প্রয়োজন নেই তবু দলের স্বার্থে বাড়তি গম কেনা by ইফতেখার মাহমুদ
প্রয়োজন
নেই, কিন্তু মন্ত্রী-সাংসদ ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের স্বার্থে সরকার
আরও এক লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা-ও আবার বাজারদরের চেয়ে
কেজিতে ১০ টাকা বেশিতে। ফলে সরকারের ক্ষতি হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
মন্ত্রী-সাংসদ ও নেতাদের চাহিদাপত্র দেওয়ার পর সরকার অতিরিক্ত গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। বাজারে প্রতি কেজি গমের দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা। আর সরকার কিনছে ২৮ টাকা দরে। প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা মুনাফার কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সরকারি গুদামে গম সরবরাহে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।
সরকারি গুদামে বর্তমানে ৩ লাখ ১৫ হাজার টন গম রয়েছে। খাদ্য বিভাগের দৈনিক খাদ্যশস্যবিষয়ক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, রাশিয়া থেকে আনা গম পরিবহন খরচসহ দেশের বাজারে পড়ে ১৯ টাকা কেজি। কিন্তু সরকার কৃষকের নাম করে ওই গম ২৮ টাকা কেজি দরে কিনছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নতুন করে এক লাখ টন গম কেনায় সরকারের বাড়তি ১০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাজারদরের সঙ্গে গমের সংগ্রহমূল্যের পার্থক্য ১০ টাকা। এটা অস্বাভাবিক। সাধারণত এ পার্থক্য হয় দুই থেকে তিন টাকা। অতিরিক্ত মুনাফার কারণেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
সরকারি গুদামে গম সংগ্রহ বাড়াতে সরকারদলীয় ৮০ জন নেতা খাদ্যমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র বা ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন মন্ত্রী, ৬০ জন সাংসদ এবং অন্যরা সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংসদের মনোনীত ব্যক্তিরা গম সরবরাহ করছেন বলে জানা গেছে। বেশ কয়েকটি এলাকায় সাংসদেরা নিজেই গম সরবরাহ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করছি। সাংসদ ও চেয়ারম্যানরা তাঁর এলাকায় বরাদ্দ রাখার জন্য চাহিদাপত্র পাঠাতেই পারেন। এটা দোষের কিছু না। তবে আমরা কৃষক ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে গম নিচ্ছি না।’
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফায়েজ আহমেদ বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গম উৎপাদনকারী জেলাগুলোর তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন জেলা থেকে গম সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংসদ ও মন্ত্রীদের চাহিদাপত্রের বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
গম সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো মন্ত্রীরা হলেন ভূমিমন্ত্রী ও পাবনা-৪ আসনের সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, নওগাঁ-৪ আসনের সাংসদ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহ্রিয়ার আলম। নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ ও হুইপ মো. শহীদুজ্জামান সরকারও এই তালিকায় রয়েছেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রীর কাছে তাঁর জেলা থেকে বাড়তি গম নেওয়ার চাহিদাপত্র দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি গুদামে গম দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে অনেকে এসেছিল। তা সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার টন গম হতে পারে।’
বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, ‘জামালপুরের অন্যান্য উপজেলার তুলনায় আমার এলাকায় গমের সংগ্রহ কম করা হয়েছে। আমার এলাকার কৃষকের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিই।’
স্বাস্থ্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার ৬ নম্বর বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান লালু গত ২৫ মার্চ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। তিনি লিখেন, ‘অভ্যন্তরীণ গম সংগ্রহের আওতায় আমার ইউনিয়ন থেকে দেড় হাজার মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করলে আমার সঙ্গে কৃষকের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।’ আওয়ামী লীগ বোয়ালিয়া ইউনিয়ন শাখাকে শক্তিশালী করতে তিনি এই ইউনিয়ন থেকে গম সংগ্রহের অনুমতি দিতে খাদ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।
জিল্লুর রহমানের ওই আবেদনের ওপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস লিখেন ‘জোর সুপারিশ করছি।’ খাদ্য মন্ত্রণালয় জিল্লুর রহমানের এই আবদারের প্রতি সম্মান দেখাতে ভুল করেনি।
জানতে চাইলে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গতবার (প্রথম দফায়) মাত্র ২৮ মেট্রিক টন মাল (গম) সরবরাহের পারমিট পেয়েছিলাম। এতে বেশি লাভ থাকেনি। এবার তাই দেড় হাজার টন দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। এমপি সাহেব অবশ্য জানিয়েছেন নতুন করে মাল (গম) সাপ্লাইয়ের কাগজ এসেছে। শিগগিরই উনি আমাদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিবেন।’
সাংসদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন জায়গায় দল-পার্টি আছে। তাদের সহায়তা করতে হয়। তবে তারা যাতে কৃষকদের কাছ থেকে গম কিনে সরকারি গুদামে দেয়, সে জন্য আমরা তাদের নির্দেশ দিয়ে থাকি।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রী, সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের আবেদনের ভিত্তিতে নতুন করে আরও এক লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী ১১ কার্যদিবসের মধ্যে ওই গম সরকারি গুদামে সরবরাহ করা হবে। গত ১ এপ্রিল খাদ্য অধিদপ্তরের যে সভায় দেড় লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে প্রথম সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হয়েছিল, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি গম সংগ্রহ করতে হবে।
৩০ জুনের মধ্যে ওই দেড় লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও প্রথম দেড় মাসেই লক্ষ্যমাত্রার পুরো গমই সংগ্রহ হয়ে যায়। মন্ত্রী, সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাহিদাপত্র ও সুপারিশে খাদ্য মন্ত্রণালয় বাড়তি এক লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অনেক জেলায় সাংসদ নিজেই গম সরবরাহ করছেন। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে সরকারদলীয় সাংসদ দবিরুল ইসলাম নিজেই সরকারি গুদামে এক টন গম দিয়ে তাঁর জেলায় গম সরবরাহ শুরু করেছেন। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও গম সরবরাহ করেছেন।
এ বিষয়ে দবিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ের অন্যান্য এলাকায় কে গম সরবরাহ করবে, তা নিয়ে মারামারি-হানাহানি হয়েছে। আমার আসনে আমি তা হতে দিইনি। আমরা নিজেরা গম চাষ করি। তাই আমি নিজেই এক টন গম সরবরাহ করেছি।’
খাদ্য বিভাগের ইতিহাসে এত বিপুল পরিমাণ গম এর আগে কখনো কেনা হয়নি। সরকার সাধারণত গমচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গমের একটি সর্বনিম্ন মূল্য ঘোষণা করে থাকে।
চাহিদাপত্র পাঠানো সাংসদ ও নেতারা
নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ ও হুইপ মো. শহীদুজ্জামান সরকার ৬০০ মেট্রিক টন, দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপাল ৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, মহিলা-৪৭ আসনের সাংসদ রওশন আরা মান্নান দুই হাজার মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ-১ আসনের সাংসদ আবদুল হাই পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, কুড়িগ্রাম-২ এর তাজুল ইসলাম চৌধুরী তিন হাজার মেট্রিক টন, নান্দিনা বাজার জামালপুর জেলার মো. রফিকুল ইসলাম পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, বগুড়া-৫ আসনের সাংসদ হাবিবুর রহমান ২০০ মেট্রিক টন, রাজবাড়ী-১ আসনের সাংসদ কাজী কেরামত আলী দুই হাজার মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ-৩ আসনের সাংসদ মো. নবী নেওয়াজ এক হাজার মেট্রিক টন, নওগাঁ-৪ আসনের সাংসদ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক দুই হাজার মেট্রিক টন, দিনাজপুর-২ আসনের সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দুই হাজার মেট্রিক টন, নেত্রকোনা-২ আসনের সাংসদ আরিফ খান জয় এক হাজার মেট্রিক টন, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ৫০০ মেট্রিক টন, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সাংসদ মো. হাসিবুর রহমান স্বপন এক হাজার মেট্রিক টন, নাটোর-২ আসনের সাংসদ মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, গাইবান্ধা-২ আসনের সাংসদ মাহবুব আরা বেগম গিনি দুই হাজার মেট্রিক টন, সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৩ হাজার মেট্রিক টন, কুমিল্লা-২ আসনের সাংসদ মো. আমির হোসেন পাঁচ হাজার মেট্রিক রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ মো. আয়েন উদ্দিন চার হাজার মেট্রিক টন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাংসদ মো. দবিরুল ইসলাম ১০ হাজার মেট্রিক টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক) এক হাজার মেট্রিক টন, রাজবাড়ী-২ আসনের সাংসদ মো. জিল্লুল হাকিম পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাংসদ এম এ আউয়াল, পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, লালমনিরহাট-১ আসনের সাংসদ মোতাহার হোসেন ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, নওগাঁ-৬ আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম এক হাজার মেট্রিক টন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ছয় হাজার মেট্রিক টন, হুইপ ও সাংসদ মো. শহীদুজ্জামান ছয় হাজার মেট্রিক টন, দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন বীরগঞ্জ উপজেলা ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, জামালপুর-৩ আসনের সাংসদ মির্জা আজম দুই হাজার মেট্রিক টন, চাঁদপুর জেলার জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, পাবনা-২ আসনের সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক আরজু ১ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন, সাংসদ রাশেদ খান মেনন ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, রংপুরের সাংসদ টিপু মুনশী এক হাজার মেট্রিক টন, মহিলা আসন-২৭-এর সাংসদ অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, গাইবান্ধা-৪ আসনের সাংসদ অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ চার হাজার মেট্রিক টন, নওগাঁ-১ আসনের সাংসদ সাধন চন্দ্র মজুমদার ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ মো. রেজাউল হক চৌধুরী দুই হাজার মেট্রিক টন, মো. মমিনুল ইসলামের নামে (সুপারিশ-দিনাজপুর-৩ আসনের সাংসদ ইকবালুর রহিম) দুই হাজার মেট্রিক টন, মাদারীপুর-২ আসনের সাংসদ শাজাহান খান পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, টাঙ্গাইল-১ আসনের সাংসদ মো. আবদুর রাজ্জাক ৫০০ মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ-১ আসনের সাংসদ তাহজীব আলম সিদ্দিকী ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, নাটোর-১ আসনের সাংসদ আবুল কালাম আজাদ দুই হাজার মেট্রিক টন, রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ মো. আয়েন উদ্দিন ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, যশোর-২ আসনের সাংসদ মো. মনিরুল ইসলাম দুই হাজার মেট্রিক টন।
মন্ত্রী-সাংসদ ও নেতাদের চাহিদাপত্র দেওয়ার পর সরকার অতিরিক্ত গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়। বাজারে প্রতি কেজি গমের দাম ১৮ থেকে ২০ টাকা। আর সরকার কিনছে ২৮ টাকা দরে। প্রতি কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা মুনাফার কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সরকারি গুদামে গম সরবরাহে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন।
সরকারি গুদামে বর্তমানে ৩ লাখ ১৫ হাজার টন গম রয়েছে। খাদ্য বিভাগের দৈনিক খাদ্যশস্যবিষয়ক প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, রাশিয়া থেকে আনা গম পরিবহন খরচসহ দেশের বাজারে পড়ে ১৯ টাকা কেজি। কিন্তু সরকার কৃষকের নাম করে ওই গম ২৮ টাকা কেজি দরে কিনছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নতুন করে এক লাখ টন গম কেনায় সরকারের বাড়তি ১০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাজারদরের সঙ্গে গমের সংগ্রহমূল্যের পার্থক্য ১০ টাকা। এটা অস্বাভাবিক। সাধারণত এ পার্থক্য হয় দুই থেকে তিন টাকা। অতিরিক্ত মুনাফার কারণেই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জড়িত হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
সরকারি গুদামে গম সংগ্রহ বাড়াতে সরকারদলীয় ৮০ জন নেতা খাদ্যমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র বা ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন মন্ত্রী, ৬০ জন সাংসদ এবং অন্যরা সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংসদের মনোনীত ব্যক্তিরা গম সরবরাহ করছেন বলে জানা গেছে। বেশ কয়েকটি এলাকায় সাংসদেরা নিজেই গম সরবরাহ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করছি। সাংসদ ও চেয়ারম্যানরা তাঁর এলাকায় বরাদ্দ রাখার জন্য চাহিদাপত্র পাঠাতেই পারেন। এটা দোষের কিছু না। তবে আমরা কৃষক ছাড়া অন্য কারও কাছ থেকে গম নিচ্ছি না।’
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফায়েজ আহমেদ বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে গম উৎপাদনকারী জেলাগুলোর তথ্য নেওয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন জেলা থেকে গম সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংসদ ও মন্ত্রীদের চাহিদাপত্রের বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
গম সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো মন্ত্রীরা হলেন ভূমিমন্ত্রী ও পাবনা-৪ আসনের সাংসদ শামসুর রহমান শরীফ, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, নওগাঁ-৪ আসনের সাংসদ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহ্রিয়ার আলম। নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ ও হুইপ মো. শহীদুজ্জামান সরকারও এই তালিকায় রয়েছেন।
নৌপরিবহনমন্ত্রীর কাছে তাঁর জেলা থেকে বাড়তি গম নেওয়ার চাহিদাপত্র দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি গুদামে গম দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে আমার কাছে অনেকে এসেছিল। তা সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার টন গম হতে পারে।’
বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, ‘জামালপুরের অন্যান্য উপজেলার তুলনায় আমার এলাকায় গমের সংগ্রহ কম করা হয়েছে। আমার এলাকার কৃষকের এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিই।’
স্বাস্থ্য, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পাওয়া যায়নি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার ৬ নম্বর বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান লালু গত ২৫ মার্চ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। তিনি লিখেন, ‘অভ্যন্তরীণ গম সংগ্রহের আওতায় আমার ইউনিয়ন থেকে দেড় হাজার মেট্রিক টন গম সংগ্রহ করলে আমার সঙ্গে কৃষকের সুসম্পর্ক বজায় থাকবে।’ আওয়ামী লীগ বোয়ালিয়া ইউনিয়ন শাখাকে শক্তিশালী করতে তিনি এই ইউনিয়ন থেকে গম সংগ্রহের অনুমতি দিতে খাদ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।
জিল্লুর রহমানের ওই আবেদনের ওপর চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস লিখেন ‘জোর সুপারিশ করছি।’ খাদ্য মন্ত্রণালয় জিল্লুর রহমানের এই আবদারের প্রতি সম্মান দেখাতে ভুল করেনি।
জানতে চাইলে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘গতবার (প্রথম দফায়) মাত্র ২৮ মেট্রিক টন মাল (গম) সরবরাহের পারমিট পেয়েছিলাম। এতে বেশি লাভ থাকেনি। এবার তাই দেড় হাজার টন দেওয়ার জন্য আবেদন করেছি। এমপি সাহেব অবশ্য জানিয়েছেন নতুন করে মাল (গম) সাপ্লাইয়ের কাগজ এসেছে। শিগগিরই উনি আমাদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিবেন।’
সাংসদ গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন জায়গায় দল-পার্টি আছে। তাদের সহায়তা করতে হয়। তবে তারা যাতে কৃষকদের কাছ থেকে গম কিনে সরকারি গুদামে দেয়, সে জন্য আমরা তাদের নির্দেশ দিয়ে থাকি।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রী, সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের আবেদনের ভিত্তিতে নতুন করে আরও এক লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী ১১ কার্যদিবসের মধ্যে ওই গম সরকারি গুদামে সরবরাহ করা হবে। গত ১ এপ্রিল খাদ্য অধিদপ্তরের যে সভায় দেড় লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, সেখানে প্রথম সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হয়েছিল, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি গম সংগ্রহ করতে হবে।
৩০ জুনের মধ্যে ওই দেড় লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হলেও প্রথম দেড় মাসেই লক্ষ্যমাত্রার পুরো গমই সংগ্রহ হয়ে যায়। মন্ত্রী, সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের চাহিদাপত্র ও সুপারিশে খাদ্য মন্ত্রণালয় বাড়তি এক লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
অনেক জেলায় সাংসদ নিজেই গম সরবরাহ করছেন। ঠাকুরগাঁও-২ আসনে সরকারদলীয় সাংসদ দবিরুল ইসলাম নিজেই সরকারি গুদামে এক টন গম দিয়ে তাঁর জেলায় গম সরবরাহ শুরু করেছেন। তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যরাও গম সরবরাহ করেছেন।
এ বিষয়ে দবিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ের অন্যান্য এলাকায় কে গম সরবরাহ করবে, তা নিয়ে মারামারি-হানাহানি হয়েছে। আমার আসনে আমি তা হতে দিইনি। আমরা নিজেরা গম চাষ করি। তাই আমি নিজেই এক টন গম সরবরাহ করেছি।’
খাদ্য বিভাগের ইতিহাসে এত বিপুল পরিমাণ গম এর আগে কখনো কেনা হয়নি। সরকার সাধারণত গমচাষিদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে গমের একটি সর্বনিম্ন মূল্য ঘোষণা করে থাকে।
চাহিদাপত্র পাঠানো সাংসদ ও নেতারা
নওগাঁ-২ আসনের সাংসদ ও হুইপ মো. শহীদুজ্জামান সরকার ৬০০ মেট্রিক টন, দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপাল ৪ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, মহিলা-৪৭ আসনের সাংসদ রওশন আরা মান্নান দুই হাজার মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ-১ আসনের সাংসদ আবদুল হাই পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, কুড়িগ্রাম-২ এর তাজুল ইসলাম চৌধুরী তিন হাজার মেট্রিক টন, নান্দিনা বাজার জামালপুর জেলার মো. রফিকুল ইসলাম পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, বগুড়া-৫ আসনের সাংসদ হাবিবুর রহমান ২০০ মেট্রিক টন, রাজবাড়ী-১ আসনের সাংসদ কাজী কেরামত আলী দুই হাজার মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ-৩ আসনের সাংসদ মো. নবী নেওয়াজ এক হাজার মেট্রিক টন, নওগাঁ-৪ আসনের সাংসদ বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক দুই হাজার মেট্রিক টন, দিনাজপুর-২ আসনের সাংসদ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দুই হাজার মেট্রিক টন, নেত্রকোনা-২ আসনের সাংসদ আরিফ খান জয় এক হাজার মেট্রিক টন, সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ৫০০ মেট্রিক টন, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সাংসদ মো. হাসিবুর রহমান স্বপন এক হাজার মেট্রিক টন, নাটোর-২ আসনের সাংসদ মো. শফিকুল ইসলাম শিমুল পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, গাইবান্ধা-২ আসনের সাংসদ মাহবুব আরা বেগম গিনি দুই হাজার মেট্রিক টন, সাংসদ খন্দকার মোশাররফ হোসেন ১৩ হাজার মেট্রিক টন, কুমিল্লা-২ আসনের সাংসদ মো. আমির হোসেন পাঁচ হাজার মেট্রিক রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ মো. আয়েন উদ্দিন চার হাজার মেট্রিক টন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাংসদ মো. দবিরুল ইসলাম ১০ হাজার মেট্রিক টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বিশ্বাস পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, সাংসদ ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীর প্রতীক) এক হাজার মেট্রিক টন, রাজবাড়ী-২ আসনের সাংসদ মো. জিল্লুল হাকিম পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, লক্ষ্মীপুর-১ আসনের সাংসদ এম এ আউয়াল, পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, লালমনিরহাট-১ আসনের সাংসদ মোতাহার হোসেন ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, নওগাঁ-৬ আসনের সাংসদ ইসরাফিল আলম এক হাজার মেট্রিক টন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন ছয় হাজার মেট্রিক টন, হুইপ ও সাংসদ মো. শহীদুজ্জামান ছয় হাজার মেট্রিক টন, দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন বীরগঞ্জ উপজেলা ১ হাজার ২০০ মেট্রিক টন, জামালপুর-৩ আসনের সাংসদ মির্জা আজম দুই হাজার মেট্রিক টন, চাঁদপুর জেলার জন্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, পাবনা-২ আসনের সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক আরজু ১ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন, সাংসদ রাশেদ খান মেনন ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, রংপুরের সাংসদ টিপু মুনশী এক হাজার মেট্রিক টন, মহিলা আসন-২৭-এর সাংসদ অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, গাইবান্ধা-৪ আসনের সাংসদ অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ চার হাজার মেট্রিক টন, নওগাঁ-১ আসনের সাংসদ সাধন চন্দ্র মজুমদার ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, কুষ্টিয়া-১ আসনের সাংসদ মো. রেজাউল হক চৌধুরী দুই হাজার মেট্রিক টন, মো. মমিনুল ইসলামের নামে (সুপারিশ-দিনাজপুর-৩ আসনের সাংসদ ইকবালুর রহিম) দুই হাজার মেট্রিক টন, মাদারীপুর-২ আসনের সাংসদ শাজাহান খান পাঁচ হাজার মেট্রিক টন, টাঙ্গাইল-১ আসনের সাংসদ মো. আবদুর রাজ্জাক ৫০০ মেট্রিক টন, ঝিনাইদহ-১ আসনের সাংসদ তাহজীব আলম সিদ্দিকী ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, নাটোর-১ আসনের সাংসদ আবুল কালাম আজাদ দুই হাজার মেট্রিক টন, রাজশাহী-৩ আসনের সাংসদ মো. আয়েন উদ্দিন ১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন, যশোর-২ আসনের সাংসদ মো. মনিরুল ইসলাম দুই হাজার মেট্রিক টন।
No comments