দুবাইয়ে ট্যাক্সিচালক রশিদের অপেক্ষা
বছরের
প্রথম দিন ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারান দুবাই প্রবাসী বাংলাদেশী
ট্যাক্সিচালক সালাম আব্দুল রশিদ (৩২)। রশিদের মুখমণ্ডলে চারবার অস্ত্রোপচার
হয়েছে। তবে দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি। ডাক্তাররা আশ্বাস দিয়েছেন যে, তার ডান
চোখে দৃষ্টি ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। রশিদ এখন তার নিয়োগ প্রতিষ্ঠানের কাছ
থেকে ক্ষতিপূরণ পাবার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। রশিদের ঘটনা এবং বর্তমান
পরিস্থিতি নিয়ে গালফ নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়,
নতুন বছরের শুরুতে ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন রশিদ। প্রত্যাশা ছিল
স্বল্প সময়ে কিছু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন
না নতুন বছরে রূঢ় বাস্তবতা অপেক্ষা করছে তার জন্য। ঘনকুয়াশায় চোখে কিছু
দেখতে না পেয়ে দুবাই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কাছে এক ট্রাকে গিয়ে আঘাত
করেন। এরপর চিরতরে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে গেছে তার দৃষ্টি। দুর্ঘটনার পর
দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিনি। গালফ নিউজকে রশিদ বলেন, সময়টা ছিল আনুমানিক
ভোর ছয়টা। পুরো রাস্তা ঘনকুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল। আমি কিছুই দেখতে
পাচ্ছিলাম না। কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিলাম আর
ট্রাকে গিয়ে আঘাত করেছিলাম তা আমার মনে নেই। দুবাইতে চার বছর ধরে ট্যাক্সি
চালিয়ে আসছেন রশিদ। প্রতিদিন ভোর তিনটার সময় গাড়ি নিয়ে বের হন তিনি। নতুন
বছরের শুরুতে সেদিন সকালেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। ওইদিনের কথা স্মরণ করে রশিদ
বলেন, আর দশটা দিনের মতো সেদিনও একইরকম ছিল। কয়েকটি ট্রিপ নেয়ার পর আমি
জেডব্লিউ মারকুইস হোটেলের দিকে যাচ্ছিলাম। নিউ জাবিল ফ্লাইওভার থেকে নামার
পর ছোট একটি ট্র্যাফিক লাইট অতিক্রম করি। সর্বশেষ যেটা মনে আছে তা হলো,
বিরাট শব্দ করে একটি আঘাত আর আমার মুখমণ্ডল দিয়ে রক্ত বয়ে যাচ্ছে।
দুর্ঘটনায় রশিদের মুখমণ্ডলে একাধিক স্থান জখমসহ ভেঙে যায়। চারবার
অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু তার দৃষ্টিশক্তি ফেরানো সম্ভব হয় নি। রশিদ
বলেন, আইসিইউতে ১৭ দিন ছিলাম। চারবার সার্জারি করতে হয়েছে- নাকে, চোয়ালে,
চোখে ও মাথায়। আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখনও আমি জানতাম না যে, আমার
দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। হাসপাতালের নার্স আমাকে সেটা জানায়। এটা জানার
পর কি অনুভব করা উচিত ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমি অনুভব করি আল্লাহ
আমাকে নতুন এক জীবন দিয়েছেন। আর আমি সেজন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই।
হাসপাতালের নার্স আমাকে এটাও জানায় যে, ডান চোখে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার
সম্ভাবনা রয়েছে। রশিদ এখন ডান চোখে চিকিৎসা নেয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।
ডাক্তাররা জানিয়েছেন কয়েক মাস পর চোখের চিকিৎসা শুরু করা যাবে। সম্ভবত তাকে
আরেকবার অস্ত্রোপচার করতে হতে পারে। কিন্তু এ জন্য রশিদকে আদালতে ঝুলে
থাকা একটি মামলার নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মামলাটি হলো রশিদের
নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান দুবাই ট্যাক্সি করপোরেশনের (ডিটিসি) কাছ থেকে তার
বকেয়া এবং ক্ষতিপূরণ পাবার মামলা। রশিদ বলেন, হাসপাতালের ট্রমা সেন্টার
থেকে ২০শে ফেব্রুয়ারি ছাড়পত্র পাবার পর থেকে আমি অপেক্ষা করছি। বন্ধুদের
সাহায্য নিয়ে কয়েকবার অফিসে গিয়েছি কিন্তু এক কানাকড়িও এখনও পাই নি।
ট্যাক্সিচালক হিসেবে কাজ ছাড়া কোন মজুরি পাই না। কাজেই আমার বাড়িভাড়া বা
খাবারের খরচ বহন করার মতো কোন অর্থ আমার কাছে নেই। বন্ধুদের বদান্যতায় আমি
চলছি। এখন নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন রশিদ।
মামলার বিষয়ে ডিটিসির এক মুখপাত্র গালফ নিউজকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের আইনি দল
ইনস্যুরেন্স প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মামলাটি নিয়ে কথাবার্তা বলছে। রশিদকে তার
প্রাপ্য অর্থ পাইয়ে দেয়ার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলে জানান ওই
মুখপাত্র। তিনি আরও বলেন, ইনস্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান রশিদকে ৩৫ হাজার দিরহাম
দিতে চেয়েছে কিন্তু আমরা তাতে সম্মত হই নি। আমরা চাইছি রশিদকে যেন আরও বেশি
পরিমাণ অর্থ পাইয়ে দেয়া যায়। এর জন্য এখন শুধু অনুমোদনের অপেক্ষা। রশিদের
নিয়োগ ভিসার মেয়াদ আছে ২০১৬ সালের এপ্রিল পর্যন্ত। তার প্রত্যাশা সে সময়
পর্যন্ত যেন দুবাইয়ে থাকতে পারেন। আর ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার
জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে পারেন। রশিদ বলেন, দেশে গেলে কি হবে, আমি
তা জানি না। দেশে উপযুক্ত চিকিৎসা নিতে পারবো বলে মনে হয় না। আমরা গরিব আর
আমার পরিবারের ওপর আমি বোঝা হতে চাই না। রশিদের পরিবারে তার বৃদ্ধ পিতা আর
ছোট ভাই রয়েছে। আর তিন বছর আগে বিয়ে করেন রশিদ। পরিবারের একমাত্র
উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনিই ছিলেন। এখন সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণ পাবার আসায়
দিন গুনছেন রশিদ।
No comments