মানব পাচার- ‘ওরা তখন ফুঁপিয়ে কাঁদছিল’
থাইল্যান্ডে
মানব পাচারের ইতিবৃত্ত খুঁজে বের করতে দেশটির তিনটি প্রদেশে সরেজমিন
অনুসন্ধান চালান বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জনাথন হেড। এতে উঠে
এসেছে লোমহর্ষক সব চিত্র। বের করার চেষ্টা করেছেন পাচারের পেছনের রাঘব
বোয়ালদের। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে দেখেছেন পাচারকারীদের ব্যবহার করা
স্থানগুলো। সেখানে এখনও যত্রতত্র পড়ে আছে মৃত মানুষের হাড়গোড়। পাচারকারীদের
হাত থেকে প্রাণে বেঁচে আসা উদ্ধারকৃতদের চোখে মুখে আতঙ্ক আর বিভীষিকার
চিত্র তুলে ধরেছেন প্রতিবেদনে। তিনি লিখেছেন- এ মাসের শুরুর দিকে আন্দামান
উপকূলে একটি দ্বীপের ম্যানগ্রোভ বনে প্রবেশ করি। সঙ্গে ছিল কয়েকজন থাই
স্বেচ্ছাসেবী। ওই দ্বীপে বেশ কয়েকটি কবরের খবর পেয়েছিল তারা। ধারণা করা
হচ্ছিল, ওই দ্বীপ মানব পাচারকারীরা ব্যবহার করতো। সেখানে মালয়েশিয়া যেতে
ইচ্ছুক অভিবাসীদের রাখতো পাচারকারীরা। এক দ্বীপের একটি স্থানে কিছু
হাড়গোড়ের সন্ধান পাওয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাটি খোঁড়া শুরু হয়ে গেল। কিছুটা
গভীরে খোঁড়ার পরই আর্দ্র জামার অস্তিত্ব টের পাওয়া গেল। সেটার ভেতরেই এক
মহিলার হলদে হাড় দেখা গেল। এ মহিলা কে বা কীভাবেই তিনি মারা গেলেন, আমরা
এখনও জানি না। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে, তিনি অভিবাসীদের একজন। এখানে আসতে
তাকে নিশ্চয়ই বিশাল পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। মালয়েশিয়ায় আরেকটু ভাল জীবন বুনার
স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু তার আগেই মারা গেলেন তিনি। কে জানে! হয়তো মারা না
গেলে আরও খারাপ ভাগ্য অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
মানব-বাণিজ্য: গত অক্টোবরে আমি প্রায় একই এলাকায় ছিলাম। তাকুয়া পা জেলায় বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে সরকারি কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছেন। এ খবর পেয়ে আমরা ব্যাংকক থেকে সেখানে ছুটে যাই। কমিউনিটি হলে আমরা ৮১ জন মানুষকে দেখতে পাই। তাদের চেহারায় ভয়াবহ চাপের ছাপ ছিল স্পষ্ট। আমরা তাদের প্রার্থনারত অবস্থায় দেখতে পাই। এ সময় তাদের প্রায় প্রত্যেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।
বেশ কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারে নির্যাতন চলছে। কিন্তু এরা কেউই রোহিঙ্গা ছিল না। এরা ছিল বাংলাদেশী। এদের কেউ কেউ আমাদের বলেছেন, তাদেরকে জোর করে নৌকায় তুলে এখানে নিয়ে আসা হয়। জেলা প্রধান মানিত পিয়ানথং আমাদের নিয়ে যান এ অভিবাসীদের উদ্ধার স্থলের দিকে। জায়গাটি ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বেশ কয়েকদিন আগে আমরা যে মহিলার কবরের সন্ধান পেয়েছিলাম, এ জায়গাটি তার চেয়ে বেশি দূরে নয়। এ জঙ্গলে অভিবাসীদের বহুদিন না খাইয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে পেটানো হয়েছে। মানিত আমাদের জানালেন, তার জেলাকে অনেকদিন ধরে মানব পাচারকারীরা ব্যবহার করছে। তিনি এটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় আইনি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তিনি তেমন সাহায্য পাননি। এর পরের কয়েকদিন ধরে আমি মানিতের দিকে নজর রাখছিলাম। আমি তাকে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের কড়া মেজাজের ফোন কলগুলো সামলাতে দেখেছি। কেন মানিত গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললো, তা নিয়ে বেচারা বেশ হেনস্থা হয়েছে। মানিতকে উদ্ধারকৃত বাংলাদেশীদের ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠাতে বলা হলো। কিন্তু এটা একটি ওপেন সিক্রেট যে, ওই সরকারি বন্দি-কেন্দ্রে আটক অভিবাসীদের প্রায়ই আবার মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।
মানিত নিজের লোকদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজে লাগালেন। যাতে করে এমন আরও বন্দিশিবিরের খোঁজ পাওয়া যায়। তিনি প্রধান সড়কে ২৪ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়া স্থানীয় জেলে সমপ্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানালেন যাতে কোন নৌকা আসতে দেখলে তাকে জানানো হয়। বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গারা যে বর্ধিষ্ণু হারে থাই উপকূলের দিকে যাচ্ছিল, তাতে মনে হয় মানব-ব্যবসা বিস্তৃত হচ্ছিল। অবাক হবার কিছু নেই, এটি ছিল মারাত্মক লাভজনক!
ব্যবসায়িক কাঠামো: রাবার গাছগুলোর নিচের বাষ্প শ্বাস আটকে দেয়। হঠাৎ দেখলাম, উজ্জ্বল কমলা রঙের শার্ট পরা এক তরুণ আমার পাশ দিয়ে দ্রুত চলে গেল। তার সঙ্গে কথা বললাম। খুব দ্রুতই সে কথা বলতে লাগলো। ৬ মাস আগে সেসহ আরও প্রায় ৬০০ মানুষ এখানে থাকতো। কোন ধরনের আশ্রয় ছাড়াই এখানে থাকতে হতো। ঝরে পড়া পাতা ছিল তাদের বিছানা। সে বললো, এখানেরই একটি তাঁবুতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর আমাদের পিতামাতাকে ফোন দেয়া হলো। তাদের কাছ থেকে টাকা চাইতে বাধ্য করা হলো আমাদের। তারা টাকা না দিতে পারলে, আমাদের পেটানো হতো। আরেক জায়গা সে দেখালো, যেখানে কিছু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গেল। তারা ট্রাকে করে ওই মৃতদেহগুলো কোথায় যেন নিয়ে গেল! এটাই হচ্ছে এ ব্যবসার কাঠামো। নৌকায় করে অভিবাসীদের এখানে নিয়ে আসে মানব পাচারকারীরা। পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ৩০০ জনকে নৌকায় করে থাইল্যান্ড নিয়ে আসার দাম ২০ হাজার ডলার। এরপর অভিবাসীদের জঙ্গলে আটকে রাখা হয়। মাথাপিছু ২-৩ হাজার ডলার করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করে পাচারকারীরা। প্রশ্ন হলো, কিভাবে একটি থাই গ্রামে এ রমরমা ব্যবসা চলে? আমি যে বন্দিশিবির দেখেছি, সেটি হাত ইয়াই শহর থেকে গাড়ি দিয়ে ৩০ মিনিটের পথ। অর্থাৎ এ ব্যবসায় স্থানীয়দেরও জড়িয়েছে মানব পাচারকারীরা। বয় নামের স্থানীয় এক তরুণ জানিয়েছে, স্থানীয় প্রায় পুরো সমপ্রদায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর আগে সে পাখি শিকার করতে গিয়ে কয়েকটি বন্দিশিবির দেখতে পায়। সেখানে বহু শিশুও ছিল। তাদের পেটাতেও দেখেছে বয়। এরপর থেকে ওই শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষদের আশ্রয় দেয়ার চেষ্টা করেছে সে। সে বলে, এখানকার স্থানীয় পুরো সমপ্রদায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর কারণ, অর্থ! পাচারকারীরা প্রত্যেককে কিনে ফেলেছে। তারা কিছু মানুষকে বন্দিশিবির পাহারার কাজে লাগিয়েছে। স্থানীয়দের প্রধান আয়ের উৎস রাবারের দাম পড়তির দিকে। তাই এ ব্যবসা ছিল তাদের জন্য দারুণ এক বিকল্প! বয় আমাকে জানায়, স্থানীয় তরুণদের লোভ দেখানোর জন্য মাদকও ব্যবহার করে পাচারকারীরা। তাই অভিবাসীরা পালাতে পারলেও আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তাদের। কেউ না কেউ তাদের ধরে ফেলতো! বন্দিশিবিরে ভয়াবহ শাস্তির ঝুঁকি তো ছিলই।
সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ: কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এসব করতে পারতো না মানব পাচারকারীরা। তবে ঠিক কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসবে জড়িত ছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে, খুবই উঁচুপর্যায় থেকে এসবে সায় ছিল। গত বছরের শেষ দিকে, আমাকে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা অনেক কিছু বলেন। ওই কর্মকর্তা মানব পাচারের ব্যবসা নিয়ে অনেক কিছুই জানেন। তিনি আমাকে বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে থাই সীমান্তেই অনেক বড় একটি বন্দিশিবির রয়েছে। সেখানে অন্তত ১ হাজার মানুষকে আটক রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তারা পুলিশ নিয়ে সেসব বন্ধ করছে না? প্রশ্ন শুনে সে হেসে দিল। তিনি বলেন, আপনি তো জানেনই যে সীমান্ত হচ্ছে সামরিক এলাকা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সেখানে সামরিক বাহিনীর অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। এই অনুমোদন তিনি কখনই পাননি। আমি প্রশ্ন করলাম, তিনি কেন প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান প্রায়ুথ চ্যান-ওচা’র কাছে যাননি? তিনি গত বছর সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর মানব পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে উত্তরে বললেন, আমি যদি তা করি, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাওয়ার আগেই মানব পাচারকারীদের সতর্ক করে দেয়া হবে। ফলে তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে যাবে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই। ছয় মাস পর ২৬ জনের মৃতদেহসহ প্রথম গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটিই ছিল সেই বন্দিশিবির যেটি ওই পুলিশ কর্মকর্তা অসহায়ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন।
এটি বের করা খুব কঠিন, কারা এসবে জড়িত; কারা জড়িত নয়। স্থানীয় এক পুলিশ প্রধান মানব পাচার বন্ধে তার প্রচেষ্টা সমপর্কে আমাদের জানান। এমনকি তিনি তার নৌকা নিয়ে আশেপাশে ঘুরে অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেন আমাদের। ঠিক একদিন পর আমরা সামরিক বাহিনীর একটি ইউনিটের সঙ্গে অনুসন্ধানে যাই। ওই ইউনিট আমাদের জানায়, ওই স্থানীয় পুলিশ প্রধানই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ওই সেনারাই বা কতটুকু মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- তা নিয়েই আমরা সংশয়ে পড়ি কিছুক্ষণ পর। একটি গ্রামে অভিবাসীদের লুকিয়ে রাখা হতে পারে বলে আমাদের ধারণা ছিল। সে গ্রামটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা গ্রামে প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু আগে কথা দিলেও, এবার ওই গ্রামে আমাদের নামাতে রাজি হয়নি সেনারা!
এক কর্মকর্তা আমাদের তার তদন্তের বিস্তারিত দেখালেন। সেখানে রানোং প্রদেশের নামিদামি অনেক ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ আছে। রানোং প্রদেশ অনেকদিন ধরে মানব পাচারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তার কাছে নাম, ফোন নম্বর, ফোন কলের সময় ও বড় ধরনের নেটওয়ার্কের প্রমাণ আছে। এ তথ্যসমূহ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গূঢ় রহস্য হচ্ছে, সরকার এসব জেনেও কিছুই করেনি। ওই কর্মকর্তাকে পরে বদলি করে দেয়া হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বললেন, দেখুন, সবাই জানে যে ওখানে বন্দিশিবির আছে। এটা এমন নয় যে, কেবলমাত্র গ্রামবাসী বন্দিশিবিরে জড়িত ও পাহারার কাজ করে। অথচ থাই-মালয়েশিয়া সীমান্ত সমপূর্ণ সামরিকীকৃত। সেখানে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী গিজগিজ করছে। কারো পক্ষেই ওই এলাকায় ‘প্যাকেট’ বিনিময় ব্যাতীত এত বড় আকারের বন্দিশিবির পরিচালনা করা সম্ভব নয়!
বন্ধ হবে কবে: এবার আরেকটি সরকারি হলে গেলাম। দুইদিন আগে সেখানে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে রাখা হয়েছে। তাদের বন্দিশিবির যারা পাহারা দিচ্ছিল, তাদের পাশেই পুলিশ আটক করে রেখেছে। পুলিশ প্রধান তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন; জানতে চেষ্টা করছিলেন তাদের বস কে। রোহিঙ্গাদের জন্য আমার একটি প্রশ্ন ছিল। তাদের কতজন চিন্তিত ছিল যে, তাদের পরিবার হয়তো পাচারকারীদের চাহিদা মোতাবেক মুক্তিপণ দিতে পারবে না দালালদের? এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবাই-ই হাত তুললো! রাখাইন স্টেটের এক রোহিঙ্গা শিক্ষক মোহাম্মদ জানালেন, আমরা এখানে আসতে চাই না। আমাদের মাতৃভূমি ছাড়তে চাই না। কিন্তু আমাদের আসলে যাবার কোনো জায়গাই নেই। মিয়ানমার সরকার খুবই খারাপ। তারা আমাদের পেটায়, গুলি মেরে হত্যা করে। কিন্তু এসব শিবিরে কি হয়, তা জানতেনই না মোহাম্মদ। একপর্যায়ে তিনি পালাতে পেরেছিলেন; কিন্তু আবার ধরা পড়েন পাচারকারীদের হাতে। একটি সামরিক সূত্র আমাদের জানায় যে, রানোং-এ একটি সরকারি অভিবাসী বন্দি-কেন্দ্রে আটককৃত অনেক রোহিঙ্গাকে রাখার পর তাদের আবারও মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এর আগেও এমন হয়েছে। তারা মূলত মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক ছিল। সেখানে চাকরি, পরিবার ও ভাল ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল তারা। কিন্তু বাংলাদেশীদের তবুও যাবার জায়গা আছে। তাদের অল্প কয়েকজনকে জোর করে পাচার করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকে জেনে বুঝে সমুদ্র পথে পাড়ি জমাতে রাজি হয়। উচ্চ বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের মুঠোয় আনে পাচারকারীরা। কিন্তু এ ব্যবসার নির্মম বাস্তবতা যখন উপলব্ধি করার পর তাদের অনেকেই বাড়ি যেতে চাইলো। এ ব্যবসা এতই জমজমাট যে, এখন থাই পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে আগে থেকেই দালালদের ভাল একটি নেটওয়ার্ক আছে। যদি ওই নেটওয়ার্কগুলো ভাঙ্গা যায়, তাহলে মুহূর্তেই সেখান থেকে অভিবাসী আসার হার কমে যাবে।
মানব পাচারবিরোধী অভিযান: আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। মনে হয়েছিল, তারা মনেপ্রাণেই চান এসব বন্ধ করতে। তারা জানালেন, তারা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে সোংখলা, সাতুন ও রানোং প্রদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার বা প্রশ্ন করার প্রমাণ আছে বলে মনে হয়নি। ওই প্রভাবশালীরাই এ ব্যবসা চালায় বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং, যেটির অভাব আমরা অনুভব করছি, তা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
প্রথম গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাবার পরই সরকার উঠেপড়ে লাগে। এ প্রতিবেদনটি লেখার সময়, ৮০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ৩০ জনেরও বেশি সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতুনের খুব প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীও রয়েছেন। রয়েছেন কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, তবে তারা বেসামরিক। ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ কি বেশিদিন টিকবে? হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন জবাবে বললেন, পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে আরও অনেক প্রভাবশালী লোক অর্থ কামিয়েছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখনও অনেক কিছুই করতে হবে। এখনও অনেক কিছুই খুঁজে বের করার বাকি।
২০৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করলো মিয়ানমার: বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সমুদ্রে ভাসমান দুটি নৌকা থেকে ২০৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে মিয়ানমার। আন্দামান সাগরে নৌকায় ভাসমান অভিবাসী সংকট নিয়ে মিয়ানমারের ওপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এটাই দেশটির প্রথম উদ্ধার অভিযান। মিয়ানমারের নৌবাহিনী নৌকা থেকে আটকে পড়া অভিবাসীদের উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যায়। জাতিসংঘের তরফ থেকে তাদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের এক সিনিয়র কর্মকর্তা টিন মং সোয়ে জানিয়েছেন, ২১শে মে টহলরত অবস্থায় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ দুটি নৌকা উদ্ধার করে। পাচারকারীদের নৌকায় এখনও ৩ সহস্রাধিক অভিবাসী সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে খবর আসছিল, মিয়ানমার উপকূলের অদূরে সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে ৫টি নৌকা। নৌকা নিয়ে আন্দামান সাগর পার হতেও চাইছিল না পাচারকারীরা। আবার আরোহীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেড়ে দিতেও তারা অনিচ্ছুক ছিল। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর বাড়তে থাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ। পরশু মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং আমেরিকান পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী টনি ব্লিঙ্কেন। এর পরই মিয়ানমার উদ্ধার অভিযান চালায় এবং দুটি নৌকা উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে দেশটি বিপর্যস্ত আরোহীদের মানবিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। তবে দেশটির একাধিক মন্ত্রী এটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, যাচাই সাপেক্ষে শুধু মিয়ানমারের নাগরিকদেরই সেখানে থাকতে দেয়া হবে। মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় উদ্ধার করা একটি নৌকার কয়েকটি ছবি পোস্ট করা হয়। এতে দেখা যায়, নৌকার খোলের ভেতর গাদাগাদি করে রয়েছে অনেক মানুষ। ফেসবুকের ওই পোস্টে তাদের ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করে থাকে। দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে, উদ্ধারকৃত নৌকা দুটি রাখাইন রাজ্যের অদূরে বাংলাদেশের জলসীমায় ছিল এবং আরও ছোট ছোট নৌকায় আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকায় তোলার জন্য অপেক্ষায় ছিল। এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনপ্রণেতারা মিয়ানমার সরকারকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের গণকবর পাওয়ার ঘটনায় তদন্ত শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পরশু ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া এক প্রস্তাবে এ আহ্বান জানান আইনপ্রণেতারা। থাইল্যান্ড সরকার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অবৈধ অভিবাসীকে থাইল্যান্ডে পাচারে জড়িত মানব পাচার চক্রের সদস্যদের সম্পৃক্ততা অবসানেরও আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সম্প্রদায়ের একটি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ইস্যুগুলো উত্থাপনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
অস্ট্রেলিয়ার না: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সংকট মোকাবিলা করতে সহায়তা চেয়ে ইন্দোনেশিয়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে অস্ট্রেলিয়া। দমন-পীড়ন ও দরিদ্রতা থেকে মুক্তির জন্য অভিবাসনপ্রার্থী কিছু রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট জানিয়েছেন, যে পদক্ষেপ আরও মানুষকে নৌকায় ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় প্রবৃত্ত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে সেটা হবে বিভ্রান্তিমূলক। অভিবাসন প্রত্যাশীদের অস্ট্রেলিয়ায় অস্থায়ী আশ্রয় দেয়া দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানব পাচার সমস্যায় সহায়তা করার পরিবর্তে আরও বাড়াতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মানব-বাণিজ্য: গত অক্টোবরে আমি প্রায় একই এলাকায় ছিলাম। তাকুয়া পা জেলায় বেশ কয়েকজন অভিবাসীকে সরকারি কর্মকর্তারা উদ্ধার করেছেন। এ খবর পেয়ে আমরা ব্যাংকক থেকে সেখানে ছুটে যাই। কমিউনিটি হলে আমরা ৮১ জন মানুষকে দেখতে পাই। তাদের চেহারায় ভয়াবহ চাপের ছাপ ছিল স্পষ্ট। আমরা তাদের প্রার্থনারত অবস্থায় দেখতে পাই। এ সময় তাদের প্রায় প্রত্যেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন।
বেশ কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর মিয়ানমারে নির্যাতন চলছে। কিন্তু এরা কেউই রোহিঙ্গা ছিল না। এরা ছিল বাংলাদেশী। এদের কেউ কেউ আমাদের বলেছেন, তাদেরকে জোর করে নৌকায় তুলে এখানে নিয়ে আসা হয়। জেলা প্রধান মানিত পিয়ানথং আমাদের নিয়ে যান এ অভিবাসীদের উদ্ধার স্থলের দিকে। জায়গাটি ছিল জঙ্গলে পরিপূর্ণ। বেশ কয়েকদিন আগে আমরা যে মহিলার কবরের সন্ধান পেয়েছিলাম, এ জায়গাটি তার চেয়ে বেশি দূরে নয়। এ জঙ্গলে অভিবাসীদের বহুদিন না খাইয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে পেটানো হয়েছে। মানিত আমাদের জানালেন, তার জেলাকে অনেকদিন ধরে মানব পাচারকারীরা ব্যবহার করছে। তিনি এটা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বা স্থানীয় আইনি প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছ থেকে তিনি তেমন সাহায্য পাননি। এর পরের কয়েকদিন ধরে আমি মানিতের দিকে নজর রাখছিলাম। আমি তাকে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশের কড়া মেজাজের ফোন কলগুলো সামলাতে দেখেছি। কেন মানিত গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললো, তা নিয়ে বেচারা বেশ হেনস্থা হয়েছে। মানিতকে উদ্ধারকৃত বাংলাদেশীদের ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠাতে বলা হলো। কিন্তু এটা একটি ওপেন সিক্রেট যে, ওই সরকারি বন্দি-কেন্দ্রে আটক অভিবাসীদের প্রায়ই আবার মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।
মানিত নিজের লোকদের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজে লাগালেন। যাতে করে এমন আরও বন্দিশিবিরের খোঁজ পাওয়া যায়। তিনি প্রধান সড়কে ২৪ ঘণ্টা নজরদারির ব্যবস্থা করলেন। এ ছাড়া স্থানীয় জেলে সমপ্রদায়ের কাছে অনুরোধ জানালেন যাতে কোন নৌকা আসতে দেখলে তাকে জানানো হয়। বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গারা যে বর্ধিষ্ণু হারে থাই উপকূলের দিকে যাচ্ছিল, তাতে মনে হয় মানব-ব্যবসা বিস্তৃত হচ্ছিল। অবাক হবার কিছু নেই, এটি ছিল মারাত্মক লাভজনক!
ব্যবসায়িক কাঠামো: রাবার গাছগুলোর নিচের বাষ্প শ্বাস আটকে দেয়। হঠাৎ দেখলাম, উজ্জ্বল কমলা রঙের শার্ট পরা এক তরুণ আমার পাশ দিয়ে দ্রুত চলে গেল। তার সঙ্গে কথা বললাম। খুব দ্রুতই সে কথা বলতে লাগলো। ৬ মাস আগে সেসহ আরও প্রায় ৬০০ মানুষ এখানে থাকতো। কোন ধরনের আশ্রয় ছাড়াই এখানে থাকতে হতো। ঝরে পড়া পাতা ছিল তাদের বিছানা। সে বললো, এখানেরই একটি তাঁবুতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এরপর আমাদের পিতামাতাকে ফোন দেয়া হলো। তাদের কাছ থেকে টাকা চাইতে বাধ্য করা হলো আমাদের। তারা টাকা না দিতে পারলে, আমাদের পেটানো হতো। আরেক জায়গা সে দেখালো, যেখানে কিছু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। অনেক মানুষ মারা গেল। তারা ট্রাকে করে ওই মৃতদেহগুলো কোথায় যেন নিয়ে গেল! এটাই হচ্ছে এ ব্যবসার কাঠামো। নৌকায় করে অভিবাসীদের এখানে নিয়ে আসে মানব পাচারকারীরা। পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ৩০০ জনকে নৌকায় করে থাইল্যান্ড নিয়ে আসার দাম ২০ হাজার ডলার। এরপর অভিবাসীদের জঙ্গলে আটকে রাখা হয়। মাথাপিছু ২-৩ হাজার ডলার করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করে পাচারকারীরা। প্রশ্ন হলো, কিভাবে একটি থাই গ্রামে এ রমরমা ব্যবসা চলে? আমি যে বন্দিশিবির দেখেছি, সেটি হাত ইয়াই শহর থেকে গাড়ি দিয়ে ৩০ মিনিটের পথ। অর্থাৎ এ ব্যবসায় স্থানীয়দেরও জড়িয়েছে মানব পাচারকারীরা। বয় নামের স্থানীয় এক তরুণ জানিয়েছে, স্থানীয় প্রায় পুরো সমপ্রদায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কয়েক বছর আগে সে পাখি শিকার করতে গিয়ে কয়েকটি বন্দিশিবির দেখতে পায়। সেখানে বহু শিশুও ছিল। তাদের পেটাতেও দেখেছে বয়। এরপর থেকে ওই শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষদের আশ্রয় দেয়ার চেষ্টা করেছে সে। সে বলে, এখানকার স্থানীয় পুরো সমপ্রদায় এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর কারণ, অর্থ! পাচারকারীরা প্রত্যেককে কিনে ফেলেছে। তারা কিছু মানুষকে বন্দিশিবির পাহারার কাজে লাগিয়েছে। স্থানীয়দের প্রধান আয়ের উৎস রাবারের দাম পড়তির দিকে। তাই এ ব্যবসা ছিল তাদের জন্য দারুণ এক বিকল্প! বয় আমাকে জানায়, স্থানীয় তরুণদের লোভ দেখানোর জন্য মাদকও ব্যবহার করে পাচারকারীরা। তাই অভিবাসীরা পালাতে পারলেও আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তাদের। কেউ না কেউ তাদের ধরে ফেলতো! বন্দিশিবিরে ভয়াবহ শাস্তির ঝুঁকি তো ছিলই।
সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশ: কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এসব করতে পারতো না মানব পাচারকারীরা। তবে ঠিক কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এসবে জড়িত ছিলেন, তা এখনও জানা যায়নি। কিন্তু এটি নিশ্চিত যে, খুবই উঁচুপর্যায় থেকে এসবে সায় ছিল। গত বছরের শেষ দিকে, আমাকে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা অনেক কিছু বলেন। ওই কর্মকর্তা মানব পাচারের ব্যবসা নিয়ে অনেক কিছুই জানেন। তিনি আমাকে বলেন, মালয়েশিয়ার সঙ্গে থাই সীমান্তেই অনেক বড় একটি বন্দিশিবির রয়েছে। সেখানে অন্তত ১ হাজার মানুষকে আটক রাখা হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তারা পুলিশ নিয়ে সেসব বন্ধ করছে না? প্রশ্ন শুনে সে হেসে দিল। তিনি বলেন, আপনি তো জানেনই যে সীমান্ত হচ্ছে সামরিক এলাকা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে সেখানে সামরিক বাহিনীর অনুমতি ছাড়া আমি কিছুই করতে পারি না। এই অনুমোদন তিনি কখনই পাননি। আমি প্রশ্ন করলাম, তিনি কেন প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপ্রধান প্রায়ুথ চ্যান-ওচা’র কাছে যাননি? তিনি গত বছর সামরিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর মানব পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে উত্তরে বললেন, আমি যদি তা করি, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাওয়ার আগেই মানব পাচারকারীদের সতর্ক করে দেয়া হবে। ফলে তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে যাবে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া তার কিছুই করার নেই। ছয় মাস পর ২৬ জনের মৃতদেহসহ প্রথম গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। এটিই ছিল সেই বন্দিশিবির যেটি ওই পুলিশ কর্মকর্তা অসহায়ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন।
এটি বের করা খুব কঠিন, কারা এসবে জড়িত; কারা জড়িত নয়। স্থানীয় এক পুলিশ প্রধান মানব পাচার বন্ধে তার প্রচেষ্টা সমপর্কে আমাদের জানান। এমনকি তিনি তার নৌকা নিয়ে আশেপাশে ঘুরে অনুসন্ধানের প্রস্তাব দেন আমাদের। ঠিক একদিন পর আমরা সামরিক বাহিনীর একটি ইউনিটের সঙ্গে অনুসন্ধানে যাই। ওই ইউনিট আমাদের জানায়, ওই স্থানীয় পুলিশ প্রধানই মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ওই সেনারাই বা কতটুকু মানব পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ- তা নিয়েই আমরা সংশয়ে পড়ি কিছুক্ষণ পর। একটি গ্রামে অভিবাসীদের লুকিয়ে রাখা হতে পারে বলে আমাদের ধারণা ছিল। সে গ্রামটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা গ্রামে প্রবেশ করতে চাইলাম। কিন্তু আগে কথা দিলেও, এবার ওই গ্রামে আমাদের নামাতে রাজি হয়নি সেনারা!
এক কর্মকর্তা আমাদের তার তদন্তের বিস্তারিত দেখালেন। সেখানে রানোং প্রদেশের নামিদামি অনেক ব্যবসায়ীর কথা উল্লেখ আছে। রানোং প্রদেশ অনেকদিন ধরে মানব পাচারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তার কাছে নাম, ফোন নম্বর, ফোন কলের সময় ও বড় ধরনের নেটওয়ার্কের প্রমাণ আছে। এ তথ্যসমূহ কেন্দ্রীয় সরকারকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গূঢ় রহস্য হচ্ছে, সরকার এসব জেনেও কিছুই করেনি। ওই কর্মকর্তাকে পরে বদলি করে দেয়া হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন বললেন, দেখুন, সবাই জানে যে ওখানে বন্দিশিবির আছে। এটা এমন নয় যে, কেবলমাত্র গ্রামবাসী বন্দিশিবিরে জড়িত ও পাহারার কাজ করে। অথচ থাই-মালয়েশিয়া সীমান্ত সমপূর্ণ সামরিকীকৃত। সেখানে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী গিজগিজ করছে। কারো পক্ষেই ওই এলাকায় ‘প্যাকেট’ বিনিময় ব্যাতীত এত বড় আকারের বন্দিশিবির পরিচালনা করা সম্ভব নয়!
বন্ধ হবে কবে: এবার আরেকটি সরকারি হলে গেলাম। দুইদিন আগে সেখানে বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে রাখা হয়েছে। তাদের বন্দিশিবির যারা পাহারা দিচ্ছিল, তাদের পাশেই পুলিশ আটক করে রেখেছে। পুলিশ প্রধান তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন; জানতে চেষ্টা করছিলেন তাদের বস কে। রোহিঙ্গাদের জন্য আমার একটি প্রশ্ন ছিল। তাদের কতজন চিন্তিত ছিল যে, তাদের পরিবার হয়তো পাচারকারীদের চাহিদা মোতাবেক মুক্তিপণ দিতে পারবে না দালালদের? এ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সবাই-ই হাত তুললো! রাখাইন স্টেটের এক রোহিঙ্গা শিক্ষক মোহাম্মদ জানালেন, আমরা এখানে আসতে চাই না। আমাদের মাতৃভূমি ছাড়তে চাই না। কিন্তু আমাদের আসলে যাবার কোনো জায়গাই নেই। মিয়ানমার সরকার খুবই খারাপ। তারা আমাদের পেটায়, গুলি মেরে হত্যা করে। কিন্তু এসব শিবিরে কি হয়, তা জানতেনই না মোহাম্মদ। একপর্যায়ে তিনি পালাতে পেরেছিলেন; কিন্তু আবার ধরা পড়েন পাচারকারীদের হাতে। একটি সামরিক সূত্র আমাদের জানায় যে, রানোং-এ একটি সরকারি অভিবাসী বন্দি-কেন্দ্রে আটককৃত অনেক রোহিঙ্গাকে রাখার পর তাদের আবারও মানব পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। এর আগেও এমন হয়েছে। তারা মূলত মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক ছিল। সেখানে চাকরি, পরিবার ও ভাল ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল তারা। কিন্তু বাংলাদেশীদের তবুও যাবার জায়গা আছে। তাদের অল্প কয়েকজনকে জোর করে পাচার করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকে জেনে বুঝে সমুদ্র পথে পাড়ি জমাতে রাজি হয়। উচ্চ বেতনে চাকরির লোভ দেখিয়ে তাদের মুঠোয় আনে পাচারকারীরা। কিন্তু এ ব্যবসার নির্মম বাস্তবতা যখন উপলব্ধি করার পর তাদের অনেকেই বাড়ি যেতে চাইলো। এ ব্যবসা এতই জমজমাট যে, এখন থাই পাচারকারীদের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সেখানে আগে থেকেই দালালদের ভাল একটি নেটওয়ার্ক আছে। যদি ওই নেটওয়ার্কগুলো ভাঙ্গা যায়, তাহলে মুহূর্তেই সেখান থেকে অভিবাসী আসার হার কমে যাবে।
মানব পাচারবিরোধী অভিযান: আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। মনে হয়েছিল, তারা মনেপ্রাণেই চান এসব বন্ধ করতে। তারা জানালেন, তারা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাছে সোংখলা, সাতুন ও রানোং প্রদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার বা প্রশ্ন করার প্রমাণ আছে বলে মনে হয়নি। ওই প্রভাবশালীরাই এ ব্যবসা চালায় বলে ধারণা করা হয়। সুতরাং, যেটির অভাব আমরা অনুভব করছি, তা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
প্রথম গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাবার পরই সরকার উঠেপড়ে লাগে। এ প্রতিবেদনটি লেখার সময়, ৮০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ৩০ জনেরও বেশি সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতুনের খুব প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীও রয়েছেন। রয়েছেন কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা, তবে তারা বেসামরিক। ৫০ জনেরও বেশি পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। সরকারের এসব পদক্ষেপ কি বেশিদিন টিকবে? হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন জবাবে বললেন, পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে আরও অনেক প্রভাবশালী লোক অর্থ কামিয়েছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখনও অনেক কিছুই করতে হবে। এখনও অনেক কিছুই খুঁজে বের করার বাকি।
২০৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করলো মিয়ানমার: বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সমুদ্রে ভাসমান দুটি নৌকা থেকে ২০৮ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে মিয়ানমার। আন্দামান সাগরে নৌকায় ভাসমান অভিবাসী সংকট নিয়ে মিয়ানমারের ওপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে এটাই দেশটির প্রথম উদ্ধার অভিযান। মিয়ানমারের নৌবাহিনী নৌকা থেকে আটকে পড়া অভিবাসীদের উদ্ধার করে তীরে নিয়ে যায়। জাতিসংঘের তরফ থেকে তাদের সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের এক সিনিয়র কর্মকর্তা টিন মং সোয়ে জানিয়েছেন, ২১শে মে টহলরত অবস্থায় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ দুটি নৌকা উদ্ধার করে। পাচারকারীদের নৌকায় এখনও ৩ সহস্রাধিক অভিবাসী সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে খবর আসছিল, মিয়ানমার উপকূলের অদূরে সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে ৫টি নৌকা। নৌকা নিয়ে আন্দামান সাগর পার হতেও চাইছিল না পাচারকারীরা। আবার আরোহীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেড়ে দিতেও তারা অনিচ্ছুক ছিল। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারের ওপর বাড়তে থাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ। পরশু মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং আমেরিকান পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী টনি ব্লিঙ্কেন। এর পরই মিয়ানমার উদ্ধার অভিযান চালায় এবং দুটি নৌকা উদ্ধার করে তীরে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে দেশটি বিপর্যস্ত আরোহীদের মানবিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে। তবে দেশটির একাধিক মন্ত্রী এটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, যাচাই সাপেক্ষে শুধু মিয়ানমারের নাগরিকদেরই সেখানে থাকতে দেয়া হবে। মিয়ানমারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় উদ্ধার করা একটি নৌকার কয়েকটি ছবি পোস্ট করা হয়। এতে দেখা যায়, নৌকার খোলের ভেতর গাদাগাদি করে রয়েছে অনেক মানুষ। ফেসবুকের ওই পোস্টে তাদের ‘বাঙালি’ বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখ্য, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করে থাকে। দেশটির কর্তৃপক্ষ বলছে, উদ্ধারকৃত নৌকা দুটি রাখাইন রাজ্যের অদূরে বাংলাদেশের জলসীমায় ছিল এবং আরও ছোট ছোট নৌকায় আসা অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকায় তোলার জন্য অপেক্ষায় ছিল। এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনপ্রণেতারা মিয়ানমার সরকারকে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের গণকবর পাওয়ার ঘটনায় তদন্ত শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পরশু ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া এক প্রস্তাবে এ আহ্বান জানান আইনপ্রণেতারা। থাইল্যান্ড সরকার ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য অবৈধ অভিবাসীকে থাইল্যান্ডে পাচারে জড়িত মানব পাচার চক্রের সদস্যদের সম্পৃক্ততা অবসানেরও আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সম্প্রদায়ের একটি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ইস্যুগুলো উত্থাপনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
অস্ট্রেলিয়ার না: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসী সংকট মোকাবিলা করতে সহায়তা চেয়ে ইন্দোনেশিয়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে অস্ট্রেলিয়া। দমন-পীড়ন ও দরিদ্রতা থেকে মুক্তির জন্য অভিবাসনপ্রার্থী কিছু রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট জানিয়েছেন, যে পদক্ষেপ আরও মানুষকে নৌকায় ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় প্রবৃত্ত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে সেটা হবে বিভ্রান্তিমূলক। অভিবাসন প্রত্যাশীদের অস্ট্রেলিয়ায় অস্থায়ী আশ্রয় দেয়া দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানব পাচার সমস্যায় সহায়তা করার পরিবর্তে আরও বাড়াতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
No comments