পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতির কাহিনী by নাজমুল আহসান
রোহিঙ্গাদের কোন আইনগত পরিচয় নেই |
গল্পটা
আরকামের একার নয়। মাত্র ১২ বছর বয়সে যে তার চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে
দেখেছে। তার বাবার অপরাধ ছিল মসজিদে নামাজ আদায় করা। বৌদ্ধ প্রতিবেশীরা
তাদের নির্দেশ দিয়েছিল ইসলাম পালন না করতে। কিন্তু ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঁকড়ে
রাখার শাস্তি হিসেবেই তার পিতাকে মাথায় পাথর মেরে, ছুরিকাঘাত করে সেদিন
হত্যা করা হয়। ১৮ বছর বয়সী আরকাম এখন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের
পাশের একটি শিপিং কনটেইনারে কাজ করেন। তার সঙ্গে রয়েছে মিয়ানমার থেকে
যাওয়া আরও ৭ রোহিঙ্গা। স্বল্প বেতনে চাকরি করে, কোনমতে সন্ধ্যাবেলায় খাদ্য
এবং কাপড় জোটে তাদের। প্রায় একই ধরনের গল্প শোনালো আরকামের সঙ্গে থাকা আরেক
রোহিঙ্গা যুবক আসহান (২০)। তার বয়স যখন ৯ বছর, তার পিতা ও বড় ভাই পাশের
একটি মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল। তারা আর কখনই ফিরে আসেনি। প্রায় দেড় বছর
আগে একদল বৌদ্ধ রাখাইন তাদের ঘরসহ গোটা গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সে সহ
আরও ডজনখানেক মানুষ নদী সাঁতরে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। নদীর অপরপাশে অপেক্ষা
করছিল পাচারকারীরা। জোর করে তাদের নৌকায় ওঠায় পাচারকারীরা। কিন্তু বহুদিন
পরও মুক্তিপণ পরিশোধের জন্য কাউকে ঠিক করতে পারেনি আসহান। এতে পাচারকারীরা
তার ওপর ক্ষেপে যায় ও মেরে ফেলার হুমকি দেয়। শেষ পর্যন্ত তার গ্রামের
অধিবাসীরা তার মুক্তির জন্য ৭০ হাজার টাকা তুলে দেয় পাচারকারীদের কাছে।
প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় রোহিঙ্গাদের। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব পায়নি তারা। অথচ, সেখানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ২৫০০০ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে নৌকায় চেপেছে। অবশেষে শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু বোঝাই মানবপাচারকারীদের নৌকার দৃশ্য বিশ্বের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়।
২০১২ সালের পর থেকে, স্থানীয় বৌদ্ধদের দ্বারা ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের পরিস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই করুণ। এটা সত্য যে, নৌকায় করে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। কিন্তু রাখাইনদের মর্মন্তুদ পরিস্থিতির কারণেই রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করছে যে, রাখাইনে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, রোহিঙ্গারা গণহারে নৃশংসতা এমনকি গণহত্যার শিকার হওয়ার বিশাল ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়েছে। কক্সবাজারের শামলাপুর গ্রামের তোহেবা খাতুন (৫০) নামের এক রোহিঙ্গা নারী জানান, তিনি ১৮ বছর আগে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। তার স্বামীকে জোর করে নিজেদের কাজে খাটিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, আমরা সারাদিন কিছু না খেয়ে কাজ করতাম। কেউই কাজ শেষে মজুরি পেত না। একদিন ৬০ কেজি ওজনের অস্ত্রের বাক্স বইতে না পারায় তোহেবা খাতুনের স্বামীকে ব্যাপক মারধর করে সেনাবাহিনী। এক পর্যায়ে সব বিক্রি করে বাংলাদেশে চলে আসে তারা।
নিজের ১৪ বছর বয়সী মেয়ের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় তোহেবার। তার মেয়ে মালয়েশিয়া যেতে নৌকায় উঠেছে। গত ২ মাস ধরে মেয়ের কোন খবর পাচ্ছেন না তিনি। মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের কোন আইনগত পরিচয় নেই। কাগজে কলমে কাজ করার অনুমতিও নেই। কিন্তু বাস্তবে বহু রোহিঙ্গাই স্বল্পমূল্যে কাজ করছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার সুযোগ নেই কারও। খুব অল্প কিছু এনজিও পরিচালিত ‘শিখন কেন্দ্রে’ অংশ নেয় কিছু রোহিঙ্গা শিশু। কিন্তু এরপরও বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের চেয়ে মালয়েশিয়ায় আরকাম ও আসহান বেশি অর্থ উপার্জন করছে। সবচেয়ে বড় কথা, আসহান এখন জানে যে, রাতে ঘুমানোর পর সে সকালে জেগে উঠতে পারবে।
স্বাধীন রাজ্য আরাকানে মুসলমানরা সর্বপ্রথম পাড়ি জমায় খুব সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীর দিকে। তারা ছিল মূলত সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ী। এদের বংশধররা তো ছিলই। সতেরো শতাব্দীতে আরাকানিজদের হাতে আটক হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানও পাড়ি জমায় আরাকানে। ওই মুসলমানদের অনেককে আরাকান রাজার সেনাবাহিনীতে জোরপূর্বক নিযুক্ত করা হয়। অনেককে বিভিন্ন স্থানে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অনেকেই আরাকানেই থেকে যেতে বাধ্য হয়।
‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির অর্থ ‘রোহাং-এর বাসিন্দা’। আগে আরাকানকে ‘রোহাং’ নামেই ডাকতো মুসলিমরা। ১৭৯৫ সালের দিকে আরাকান রাজ্য দখলে নেয় বার্মিজ সেনাবাহিনী। এ সময়টাতে মুসলিম ও আরাকানিজদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল না। কিন্তু ১৮২৫ সালে বৃটিশরা যখন আরাকান জয় করে, এরপরই পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। আরাকান ও বার্মা- উভয়ই ছিল বৃটিশ ভারতের অংশ।
গণ-অভিবাসন ঔপনিবেশিক অর্থনীতিকে অনেকগুণ সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্থানীয় আরাকানিজরা তীব্র ঘৃণার সঙ্গে বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু তাদের কিছু করারও ছিল না। তাদের ধারণা ছিল, তাদের চাকরি ও জমি দখলে নিচ্ছে বাইরের মানুষরা। যাদের তারা এখনও ‘অবৈধ অভিবাসী’ অথবা ‘বাঙালি’ (মর্যাদাহানিকরভাবে) হিসেবে সম্বোধন করে। উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমপর্ক আরও তিক্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন স্থানীয় রাখাইনরা ছিল মূলত অক্ষশক্তি তথা জাপানের পক্ষে। অপরদিকে বৃটিশরা ছিল অক্ষশক্তির বিরোধীপক্ষ তথা মিত্রপক্ষের অন্যতম পুরোধা।
যুদ্ধ পরবর্তী বার্মার ১৩৫টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত জনগোষ্ঠী, যেমন কাচিন, কারেন ও চীনাদের মতো রাখাইনরাও দেশটির সামরিক সরকারের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়। বার্মার স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো নিজেদের বৃটিশ ঔপনিবেশিক নির্যাতনের ভুক্তভোগী (ভিকটিম) মনে করে। অর্থাৎ রাখাইন বা বার্মিজ উভয় কর্তৃপক্ষই নিজেদের বৃটিশ শাসনের ভুক্তভোগী মনে করে। রাখাইনরা আবার বার্মিজদের থেকেও নির্যাতনের শিকার। সে রাখাইনরাই এবার মূলত রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করছে। বার্মিজরা এখানে রাখাইনদের সমর্থন দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের দাবি এদের কারো কাছেই ধর্তব্য নয়। এরই ফলশ্রুতিতে মিয়ানমার সরকার কখনই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। তাদের অন্যতম আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়নি।
বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। ৯০’র দশকের মাঝামাঝি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করানো হয়েছিল। রোহিঙ্গারা নিজেরাও নিজেদের ‘সাধারণ’ বাঙালি ভাবতে রাজি নয়। বরং তাদের দাবি, তারা আরাকান রাজ্যের ঐশ্বর্যবান ও প্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এর ওপর ভিত্তি করেই প্রোথিত মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও অন্যতম আদিবাসী নৃগোষ্ঠী হিসেবে তাদের স্বীকৃতির দাবি।
দু’পক্ষের মধ্যে মিটমাটের প্রচেষ্টা ২০১২ সালে রাখাইন প্রদেশে জাতিগত নির্মূলাভিযানের কারণে শেষ হয়ে গেছে। তিন রোহিঙ্গা পুরুষ কর্তৃক এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় শুরু হয় ওই ঘটনা। সে সময় রাখাইন প্রদেশের সিতয়ে সহ বিভিন্ন স্থানে রাখাইন জনগোষ্ঠীর তাণ্ডবে ২০০ জন নিহত হয়। পালাতে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। নিজেদের বসতভিটা থেকে উৎখাত হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। স্কুল ও হাসপাতালের সেবা নিষিদ্ধ হয় তাদের জন্য।
ইন্টারন্যাশনাল স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভ (আইএসসিআই)- এর গবেষকরা বলছেন, ওই সহিংসতার অনেকগুলোই পরিকল্পিত। অনেক রাখাইন পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেছেন গবেষকরা। তারা জানিয়েছেন, তাদেরকে সহিংসতার সময় বাসে করে সিতয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুসলিমদের ওপর হামলা করতে। সঙ্গে করে ছুরি রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। সে সময় পুরো দিনের জন্য বিনামূল্যে খাবার দেয়া হয়েছিল আক্রমণে অংশ নেয়া রাখাইনদের। মিয়ানমারের তীব্র মুসলিম-বিরোধী পরিস্থিতিতে একে খুব ভালো রাজনীতি হিসেবে দেখা হয়। মিয়ানমারের মুসলিম-বিরোধী ওই তীব্রতা ছড়িয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু ও রাজনীতিবিদরা। কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশটির তুলনামূলক সুষ্ঠু ও স্বাধীন সাধারণ নির্বাচন। বর্তমান সরকারের জন্য রোহিঙ্গা নির্মূলাভিযানে সমর্থন দেয়াটা মূলত সে নির্বাচনে পরাজয় ঠেকানোর শেষ প্রচেষ্টার অংশ।
২০১২ সালের জাতিগত নির্মূলাভিযানকে আইএসসিআই-এর অধ্যাপক পেনি গ্রিন আখ্যায়িত করছেন ‘গণহত্যার প্রক্রিয়া’ হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে, বিভিন্ন ধাপে ধাপে একটি জাতির ওপর গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো- ওই জাতিটিকে কলঙ্কিত করে উপস্থাপন করা, এরপর তাকে হয়রানির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, পৃথক্করণ করা এবং পদ্ধতিগতভাবে নাগরিক অধিকার দুর্বল করা। রোহিঙ্গাদের বেলায় প্রথম চারটি ধাপ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। প্রথমত, তাদের নাগরিকত্ব ও আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে চাকরির বেলায় বৈষম্য করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী হামলা করেছে, ধর্মীয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তৃতীয়ত, তাদের পৃথক করা হয়েছে মূল সমাজ থেকে। ২০১২ সালে তাদের গ্রাম ধ্বংস করে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। চতুর্থত, পরিচয়পত্র বাতিল করে তাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। অন্যত্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এসবই পদ্ধতিগতভাবে নাগরিক অধিকার দুর্বল করার উদাহরণ। রাখাইন প্রদেশে তাদের ওপর পঞ্চম ধাপ অর্থাৎ গণহত্যা যে এড়ানো যাবে না, তা নয়। কিন্তু অধ্যাপক গ্রিনের মতে পঞ্চম ধাপ অর্থাৎ গণহত্যা হওয়া অসম্ভবও নয়।
মিয়ানমার সরকার অবশ্য তীব্রভাবে এসব দাবি অস্বীকার করেছে। কিন্তু অধ্যাপক গ্রিনের যুক্তি, ২০১২ সালের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউকেই বিচারের মুখোমুখি করেনি সরকার, সাজা দূরে থাক। তাই গণহত্যার সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এতসব সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে শান্ত। তবে অনেকে উগ্র ধারণা পোষণ করে মিয়ানমার ও পুরো বৌদ্ধ ধর্মের ওপর। সামপ্রতিককালে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এর প্রধান আবু বকর বাগদাদি প্রশ্ন রাখেন, বার্মার দুর্বল লাখো মুসলমানদের সমর্থনে সৌদি রাজপরিবার ও তাদের সহযোগীরা কী করেছে?
তবে এখন পর্যন্ত ইসলামী জঙ্গিদের কাছে এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতায়ই সীমাবদ্ধ রয়েছে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি। রাখাইন আরেকটি চেচনিয়া বা কাশ্মীর হয়নি। এর কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত, বিদেশী জিহাদিরা এখন ইরাক-সিরিয়ায় আইএস-এ যোগ দিতে ব্যস্ত। গরিব কৃষক ও জেলে রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর চেয়েও খিলাফত প্রতিষ্ঠাই তাদের কাছে এখন বড় বিষয়। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার নিজের সীমান্ত বেশ কঠোরভাবে সুরক্ষিত করে রেখেছে। ফলে বিদেশী জিহাদিরা দেশটিতে পৌঁছে যুদ্ধ বাধাতে পারছে না। আর তৃতীয় কারণটি নরওয়েজিয়ান এক বিশেষজ্ঞ খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, ইসলামী জঙ্গিরা সেখানে যায় না, যেখানে মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হয়। তারা যায় সেখানে, যেখানে মুসলমানরা যুদ্ধ করে! তাই রাখাইন প্রদেশে যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও হত্যার ক্ষেত্র বেশি। আর রোহিঙ্গারা লড়াই করতে পারছে না। তাদের কাছে তাই লড়াইয়ের বিকল্প হলো পালিয়ে যাওয়া। আর তা করতে গিয়েই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সে সংকটের চিত্রই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
(ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)
প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় রোহিঙ্গাদের। মিয়ানমারে নাগরিকত্ব পায়নি তারা। অথচ, সেখানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ২৫০০০ রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে নৌকায় চেপেছে। অবশেষে শত শত নারী-পুরুষ ও শিশু বোঝাই মানবপাচারকারীদের নৌকার দৃশ্য বিশ্বের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়।
২০১২ সালের পর থেকে, স্থানীয় বৌদ্ধদের দ্বারা ১ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের পরিস্থিতি আক্ষরিক অর্থেই করুণ। এটা সত্য যে, নৌকায় করে সাগর পাড়ি দেয়ার সময় পাচারকারীদের নির্যাতনের শিকার হয় তারা। কিন্তু রাখাইনদের মর্মন্তুদ পরিস্থিতির কারণেই রোহিঙ্গারা সাগর পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করছে যে, রাখাইনে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, রোহিঙ্গারা গণহারে নৃশংসতা এমনকি গণহত্যার শিকার হওয়ার বিশাল ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়েছে। কক্সবাজারের শামলাপুর গ্রামের তোহেবা খাতুন (৫০) নামের এক রোহিঙ্গা নারী জানান, তিনি ১৮ বছর আগে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। তার স্বামীকে জোর করে নিজেদের কাজে খাটিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তিনি বলেন, আমরা সারাদিন কিছু না খেয়ে কাজ করতাম। কেউই কাজ শেষে মজুরি পেত না। একদিন ৬০ কেজি ওজনের অস্ত্রের বাক্স বইতে না পারায় তোহেবা খাতুনের স্বামীকে ব্যাপক মারধর করে সেনাবাহিনী। এক পর্যায়ে সব বিক্রি করে বাংলাদেশে চলে আসে তারা।
নিজের ১৪ বছর বয়সী মেয়ের জন্য খুব দুশ্চিন্তা হয় তোহেবার। তার মেয়ে মালয়েশিয়া যেতে নৌকায় উঠেছে। গত ২ মাস ধরে মেয়ের কোন খবর পাচ্ছেন না তিনি। মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গাদের কোন আইনগত পরিচয় নেই। কাগজে কলমে কাজ করার অনুমতিও নেই। কিন্তু বাস্তবে বহু রোহিঙ্গাই স্বল্পমূল্যে কাজ করছে বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার সুযোগ নেই কারও। খুব অল্প কিছু এনজিও পরিচালিত ‘শিখন কেন্দ্রে’ অংশ নেয় কিছু রোহিঙ্গা শিশু। কিন্তু এরপরও বাস্তবতা হচ্ছে, মিয়ানমারের চেয়ে মালয়েশিয়ায় আরকাম ও আসহান বেশি অর্থ উপার্জন করছে। সবচেয়ে বড় কথা, আসহান এখন জানে যে, রাতে ঘুমানোর পর সে সকালে জেগে উঠতে পারবে।
স্বাধীন রাজ্য আরাকানে মুসলমানরা সর্বপ্রথম পাড়ি জমায় খুব সম্ভবত অষ্টম শতাব্দীর দিকে। তারা ছিল মূলত সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসায়ী। এদের বংশধররা তো ছিলই। সতেরো শতাব্দীতে আরাকানিজদের হাতে আটক হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানও পাড়ি জমায় আরাকানে। ওই মুসলমানদের অনেককে আরাকান রাজার সেনাবাহিনীতে জোরপূর্বক নিযুক্ত করা হয়। অনেককে বিভিন্ন স্থানে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। অনেকেই আরাকানেই থেকে যেতে বাধ্য হয়।
‘রোহিঙ্গা’ শব্দটির অর্থ ‘রোহাং-এর বাসিন্দা’। আগে আরাকানকে ‘রোহাং’ নামেই ডাকতো মুসলিমরা। ১৭৯৫ সালের দিকে আরাকান রাজ্য দখলে নেয় বার্মিজ সেনাবাহিনী। এ সময়টাতে মুসলিম ও আরাকানিজদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল না। কিন্তু ১৮২৫ সালে বৃটিশরা যখন আরাকান জয় করে, এরপরই পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। আরাকান ও বার্মা- উভয়ই ছিল বৃটিশ ভারতের অংশ।
গণ-অভিবাসন ঔপনিবেশিক অর্থনীতিকে অনেকগুণ সমৃদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্থানীয় আরাকানিজরা তীব্র ঘৃণার সঙ্গে বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু তাদের কিছু করারও ছিল না। তাদের ধারণা ছিল, তাদের চাকরি ও জমি দখলে নিচ্ছে বাইরের মানুষরা। যাদের তারা এখনও ‘অবৈধ অভিবাসী’ অথবা ‘বাঙালি’ (মর্যাদাহানিকরভাবে) হিসেবে সম্বোধন করে। উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমপর্ক আরও তিক্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। তখন স্থানীয় রাখাইনরা ছিল মূলত অক্ষশক্তি তথা জাপানের পক্ষে। অপরদিকে বৃটিশরা ছিল অক্ষশক্তির বিরোধীপক্ষ তথা মিত্রপক্ষের অন্যতম পুরোধা।
যুদ্ধ পরবর্তী বার্মার ১৩৫টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত জনগোষ্ঠী, যেমন কাচিন, কারেন ও চীনাদের মতো রাখাইনরাও দেশটির সামরিক সরকারের দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়। বার্মার স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো নিজেদের বৃটিশ ঔপনিবেশিক নির্যাতনের ভুক্তভোগী (ভিকটিম) মনে করে। অর্থাৎ রাখাইন বা বার্মিজ উভয় কর্তৃপক্ষই নিজেদের বৃটিশ শাসনের ভুক্তভোগী মনে করে। রাখাইনরা আবার বার্মিজদের থেকেও নির্যাতনের শিকার। সে রাখাইনরাই এবার মূলত রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করছে। বার্মিজরা এখানে রাখাইনদের সমর্থন দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের দাবি এদের কারো কাছেই ধর্তব্য নয়। এরই ফলশ্রুতিতে মিয়ানমার সরকার কখনই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়নি। তাদের অন্যতম আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়নি।
বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি নয়। ৯০’র দশকের মাঝামাঝি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তন করানো হয়েছিল। রোহিঙ্গারা নিজেরাও নিজেদের ‘সাধারণ’ বাঙালি ভাবতে রাজি নয়। বরং তাদের দাবি, তারা আরাকান রাজ্যের ঐশ্বর্যবান ও প্রাচীন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। এর ওপর ভিত্তি করেই প্রোথিত মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও অন্যতম আদিবাসী নৃগোষ্ঠী হিসেবে তাদের স্বীকৃতির দাবি।
দু’পক্ষের মধ্যে মিটমাটের প্রচেষ্টা ২০১২ সালে রাখাইন প্রদেশে জাতিগত নির্মূলাভিযানের কারণে শেষ হয়ে গেছে। তিন রোহিঙ্গা পুরুষ কর্তৃক এক রাখাইন নারীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় শুরু হয় ওই ঘটনা। সে সময় রাখাইন প্রদেশের সিতয়ে সহ বিভিন্ন স্থানে রাখাইন জনগোষ্ঠীর তাণ্ডবে ২০০ জন নিহত হয়। পালাতে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। নিজেদের বসতভিটা থেকে উৎখাত হয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়। স্কুল ও হাসপাতালের সেবা নিষিদ্ধ হয় তাদের জন্য।
ইন্টারন্যাশনাল স্টেট ক্রাইম ইনিশিয়েটিভ (আইএসসিআই)- এর গবেষকরা বলছেন, ওই সহিংসতার অনেকগুলোই পরিকল্পিত। অনেক রাখাইন পুরুষদের সঙ্গে কথা বলেছেন গবেষকরা। তারা জানিয়েছেন, তাদেরকে সহিংসতার সময় বাসে করে সিতয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মুসলিমদের ওপর হামলা করতে। সঙ্গে করে ছুরি রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। সে সময় পুরো দিনের জন্য বিনামূল্যে খাবার দেয়া হয়েছিল আক্রমণে অংশ নেয়া রাখাইনদের। মিয়ানমারের তীব্র মুসলিম-বিরোধী পরিস্থিতিতে একে খুব ভালো রাজনীতি হিসেবে দেখা হয়। মিয়ানমারের মুসলিম-বিরোধী ওই তীব্রতা ছড়িয়েছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু ও রাজনীতিবিদরা। কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশটির তুলনামূলক সুষ্ঠু ও স্বাধীন সাধারণ নির্বাচন। বর্তমান সরকারের জন্য রোহিঙ্গা নির্মূলাভিযানে সমর্থন দেয়াটা মূলত সে নির্বাচনে পরাজয় ঠেকানোর শেষ প্রচেষ্টার অংশ।
২০১২ সালের জাতিগত নির্মূলাভিযানকে আইএসসিআই-এর অধ্যাপক পেনি গ্রিন আখ্যায়িত করছেন ‘গণহত্যার প্রক্রিয়া’ হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবেই দেখা গেছে, বিভিন্ন ধাপে ধাপে একটি জাতির ওপর গণহত্যা সংঘটিত হয়। সেগুলো হলো- ওই জাতিটিকে কলঙ্কিত করে উপস্থাপন করা, এরপর তাকে হয়রানির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, পৃথক্করণ করা এবং পদ্ধতিগতভাবে নাগরিক অধিকার দুর্বল করা। রোহিঙ্গাদের বেলায় প্রথম চারটি ধাপ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। প্রথমত, তাদের নাগরিকত্ব ও আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি থেকে দূরে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে চাকরির বেলায় বৈষম্য করা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী হামলা করেছে, ধর্মীয়ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তৃতীয়ত, তাদের পৃথক করা হয়েছে মূল সমাজ থেকে। ২০১২ সালে তাদের গ্রাম ধ্বংস করে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হয়েছে। চতুর্থত, পরিচয়পত্র বাতিল করে তাদের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। অন্যত্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এসবই পদ্ধতিগতভাবে নাগরিক অধিকার দুর্বল করার উদাহরণ। রাখাইন প্রদেশে তাদের ওপর পঞ্চম ধাপ অর্থাৎ গণহত্যা যে এড়ানো যাবে না, তা নয়। কিন্তু অধ্যাপক গ্রিনের মতে পঞ্চম ধাপ অর্থাৎ গণহত্যা হওয়া অসম্ভবও নয়।
মিয়ানমার সরকার অবশ্য তীব্রভাবে এসব দাবি অস্বীকার করেছে। কিন্তু অধ্যাপক গ্রিনের যুক্তি, ২০১২ সালের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউকেই বিচারের মুখোমুখি করেনি সরকার, সাজা দূরে থাক। তাই গণহত্যার সম্ভাব্যতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এতসব সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যভাবে শান্ত। তবে অনেকে উগ্র ধারণা পোষণ করে মিয়ানমার ও পুরো বৌদ্ধ ধর্মের ওপর। সামপ্রতিককালে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস-এর প্রধান আবু বকর বাগদাদি প্রশ্ন রাখেন, বার্মার দুর্বল লাখো মুসলমানদের সমর্থনে সৌদি রাজপরিবার ও তাদের সহযোগীরা কী করেছে?
তবে এখন পর্যন্ত ইসলামী জঙ্গিদের কাছে এমন বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তৃতায়ই সীমাবদ্ধ রয়েছে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি। রাখাইন আরেকটি চেচনিয়া বা কাশ্মীর হয়নি। এর কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত, বিদেশী জিহাদিরা এখন ইরাক-সিরিয়ায় আইএস-এ যোগ দিতে ব্যস্ত। গরিব কৃষক ও জেলে রোহিঙ্গাদের বাঁচানোর চেয়েও খিলাফত প্রতিষ্ঠাই তাদের কাছে এখন বড় বিষয়। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার নিজের সীমান্ত বেশ কঠোরভাবে সুরক্ষিত করে রেখেছে। ফলে বিদেশী জিহাদিরা দেশটিতে পৌঁছে যুদ্ধ বাধাতে পারছে না। আর তৃতীয় কারণটি নরওয়েজিয়ান এক বিশেষজ্ঞ খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, ইসলামী জঙ্গিরা সেখানে যায় না, যেখানে মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হয়। তারা যায় সেখানে, যেখানে মুসলমানরা যুদ্ধ করে! তাই রাখাইন প্রদেশে যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়েও হত্যার ক্ষেত্র বেশি। আর রোহিঙ্গারা লড়াই করতে পারছে না। তাদের কাছে তাই লড়াইয়ের বিকল্প হলো পালিয়ে যাওয়া। আর তা করতে গিয়েই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। সে সংকটের চিত্রই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে ফুটে উঠেছে।
(ইকোনমিস্ট অবলম্বনে)
No comments