এই এফবিসিসিআই লইয়া আমরা কী করিব? by শওকত হোসেন
ব্যবসায়ীদের
শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতিসমূহের ফেডারেশন বা এফবিসিসিআইয়ের
নির্বাচন ২৩ মে। এই নির্বাচনের সংবাদ গণমাধ্যমে আসছে সামান্যই।
রিপোর্টাররা আগ্রহী হয়ে এই নির্বাচন নিয়ে সংবাদ তেমন লিখছেনও না। কারণ, এই
নির্বাচনের ‘নিউজ ভ্যালু’ সামান্যই।
অথচ একটা সময় ছিল, এফবিসিসিআই নির্বাচন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেত। ব্যবসায়ী মহলের মূল আলোচনাই থাকত এফবিসিসিআই নির্বাচন নিয়ে। মনে আছে, সভাপতি প্রার্থীদের দিনের পর দিন আমরা অনুসরণ করতাম, সব পরিচিতি সভায় যেতাম, সাক্ষাৎকার ছাপা হতো প্রথম পাতায়। খারাপ কিছুও ঘটত সে সময়। যেমন, কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা ছিলেন, যাঁদের বড় ব্যবসা ছিল নির্বাচনের সময় ভোট বিক্রি করা। বিশেষ করে একজন সাবেক সভাপতি ও দুই সাবেক সহসভাপতির বড় ব্যবসাই ছিল নিজের দখলে থাকা ভোট বিক্রি করা।
এফবিসিসিআই নির্বাচনের সেই জৌলুশ আর নেই। এখন নির্বাচনের আগেই সবাই জানেন কে হতে যাচ্ছেন সভাপতি। আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করা। নির্বাচনটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কার আর আগ্রহ থাকে?
আসলে এফবিসিসিআই নিজেই গুরুত্ব হারিয়েছে। যে সংস্থাটিরই গুরুত্ব কম, তার নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বও কমই থাকবে। সংগঠনটির কাজ হচ্ছে বিদেশ থেকে কোনো ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এলে বৈঠক করা। এটি একটি রুটিন কাজ। আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে বিদেশ সফর করা। এ ছাড়া বাজেটের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এফবিসিসিআই যৌথভাবে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে। সেখানে বাজেটের রাজস্ব প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। এখন এফবিসিসিআইকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাদের কয়টি প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী বা সরকার গ্রহণ করে? তারা তা বলতে পারবে না। এ নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই সংগঠনটির। আগে তাও এই বৈঠকে অন্তত অর্থমন্ত্রীরা পুরোটা সময় থাকতেন, ব্যবসায়ীদের কথা শুনতেন। এখন তো তাও হয় না। অর্থমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েই চলে যান।
প্রতিটি দেশেই ব্যবসায়ীদের একটি শীর্ষ সংগঠন থাকে। এটাই নিয়ম। সেই নিয়ম মেনে বাংলাদেশেও এফবিসিসিআই আছে। পাশের দেশ ভারতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটির নাম ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা ফিকি। ফিকির কার্যালয়ে গিয়ে দেখেছি সেখানকার কর্মযজ্ঞ। ফিকির ওয়েবসাইটে গেলেই পাওয়া যাবে তাদের কাজের বিশাল বিবরণ। অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিতভাবে গবেষণা ও জরিপ করে থাকে ফিকি। প্রতিটি নতুন আইন বা চুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করে ফিকি। আর এফবিসিসিআইয়ের ওয়েবসাইটে এখন ঢুকলে দেখা যাবে প্রকাশনা বলতে আছে ২০১১ সালের একটি বুলেটিন। এফবিসিসিআই শেষ কবে গবেষণা করেছিল, সেটিই বরং গবেষণার বিষয়। গবেষণা সেল একটা আছে বটে, তবে তাদের কাজ হচ্ছে এফবিসিসিআই সভাপতির বক্তব্য লিখে দেওয়া।
এফবিসিসিআইয়ের গবেষণা সেলের দৈন্য টের পাওয়া যায় হরতাল-অবরোধ বা বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। তখন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ নিয়ে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি যে কত, সে হিসাব করার যোগ্যতা ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনটির নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির হাস্যকর একটি হিসাব পাওয়া যায়। যেমন, এফবিসিসিআই বলে দিল হরতাল-অবরোধের ৪৪ দিনে অর্থনীতির ক্ষতি ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। অথচ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে এ সময় উৎপাদন ক্ষতি ৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ক্ষতি অবশ্য তার তিন গুণ, ১৭ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এফবিসিসিআই আর অন্য দুই সংস্থার মধ্যে হিসাবের পার্থক্য বিশাল। যদিও এফবিসিসিআই উৎপাদনের পাশাপাশি সম্পদের ক্ষতির তথ্য দিচ্ছে। তাহলেও এত বড় পার্থক্য হবে না। কারণ, উৎপাদন ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি।
এফবিসিসিআইয়ের গবেষণার প্রক্রিয়াটি কিন্তু অত্যন্ত সহজ। সদস্য সমিতিগুলো জানায়, তাদের ক্ষতির পরিমাণ আর এফবিসিসিআই সেগুলো যোগ দিয়ে বিশাল একটা সংখ্যা বের করে। এ জন্য গবেষণা সেল লাগে না, একটি ক্যালকুলেটরই যথেষ্ট। এ রকম অবিশ্বাস্য হিসাব দেয় বলেই এফবিসিসিআইয়ের কথা এখন আর কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না।
অবশ্য এফবিসিসিআইয়ের এই হিসাব একদমই কাজে লাগে না তা নয়। বড় অঙ্কের ক্ষতির কথা বললে ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা পেতে সহজ হয়। আসলে এটি হচ্ছে অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের একধরনের রাজনীতি। এর মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ খেলাপিরা বিশেষ সুবিধা পান। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ক্ষয়-ক্ষতির বিশাল বিবরণ দিয়ে ঋণখেলাপিরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করেছিলেন।
এফবিসিসিআই যে কতটা গুরুত্ব হারিয়েছে তা দেখা যায় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। রাজনৈতিক
সংকট দেখা দিলেই এফবিসিসিআই প্রতিবারই সংকট নিরসনে মধ্যস্থতার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেই ১৯৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় থেকেই। প্রতিবারই দেখা গেছে, এফবিসিসিআই দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কারণ, শেষ পর্যন্ত কেউই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী হন না। বিশেষ করে বিরোধী দল একদমই পাত্তা দেয় না এফবিসিসিআইকে। গুরুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা—দুটোই নেই এফবিসিসিআইয়ের।
এফবিসিসিআইকে এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখা বলা হয়। সভাপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকেই তা শুরু হয়ে যায়। দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের পছন্দের ব্যক্তিই হন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। আবার ক্ষমতাসীনদের অর্থ দিয়ে সভাপতি হওয়ারও উদাহরণ আছে।
এফবিসিসিআইয়ের এখনকার সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহ্মদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। এর আগের সভাপতি এ কে আজাদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একবার মনোনয়নও চেয়েছিলেন। তারও আগের সভাপতি আনিসুল হক এখন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচিত মেয়র। তবে এফবিসিসিআই সভাপতি হয়েছিলেন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনেই।
এরও আগে এফবিসিসিআইয়ের দুবারের নির্বাচিত সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন আওয়ামী লীগের হয়ে দুই দফায় কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি এখন সাংসদ। আরেক সভাপতি সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা।
দুই দফায় সভাপতি ছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। তবে তখন তিনি পরিচিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে। এখন তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। আর গত বিএনপি সরকারের সময় সভাপতি ছিলেন মীর নাসির হোসেন। বলা হয়, তিনি সভাপতি হয়েছিলেন হাওয়া ভবনের সমর্থনেই।
এফবিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি হওয়ার কয়েকটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। বলতে হবে যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন পেয়েছেন। এটা হচ্ছে নির্বাচনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী বিদায় করার প্রথম ধাপ। ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই সবাই এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হচ্ছেন। এবারও কোনো ব্যতিক্রম ঘটার কারণ নেই।
সরাসরি নির্বাচন হয় না বলেই সরকারের আস্থাভাজনকে সভাপতি করা এখন অনেক সহজ। এফবিসিসিআইয়ের ৫২ জন পরিচালক থাকেন। তাঁদের মধ্য থেকেই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন সভাপতি ও দুই সহসভাপতি। এই ৫২ জনের ২০ জনই সরকার মনোনীত সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি পরিচালক হন। বাকিদের নির্বাচনে জয়ী হতে হয়।
কারসাজিটা হয় মনোনীত পরিচালক পদেই। সরকারের আস্থাভাজন ব্যবসায়ী প্রথমে মনোনীত সংগঠনের প্রতিনিধি করে সরাসরি পরিচালক পদে মনোনয়ন হন। সেখান থেকে পরে তিনি হন সভাপতি। অর্থাৎ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো ঝুঁকিতেই যেতে হচ্ছে না। বর্তমান সভাপতি কাজী আকরাম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি পরিচালক হন। সেখান থেকে হয়েছেন সভাপতি।
গুরুত্বপূর্ণ চেম্বার ও সমিতির প্রতিনিধিরা যাতে এফবিসিসিআইয়ে আসতে পারেন, এ জন্যই ১৮ জন মনোনীত পরিচালকের বিধান রাখা হয়েছিল। আর এখন সেই বিধানটি ব্যবহৃত হচ্ছে সরকার-সমর্থিত সভাপতি হওয়ার জন্য। আবদুল মাতলুব আহমাদ এবার মনোনীত পরিচালক হয়েছেন রাজশাহী চেম্বার থেকে। অথচ এর আগে তিনি পরিচালক হয়েছিলেন বিমা সমিতি থেকে। কিন্তু যাতে নির্বাচন করতে না হয়, এ জন্য রাজশাহী চেম্বারের প্রতিনিধি হয়েছেন।
এত কাণ্ড করে সভাপতি হতে হয় বলেই তিনি হয়ে যান সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখার সভাপতি। আর এই এফবিসিসিআইয়ের কাজ হয় সরকারকে সব কাজে সমর্থন দেওয়া। এ কারণে সরকারের কোনো অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানেও যেতে পারে না। ফলে বিরোধী দলও গুরুত্ব দেয় না এই এফবিসিসিআইকে। তাহলে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’র ভাষায় বলতে হয়, ‘এই এফবিসিসিআই লইয়া আমরা কী করিব?’
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com
অথচ একটা সময় ছিল, এফবিসিসিআই নির্বাচন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেত। ব্যবসায়ী মহলের মূল আলোচনাই থাকত এফবিসিসিআই নির্বাচন নিয়ে। মনে আছে, সভাপতি প্রার্থীদের দিনের পর দিন আমরা অনুসরণ করতাম, সব পরিচিতি সভায় যেতাম, সাক্ষাৎকার ছাপা হতো প্রথম পাতায়। খারাপ কিছুও ঘটত সে সময়। যেমন, কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা ছিলেন, যাঁদের বড় ব্যবসা ছিল নির্বাচনের সময় ভোট বিক্রি করা। বিশেষ করে একজন সাবেক সভাপতি ও দুই সাবেক সহসভাপতির বড় ব্যবসাই ছিল নিজের দখলে থাকা ভোট বিক্রি করা।
এফবিসিসিআই নির্বাচনের সেই জৌলুশ আর নেই। এখন নির্বাচনের আগেই সবাই জানেন কে হতে যাচ্ছেন সভাপতি। আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করা। নির্বাচনটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে কার আর আগ্রহ থাকে?
আসলে এফবিসিসিআই নিজেই গুরুত্ব হারিয়েছে। যে সংস্থাটিরই গুরুত্ব কম, তার নির্বাচন নিয়ে গুরুত্বও কমই থাকবে। সংগঠনটির কাজ হচ্ছে বিদেশ থেকে কোনো ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এলে বৈঠক করা। এটি একটি রুটিন কাজ। আরেকটি বড় কাজ হচ্ছে বিদেশ সফর করা। এ ছাড়া বাজেটের আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এফবিসিসিআই যৌথভাবে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে। সেখানে বাজেটের রাজস্ব প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। এখন এফবিসিসিআইকে যদি প্রশ্ন করা হয়, তাদের কয়টি প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী বা সরকার গ্রহণ করে? তারা তা বলতে পারবে না। এ নিয়ে কোনো গবেষণাও নেই সংগঠনটির। আগে তাও এই বৈঠকে অন্তত অর্থমন্ত্রীরা পুরোটা সময় থাকতেন, ব্যবসায়ীদের কথা শুনতেন। এখন তো তাও হয় না। অর্থমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েই চলে যান।
প্রতিটি দেশেই ব্যবসায়ীদের একটি শীর্ষ সংগঠন থাকে। এটাই নিয়ম। সেই নিয়ম মেনে বাংলাদেশেও এফবিসিসিআই আছে। পাশের দেশ ভারতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটির নাম ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বা ফিকি। ফিকির কার্যালয়ে গিয়ে দেখেছি সেখানকার কর্মযজ্ঞ। ফিকির ওয়েবসাইটে গেলেই পাওয়া যাবে তাদের কাজের বিশাল বিবরণ। অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিতভাবে গবেষণা ও জরিপ করে থাকে ফিকি। প্রতিটি নতুন আইন বা চুক্তির প্রভাব বিশ্লেষণ করে ফিকি। আর এফবিসিসিআইয়ের ওয়েবসাইটে এখন ঢুকলে দেখা যাবে প্রকাশনা বলতে আছে ২০১১ সালের একটি বুলেটিন। এফবিসিসিআই শেষ কবে গবেষণা করেছিল, সেটিই বরং গবেষণার বিষয়। গবেষণা সেল একটা আছে বটে, তবে তাদের কাজ হচ্ছে এফবিসিসিআই সভাপতির বক্তব্য লিখে দেওয়া।
এফবিসিসিআইয়ের গবেষণা সেলের দৈন্য টের পাওয়া যায় হরতাল-অবরোধ বা বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। তখন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ নিয়ে। কিন্তু প্রকৃত ক্ষতি যে কত, সে হিসাব করার যোগ্যতা ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনটির নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির হাস্যকর একটি হিসাব পাওয়া যায়। যেমন, এফবিসিসিআই বলে দিল হরতাল-অবরোধের ৪৪ দিনে অর্থনীতির ক্ষতি ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। অথচ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে এ সময় উৎপাদন ক্ষতি ৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ক্ষতি অবশ্য তার তিন গুণ, ১৭ হাজার কোটি টাকা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এফবিসিসিআই আর অন্য দুই সংস্থার মধ্যে হিসাবের পার্থক্য বিশাল। যদিও এফবিসিসিআই উৎপাদনের পাশাপাশি সম্পদের ক্ষতির তথ্য দিচ্ছে। তাহলেও এত বড় পার্থক্য হবে না। কারণ, উৎপাদন ক্ষতিই সবচেয়ে বেশি।
এফবিসিসিআইয়ের গবেষণার প্রক্রিয়াটি কিন্তু অত্যন্ত সহজ। সদস্য সমিতিগুলো জানায়, তাদের ক্ষতির পরিমাণ আর এফবিসিসিআই সেগুলো যোগ দিয়ে বিশাল একটা সংখ্যা বের করে। এ জন্য গবেষণা সেল লাগে না, একটি ক্যালকুলেটরই যথেষ্ট। এ রকম অবিশ্বাস্য হিসাব দেয় বলেই এফবিসিসিআইয়ের কথা এখন আর কেউ তেমন গুরুত্ব দেয় না।
অবশ্য এফবিসিসিআইয়ের এই হিসাব একদমই কাজে লাগে না তা নয়। বড় অঙ্কের ক্ষতির কথা বললে ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা পেতে সহজ হয়। আসলে এটি হচ্ছে অর্থনীতি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের একধরনের রাজনীতি। এর মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ খেলাপিরা বিশেষ সুবিধা পান। গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ক্ষয়-ক্ষতির বিশাল বিবরণ দিয়ে ঋণখেলাপিরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিশেষ সুবিধা আদায় করেছিলেন।
এফবিসিসিআই যে কতটা গুরুত্ব হারিয়েছে তা দেখা যায় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। রাজনৈতিক
সংকট দেখা দিলেই এফবিসিসিআই প্রতিবারই সংকট নিরসনে মধ্যস্থতার আগ্রহ প্রকাশ করে। সেই ১৯৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় থেকেই। প্রতিবারই দেখা গেছে, এফবিসিসিআই দুই নেত্রীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কারণ, শেষ পর্যন্ত কেউই তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী হন না। বিশেষ করে বিরোধী দল একদমই পাত্তা দেয় না এফবিসিসিআইকে। গুরুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতা—দুটোই নেই এফবিসিসিআইয়ের।
এফবিসিসিআইকে এখন সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখা বলা হয়। সভাপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকেই তা শুরু হয়ে যায়। দেখা গেছে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের পছন্দের ব্যক্তিই হন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। আবার ক্ষমতাসীনদের অর্থ দিয়ে সভাপতি হওয়ারও উদাহরণ আছে।
এফবিসিসিআইয়ের এখনকার সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহ্মদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য। এর আগের সভাপতি এ কে আজাদ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একবার মনোনয়নও চেয়েছিলেন। তারও আগের সভাপতি আনিসুল হক এখন আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচিত মেয়র। তবে এফবিসিসিআই সভাপতি হয়েছিলেন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনেই।
এরও আগে এফবিসিসিআইয়ের দুবারের নির্বাচিত সভাপতি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন আওয়ামী লীগের হয়ে দুই দফায় কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি এখন সাংসদ। আরেক সভাপতি সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা।
দুই দফায় সভাপতি ছিলেন আবদুল আউয়াল মিন্টু। তবে তখন তিনি পরিচিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ হিসেবে। এখন তিনি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। আর গত বিএনপি সরকারের সময় সভাপতি ছিলেন মীর নাসির হোসেন। বলা হয়, তিনি সভাপতি হয়েছিলেন হাওয়া ভবনের সমর্থনেই।
এফবিসিসিআইয়ের নতুন সভাপতি হওয়ার কয়েকটি প্রক্রিয়া আছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। বলতে হবে যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন পেয়েছেন। এটা হচ্ছে নির্বাচনে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী বিদায় করার প্রথম ধাপ। ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই সবাই এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি হচ্ছেন। এবারও কোনো ব্যতিক্রম ঘটার কারণ নেই।
সরাসরি নির্বাচন হয় না বলেই সরকারের আস্থাভাজনকে সভাপতি করা এখন অনেক সহজ। এফবিসিসিআইয়ের ৫২ জন পরিচালক থাকেন। তাঁদের মধ্য থেকেই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন সভাপতি ও দুই সহসভাপতি। এই ৫২ জনের ২০ জনই সরকার মনোনীত সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি পরিচালক হন। বাকিদের নির্বাচনে জয়ী হতে হয়।
কারসাজিটা হয় মনোনীত পরিচালক পদেই। সরকারের আস্থাভাজন ব্যবসায়ী প্রথমে মনোনীত সংগঠনের প্রতিনিধি করে সরাসরি পরিচালক পদে মনোনয়ন হন। সেখান থেকে পরে তিনি হন সভাপতি। অর্থাৎ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো ঝুঁকিতেই যেতে হচ্ছে না। বর্তমান সভাপতি কাজী আকরাম বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের প্রতিনিধি হিসেবে সরাসরি পরিচালক হন। সেখান থেকে হয়েছেন সভাপতি।
গুরুত্বপূর্ণ চেম্বার ও সমিতির প্রতিনিধিরা যাতে এফবিসিসিআইয়ে আসতে পারেন, এ জন্যই ১৮ জন মনোনীত পরিচালকের বিধান রাখা হয়েছিল। আর এখন সেই বিধানটি ব্যবহৃত হচ্ছে সরকার-সমর্থিত সভাপতি হওয়ার জন্য। আবদুল মাতলুব আহমাদ এবার মনোনীত পরিচালক হয়েছেন রাজশাহী চেম্বার থেকে। অথচ এর আগে তিনি পরিচালক হয়েছিলেন বিমা সমিতি থেকে। কিন্তু যাতে নির্বাচন করতে না হয়, এ জন্য রাজশাহী চেম্বারের প্রতিনিধি হয়েছেন।
এত কাণ্ড করে সভাপতি হতে হয় বলেই তিনি হয়ে যান সরকারি দলের ব্যবসায়ী শাখার সভাপতি। আর এই এফবিসিসিআইয়ের কাজ হয় সরকারকে সব কাজে সমর্থন দেওয়া। এ কারণে সরকারের কোনো অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানেও যেতে পারে না। ফলে বিরোধী দলও গুরুত্ব দেয় না এই এফবিসিসিআইকে। তাহলে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’র ভাষায় বলতে হয়, ‘এই এফবিসিসিআই লইয়া আমরা কী করিব?’
শওকত হোসেন: সাংবাদিক।
massum99@gmail.com
No comments