভাবে বলে বেড়িয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, প্রাচীন ভারতের ধর্মশাস্ত্রে, বিশেষত বেদে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা মন্ত্র লুকানো আছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোদি দাবি করেন, কসমেটিক সার্জারি ও জেনেটিক বিজ্ঞানের প্রথম উল্লেখ নাকি বেদেই রয়েছে। প্রমাণ? কেন, মহাভারতে যে কর্ণ ও গণেশের কথা আছে, তাতেই প্রমাণ মেলে। কর্ণ তাঁর মাতৃগর্ভ থেকে জন্মাননি, তার মানে হলো, সেই বৈদিক যুগেই জেনেটিক শাস্ত্র প্রাচীন ভারতীয়দের আয়ত্তে ছিল, যার সাহায্যে মায়ের গর্ভের বাইরে কর্ণ জন্ম নিয়েছিলেন। আর গণেশের যে হাতির শুঁড় রয়েছে, সে-ও নিশ্চয় এই জন্য যে প্রাচীন ভারতীয় শল্যচিকিৎসকেরা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে এমন অসাধ্য সাধন করেছিলেন!
মোদির দেখানো পথ ধরে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করে চলেছেন। তাঁদের একজন বলেছেন, চার হাজার বছর আগেই ভারতে হাওয়াই জাহাজ ছিল। ছোটখাটো বিমান নয়, রীতিমতো বিশাল, যা কেবল এক দেশ থেকে অন্য দেশে নয়, এক সৌরমণ্ডল থেকে অন্য সৌরমণ্ডলে অনায়াসে উড়ে যেত পারত। এমনকি রকেটের ব্যবহারেও পারঙ্গম ছিল বৈদিক যুগের ভারতীয়রা।
এই পণ্ডিতদের একজন হলেন সুদর্শন রাও, তাঁর ওপর ভার পড়েছে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার। ভারতের ইংরেজি ম্যাগাজিন আউটলুক-এ ২০১৪ সালের ২১ জুলাই প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এই ভদ্রলোক বলেন, ফিকশন বা কল্পকাহিনি রচনার বয়স মাত্র ১০০ বছর। তার আগে কোনো কল্পকাহিনি লেখা হয়নি। অতএব, চার হাজার বছর আগে লেখা মহাভারত কোনো কল্পকাহিনি নয়। তাঁর সে কথা সমর্থন করে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে সম্প্রতি বলেছেন, ভারত থেকে সব পশ্চিমা ধ্যানধারণা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে। এই খবর হাফিংটন পোস্ট ইন্ডিয়া সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে এ মাসের ১১ তারিখে।
যে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনো নিরক্ষর, সেখানে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তাহলে ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত দেশে বিভেদের নতুন নতুন দেয়াল তুলে দেওয়া হবে। ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ-বিদেশে মোদি এমন একটা বার্তা দিয়েছিলেন, ধর্মভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের বদলে তিনি সারা দেশের মানুষকে এক করার কাজে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তা যে বিদেশিদের চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়, ক্রমেই তা খোলাসা হচ্ছে। রাজনীতিতে ধর্মকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে যিনি ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন, হঠাৎ নিজের খোলনলচে আমূল বদলে ফেলবেন, রাহুল গান্ধীর কথায়, তেমন আশা করে দেশের মানুষ ধোঁকা খেয়েছে। ‘মিষ্টি মিষ্টি অনেক কথা মোদি বলেছেন, কিন্তু লোকসভায় তাঁর দলের বিজয়ের প্রধান কারণ ধর্মীয় বিভক্তি,’ এ কথা রাহুল গান্ধীর। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক দিগ্বিজয় সিংহ কথাটাকে খানিকটা হুল ফোটানোর স্বরে বলেছেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সমর্থকেরা হলো ‘দেশি তালেবান’।
ভারতে যদি ধর্মীয় গোঁড়ামি মাথাচাড়া দেয়, আর তার প্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে, তার প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশেও গড়াবে, এ শুধু সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সে তো কোনো বানানো গল্প নয়। একের পর এক ব্লগার হত্যা, হিন্দুমন্দির আক্রমণ, খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকের ওপর হামলা—গত কয়েক মাসের এসব ঘটনা মোটেই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। ভারতের মতো আমাদেরও ‘দেশি তালেবান’ রয়েছে, হয়তো ইসলামিক স্টেটের সমর্থকও। এদের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন কেউ আমাদের সরকারের ভেতরে নেই, সে কথা হলফ করে বলা যাবে না। সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী ওলামা লীগ বাংলাদেশে শরিয়াহ আইন চালুর দাবি তুলেছে। কই, সে দাবির বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল কোনো মহল থেকে অর্থপূর্ণ প্রতিবাদের কোনো আওয়াজ তো কানে আসেনি।
ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ তুলেছেন সে দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা। দেশের প্রধান লেখক, কবিরা সরকারি পুরস্কার ও খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তাতে আর কিছু না হোক, দেশের মানুষের চোখে বিচারের কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া হচ্ছে মোদি সরকারকে। আমাদের দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরাও অব্যাহত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করবেন—এমন আশা করা কি খুব বেশি কিছু?
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
এমনিতে মোদির মুখে কথার খই ফোটে। ইকলাখ নিহত হওয়ার পরে আট দিন হেন বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি মন্তব্য করেননি। দেশ-বিদেশের হরেক মানুষের কাছে তিনি ব্যক্তিগত টুইটার বার্তা পাঠিয়েছেন। লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, চীনের জাতীয় দিবসেও উষ্ণ অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি। শুধু ভুলে গেলেন উন্মত্ত জনতার হাতে এক অসহায় ভারতীয় নাগরিকের হত্যার নিন্দা করতে।
বিহারে নির্বাচনী সভায় গিয়ে তিনি অবশেষে তাঁর নীরবতা ভেঙেছেন। আট দিন পরে বলা সে কথায় এই হত্যাকাণ্ডের কোনো নিন্দা নয়, এমনকি এ নিয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য পর্যন্ত নয়। তার বদলে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ভেদাভেদ ভুলে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে আবেদন করেন, মোদি সে কথার পুনরাবৃত্তি করেন। অনুমান করি, গো-মাংস ভক্ষণ নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের সমালোচনা করে বিহারের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের ঠিক আগে নিজের সমর্থকদের নিরাশ করতে চাননি মোদি। বিহারের মতো অনগ্রসর রাজ্যে ধর্ম রাজনীতির একটি বড় অস্ত্র। মোদি সে অস্ত্র এই মোক্ষম সময়ে ব্যবহার করবেন না, তা কী করে হয়?
মোদি ও তাঁর দল যে বিহারের নির্বাচনে গো-মাংসের বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চায়, সে কথার প্রমাণ এসেছে বিহারে বিজেপির অন্যতম নেতা জোশি মোদির কাছ থেকে। তিনি সোজাসুজি বলেছেন, কারা গো-মাংসের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে, বিহারের নির্বাচনে সে প্রশ্নের ফয়সালা হবে। ‘রাজ্যের মানুষকেই ঠিক করতে হবে তারা গো-মাংস নিষিদ্ধ করার পক্ষে না বিপক্ষে।’
গো-মাংস নিয়ে ভারতে এর আগেও দাঙ্গা হয়েছে। এবারের দাঙ্গা তার চেয়ে খুব ভিন্ন কিছু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফায়দা নেওয়ার চেষ্টায় মৌলবাদীরা দাঙ্গা থামানোর বদলে তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ইকলাখের হত্যাকাণ্ডকে একটি দুর্ঘটনা বলে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ—তিনি এমন দাবিও করেছেন। আরেক মন্ত্রী যারা গো-মাংস ছাড়তে অক্ষম, তাদের পাকিস্তানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একজন মন্ত্রী এমন কথাও বলেছেন, মোহাম্মদ ইকলাখের হত্যা মোটেই সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়। গ্রামের লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গো-হত্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাঁর এ কথার একটাই অর্থ, খুন হয়েছে, বেশ হয়েছে।
ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ তুলেছেন সে দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা। দেশের প্রধান লেখক, কবিরা সরকারি পুরস্কার ও খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে একের পর সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ ঘটে চলেছে, তাতে শঙ্কিত হয়েছেন ভারতের বুদ্ধিজীবীরা। তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের অংশ হিসেবে হিন্দু-মুসলমান বিয়েতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ধর্মান্তরিত হয়েছেন, এমন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উপাসনালয় আক্রান্ত হয়েছে। নয়নতারা শেহগাল ও শশী দেশপান্ডের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় লেখক অভিযোগ করেছেন, এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনায় উসকানি দিয়ে অথবা নীরব থেকে দেশের কেন্দ্রীয় নেতারা হিন্দুত্ববাদীদের উৎসাহিত করছেন। এঁদের কেউ কেউ খোলামেলাভাবেই অভিযোগ করেছেন, সাম্প্রদায়িকতায় প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মোদি ভারতীয় জীবনে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নানাভাবে বলে বেড়িয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, প্রাচীন ভারতের ধর্মশাস্ত্রে, বিশেষত বেদে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা মন্ত্র লুকানো আছে। গত বছরের ২৮ অক্টোবর ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোদি দাবি করেন, কসমেটিক সার্জারি ও জেনেটিক বিজ্ঞানের প্রথম উল্লেখ নাকি বেদেই রয়েছে। প্রমাণ? কেন, মহাভারতে যে কর্ণ ও গণেশের কথা আছে, তাতেই প্রমাণ মেলে। কর্ণ তাঁর মাতৃগর্ভ থেকে জন্মাননি, তার মানে হলো, সেই বৈদিক যুগেই জেনেটিক শাস্ত্র প্রাচীন ভারতীয়দের আয়ত্তে ছিল, যার সাহায্যে মায়ের গর্ভের বাইরে কর্ণ জন্ম নিয়েছিলেন। আর গণেশের যে হাতির শুঁড় রয়েছে, সে-ও নিশ্চয় এই জন্য যে প্রাচীন ভারতীয় শল্যচিকিৎসকেরা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে এমন অসাধ্য সাধন করেছিলেন!
মোদির দেখানো পথ ধরে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করে চলেছেন। তাঁদের একজন বলেছেন, চার হাজার বছর আগেই ভারতে হাওয়াই জাহাজ ছিল। ছোটখাটো বিমান নয়, রীতিমতো বিশাল, যা কেবল এক দেশ থেকে অন্য দেশে নয়, এক সৌরমণ্ডল থেকে অন্য সৌরমণ্ডলে অনায়াসে উড়ে যেত পারত। এমনকি রকেটের ব্যবহারেও পারঙ্গম ছিল বৈদিক যুগের ভারতীয়রা।
এই পণ্ডিতদের একজন হলেন সুদর্শন রাও, তাঁর ওপর ভার পড়েছে ভারতের ইতিহাস নতুন করে লেখার কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার। ভারতের ইংরেজি ম্যাগাজিন আউটলুক-এ ২০১৪ সালের ২১ জুলাই প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এই ভদ্রলোক বলেন, ফিকশন বা কল্পকাহিনি রচনার বয়স মাত্র ১০০ বছর। তার আগে কোনো কল্পকাহিনি লেখা হয়নি। অতএব, চার হাজার বছর আগে লেখা মহাভারত কোনো কল্পকাহিনি নয়। তাঁর সে কথা সমর্থন করে কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা সম্প্রতি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে সম্প্রতি বলেছেন, ভারত থেকে সব পশ্চিমা ধ্যানধারণা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে। এই খবর হাফিংটন পোস্ট ইন্ডিয়া সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে এ মাসের ১১ তারিখে।
যে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ এখনো নিরক্ষর, সেখানে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, তাহলে ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত দেশে বিভেদের নতুন নতুন দেয়াল তুলে দেওয়া হবে। ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ-বিদেশে মোদি এমন একটা বার্তা দিয়েছিলেন, ধর্মভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের বদলে তিনি সারা দেশের মানুষকে এক করার কাজে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তা যে বিদেশিদের চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়, ক্রমেই তা খোলাসা হচ্ছে। রাজনীতিতে ধর্মকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে যিনি ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন, হঠাৎ নিজের খোলনলচে আমূল বদলে ফেলবেন, রাহুল গান্ধীর কথায়, তেমন আশা করে দেশের মানুষ ধোঁকা খেয়েছে। ‘মিষ্টি মিষ্টি অনেক কথা মোদি বলেছেন, কিন্তু লোকসভায় তাঁর দলের বিজয়ের প্রধান কারণ ধর্মীয় বিভক্তি,’ এ কথা রাহুল গান্ধীর। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক দিগ্বিজয় সিংহ কথাটাকে খানিকটা হুল ফোটানোর স্বরে বলেছেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের সমর্থকেরা হলো ‘দেশি তালেবান’।
ভারতে যদি ধর্মীয় গোঁড়ামি মাথাচাড়া দেয়, আর তার প্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে, তার প্রতিক্রিয়া আমাদের দেশেও গড়াবে, এ শুধু সময়ের ব্যাপার। বাংলাদেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সে তো কোনো বানানো গল্প নয়। একের পর এক ব্লগার হত্যা, হিন্দুমন্দির আক্রমণ, খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকের ওপর হামলা—গত কয়েক মাসের এসব ঘটনা মোটেই বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। ভারতের মতো আমাদেরও ‘দেশি তালেবান’ রয়েছে, হয়তো ইসলামিক স্টেটের সমর্থকও। এদের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন কেউ আমাদের সরকারের ভেতরে নেই, সে কথা হলফ করে বলা যাবে না। সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত আওয়ামী ওলামা লীগ বাংলাদেশে শরিয়াহ আইন চালুর দাবি তুলেছে। কই, সে দাবির বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল কোনো মহল থেকে অর্থপূর্ণ প্রতিবাদের কোনো আওয়াজ তো কানে আসেনি।
ভারতে সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ তুলেছেন সে দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরা। দেশের প্রধান লেখক, কবিরা সরকারি পুরস্কার ও খেতাব ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তাতে আর কিছু না হোক, দেশের মানুষের চোখে বিচারের কাঠগড়ায় তুলে দেওয়া হচ্ছে মোদি সরকারকে। আমাদের দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীরাও অব্যাহত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করবেন—এমন আশা করা কি খুব বেশি কিছু?
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments