ধান আছে, হাসি নেই by ইফতেখার মাহমুদ
মেঘনার তীরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ মোকাম। এখানে কৃষকেরা সরাসরি তাঁদের ধান–চাল বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। ধানের দাম নিয়ে হতাশ কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে আসা কৃষক শহিদ। গত বুধবার তোলা ছবি l প্রথম আলো |
জ্যৈষ্ঠ
মাসে মেঘনার ঢেউ আরও বেশি থাকে। ঢেউয়ে ভেসে ভেসে বিশাল বজরা নৌকায় ধান
আসে। এ বছর ঢেউও নেই, ধানও কম। ইগল পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নৌকায় বসে ধান
মাপা দেখতে দেখতে এ কথা বলছিলেন কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে আসা কৃষক শহিদ।
হতাশ আর বিষণ্ন মুখে বললেন, ‘এক মণ ধান বেইচা আধা কেজি ওজনের একটা ইলিশও
কিনতে পারতেছি না।’
আশুগঞ্জের ধান বেচাকেনার জন্য খ্যাত মেঘনাঘাটে দাঁড়ানো কৃষক শহিদের পরনে রংচটা লুঙ্গি, গায়ের শার্টের রংও ফ্যাকাশে। তার চেয়েও ফ্যাকাশে তাঁর মুখ। ধান নিয়ে কথা বলতে গেলে বলে উঠলেন, ‘তিন বছর ধইরা দাম পাই না। এখন বুঝতাছেন কেন মানুষ সাগর পাড়ি দিয়া থাইল্যান্ডের জঙ্গলে যায়।’
বুধবার আশুগঞ্জ চালের মোকামে গিয়ে দেখা গেল, দেশের ধানের সবচেয়ে এই বাজারের কৃষক ও ধান ব্যবসায়ীদের এমন মলিন মুখ যেন পুরো এলাকাতেই ভর করেছে। এ যেন সারা দেশের কৃষকেরই প্রতিচ্ছবি। বোরোর ভরা মৌসুমে বাজারজুড়ে হট্টগোলের বদলে বিরাজ করছে একধরনের নিস্তব্ধতা। হাতে গোনা কয়েকটা ধানের নৌকা আসছে। তারও আবার ক্রেতা নেই। দাম সরকারের সংগ্রহ মূল্যের প্রায় অর্ধেক।
হাতে ক্যামেরা আর কাগজ-কলম দেখে একজন ধানশ্রমিক মন্তব্য করলেন, ‘ভাই লিইক্কা দেন, আশুগঞ্জ অচল হইয়া গেছে। ধান দিয়া এই এলাকা উঠছিল। এখন সেই ধানই নাই, যা আছে তারও দাম নাই। ধানের দামের মতো এলাকার মাইনষের জীবনও পইড়া গেছে।’
ধানচাষিদের এই ‘পড়ে যাওয়া’ জীবনের চিত্র অবশ্য অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামের মধ্যেই মেলে। আশুগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা গেল, প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা আর খাসির মাংস ৫৫০ টাকা। এক কেজি ইলিশ এক হাজার টাকা। আর এক মণ ধানের দর ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। অর্থাৎ এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক এক কেজি খাসির মাংসও কিনতে পারছেন না। আর এক কেজির একটি ইলিশ কিনতে গেলে তাঁকে দুই মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জিয়াউল করিম খান জানালেন, আশুগঞ্জ মোকামে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশির ভাগ ধান আসে। আগে এই মৌসুমে দিনে ৫০-৬০ হাজার মণ ধান আসত। এবার ২০-২৫ হাজার মণের বেশি আসেনি। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম দামে ধান বিক্রি হচ্ছে। সরকার প্রতি মণ ধান ৮৮০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিলেও আশুগঞ্জ বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায়। আর সরকারি হিসেবেই প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭০০ টাকা।
শুধু আশুগঞ্জের চাতাল নয়, দেশের ১৮ হাজার চালকলের ৭০ শতাংশই বন্ধ রয়েছে। কারণ, বাজারে ধানের দাম কম, ফলে সরবরাহও কমে গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বড় ধান-চালের বাজার নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় ধান-চালের বাজারে একই চিত্র দেখা গেছে।
প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা নিয়ে আমরা সাময়িক অসুবিধায় আছি—মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী
এ বিষয়ে সরকার কী ভাবছে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ১২ লাখ টন চাল আমদানি হতেই ধানের দাম কমে যাওয়ার এই চিত্র থেকে প্রমাণিত হয়, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আর এবার বোরোর উৎপাদনও ভালো হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা নিয়ে আমরা সাময়িক অসুবিধায় আছি। আশা করি দ্রুত এই সমস্যা কেটে যাবে।’ খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে দ্রুত ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও কৃষিমন্ত্রী জানান।
এবার বোরোর রেকর্ড ফলন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা এফএও বলছে, এবার বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান হবে, যা আগের যেকোনো বছরের তুলনায় রেকর্ড। আর সারা দেশে ধানের মোট উৎপাদন ৩ কোটি ৩৬ লাখ টন হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি, যা আগের বছরের চেয়ে দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার গত কয়েক বছর ধরেই কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়ার জন্য প্রতি মণ ধান ৮০০ টাকার ওপরে নির্ধারণ করছে। কিন্তু বাজারে ধান গত বছর বা এ বছর কোনো সময়ই ৭০০ টাকার ওপরে ওঠে নাই। বর্তমানে দেশের অনেক স্থানে ৪৫০ টাকা মণ দরেও ধান বিক্রি হচ্ছে। ফলে সরকারের উচিত বাজার দরের চেয়ে এক থেকে দেড় শ টাকা বাড়িয়ে দ্রুত ধান-চাল সংগ্রহ করা। আর দাম কমিয়ে দিয়ে ধান সংগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। এতে বাজারে ধানের দাম দ্রুত বাড়বে।’
মাহবুব হোসেন পরামর্শ দিয়ে বলেন, গত বছর সরকার গম ভাঙিয়ে আটা করে বিক্রি করেছে। এবার চাল ভাঙিয়ে গুঁড়ি বিক্রি করতে পারে। এতে সরকার আরও বেশি চাল কিনতে পারবে।
সরেজমিন আশুগঞ্জ: মেঘনাপারের ধানের মোকাম-সংলগ্ন গালায় (ঘাট) থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে যেতে তেমন ভিড় দেখা গেল না। তবে ধানের বড় মোকাম কবির-শহিদ ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা গেল বেশ ভিড়। ভিড় বিক্রেতাদের নয়, পাওনাদারদের। এ বছরের নয়, গত বছরের ধানের দামের তাগাদায় এসেছেন তাঁরা।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ধান-চালের বাজার নিয়ে আলাপ তুলতেই ক্ষোভ-বেদনা আর হতাশার কথা জানালেন কৃষকেরা। শহিদ-কবির ট্রেডার্সের ক্যাশ বাক্সের সামনে বসা একজন ধান ব্যবসায়ী বললেন, ‘সব শেষ হওয়ার পর ওনারা আসছেন কৃষকের খোঁজখবর নিতে। ইন্ডিয়ান চাইলে বাজার যখন ভইরা গেল, তখন কোতায় আছিলেন। এখন ১০ পারসেন কেন, ১০০ পারসেন টেকশ (কর) বসাইলেও লাভ নাই।’
আশুগঞ্জে আছে ৪১০টি চালকল। ধান বেচাকেনা কম, চালকলের অর্ধেকই বন্ধ। বেশির ভাগ মোকামে ব্যবসায়ীদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেল। অনেক মোকামমালিক পাওনাদার কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ভয়ে দোকানে আসছেন না। এ নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে মোকামের ব্যবসায়ীদের মনোমালিন্য ও হাঙ্গামাও হচ্ছে।
ঘাটে আসা নৌকা থেকে ধান মেপে নেওয়ার সময় কথা হয় আশুগঞ্জের সোহাগপুরের রেফায়েত উল্লাহ অটো রাইস মিলের প্রতিনিধি মমিন মিঞার সঙ্গে। প্রতি মণ মোটা ধান ৫৩০, বিআর-২৮ ধান ৬০০ টাকায় কিনছেন তিনি। সরকার আমদানি করা চালের ওপরে ১০ শতাংশ কর আরোপ করার ঘোষণার পরদিন প্রতি মণ চালের দর ১০০ থেকে ২০০ টাকা বাড়লেও ধানের দর ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। এ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি গুদামে চাল কেনা শুরু না করায় দাম কিছুটা বেড়ে আবারও কমে গেছে।
বাজারের ধানের আড়তদারেরা জানালেন, সরকার পয়লা মে থেকে দেড় লাখ টন ধান ও সাড়ে আট লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু গত ২০ দিনে ধান-চাল কেনার প্রাথমিক কাজই শেষ হয়নি। জেলা পর্যায় থেকে এখনো কোনো উপজেলার খাদ্যগুদামে কত পরিমাণে চাল কেনা হবে এবং কোন কোন চালকল মালিকের সঙ্গে চুক্তি হবে, সেই নির্দেশনা আসেনি। ফলে চালকল মালিকেরা এখনো ধান কেনা শুরু করেননি।
কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা মিঠামইনের কৃষক দুলাল মিঞার সঙ্গে ধান-চালের দর নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানালেন আরেক ক্ষোভের কথা। বললেন, ‘সরকার মুখে বলে কৃষকের জন্য ধান-চালের দাম ধরে দিছে। কিন্তু চুক্তি করে চালকলমালিকদের সঙ্গে। চালকলমালিকেরা গত বোরো ও আমনের চাল আর ইন্ডিয়া থেকে সস্তায় আনা চাল সরকারি গুদামে দেওয়ার জন্য রাইখা দিছে। ফলে এবার তাদের ধান কেনার দরকার নাই।’
বাজারের আরেক মোকামে বসে কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা ও আশুগঞ্জের ছয়জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, কৃষকের হাত থেকে ধান প্রথমে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হাতে। তারপর যায় মোকামের ফড়িয়াদের হাতে। তারপর মোকামের ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে যায় চালকলমালিকের কাছে। এই তিন হাত ঘুরে তারপরই সরকারি গুদামে চাল যায়। ফলে সরকার ৮৮০ টাকা প্রতি মণ ধানের দর ধরলেও তা কখনোই কৃষক পান না। গত বছর কৃষক মোটা ধানের চালের দর পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ ৬৫০ টাকা। এবার ৫৫০-এর ওপরে উঠছে না।
আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে ধান-চালের দর ও গুদামের সংগ্রহ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমরা ধান-চালের বাজার নিয়ে কারবার করি না। এখনো জেলা থেকে চালকলমালিকদের সঙ্গে চুক্তি করার নির্দেশ আসেনি। আশা করি, মাসের শেষের দিকে চালকলমালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে চাল কেনা শুরু হবে।’
আশুগঞ্জের ধান বেচাকেনার জন্য খ্যাত মেঘনাঘাটে দাঁড়ানো কৃষক শহিদের পরনে রংচটা লুঙ্গি, গায়ের শার্টের রংও ফ্যাকাশে। তার চেয়েও ফ্যাকাশে তাঁর মুখ। ধান নিয়ে কথা বলতে গেলে বলে উঠলেন, ‘তিন বছর ধইরা দাম পাই না। এখন বুঝতাছেন কেন মানুষ সাগর পাড়ি দিয়া থাইল্যান্ডের জঙ্গলে যায়।’
বুধবার আশুগঞ্জ চালের মোকামে গিয়ে দেখা গেল, দেশের ধানের সবচেয়ে এই বাজারের কৃষক ও ধান ব্যবসায়ীদের এমন মলিন মুখ যেন পুরো এলাকাতেই ভর করেছে। এ যেন সারা দেশের কৃষকেরই প্রতিচ্ছবি। বোরোর ভরা মৌসুমে বাজারজুড়ে হট্টগোলের বদলে বিরাজ করছে একধরনের নিস্তব্ধতা। হাতে গোনা কয়েকটা ধানের নৌকা আসছে। তারও আবার ক্রেতা নেই। দাম সরকারের সংগ্রহ মূল্যের প্রায় অর্ধেক।
হাতে ক্যামেরা আর কাগজ-কলম দেখে একজন ধানশ্রমিক মন্তব্য করলেন, ‘ভাই লিইক্কা দেন, আশুগঞ্জ অচল হইয়া গেছে। ধান দিয়া এই এলাকা উঠছিল। এখন সেই ধানই নাই, যা আছে তারও দাম নাই। ধানের দামের মতো এলাকার মাইনষের জীবনও পইড়া গেছে।’
ধানচাষিদের এই ‘পড়ে যাওয়া’ জীবনের চিত্র অবশ্য অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামের মধ্যেই মেলে। আশুগঞ্জ বাজারে গিয়ে দেখা গেল, প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা আর খাসির মাংস ৫৫০ টাকা। এক কেজি ইলিশ এক হাজার টাকা। আর এক মণ ধানের দর ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। অর্থাৎ এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক এক কেজি খাসির মাংসও কিনতে পারছেন না। আর এক কেজির একটি ইলিশ কিনতে গেলে তাঁকে দুই মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জিয়াউল করিম খান জানালেন, আশুগঞ্জ মোকামে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বেশির ভাগ ধান আসে। আগে এই মৌসুমে দিনে ৫০-৬০ হাজার মণ ধান আসত। এবার ২০-২৫ হাজার মণের বেশি আসেনি। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে কম দামে ধান বিক্রি হচ্ছে। সরকার প্রতি মণ ধান ৮৮০ টাকায় কেনার ঘোষণা দিলেও আশুগঞ্জ বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫২০ থেকে ৫৫০ টাকায়। আর সরকারি হিসেবেই প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭০০ টাকা।
শুধু আশুগঞ্জের চাতাল নয়, দেশের ১৮ হাজার চালকলের ৭০ শতাংশই বন্ধ রয়েছে। কারণ, বাজারে ধানের দাম কম, ফলে সরবরাহও কমে গেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বড় ধান-চালের বাজার নওগাঁ, বগুড়া, দিনাজপুর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় ধান-চালের বাজারে একই চিত্র দেখা গেছে।
প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা নিয়ে আমরা সাময়িক অসুবিধায় আছি—মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী
এ বিষয়ে সরকার কী ভাবছে জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ১২ লাখ টন চাল আমদানি হতেই ধানের দাম কমে যাওয়ার এই চিত্র থেকে প্রমাণিত হয়, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। আর এবার বোরোর উৎপাদনও ভালো হয়েছে। এ তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘প্রাচুর্যের বিড়ম্বনা নিয়ে আমরা সাময়িক অসুবিধায় আছি। আশা করি দ্রুত এই সমস্যা কেটে যাবে।’ খাদ্য বিভাগের মাধ্যমে দ্রুত ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও কৃষিমন্ত্রী জানান।
এবার বোরোর রেকর্ড ফলন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক সংস্থা এফএও বলছে, এবার বাংলাদেশে বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান হবে, যা আগের যেকোনো বছরের তুলনায় রেকর্ড। আর সারা দেশে ধানের মোট উৎপাদন ৩ কোটি ৩৬ লাখ টন হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি, যা আগের বছরের চেয়ে দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালকের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার গত কয়েক বছর ধরেই কৃষককে ন্যায্যমূল্য দেওয়ার জন্য প্রতি মণ ধান ৮০০ টাকার ওপরে নির্ধারণ করছে। কিন্তু বাজারে ধান গত বছর বা এ বছর কোনো সময়ই ৭০০ টাকার ওপরে ওঠে নাই। বর্তমানে দেশের অনেক স্থানে ৪৫০ টাকা মণ দরেও ধান বিক্রি হচ্ছে। ফলে সরকারের উচিত বাজার দরের চেয়ে এক থেকে দেড় শ টাকা বাড়িয়ে দ্রুত ধান-চাল সংগ্রহ করা। আর দাম কমিয়ে দিয়ে ধান সংগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। এতে বাজারে ধানের দাম দ্রুত বাড়বে।’
মাহবুব হোসেন পরামর্শ দিয়ে বলেন, গত বছর সরকার গম ভাঙিয়ে আটা করে বিক্রি করেছে। এবার চাল ভাঙিয়ে গুঁড়ি বিক্রি করতে পারে। এতে সরকার আরও বেশি চাল কিনতে পারবে।
সরেজমিন আশুগঞ্জ: মেঘনাপারের ধানের মোকাম-সংলগ্ন গালায় (ঘাট) থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে যেতে তেমন ভিড় দেখা গেল না। তবে ধানের বড় মোকাম কবির-শহিদ ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা গেল বেশ ভিড়। ভিড় বিক্রেতাদের নয়, পাওনাদারদের। এ বছরের নয়, গত বছরের ধানের দামের তাগাদায় এসেছেন তাঁরা।
সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ধান-চালের বাজার নিয়ে আলাপ তুলতেই ক্ষোভ-বেদনা আর হতাশার কথা জানালেন কৃষকেরা। শহিদ-কবির ট্রেডার্সের ক্যাশ বাক্সের সামনে বসা একজন ধান ব্যবসায়ী বললেন, ‘সব শেষ হওয়ার পর ওনারা আসছেন কৃষকের খোঁজখবর নিতে। ইন্ডিয়ান চাইলে বাজার যখন ভইরা গেল, তখন কোতায় আছিলেন। এখন ১০ পারসেন কেন, ১০০ পারসেন টেকশ (কর) বসাইলেও লাভ নাই।’
আশুগঞ্জে আছে ৪১০টি চালকল। ধান বেচাকেনা কম, চালকলের অর্ধেকই বন্ধ। বেশির ভাগ মোকামে ব্যবসায়ীদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেল। অনেক মোকামমালিক পাওনাদার কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ভয়ে দোকানে আসছেন না। এ নিয়ে কৃষকদের সঙ্গে মোকামের ব্যবসায়ীদের মনোমালিন্য ও হাঙ্গামাও হচ্ছে।
ঘাটে আসা নৌকা থেকে ধান মেপে নেওয়ার সময় কথা হয় আশুগঞ্জের সোহাগপুরের রেফায়েত উল্লাহ অটো রাইস মিলের প্রতিনিধি মমিন মিঞার সঙ্গে। প্রতি মণ মোটা ধান ৫৩০, বিআর-২৮ ধান ৬০০ টাকায় কিনছেন তিনি। সরকার আমদানি করা চালের ওপরে ১০ শতাংশ কর আরোপ করার ঘোষণার পরদিন প্রতি মণ চালের দর ১০০ থেকে ২০০ টাকা বাড়লেও ধানের দর ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। এ তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি গুদামে চাল কেনা শুরু না করায় দাম কিছুটা বেড়ে আবারও কমে গেছে।
বাজারের ধানের আড়তদারেরা জানালেন, সরকার পয়লা মে থেকে দেড় লাখ টন ধান ও সাড়ে আট লাখ টন চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু গত ২০ দিনে ধান-চাল কেনার প্রাথমিক কাজই শেষ হয়নি। জেলা পর্যায় থেকে এখনো কোনো উপজেলার খাদ্যগুদামে কত পরিমাণে চাল কেনা হবে এবং কোন কোন চালকল মালিকের সঙ্গে চুক্তি হবে, সেই নির্দেশনা আসেনি। ফলে চালকল মালিকেরা এখনো ধান কেনা শুরু করেননি।
কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা মিঠামইনের কৃষক দুলাল মিঞার সঙ্গে ধান-চালের দর নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানালেন আরেক ক্ষোভের কথা। বললেন, ‘সরকার মুখে বলে কৃষকের জন্য ধান-চালের দাম ধরে দিছে। কিন্তু চুক্তি করে চালকলমালিকদের সঙ্গে। চালকলমালিকেরা গত বোরো ও আমনের চাল আর ইন্ডিয়া থেকে সস্তায় আনা চাল সরকারি গুদামে দেওয়ার জন্য রাইখা দিছে। ফলে এবার তাদের ধান কেনার দরকার নাই।’
বাজারের আরেক মোকামে বসে কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা ও আশুগঞ্জের ছয়জন কৃষকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, কৃষকের হাত থেকে ধান প্রথমে যায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের হাতে। তারপর যায় মোকামের ফড়িয়াদের হাতে। তারপর মোকামের ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে যায় চালকলমালিকের কাছে। এই তিন হাত ঘুরে তারপরই সরকারি গুদামে চাল যায়। ফলে সরকার ৮৮০ টাকা প্রতি মণ ধানের দর ধরলেও তা কখনোই কৃষক পান না। গত বছর কৃষক মোটা ধানের চালের দর পেয়েছিলেন সর্বোচ্চ ৬৫০ টাকা। এবার ৫৫০-এর ওপরে উঠছে না।
আশুগঞ্জ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে ধান-চালের দর ও গুদামের সংগ্রহ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমরা ধান-চালের বাজার নিয়ে কারবার করি না। এখনো জেলা থেকে চালকলমালিকদের সঙ্গে চুক্তি করার নির্দেশ আসেনি। আশা করি, মাসের শেষের দিকে চালকলমালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে চাল কেনা শুরু হবে।’
No comments