উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে যৌন নির্যাতন by মাহমুদ মানজুর
দেশজুড়ে
বাড়ছে নারী নির্যাতনের ঘটনা। দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। নারী
নির্যাতনের ঘটনায় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে মহিলা ও শিশু
বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল হেল্পলাইনে সারা দেশ থেকে মোট ৪৫২৬ জন
সাহায্য-পরামর্শ চেয়েছেন। এর মধ্যে গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ অভিযোগ এসেছে
১২২৮টি। সূত্র জানায়, বেশির ভাগ অভিযোগ যৌতুক এবং যৌন হয়রানিকেন্দ্রিক
অভিযোগ। আর এই অভিযোগের সূত্র ধরে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল
হেল্পলাইন সেন্টার থেকে গত চার মাসে চিকিৎসা সহযোগিতা পেয়েছেন ১১৪ জন,
কাউন্সেলিং সহযোগিতা পেয়েছেন ১০০ জন, পুলিশি সহযোগিতা নিয়েছেন ২২১ জন,
আইনগত ৭০৮ জন, নির্যাতন ও যৌন হয়রানি মোকাবিলার জন্য তথ্য-পরামর্শ নিয়েছেন
মোট ৩ হাজার ৩৮৩ জন। লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের উপর ২০০৬ সালের জাতিসংঘের
সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন নির্যাতনের শিকার হন।
২০০৮ সালে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টি সেন্টারাল প্রোগ্রামের
আওতায় দেশব্যাপী পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী শতকরা ৫৮ ভাগ নির্যাতনের শিকার
নারী ও শিশুর বয়স হচ্ছে ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মধ্যে। বাংলাদেশে নারীদের
শারীরিক নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতন নিপীড়নের এটি সচরাচর চিত্র বলে মনে করা
হয়েছে ওই সমীক্ষায়। দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি সামপ্রতিক সময়ে
বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে এমনটা বলছেন নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল। তিনি
বলেন, দেশে এখন যৌন সন্ত্রাস চলছে। এটা সংঘবদ্ধভাবে ঘটছে। পুলিশ আর যৌন
সন্ত্রাসীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ঘটাচ্ছে এমন পৈশাচিক কার্যক্রম। দিনের পর দিন যৌন
সন্ত্রাস ঘটে চলেছে, অথচ বিচার বলে কিছু দেখছি না। উল্টো এই সন্ত্রাসকে মদদ
দিচ্ছে রাষ্ট্র। তা না হলে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের একজন সামান্য
ক্যান্টিন বয় কেমন করে যৌন সন্ত্রাস করার সাহস পায়। কেমন করে এই ক্যান্টিন
বয়কে বাঁচানোর জন্য স্কুলের মাথারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করে? কেমন
করে বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া যৌন সন্ত্রাসকে রাষ্ট্রের
কর্তাব্যক্তিরা ‘দুষ্টুমি’ বলে উড়িয়ে দেয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়
সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে
মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল
হেল্পলাইন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২০১২ সালে। দেশের যে কোন প্রান্ত
থেকে যে কোন সময় ১০৯২১ নম্বরে বিনামূল্যে ফোন করে সাহায্য পেতে পারেন
নির্যাতনের শিকার যে কোন নারী ও শিশু। সেই ধারাবাহিকতায় এই হেল্পলাইন
সেন্টারের প্রথম বছরে অভিযোগ আসে ৪৮২৪টি। ২০১৩ সালে ৫৫৪৯টি। আর গত বছর
অভিযোগ আসে তিনগুণ বেশি ১৪৭৬৭ টি। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে গঠিত এই
হেল্পলাইন সেন্টারের প্রোগ্রাম অফিসার রাইসুল ইসলাম জানান, দিন যত যাচ্ছে
হেল্পলাইনে অভিযোগের সংখ্যা ততই বেড়ে চলেছে। তবে কি দেশে নারী ও শিশু
নির্যাতনের হার ক্রমশ বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, সেটা
আমি বলতে পারবো না। তবে প্রতিনিয়ত যে পরিমাণ অভিযোগ গ্রহণ করছি, নারীদের
সঙ্গে আলাপ করছি, তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করছি- তাতে এটুকু বলতে পারি
আমাদের নারীরা এখন অনেক বেশি সচেতন এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এদিকে
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের একটি জরিপে দেখা গেছে গত চার মাসে (জানুয়ারি
থেকে এপ্রিল) দেশে শুধু ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেছে ১৫৮টি। এরমধ্যে শিশুর সংখ্যা
৯৩ আর নারীর সংখ্যা ৬১ জন। বাকি ৪ জনের বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। নারী
নির্যাতন প্রতিরোধ প্রকল্পের প্রোগ্রাম অফিসার রাইসুল ইসলাম মানবজমিনকে
জানান, প্রতিদিন সারা দেশ থেকে ১০৯২১ নম্বরে আমাদের কাছে অসংখ্য ফোন আসছে।
যার বেশির ভাগই যৌতুকের দায়ে নারী নির্যাতন, বাল্যবিয়ে কিংবা যৌন হয়রানি
বিষয়ক। এমন অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই ভিকটিমকে রক্ষা করার
সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে থাকি। অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট
থানা-পুলিশকে অবহিত করি পুরো ঘটনা। ভিকটিমের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ঐ এলাকার
হাসপাতালের সঙ্গেও যোগাযোগ করিয়ে দেই ভিকটিমকে। একই সঙ্গে আইনি সহযোগিতা
এবং পরামর্শও দিয়ে থাকি। প্রোগ্রাম অফিসার আরও জানান, বাল্য বিবাহ, যৌতুক
কিংবা যৌন হয়রানির পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের ঘটনাও অনেক বেশি। যদিও এ
ধরনের অভিযোগ আমাদের এখানে খুব কমই আসে। কারণ ভিকটিমরা মানসিক নির্যাতনের
বিষয়ে এখনও সচেতন নয়। তারা জানে না মানসিক নির্যাতনও অপরাধ। পাশাপাশি
সামাজিক রীতি-নীতি, নিরাপত্তাহীনতা, আইনি সেবা, সহায়তা সম্পর্কে অজ্ঞতার
কারণে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুকে সেবা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত করে। আমরা
চেষ্টা করছি দেশের প্রতিটি নারী ও শিশু তাদের যে কোন মানসিক ও শারীরিক
নির্যাতনের খবর আমাদের জানাক। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
No comments