খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই -বিশেষ সাক্ষাৎকারে : ফজলে হাসান আবেদ by সিমু নাসের
বিশ্বখাদ্য পুরস্কার হাতে ফজলে হাসান আবেদ |
স্যার ফজলে হাসান আবেদের
জন্ম ১৯৩৬ সালে। ১৯৭২ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন
ব্র্যাক। সময়ের পরিক্রমায় তাঁর এই প্রতিষ্ঠান দেশ ছেড়ে দেশের বাইরেও তার
কার্যক্রম বিস্তার করেছে। বাংলাদেশ, এশিয়া ও আফ্রিকার ১০টি দেশের সাড়ে
১৩ কোটি মানুষ বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের সেবার আওতাভুক্ত। শিক্ষা,
স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি খাতে অবদানের জন্য ফজলে হাসান আবেদ পেয়েছেন
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কার। সম্প্রতি তিনি কৃষি উন্নয়নে বিশ্বের
সবচেয়ে বড় পুরস্কার, ‘ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ ২০১৫’ জিতেছেন। সেটা গ্রহণ
করতে তিনি গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ গ্রহণের দুই দিন
পরে (১৭ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া রাজ্যের দে ময়েন শহরের হোটেল
ম্যারিয়টে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে। : সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিমু নাসের
প্রথম আলো : যেকোনো স্বীকৃতিই মানুষকে আরও কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। এই পুরস্কার আপনাকে ও আপনার প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে কীভাবে আরও সামনে এগিয়ে দেবে বলে মনে করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : আমার কাছে সবচেয়ে খুশির বিষয় হলো, এটা আমার একার পুরস্কার না। এই পুরস্কার ব্র্যাকের সব কর্মীকে তাদের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমি তাদের প্রধান হিসেবে হয়তো বা এই পুরস্কার গ্রহণ করছি। কিন্তু ব্র্যাকের কর্মীদের নিরলস পরিশ্রম ছাড়া এই অর্জন সম্ভব হতো না। তাই এই পুরস্কারের আনন্দ আমরা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছি। ব্র্যাকের পেছনে যে শ্রম দিয়েছে, ব্র্যাকের কাজে যারা সহযোগিতা করেছে, এ পুরস্কার তাদের সবাইকে সম্মানিত করেছে।
প্রথম আলো : ব্র্যাকের কার্যক্রমে এই পুরস্কার কী প্রভাব ফেলবে?
ফজলে হাসান আবেদ : পুরস্কারের অঙ্কের দিকে থেকে এই পুরস্কার আমাদের জন্য বড় কোনো ব্যাপার নয়। তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এটার অর্থমূল্য আড়াই লাখ ডলার। আর আমাদের ব্র্যাকের বাজেট এখন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
প্রথম আলো : টাকার জায়গা থেকে জানতে চাইছি না...
ফজলে হাসান আবেদ : আচ্ছা, আচ্ছা। যেটা হবে সেটা হলো, এই অর্জনের ফলে এখন পৃথিবীর মানুষ ব্র্যাককে আরও ভালো করে জানবে, চিনবে। তারা ব্র্যাকের প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ পাবে। দাতারা আমাদের ওপর আরও আস্থা পাবে। বুঝতে পারবে, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ পাওয়া মানে এটা অবশ্যই খুব ভালো একটা প্রতিষ্ঠান। ফান্ড রেইজিং একটু সহজ হবে আমাদের জন্য। এটা এই পুরস্কারের একটা প্লাস পয়েন্ট। এ ছাড়া ব্র্যাক পৃথিবীর অন্য যেসব দেশে কার্যক্রম চালায়, সেসব জায়গাতেও এই পুরস্কার প্রভাব ফেলবে।
প্রথম আলো : যোগাযোগের জায়গাটাতে...
ফজলে হাসান আবেদ : আর সার্বিকভাবে বলতে গেলে তো এর ফলে ব্র্যাক সম্পর্কে আরও মানুষ জানবে। এটাকে তো বলা হয় কৃষির নোবেল। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা পেয়েছি একই রকম পুরস্কার। ওয়াইজ প্রাইজ ফর এডুকেশন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও পেয়েছি একই মানের পুরস্কার। পেয়েছি হিলটন ফাউন্ডেশন পুরস্কার। এটা তো এখন ২০ লাখ ডলারের পুরস্কার। আমরা নোবেল ছাড়া আসলে সব বড় পুরস্কারই পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কার নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি নোবেল পেতে চাই না। (হাসতে হাসতে) এটা আমার জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে। চারদিক থেকে সাক্ষাৎকার দেওয়া, বক্তব্য দেওয়ার চাপ আসবে। আমার মৃত্যুর পর যদি ব্র্যাক নোবেল পায়, সেটাই হবে ভালো।
প্রথম আলো : খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে গত কয়েক দিন অনেক সেমিনার হলো, বিশিষ্টজনেরা ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০০ কোটি লোকের খাদ্য সংস্থানের কথা বললেন। আপনার কাছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মানে কী? সবাই খেতে পারছে—এটাই কি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা?
ফজলে হাসান আবেদ : না, আসলে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে বলে আমাদের খাদ্যের দরকার ৩ কোটি ৩০ লাখ টন চাল। তো আমরা এখন ৩ কোটি ৪০ লাখ টন উৎপাদন করছি। এই উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন চাল আমরা এখন রপ্তানি করতে পারি। আমার মনে হয়, এখন যেটা হচ্ছে বাংলাদেশে, খুব কম লোকই চরম দারিদ্র্যে ভুগছে; অন্তত খাবারের দিক থেকে নয়। তবে কিছু পরিবার আছে, যাদের তিন-চারটা বাচ্চা, আয়-রোজগার তেমন নেই, নিজে কাজ করে যে খাবারটা পায়, সেটার অর্ধেক নিয়ে এসে বাচ্চাদের দিচ্ছে। আর এরা অপুষ্টির শিকার। এরা নিজে স্কুলে যায় না, তাদের বাচ্চারাও স্কুলে যায় না। এ জন্য আমাদের একটা ‘আলট্রা পুওর প্রোগ্রাম’ করা হয়েছে। আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে চরম দারিদ্র্য থেকে তাদের মুক্ত করতে সহায়তা করছি। এটাকে বলা যায় দারিদ্র্য চক্র ভাঙার একটা চেষ্টা। এই চক্রটা একবার ভেঙে দিতে পারলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আর এই অতি দারিদ্র্যের ভেতর থাকবে না।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের মতো একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, যেখানে মানুষ অনুপাতে কৃষিজমি কম, সেখানে এটা কত বড় সাফল্য মনে করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : এটা বিশাল বড় সাফল্য তো বটেই। একটা আশার জিনিস হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা কিন্তু আর খুব বেশি বাড়বে না। পরিসংখ্যান বলে, আমাদের মহিলাপ্রতি বাচ্চার সংখ্যা ২ দশমিক ১। এটা চলতে থাকবে আগামী ৩০ বছর। আর ১ শতাংশ করে যদি বাড়ে, তবে ২০৬০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ থেকে ২১ কোটি। এরপর আর না বেড়ে সেটা একটু কমবে। অনেকটা চীনের মতোই। এটা আগামী ৩০ বছরে কমবে। কারণ, তারা তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে। এখন গড়ে একটা পরিবারে তাদের ১ দশমিক ৪টা বাচ্চা। আমাদেরও তা-ই হবে। খুলনা বিভাগে ইতিমধ্যে এক পরিবারে দুইয়ের কম বাচ্চা হচ্ছে। এখন বেশি আছে শুধু চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে। এর বাইরে বাকি সব বিভাগেই মহিলা অনুপাতে বাচ্চার সংখ্যা দুইয়ের চেয়ে কম। চট্টগ্রামে সেটা ৩ দশমিক ৪ আর সিলেটে ৩ দশমিক ১। এই দুটো বিভাগকে ২–এ বা এর নিচে আনতে পারলেই দ্রুতগতিতে আমাদের জনসংখ্যা কমতে থাকবে। এখন ১ কোটি ৯০ লাখ ছেলেমেয়ে প্রাইমারি স্কুলে যায়। আস্তে আস্তে কিন্তু এর সংখ্যা কমতে থাকবে। আমরা এখন যে প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়েছি, সেগুলোতে একটা শ্রেণিতে এখন ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী পড়ে। ৩০ বছর পর দেখা যাবে তখন একেকটা ক্লাসে ৩০ জন বাচ্চা পড়ছে। তখন আর আমাদের নতুন করে স্কুল বানাতে হবে না। যুক্তরাজ্যেও তা-ই হয়েছে। অনেক স্কুলই বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষার্থীর অভাবে। এসব জিনিসও আসবে আমাদের দেশে। আমি হয়তো বা দেখে যেতে পারব না।
প্রথম আলো : রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কৃষি নীতিমালা দেশের খাদ্য উৎপাদনে কীভাবে ভূমিকা রাখে?
ফজলে হাসান আবেদ : সরকার তো সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী খুব ভালো একজন মন্ত্রী। তিনি তিন-তিনবার আমাদের কৃষিমন্ত্রী। তিনি কৃষি ও কৃষকদের উন্নতির ব্যাপারে আন্তরিক। উনি আবার দূরদর্শীও বটে। তিনি চিন্তা করেন বাংলাদেশে আমরা ধান উৎপাদনে অনেক পানি অপচয় করি। এই অপচয় কীভাবে কমানো যায়। না কমাতে পারলে ধীরে ধীরে আমাদের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে। ১০০ বছর পর একসময় দেখা যাবে সেচের জন্য অনেক বেশি নিচ পর্যন্ত পাইপ বসাতে হচ্ছে, পানিই পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্যই তিনি কৃষকদের বলেন, অযথাই পানি দেবেন না। অপচয় করবেন না। এবং আমার মনে হয়, বিএনপি সরকারের আমলেও আমরা ভালো কৃষিমন্ত্রী পেয়েছিলাম। এম কে আনোয়ার ছিলেন মন্ত্রী। এরশাদের পরে আমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই সরকারের আমলেই আমরা খুব ভালো কৃষিমন্ত্রী পেয়েছি। তাঁরা সবাই ছিলেন পরিশ্রমী। তাঁরা খুব ভালো করেছেন। প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিয়ে সার, ডিজেলকে কৃষকের নাগালে রাখার চেষ্টা করেছেন। দুই সরকারই দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করেছে, তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এ ব্যাপারে। তবে আমার মনে হয় আওয়ামী আমলে কাজ একটু বেশি হয়েছে। ভিজিএ, ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম), দুস্থ মাতা ইত্যাদি প্রকল্প আওয়ামী সরকার একটু বাড়িয়েছে। যদিও অনেক কিছুই যেমন বয়স্ক ভাতা শুরু করেছিল বিএনপি। তারপর আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব সেটা বাড়িয়েছেন।
প্রথম আলো : কৃষি প্রযুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার উচ্চ ফলনশীল জাত। এর বাইরে সামনে আর কী ধরনের প্রযুক্তি কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমাদের দেশে কী ধরনের প্রযুক্তি খাদ্য উৎপাদন বাড়াবে?
ফজলে হাসান আবেদ : উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যেই আরও নতুন নতুন জাত তৈরি হচ্ছে। ইরি, বিরি সব জায়গাতেই গবেষণা চলছে আরও উচ্চ ফলনশীল জাত আবিষ্কারের। আমাদের দেশে এখন গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৬ টন। চীনে এটা ৯ টন। আমাদের আরও অন্তত ৩ টন বাড়ানোর সুযোগ আছে। চীনের কৃষকেরা যদি করতে পারেন, আমাদের কৃষকেরা করতে পারবেন না কেন? আমি মানি যে চীনের কৃষকেরা আমাদের কৃষকদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত, তাঁরা জানেন কোন ফসলের জন্য কতটুকু সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। তাঁরা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন অনেক বেশি। আমাদের কৃষকেরাও আস্তে আস্তে শিক্ষিত হচ্ছেন। আমি আশা করি, আগামী ২০ বছরের মধ্যেই আমাদের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন চীনের মতোই হয়ে যাবে।
প্রথম আলো : কিন্তু দিনকে দিন আমাদের উৎপাদনযোগ্য জমি তো কমছে...
ফজলে হাসান আবেদ : জমি কমছে কিন্তু উৎপাদন তো বাড়ছে। ৯০ লাখ হেক্টর থেকে ৮০ লাখ হেক্টরে চলে এসেছে আমাদের জমি। সেটা হয়তো ৭০ লাখ হেক্টরে চলে আসবে। ৭০ লাখ হেক্টরে আমাদের ৩০ শতাংশ বেশি ফসল ফলাতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
প্রথম আলো : আপনারা যখনই প্রয়োজন মনে করেছেন তখনই নতুন নতুন সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। কিন্তু বর্তমান ধারা অনুযায়ী অনেক বড় প্রতিষ্ঠানকেই নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চাইলে ইতিমধ্যেই তৈরি আছে এমন প্রতিষ্ঠানকে আত্তীকরণ করতে দেখা যায়। আপনাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম না কেন?
ফজলে হাসান আবেদ : আমরা তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নই। তাই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে আত্তীকরণে আমাদের আগ্রহ নেই। কোনো একটা প্রতিষ্ঠান যদি ভালো কাজ করে, তবে আমরা তাকে সহযোগিতা করতে চাই, সেটা যেন আরও সামনে এগিয়ে যায়। আমরা সহযোগিতা চুক্তিতে এগোতে চাই। আর সেই সূত্রেই এখন আমরা প্রচুর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, কৃষি—সব ক্ষেত্রেই। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখে একসঙ্গে কাজ করি। এভাবেই আমরা কাজ করি।
প্রথম আলো : সেদিন বক্তব্যে আপনি বলেছেন, যখন যেটা প্রয়োজন হয়েছে আপনারা সেটাই করেছেন। এই সময়ে বাংলাদেশের জন্য কোন জিনিসটি জরুরি বলে মনে করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : শিক্ষায় আমাদের এখনো অনেক কিছু করার আছে। এই জায়গাটায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। শিক্ষায় উন্নতির জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, শিক্ষার মানের তত্ত্বাবধান। আমরা চাই সবাই শিক্ষিত হোক কিন্তু আমাদের দরিদ্র লোকদের শিক্ষার মান এতই খারাপ যে এটায় সরকারকে নজর দিতে হবে। ধনী লোকেরা তাঁদের সন্তানকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত করে তুলছেন কিন্তু সেটার অনুপাত খুবই কম। তাই সরকারি শিক্ষার মান উন্নত না করলে কিন্তু জাতি হিসেবেও উন্নতি করা যায় না। কাজেই উন্নত সরকারি শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো : আপনাদের ব্র্যাক স্কুলের কী অবস্থা?
ফজলে হাসান আবেদ : আমাদের স্কুল তো ভালো চলছে। কিন্তু আমরা মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্র নিয়ে কাজ করি। আর ১০ শতাংশ হয়তো বা বেসরকারিতে যাচ্ছে কিন্তু ৮০ শতাংশ যাচ্ছে সরকারি স্কুলে। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য এই ৮০ শতাংশের উন্নত লেখাপড়া খুবই জরুরি। কাজেই এখানে অনেক কিছু করার আছে। আমরা সেই জায়গাটা নিয়েই কাজ করতে চাই।
প্রথম আলো : খাদ্যপুষ্টির দিক থেকে কি আমাদের দেশীয় খাবার মানসম্মত বলে আপনার মনে হয়?
ফজলে হাসান আবেদ : না। আমরা খাবারে বেশি তেল ব্যবহার করি। আর আমাদের খাবার তালিকায় শর্করাও বেশি। বেশি বেশি তেল ও শর্করা ক্ষতিকর। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকের পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা নেই। আমরা মনে করি, পেটভরে খেলেই বুঝি ঠিকঠাকমতো খাওয়া হলো। প্রোটিন, ভিটামিন পরিমাণমতো খাচ্ছি কি না, একদমই ভাবি না। আর আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হলো খাদ্যে ভেজাল। এর ফলে আমাদের দেশে ক্যানসার বাড়ছে, ডায়াবেটিস বাড়ছে। খাদ্যে ভেজাল যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তবে সেটা আমাদের জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। এই যে ৩০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে, এগুলো তো আগে ছিল না। এগুলো হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের কারণে। নতুন কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা দ্রুত টাকা বানাতে চান। আর আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ও হচ্ছে দিন দিন। ঘুষ ছাড়া নাকি দেশে এখন কোনো কাজই হয় না। এসব জিনিসের জন্য যারা খাদ্য ব্যবসায় আছে, তারা ভাবে আমি যদি আমার আয় ৩০ শতাংশ বাড়াতে পারি ভেজাল দিয়ে, তাহলে কেন নয়? এটা একটা চক্র। আর আমরা সবাই এই চক্রের ভেতর পড়ে গেছি।
প্রথম আলো : এই চক্র থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
ফজলে হাসান আবেদ : এই চক্র থেকে বের হতে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য সরকার এখন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকার এসে এই কমিশনের নখ, দাঁত ভেঙে দিল। তাই যতই সরকার বলুক আমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে চাই, আসলে কিন্তু সেটা না।
প্রথম আলো : এখানে আমাদের তাহলে আশার জায়গাটা কী?
ফজলে হাসান আবেদ : এত সহজে এই জায়গাটার পরিবর্তন হবে না। আস্তে আস্তে হবে। এমন না যে এই সরকারের বদলে অন্য সরকার এলে সব পাল্টে যাবে। তারাও একই কাজই করবে। যত দিন পর্যন্ত আমাদের দেশের লোক শিক্ষিত ও সচেতন না হচ্ছে, তত দিন এটা চলতেই থাকবে। তবে আমার মনে হয়, সামনের ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এই চক্র আমরা ভাঙতে পারব। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।
প্রথম আলো : আপনার কি মনে হয় আমরা এসব কারণে অন্য দেশের থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি?
ফজলে হাসান আবেদ : হ্যাঁ। তবে আমরা এখনো ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছি। যদি দুর্নীতি না থাকত, তাহলে আমরা আরও দ্রুত উন্নতি করতে পারতাম। তবে এসব কারণে দরিদ্র লোকেরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। ধনী লোকেরা পয়সা ঢেলে, ঘুষ দিয়ে আবার পয়সা বানিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু গরিব লোকেরা ঘুষও দিতে পারে না, পয়সাও বানাতে পারে না। তবে আমি আশাবাদী এই চক্র থেকে অন্যদের তুলনায় আমরা দ্রুতই বের হতে পারবে।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ফজলে হাসান আবেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : যেকোনো স্বীকৃতিই মানুষকে আরও কাজের অনুপ্রেরণা দেয়। এই পুরস্কার আপনাকে ও আপনার প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে কীভাবে আরও সামনে এগিয়ে দেবে বলে মনে করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : আমার কাছে সবচেয়ে খুশির বিষয় হলো, এটা আমার একার পুরস্কার না। এই পুরস্কার ব্র্যাকের সব কর্মীকে তাদের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমি তাদের প্রধান হিসেবে হয়তো বা এই পুরস্কার গ্রহণ করছি। কিন্তু ব্র্যাকের কর্মীদের নিরলস পরিশ্রম ছাড়া এই অর্জন সম্ভব হতো না। তাই এই পুরস্কারের আনন্দ আমরা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছি। ব্র্যাকের পেছনে যে শ্রম দিয়েছে, ব্র্যাকের কাজে যারা সহযোগিতা করেছে, এ পুরস্কার তাদের সবাইকে সম্মানিত করেছে।
প্রথম আলো : ব্র্যাকের কার্যক্রমে এই পুরস্কার কী প্রভাব ফেলবে?
ফজলে হাসান আবেদ : পুরস্কারের অঙ্কের দিকে থেকে এই পুরস্কার আমাদের জন্য বড় কোনো ব্যাপার নয়। তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। এটার অর্থমূল্য আড়াই লাখ ডলার। আর আমাদের ব্র্যাকের বাজেট এখন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার।
প্রথম আলো : টাকার জায়গা থেকে জানতে চাইছি না...
ফজলে হাসান আবেদ : আচ্ছা, আচ্ছা। যেটা হবে সেটা হলো, এই অর্জনের ফলে এখন পৃথিবীর মানুষ ব্র্যাককে আরও ভালো করে জানবে, চিনবে। তারা ব্র্যাকের প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ পাবে। দাতারা আমাদের ওপর আরও আস্থা পাবে। বুঝতে পারবে, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ পাওয়া মানে এটা অবশ্যই খুব ভালো একটা প্রতিষ্ঠান। ফান্ড রেইজিং একটু সহজ হবে আমাদের জন্য। এটা এই পুরস্কারের একটা প্লাস পয়েন্ট। এ ছাড়া ব্র্যাক পৃথিবীর অন্য যেসব দেশে কার্যক্রম চালায়, সেসব জায়গাতেও এই পুরস্কার প্রভাব ফেলবে।
প্রথম আলো : যোগাযোগের জায়গাটাতে...
ফজলে হাসান আবেদ : আর সার্বিকভাবে বলতে গেলে তো এর ফলে ব্র্যাক সম্পর্কে আরও মানুষ জানবে। এটাকে তো বলা হয় কৃষির নোবেল। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা পেয়েছি একই রকম পুরস্কার। ওয়াইজ প্রাইজ ফর এডুকেশন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও পেয়েছি একই মানের পুরস্কার। পেয়েছি হিলটন ফাউন্ডেশন পুরস্কার। এটা তো এখন ২০ লাখ ডলারের পুরস্কার। আমরা নোবেল ছাড়া আসলে সব বড় পুরস্কারই পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কার নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না কিন্তু এটা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক। আর ব্যক্তিগতভাবে আমি নোবেল পেতে চাই না। (হাসতে হাসতে) এটা আমার জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে। চারদিক থেকে সাক্ষাৎকার দেওয়া, বক্তব্য দেওয়ার চাপ আসবে। আমার মৃত্যুর পর যদি ব্র্যাক নোবেল পায়, সেটাই হবে ভালো।
প্রথম আলো : খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে গত কয়েক দিন অনেক সেমিনার হলো, বিশিষ্টজনেরা ২০৫০ সালের মধ্যে ৯০০ কোটি লোকের খাদ্য সংস্থানের কথা বললেন। আপনার কাছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মানে কী? সবাই খেতে পারছে—এটাই কি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা?
ফজলে হাসান আবেদ : না, আসলে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে বলে আমাদের খাদ্যের দরকার ৩ কোটি ৩০ লাখ টন চাল। তো আমরা এখন ৩ কোটি ৪০ লাখ টন উৎপাদন করছি। এই উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন চাল আমরা এখন রপ্তানি করতে পারি। আমার মনে হয়, এখন যেটা হচ্ছে বাংলাদেশে, খুব কম লোকই চরম দারিদ্র্যে ভুগছে; অন্তত খাবারের দিক থেকে নয়। তবে কিছু পরিবার আছে, যাদের তিন-চারটা বাচ্চা, আয়-রোজগার তেমন নেই, নিজে কাজ করে যে খাবারটা পায়, সেটার অর্ধেক নিয়ে এসে বাচ্চাদের দিচ্ছে। আর এরা অপুষ্টির শিকার। এরা নিজে স্কুলে যায় না, তাদের বাচ্চারাও স্কুলে যায় না। এ জন্য আমাদের একটা ‘আলট্রা পুওর প্রোগ্রাম’ করা হয়েছে। আমরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে চরম দারিদ্র্য থেকে তাদের মুক্ত করতে সহায়তা করছি। এটাকে বলা যায় দারিদ্র্য চক্র ভাঙার একটা চেষ্টা। এই চক্রটা একবার ভেঙে দিতে পারলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আর এই অতি দারিদ্র্যের ভেতর থাকবে না।
প্রথম আলো : বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের মতো একটা ঘনবসতিপূর্ণ দেশে, যেখানে মানুষ অনুপাতে কৃষিজমি কম, সেখানে এটা কত বড় সাফল্য মনে করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : এটা বিশাল বড় সাফল্য তো বটেই। একটা আশার জিনিস হলো, বাংলাদেশের জনসংখ্যা কিন্তু আর খুব বেশি বাড়বে না। পরিসংখ্যান বলে, আমাদের মহিলাপ্রতি বাচ্চার সংখ্যা ২ দশমিক ১। এটা চলতে থাকবে আগামী ৩০ বছর। আর ১ শতাংশ করে যদি বাড়ে, তবে ২০৬০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ২০ থেকে ২১ কোটি। এরপর আর না বেড়ে সেটা একটু কমবে। অনেকটা চীনের মতোই। এটা আগামী ৩০ বছরে কমবে। কারণ, তারা তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে। এখন গড়ে একটা পরিবারে তাদের ১ দশমিক ৪টা বাচ্চা। আমাদেরও তা-ই হবে। খুলনা বিভাগে ইতিমধ্যে এক পরিবারে দুইয়ের কম বাচ্চা হচ্ছে। এখন বেশি আছে শুধু চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে। এর বাইরে বাকি সব বিভাগেই মহিলা অনুপাতে বাচ্চার সংখ্যা দুইয়ের চেয়ে কম। চট্টগ্রামে সেটা ৩ দশমিক ৪ আর সিলেটে ৩ দশমিক ১। এই দুটো বিভাগকে ২–এ বা এর নিচে আনতে পারলেই দ্রুতগতিতে আমাদের জনসংখ্যা কমতে থাকবে। এখন ১ কোটি ৯০ লাখ ছেলেমেয়ে প্রাইমারি স্কুলে যায়। আস্তে আস্তে কিন্তু এর সংখ্যা কমতে থাকবে। আমরা এখন যে প্রাথমিক বিদ্যালয় বানিয়েছি, সেগুলোতে একটা শ্রেণিতে এখন ৬০-৭০ জন শিক্ষার্থী পড়ে। ৩০ বছর পর দেখা যাবে তখন একেকটা ক্লাসে ৩০ জন বাচ্চা পড়ছে। তখন আর আমাদের নতুন করে স্কুল বানাতে হবে না। যুক্তরাজ্যেও তা-ই হয়েছে। অনেক স্কুলই বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষার্থীর অভাবে। এসব জিনিসও আসবে আমাদের দেশে। আমি হয়তো বা দেখে যেতে পারব না।
প্রথম আলো : রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও কৃষি নীতিমালা দেশের খাদ্য উৎপাদনে কীভাবে ভূমিকা রাখে?
ফজলে হাসান আবেদ : সরকার তো সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী খুব ভালো একজন মন্ত্রী। তিনি তিন-তিনবার আমাদের কৃষিমন্ত্রী। তিনি কৃষি ও কৃষকদের উন্নতির ব্যাপারে আন্তরিক। উনি আবার দূরদর্শীও বটে। তিনি চিন্তা করেন বাংলাদেশে আমরা ধান উৎপাদনে অনেক পানি অপচয় করি। এই অপচয় কীভাবে কমানো যায়। না কমাতে পারলে ধীরে ধীরে আমাদের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে। ১০০ বছর পর একসময় দেখা যাবে সেচের জন্য অনেক বেশি নিচ পর্যন্ত পাইপ বসাতে হচ্ছে, পানিই পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্যই তিনি কৃষকদের বলেন, অযথাই পানি দেবেন না। অপচয় করবেন না। এবং আমার মনে হয়, বিএনপি সরকারের আমলেও আমরা ভালো কৃষিমন্ত্রী পেয়েছিলাম। এম কে আনোয়ার ছিলেন মন্ত্রী। এরশাদের পরে আমাদের আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই সরকারের আমলেই আমরা খুব ভালো কৃষিমন্ত্রী পেয়েছি। তাঁরা সবাই ছিলেন পরিশ্রমী। তাঁরা খুব ভালো করেছেন। প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিয়ে সার, ডিজেলকে কৃষকের নাগালে রাখার চেষ্টা করেছেন। দুই সরকারই দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করেছে, তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এ ব্যাপারে। তবে আমার মনে হয় আওয়ামী আমলে কাজ একটু বেশি হয়েছে। ভিজিএ, ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম), দুস্থ মাতা ইত্যাদি প্রকল্প আওয়ামী সরকার একটু বাড়িয়েছে। যদিও অনেক কিছুই যেমন বয়স্ক ভাতা শুরু করেছিল বিএনপি। তারপর আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেব সেটা বাড়িয়েছেন।
প্রথম আলো : কৃষি প্রযুক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার উচ্চ ফলনশীল জাত। এর বাইরে সামনে আর কী ধরনের প্রযুক্তি কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমাদের দেশে কী ধরনের প্রযুক্তি খাদ্য উৎপাদন বাড়াবে?
ফজলে হাসান আবেদ : উচ্চ ফলনশীল জাতের মধ্যেই আরও নতুন নতুন জাত তৈরি হচ্ছে। ইরি, বিরি সব জায়গাতেই গবেষণা চলছে আরও উচ্চ ফলনশীল জাত আবিষ্কারের। আমাদের দেশে এখন গড় উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৬ টন। চীনে এটা ৯ টন। আমাদের আরও অন্তত ৩ টন বাড়ানোর সুযোগ আছে। চীনের কৃষকেরা যদি করতে পারেন, আমাদের কৃষকেরা করতে পারবেন না কেন? আমি মানি যে চীনের কৃষকেরা আমাদের কৃষকদের তুলনায় বেশি শিক্ষিত, তাঁরা জানেন কোন ফসলের জন্য কতটুকু সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। তাঁরা প্রযুক্তি ব্যবহার করেন অনেক বেশি। আমাদের কৃষকেরাও আস্তে আস্তে শিক্ষিত হচ্ছেন। আমি আশা করি, আগামী ২০ বছরের মধ্যেই আমাদের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন চীনের মতোই হয়ে যাবে।
প্রথম আলো : কিন্তু দিনকে দিন আমাদের উৎপাদনযোগ্য জমি তো কমছে...
ফজলে হাসান আবেদ : জমি কমছে কিন্তু উৎপাদন তো বাড়ছে। ৯০ লাখ হেক্টর থেকে ৮০ লাখ হেক্টরে চলে এসেছে আমাদের জমি। সেটা হয়তো ৭০ লাখ হেক্টরে চলে আসবে। ৭০ লাখ হেক্টরে আমাদের ৩০ শতাংশ বেশি ফসল ফলাতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
প্রথম আলো : আপনারা যখনই প্রয়োজন মনে করেছেন তখনই নতুন নতুন সহযোগী প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন। কিন্তু বর্তমান ধারা অনুযায়ী অনেক বড় প্রতিষ্ঠানকেই নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চাইলে ইতিমধ্যেই তৈরি আছে এমন প্রতিষ্ঠানকে আত্তীকরণ করতে দেখা যায়। আপনাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম না কেন?
ফজলে হাসান আবেদ : আমরা তো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নই। তাই অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে আত্তীকরণে আমাদের আগ্রহ নেই। কোনো একটা প্রতিষ্ঠান যদি ভালো কাজ করে, তবে আমরা তাকে সহযোগিতা করতে চাই, সেটা যেন আরও সামনে এগিয়ে যায়। আমরা সহযোগিতা চুক্তিতে এগোতে চাই। আর সেই সূত্রেই এখন আমরা প্রচুর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন, কৃষি—সব ক্ষেত্রেই। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখে একসঙ্গে কাজ করি। এভাবেই আমরা কাজ করি।
প্রথম আলো : সেদিন বক্তব্যে আপনি বলেছেন, যখন যেটা প্রয়োজন হয়েছে আপনারা সেটাই করেছেন। এই সময়ে বাংলাদেশের জন্য কোন জিনিসটি জরুরি বলে মনে করেন?
ফজলে হাসান আবেদ : শিক্ষায় আমাদের এখনো অনেক কিছু করার আছে। এই জায়গাটায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। শিক্ষায় উন্নতির জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, শিক্ষার মানের তত্ত্বাবধান। আমরা চাই সবাই শিক্ষিত হোক কিন্তু আমাদের দরিদ্র লোকদের শিক্ষার মান এতই খারাপ যে এটায় সরকারকে নজর দিতে হবে। ধনী লোকেরা তাঁদের সন্তানকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত করে তুলছেন কিন্তু সেটার অনুপাত খুবই কম। তাই সরকারি শিক্ষার মান উন্নত না করলে কিন্তু জাতি হিসেবেও উন্নতি করা যায় না। কাজেই উন্নত সরকারি শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলো : আপনাদের ব্র্যাক স্কুলের কী অবস্থা?
ফজলে হাসান আবেদ : আমাদের স্কুল তো ভালো চলছে। কিন্তু আমরা মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্র নিয়ে কাজ করি। আর ১০ শতাংশ হয়তো বা বেসরকারিতে যাচ্ছে কিন্তু ৮০ শতাংশ যাচ্ছে সরকারি স্কুলে। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য এই ৮০ শতাংশের উন্নত লেখাপড়া খুবই জরুরি। কাজেই এখানে অনেক কিছু করার আছে। আমরা সেই জায়গাটা নিয়েই কাজ করতে চাই।
প্রথম আলো : খাদ্যপুষ্টির দিক থেকে কি আমাদের দেশীয় খাবার মানসম্মত বলে আপনার মনে হয়?
ফজলে হাসান আবেদ : না। আমরা খাবারে বেশি তেল ব্যবহার করি। আর আমাদের খাবার তালিকায় শর্করাও বেশি। বেশি বেশি তেল ও শর্করা ক্ষতিকর। আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকের পুষ্টি সম্পর্কে ধারণা নেই। আমরা মনে করি, পেটভরে খেলেই বুঝি ঠিকঠাকমতো খাওয়া হলো। প্রোটিন, ভিটামিন পরিমাণমতো খাচ্ছি কি না, একদমই ভাবি না। আর আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হলো খাদ্যে ভেজাল। এর ফলে আমাদের দেশে ক্যানসার বাড়ছে, ডায়াবেটিস বাড়ছে। খাদ্যে ভেজাল যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তবে সেটা আমাদের জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক। এই যে ৩০ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে, এগুলো তো আগে ছিল না। এগুলো হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের কারণে। নতুন কিছু ব্যবসায়ী আছেন যারা দ্রুত টাকা বানাতে চান। আর আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ও হচ্ছে দিন দিন। ঘুষ ছাড়া নাকি দেশে এখন কোনো কাজই হয় না। এসব জিনিসের জন্য যারা খাদ্য ব্যবসায় আছে, তারা ভাবে আমি যদি আমার আয় ৩০ শতাংশ বাড়াতে পারি ভেজাল দিয়ে, তাহলে কেন নয়? এটা একটা চক্র। আর আমরা সবাই এই চক্রের ভেতর পড়ে গেছি।
প্রথম আলো : এই চক্র থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
ফজলে হাসান আবেদ : এই চক্র থেকে বের হতে সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য সরকার এখন নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। কিন্তু আওয়ামী সরকার এসে এই কমিশনের নখ, দাঁত ভেঙে দিল। তাই যতই সরকার বলুক আমরা দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে চাই, আসলে কিন্তু সেটা না।
প্রথম আলো : এখানে আমাদের তাহলে আশার জায়গাটা কী?
ফজলে হাসান আবেদ : এত সহজে এই জায়গাটার পরিবর্তন হবে না। আস্তে আস্তে হবে। এমন না যে এই সরকারের বদলে অন্য সরকার এলে সব পাল্টে যাবে। তারাও একই কাজই করবে। যত দিন পর্যন্ত আমাদের দেশের লোক শিক্ষিত ও সচেতন না হচ্ছে, তত দিন এটা চলতেই থাকবে। তবে আমার মনে হয়, সামনের ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এই চক্র আমরা ভাঙতে পারব। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।
প্রথম আলো : আপনার কি মনে হয় আমরা এসব কারণে অন্য দেশের থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি?
ফজলে হাসান আবেদ : হ্যাঁ। তবে আমরা এখনো ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাচ্ছি। যদি দুর্নীতি না থাকত, তাহলে আমরা আরও দ্রুত উন্নতি করতে পারতাম। তবে এসব কারণে দরিদ্র লোকেরাই সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে। ধনী লোকেরা পয়সা ঢেলে, ঘুষ দিয়ে আবার পয়সা বানিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু গরিব লোকেরা ঘুষও দিতে পারে না, পয়সাও বানাতে পারে না। তবে আমি আশাবাদী এই চক্র থেকে অন্যদের তুলনায় আমরা দ্রুতই বের হতে পারবে।
প্রথম আলো: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ফজলে হাসান আবেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments