টিপ টিপ বৃষ্টি by সৈয়দ ইকবাল
ঝুলন্ত হেলপার কিশোর চিৎকার করে উঠল—মৎস্য ভবন! মৎস্য ভবন! ডান পা! ঠিক তখনি বিরান মাহমুদের পাছায় হাত বোলাল কেউ। মাথা ঘুরিয়ে সে দেখল খোঁচা খোঁচা দাড়ি-মুখের একজন মানুষ।
—জায়গা দেন নামুম!
বিরানের মেজাজ তেমন খারাপ হয় না। বাসেই চলাচল করে, অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তা ছাড়া রাগ করার নার্ভগুলো তার ভোঁতা হয়ে গেছে অনেকটা। বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ—সবখানেই তাকে ভেঙায় সবাই। অথচ তার করার কিছু নেই, সৃষ্টিকর্তা হয়তো তাকে তৈরি করেছেন মানুষের হাসির পাত্র হতে। তা না হলে তার শরীর এত লম্বা ডাইনোসরের মতো হাড্ডিসার কেন? মানুষ ছোটবেলায় ডাকত হাড়গিল, উটপাখিজাতীয় কিছু।
এখন সে ঢাকার নামী অ্যাড এজেন্সিতে ক্লায়েন্ট সার্ভিসে কাজ করে। ভালো কাজ করে বলেই টিকে আছে এই অবয়ব নিয়ে। তবু মাঝেমধ্যে অসুবিধা হয়। ক্লায়েন্ট ফোন করে বলে অন্য কাউকে পাঠাতে, তবে তা কখনো-সখনো।
এবার একজন তার পিঠ চাপড়ে বলল, কিরে ভাই, কাঁদেন ক্যান! চোখ দিয়া তো পানির ঝরনা বইতাছ্যা! বিরান লজ্জা পেয়ে রুমাল বের করে চোখ মুছল। অফিসে এসেই ছুটল মিটিং রুমে, ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে!
—হোয়াটস হ্যাপেন বিরান? কাঁদছ কেন?
সরি বলে বিরান এবার ছুটল ওয়াশ রুমে। আয়নায় দেখল, ঠিকই জল বেরোচ্ছে অনর্গল।
ওয়াশ রুম থেকে বেরোতেই ক্লায়েন্ট সুপারভাইজার মফিজ ভাই ধরলেন, পুরান ঢাকার লোক, নিজেদের একসেন্টেই বাংলা বলেন।
—কী হইলো আবার বিমার সাব? অফিসের মধ্যে কাইন্দা চোক্ষের পানি ফেলতাছেন? মনের দুঃখে পাবলিকগো সামনে কাইন্দেন না!
—মফিজ ভাই, সব সময় ফাজলামি ভালো লাগে না!
—কয় কী মাইরে-বাপ! পাবলিকের সামনে কাঁদবো আর বলা যাইবো না।
অফিস শেষে ফুটপাতে দ্রুত হাঁটছে বিরান। চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে আপনাতেই। তার মনে খুব দুঃখ। প্রতিদিন কে যেন হতাশার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে তাকে। তাই বলে তো চোখ দিয়ে এভাবে পানি বেরোনোর কথা নয়।
তার মতো কুৎসিত-দর্শন, বীভৎসপ্রায় মানুষকে তীব্র প্রেম দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিল টিপ টিপ সামদানী। অপার্থিব এই মেয়ের তার মতো মানুষকে ভালোবাসার কারণ অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি সে। টিপ টিপ সামদানীর রং কালো হলেও আলোতে ভরা। শরীরের গঠনও কালজয়ী নারী মডেলের মতো অতুলনীয়। জগৎজুড়ে এ রকম নারীর পেছনেই অভিভূত হয়ে লাইন দেয় পুরুষেরা।
অন্যদিকে বিরান মাহমুদের জীবন সত্যিই যেন বিরান, খাঁ খাঁ—মেয়েরা ঘুরেও দেখে না। প্রেম, ভালোবাসা তো দূরের কথা, ভালোবাসা কী জিনিস, টিপ টিপ সামদানী তার জীবনে আসার আগে জানাই ছিল না বিরানের।
টিপ টিপ সামদানী এলিসের মতো তাকে হাত ধরে এনে দাঁড়া করিয়ে দিল এক ওয়ান্ডারল্যান্ডে।
টিপ টিপ সামদানীকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন তুমি আমার মতো বীভৎসপ্রায় মানুষকে ভালোবাসলে? কাছে টানলে?
—এ আবার কেমন কথা! তুমি আমার কাছে তুমি। বড়-ছোট সুন্দর-অসুন্দর কিছু না! তোমার মতো অনুভূতিপ্রবণ মানুষ আমি জীবনে আর পাইনি বলেই ভালোবাসি।
বিরান মাহমুদের বিরান অন্তর্জগতে লক্ষ ফায়ার ওয়ার্ডের ফুলঝুরি জ্বলে উঠেছিল। তিন-তিনটি বছর বিরান সামনে-পেছনে, আকাশে-মাটিতে ডানে-বামে শুধু টিপ টিপ সামদানীকেই দেখেছে। তার মগজের শিরায় শিরায় নেচে চলেছে টিপ টিপ সামদানীর মাধুরী। সে ভেবেছিল, এ এক আত্মিক সম্পর্ক।
তবে এক ঝটকায় তাকে টিপ টিপ সামদানী ছুড়ে ফেলতেই বুঝল, আত্মিক-ফাত্মিক কিচ্ছু নয়! যেভাবে টেনে নিয়েছিল, সেভাবেই ছুড়ে দিল। লন্ডন থেকে তার বয়ফ্রেন্ড প্রিন্স জামান পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরতেই টিপ টিপ সামদানী বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল তাকে। বিরান মাহমুদকে সামলে ওঠার সময়টুকুও দিল না।
সামলে ওঠার সময় দিলে নাকি সম্পর্ক ঘেনঘেনে হয়ে যায়। ফোনে চট্টগ্রাম থেকে বলল টিপ টিপ সামদানী, আগামী সপ্তায় আমার হলুদ, তার এক দিন পর বিয়ে। দুদিন পর কিং অব চিটাগাংয়ে বউভাত।
বিরান তোতলাতে শুরু করেছিল, কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল।
বিরানের চাকরি প্রায় নট। সিও রেজা আলী নিজের রুমে ডেকে বললেন, ক্লায়েন্টদের থেকে কমপ্লেইন আসছে বারবার। আপনার লোক সার্ভিস দেবে কী, সে তো চোখের পানি ফেলছে! যাও, ১৫ দিনের ছুটি বেতনসহ দিলাম। ভালো আই স্পেশালিস্ট দেখাও।
আই স্পেশালিস্ট বিরানের চোখ দেখে টেস্টের পর টেস্ট দিলেন। তবে আসল সমস্যা খুঁজে পেলেন না। ঘাবড়ে গিয়ে হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দিলেন। তাতে কিছু হলো না। দেশে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে পড়ে রইল বিরান। মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন, বাবা, নামাজ পড়ো, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে জামাতে নামাজে দাঁড়ালে লোক নামাজ শেষে বলতে লাগল, এভাবে ভাই চোখের পানি নামাজে দাঁড়াইয়া ফেইলেন না, ডর লাগে। মনে হয় আইজক্যা আপনের শেষ দিন। এরপর অগত্যা জামাত ছেড়ে একা মসজিদে এসে সিজদা দিল বিরান, আল্লাহকে ডাকল ভীষণভাবে। তবে চোখ থেকে পানি পড়া আটকানো গেল না—বরং তা বেড়েই চলল। পথে হাঁটতে হাঁটতে মুখ নাড়লে বিরানের চোখের পানির ছিটা গিয়ে পড়তে লাগল অন্যের শরীরে। তো, এরপর কী? মানুষের ধমক খেতে শুরু করল বিরান মাহমুদ।
হঠাৎ টিপ টিপ সামদানীর ফোন এল, কী অবস্থা তোমার? এই জানো, আমি পারলারে এসেছি বিয়ের মেহেদি লাগাতে।
কোনো কারণ ছাড়াই মেহেদির রং এমনকি মেহেদি শব্দটি বাল্যকাল থেকে ঘেন্না লাগে বিরানের। তবু সে বলল, বাহ্! ভালো তো, কোন ডিজাইন লাগাবে—প্রিয়াঙ্কা, নাকি কারিনা?
—ধ্যাৎ! গাধা, সত্যি বিরান কিচ্ছু জানে না। কুট করে লাইন কেটে দিল টিপ টিপ সামদানী।
বাসে আশপাশের মানুষের ধমক নেই, কারও গায়ে তার চোখের পানির ছিটা গড়িয়ে পড়ছে না। ফোন আসার পর হঠাৎ পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাস্তার পাশে সেলুনে ঢুকে আয়নায় দেখল। ঠিকই তো পানি বন্ধ। বাসার কাছে রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে চায়ের টংয়ের নবা ভাইয়ের কাছে গেল। তাকে দেখেই নবা ভাই বলে উঠলেন, বন্ধ হইছেরে ভাই! বন্ধ হইছে।
একটা রাত একটা দিন পানি পড়া বন্ধ! বিরান মাহমুদ বুঝল, টিপ টিপ সামদানীর ফোন এলে পানি পড়া বন্ধ
হয়ে যায়। আবার হালকা-পাতলা পানি পড়া শুরু হতেই পুনরায় এল ফোন!
—পারলারে বিয়ের সাজ সাজতে এসেছি। জানো লাল, সবুজ ব্লাউজ আর নাকে বড় নথ কী যে মানিয়েছে!
হঠাৎ লাইন কাট। দুঃখ পাওয়ার জায়গায় খুশি হয়ে উঠল বিরান মাহমুদ! দুই দিন তাহলে চোখের পানি পড়া বন্ধ থাকবে!
টিপ টিপ সামদানীর ফোনই তাহলে চোখের পানি বন্ধের বড় ওষুধ।
দুই দিন পর বিকেলবেলা বৃষ্টির মধ্যে ভিড়ের বাসে যাচ্ছে বিরান। শাহবাগ মোড় ঘুরবে মিরপুর থেকে আসা বাসটি। আবারও টিপ টিপের ফোন।
—কী অবস্থা? বিরান, এই যে আমি পারলারে এসেছি বউভাতের সাজ সাজতে। এক পাড়ের শাড়ি পরব, খোঁপায় সাদা বড় ফুল। একেবারে দেবীর মতো লাগবে আমাকে।
—ভালো, খুব ভালো! ফাঁক পেলে প্রায়ই ফোন করো। তোমার ফোন আমার চোখের পানি পড়া থামিয়ে দিতে পারে। বিয়ের সাজের সময় যে ফোন করেছিলে, তারপর এ দুই দিন চোখের পানি পড়া বন্ধ রয়েছে। চোখের এই বজ্জাত পানি পড়া বন্ধ থাকলে আমি অফিসে জয়েন করব। আমার সব ঠিক হয়ে যাবে।
—আর তো সহসা আসব না পারলারে! ফোনও করা হবে না তোমাকে। ওহ্! না! পারলারে আসব বিয়েবার্ষিকীর সাজ সাজতে এই মাত্র বছর খানেক পরে। অবশ্যই ফোন করব তখন।
বিরান মাহমুদের সবকিছু বিষাদে ছেয়ে যায় আবার। সে ভাবে, টিপ টিপরা কেন এ রকম করে! কে জানে!
বারবার হাতল থেকে হাত ছুটে যাচ্ছিল বিরানের। পাশের লোক বলল, কী রে ভাই, হইলো কী?
—ভাইজান, একটু দেখবেন আমার চোখ দিয়া পানি বেরোচ্ছে কি না?
—না, ঠিক আছে।
আসলে বিরানের ভেতরে তখনো টলটল করছিল বিন্দু বিন্দু পানি, যা দেখা যায় না।
আচমকা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামতে চাইল বিরান।
হেলপার চিৎকার করে উঠল, হেই মিঞা! চলতি গাড়ি থ্যাইক্যা নামবেন নাকি? আগে বাঁ পা দেন।
বাসের গতি বেশ বেড়েছে তখন। চারদিকে হট্টগোল—এই, করে কী লোকটা!
পেছনের বাসের ড্রাইভারের রাগ বাড়ছে। তার ব্রেকের অবস্থা ভালো নয়। লোকটা চলতি গাড়ি থেকে এভাবে দাপিয়ে নামলে তাকে হিট করা ছাড়া উপায় নেই। হাইড্রলিক ব্রেক হলে হয়তো থামাতে পারত।
এদিকে সুগন্ধি সাবান হুইলের বিলবোর্ডের ওপরে বসা ভেজা কাক সিচুয়েশন দেখে ভাবল, এই আউলা-ঝাউলা মানুষেরা মরা ঘনালে শুধু ঝামেলা বাড়ায়।
ঠিক তখনি টিপ টিপ সামদানীর মতো নামল টিপ টিপ বৃষ্টি। দ্রুত বৃষ্টি বাড়ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে শাহবাগ মোড়। একটা লোক বাস থেকে নামতে গিয়ে অন্য বাসে চ্যাপটা হলে কারও কিছু আসে-যায় না। বোঝাই গেল না বিরানের কিসের এত তাড়া ছিল যে এভাবে চলতি বাস থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কে জানে।
—জায়গা দেন নামুম!
বিরানের মেজাজ তেমন খারাপ হয় না। বাসেই চলাচল করে, অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তা ছাড়া রাগ করার নার্ভগুলো তার ভোঁতা হয়ে গেছে অনেকটা। বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ—সবখানেই তাকে ভেঙায় সবাই। অথচ তার করার কিছু নেই, সৃষ্টিকর্তা হয়তো তাকে তৈরি করেছেন মানুষের হাসির পাত্র হতে। তা না হলে তার শরীর এত লম্বা ডাইনোসরের মতো হাড্ডিসার কেন? মানুষ ছোটবেলায় ডাকত হাড়গিল, উটপাখিজাতীয় কিছু।
এখন সে ঢাকার নামী অ্যাড এজেন্সিতে ক্লায়েন্ট সার্ভিসে কাজ করে। ভালো কাজ করে বলেই টিকে আছে এই অবয়ব নিয়ে। তবু মাঝেমধ্যে অসুবিধা হয়। ক্লায়েন্ট ফোন করে বলে অন্য কাউকে পাঠাতে, তবে তা কখনো-সখনো।
এবার একজন তার পিঠ চাপড়ে বলল, কিরে ভাই, কাঁদেন ক্যান! চোখ দিয়া তো পানির ঝরনা বইতাছ্যা! বিরান লজ্জা পেয়ে রুমাল বের করে চোখ মুছল। অফিসে এসেই ছুটল মিটিং রুমে, ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে!
—হোয়াটস হ্যাপেন বিরান? কাঁদছ কেন?
সরি বলে বিরান এবার ছুটল ওয়াশ রুমে। আয়নায় দেখল, ঠিকই জল বেরোচ্ছে অনর্গল।
ওয়াশ রুম থেকে বেরোতেই ক্লায়েন্ট সুপারভাইজার মফিজ ভাই ধরলেন, পুরান ঢাকার লোক, নিজেদের একসেন্টেই বাংলা বলেন।
—কী হইলো আবার বিমার সাব? অফিসের মধ্যে কাইন্দা চোক্ষের পানি ফেলতাছেন? মনের দুঃখে পাবলিকগো সামনে কাইন্দেন না!
—মফিজ ভাই, সব সময় ফাজলামি ভালো লাগে না!
—কয় কী মাইরে-বাপ! পাবলিকের সামনে কাঁদবো আর বলা যাইবো না।
অফিস শেষে ফুটপাতে দ্রুত হাঁটছে বিরান। চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে আপনাতেই। তার মনে খুব দুঃখ। প্রতিদিন কে যেন হতাশার চাদরে ঢেকে দিচ্ছে তাকে। তাই বলে তো চোখ দিয়ে এভাবে পানি বেরোনোর কথা নয়।
তার মতো কুৎসিত-দর্শন, বীভৎসপ্রায় মানুষকে তীব্র প্রেম দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছিল টিপ টিপ সামদানী। অপার্থিব এই মেয়ের তার মতো মানুষকে ভালোবাসার কারণ অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি সে। টিপ টিপ সামদানীর রং কালো হলেও আলোতে ভরা। শরীরের গঠনও কালজয়ী নারী মডেলের মতো অতুলনীয়। জগৎজুড়ে এ রকম নারীর পেছনেই অভিভূত হয়ে লাইন দেয় পুরুষেরা।
অন্যদিকে বিরান মাহমুদের জীবন সত্যিই যেন বিরান, খাঁ খাঁ—মেয়েরা ঘুরেও দেখে না। প্রেম, ভালোবাসা তো দূরের কথা, ভালোবাসা কী জিনিস, টিপ টিপ সামদানী তার জীবনে আসার আগে জানাই ছিল না বিরানের।
টিপ টিপ সামদানী এলিসের মতো তাকে হাত ধরে এনে দাঁড়া করিয়ে দিল এক ওয়ান্ডারল্যান্ডে।
টিপ টিপ সামদানীকে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন তুমি আমার মতো বীভৎসপ্রায় মানুষকে ভালোবাসলে? কাছে টানলে?
—এ আবার কেমন কথা! তুমি আমার কাছে তুমি। বড়-ছোট সুন্দর-অসুন্দর কিছু না! তোমার মতো অনুভূতিপ্রবণ মানুষ আমি জীবনে আর পাইনি বলেই ভালোবাসি।
বিরান মাহমুদের বিরান অন্তর্জগতে লক্ষ ফায়ার ওয়ার্ডের ফুলঝুরি জ্বলে উঠেছিল। তিন-তিনটি বছর বিরান সামনে-পেছনে, আকাশে-মাটিতে ডানে-বামে শুধু টিপ টিপ সামদানীকেই দেখেছে। তার মগজের শিরায় শিরায় নেচে চলেছে টিপ টিপ সামদানীর মাধুরী। সে ভেবেছিল, এ এক আত্মিক সম্পর্ক।
তবে এক ঝটকায় তাকে টিপ টিপ সামদানী ছুড়ে ফেলতেই বুঝল, আত্মিক-ফাত্মিক কিচ্ছু নয়! যেভাবে টেনে নিয়েছিল, সেভাবেই ছুড়ে দিল। লন্ডন থেকে তার বয়ফ্রেন্ড প্রিন্স জামান পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরতেই টিপ টিপ সামদানী বিয়ের সিদ্ধান্ত নিল তাকে। বিরান মাহমুদকে সামলে ওঠার সময়টুকুও দিল না।
সামলে ওঠার সময় দিলে নাকি সম্পর্ক ঘেনঘেনে হয়ে যায়। ফোনে চট্টগ্রাম থেকে বলল টিপ টিপ সামদানী, আগামী সপ্তায় আমার হলুদ, তার এক দিন পর বিয়ে। দুদিন পর কিং অব চিটাগাংয়ে বউভাত।
বিরান তোতলাতে শুরু করেছিল, কিছু বলার আগেই লাইন কেটে গেল।
বিরানের চাকরি প্রায় নট। সিও রেজা আলী নিজের রুমে ডেকে বললেন, ক্লায়েন্টদের থেকে কমপ্লেইন আসছে বারবার। আপনার লোক সার্ভিস দেবে কী, সে তো চোখের পানি ফেলছে! যাও, ১৫ দিনের ছুটি বেতনসহ দিলাম। ভালো আই স্পেশালিস্ট দেখাও।
আই স্পেশালিস্ট বিরানের চোখ দেখে টেস্টের পর টেস্ট দিলেন। তবে আসল সমস্যা খুঁজে পেলেন না। ঘাবড়ে গিয়ে হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক খেতে দিলেন। তাতে কিছু হলো না। দেশে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে পড়ে রইল বিরান। মাথায় হাত বুলিয়ে মা বললেন, বাবা, নামাজ পড়ো, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে জামাতে নামাজে দাঁড়ালে লোক নামাজ শেষে বলতে লাগল, এভাবে ভাই চোখের পানি নামাজে দাঁড়াইয়া ফেইলেন না, ডর লাগে। মনে হয় আইজক্যা আপনের শেষ দিন। এরপর অগত্যা জামাত ছেড়ে একা মসজিদে এসে সিজদা দিল বিরান, আল্লাহকে ডাকল ভীষণভাবে। তবে চোখ থেকে পানি পড়া আটকানো গেল না—বরং তা বেড়েই চলল। পথে হাঁটতে হাঁটতে মুখ নাড়লে বিরানের চোখের পানির ছিটা গিয়ে পড়তে লাগল অন্যের শরীরে। তো, এরপর কী? মানুষের ধমক খেতে শুরু করল বিরান মাহমুদ।
হঠাৎ টিপ টিপ সামদানীর ফোন এল, কী অবস্থা তোমার? এই জানো, আমি পারলারে এসেছি বিয়ের মেহেদি লাগাতে।
কোনো কারণ ছাড়াই মেহেদির রং এমনকি মেহেদি শব্দটি বাল্যকাল থেকে ঘেন্না লাগে বিরানের। তবু সে বলল, বাহ্! ভালো তো, কোন ডিজাইন লাগাবে—প্রিয়াঙ্কা, নাকি কারিনা?
—ধ্যাৎ! গাধা, সত্যি বিরান কিচ্ছু জানে না। কুট করে লাইন কেটে দিল টিপ টিপ সামদানী।
বাসে আশপাশের মানুষের ধমক নেই, কারও গায়ে তার চোখের পানির ছিটা গড়িয়ে পড়ছে না। ফোন আসার পর হঠাৎ পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। রাস্তার পাশে সেলুনে ঢুকে আয়নায় দেখল। ঠিকই তো পানি বন্ধ। বাসার কাছে রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে চায়ের টংয়ের নবা ভাইয়ের কাছে গেল। তাকে দেখেই নবা ভাই বলে উঠলেন, বন্ধ হইছেরে ভাই! বন্ধ হইছে।
একটা রাত একটা দিন পানি পড়া বন্ধ! বিরান মাহমুদ বুঝল, টিপ টিপ সামদানীর ফোন এলে পানি পড়া বন্ধ
হয়ে যায়। আবার হালকা-পাতলা পানি পড়া শুরু হতেই পুনরায় এল ফোন!
—পারলারে বিয়ের সাজ সাজতে এসেছি। জানো লাল, সবুজ ব্লাউজ আর নাকে বড় নথ কী যে মানিয়েছে!
হঠাৎ লাইন কাট। দুঃখ পাওয়ার জায়গায় খুশি হয়ে উঠল বিরান মাহমুদ! দুই দিন তাহলে চোখের পানি পড়া বন্ধ থাকবে!
টিপ টিপ সামদানীর ফোনই তাহলে চোখের পানি বন্ধের বড় ওষুধ।
দুই দিন পর বিকেলবেলা বৃষ্টির মধ্যে ভিড়ের বাসে যাচ্ছে বিরান। শাহবাগ মোড় ঘুরবে মিরপুর থেকে আসা বাসটি। আবারও টিপ টিপের ফোন।
—কী অবস্থা? বিরান, এই যে আমি পারলারে এসেছি বউভাতের সাজ সাজতে। এক পাড়ের শাড়ি পরব, খোঁপায় সাদা বড় ফুল। একেবারে দেবীর মতো লাগবে আমাকে।
—ভালো, খুব ভালো! ফাঁক পেলে প্রায়ই ফোন করো। তোমার ফোন আমার চোখের পানি পড়া থামিয়ে দিতে পারে। বিয়ের সাজের সময় যে ফোন করেছিলে, তারপর এ দুই দিন চোখের পানি পড়া বন্ধ রয়েছে। চোখের এই বজ্জাত পানি পড়া বন্ধ থাকলে আমি অফিসে জয়েন করব। আমার সব ঠিক হয়ে যাবে।
—আর তো সহসা আসব না পারলারে! ফোনও করা হবে না তোমাকে। ওহ্! না! পারলারে আসব বিয়েবার্ষিকীর সাজ সাজতে এই মাত্র বছর খানেক পরে। অবশ্যই ফোন করব তখন।
বিরান মাহমুদের সবকিছু বিষাদে ছেয়ে যায় আবার। সে ভাবে, টিপ টিপরা কেন এ রকম করে! কে জানে!
বারবার হাতল থেকে হাত ছুটে যাচ্ছিল বিরানের। পাশের লোক বলল, কী রে ভাই, হইলো কী?
—ভাইজান, একটু দেখবেন আমার চোখ দিয়া পানি বেরোচ্ছে কি না?
—না, ঠিক আছে।
আসলে বিরানের ভেতরে তখনো টলটল করছিল বিন্দু বিন্দু পানি, যা দেখা যায় না।
আচমকা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামতে চাইল বিরান।
হেলপার চিৎকার করে উঠল, হেই মিঞা! চলতি গাড়ি থ্যাইক্যা নামবেন নাকি? আগে বাঁ পা দেন।
বাসের গতি বেশ বেড়েছে তখন। চারদিকে হট্টগোল—এই, করে কী লোকটা!
পেছনের বাসের ড্রাইভারের রাগ বাড়ছে। তার ব্রেকের অবস্থা ভালো নয়। লোকটা চলতি গাড়ি থেকে এভাবে দাপিয়ে নামলে তাকে হিট করা ছাড়া উপায় নেই। হাইড্রলিক ব্রেক হলে হয়তো থামাতে পারত।
এদিকে সুগন্ধি সাবান হুইলের বিলবোর্ডের ওপরে বসা ভেজা কাক সিচুয়েশন দেখে ভাবল, এই আউলা-ঝাউলা মানুষেরা মরা ঘনালে শুধু ঝামেলা বাড়ায়।
ঠিক তখনি টিপ টিপ সামদানীর মতো নামল টিপ টিপ বৃষ্টি। দ্রুত বৃষ্টি বাড়ছে। ঝাপসা হয়ে আসছে শাহবাগ মোড়। একটা লোক বাস থেকে নামতে গিয়ে অন্য বাসে চ্যাপটা হলে কারও কিছু আসে-যায় না। বোঝাই গেল না বিরানের কিসের এত তাড়া ছিল যে এভাবে চলতি বাস থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কে জানে।
No comments