ছাত্রলীগের হেলিকপ্টার বিলাস by মশিউল আলম

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বৈরিতায় বাংলাদেশ যখন পর্যুদস্ত, যখন সরকারের আইন প্রয়োগের কেরামতিতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দিশাহারা হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান এক উল্টা ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। গত ২৯ মার্চ রোববার তিনি ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে খাওয়াদাওয়া করতে গিয়েছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার এক বিএনপি নেতার বাড়িতে। অবশ্য তাঁর এই হেলিকপ্টার ভ্রমণের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল খাওয়াদাওয়া—এমন কথা বললে ঠিক বলা হয় না। তিনি আসলে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে। জাকারিয়া শিক্ষানিকেতন নামের ওই বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাহমুদ সাহেবের রাজনৈতিক পরিচয় কুয়াশাচ্ছন্ন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির ভাষ্য হলো, মাহমুদ সাহেব একসময় ছাত্রলীগ করতেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক। কিন্তু কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মহসীন রেজা প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় রাজনীতি করছেন, কিন্তু আবদুল্লাহ আল মাহমুদ আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন বা করেন, এমন কথা তিনি কখনো শোনেননি। কয়রা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মতিউর রহমানও আবদুল্লাহ আল মাহমুদের রাজনৈতিক পরিচয় জানেন না।
রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোক না কেন, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ যে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বদিউজ্জামানকে অত্যন্ত সমাদর করেন এবং সভাপতি সাহেবও যে তাঁর প্রীতিধন্য, তার একটা প্রমাণ হলো, ঢাকা থেকে বদিউজ্জামানকে কয়রা নিয়ে যাওয়া এবং অনুষ্ঠান শেষে আবার ঢাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য মাহমুদ ভাড়া করেছিলেন একটি হেলিকপ্টার। কয়রাবাসী হেলিকপ্টার দেখে পুলকিত হয়েছেন, বিস্মিতও কম হননি। কারণ, হেলিকপ্টার অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি আকাশযান। গ্রামের একটি বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে আনার জন্য কেন লাখ টাকা খরচ করে হেলিকপ্টার ভাড়া করা হয়েছে—এটা একটা স্বাভাবিক কৌতূহলের বিষয়। অবশ্য মাহমুদ সাহেবকে এই প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করেছেন কি না, তা জানা যায়নি। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির কাছে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক যখন এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন, তখন তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন এই কথা বলে: ‘আমাকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে গেছে বলেই হেলিকপ্টারে গিয়েছি। গাড়িতে নিয়ে গেলে গাড়িতেই যেতাম।’
আমাদের স্মরণ করা উচিত যে প্রায় তিন মাস হতে চলল, বিএনপি-জামায়াতের ২০-দলীয় জোটের ডাকে দেশজুড়ে অবরোধ চলছে। শহরের মধ্যেই চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ, এক শহর থেকে আরেক শহর কিংবা গ্রামে যাওয়ার পথ আরও বিপৎসংকুল। পেট্রলবোমা ওত পেতে আছে সবখানে। ইতিমধ্যে শতাধিক মানুষ পেট্রলবোমা, ককটেল, আগুনে পুড়ে মারা গেছে। প্রচুর পোড়া মানুষ বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। এহেন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিকে ঢাকা থেকে কয়রা নিয়ে যাওয়া এবং অনুষ্ঠান ও খাওয়াদাওয়া শেষে ফেরত পাঠানোর কাজে মাত্র লাখ খানেক টাকা খরচ করে হেলিকপ্টার ভাড়া করা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অসংবেদনশীলতার পরিচায়ক বইকি। হেলিকপ্টার যেহেতু পেট্রলবোমা থেকে নিরাপদ উচ্চতায় ওড়াউড়ি করে, অতএব ছাত্রলীগের সভাপতির জন্য হেলিকপ্টারই ছিল যথার্থ বাহন!
কিন্তু কয়রাবাসীর মনে হেলিকপ্টার দর্শনের চেয়ে কম বিস্ময়ের উদ্রেক হয়নি, যখন তাঁরা দেখতে পেলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি অনুষ্ঠান শেষে খাওয়াদাওয়া করতে গেলেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদের সহোদর মনিরুজ্জামানের বাড়িতে। কারণ, মনিরুজ্জামান কয়রা উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি ও জেলা বিএনপির সহসমাজকল্যাণ সম্পাদক। তাঁর আরেক ভাই মোফাজ্জেল হোসেন জামায়াতে ইসলামীর একজন বড় হিতৈষী ও গোপন নেতা হিসেবে পরিচিত।
কয়রার লোকজন বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম মহসীন রেজা তো সংবাদমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেছেন এই বলে যে বিএনপি নেতার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ঠিক কাজ করেননি। আর উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান হতাশ হয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী কারও বাড়িতে কিংবা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের সভাপতি অংশ নিচ্ছেন, এটা আমরা ভাবতে পারি না।’
কিন্তু বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে যখন কার্যত দলীয় নেতা–কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়েছে, যখন তাঁকে খাবার পাঠানোর পথেও বাধা সৃষ্টির অভিযোগ শোনা যায়, তখন বিএনপির এক উপজেলা নেতার বাড়িতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির সাদর আপ্যায়ন বিরাট দৃষ্টি উন্মোচনকারী ঘটনা বলে বিবেচিত হতে পারত। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা চক্ষু মেলে দেখতে পারতেন, বিএনপির একদম উপজেলা পর্যায়েও কত উদার ও মেহমানদার নেতা আছেন! তাঁরা তাঁদের মনে এই শুভবুদ্ধি জাগ্রত করতে পারতেন যে শত্রুতা ভালো নয়, বন্ধুত্বেই উভয় পক্ষের মঙ্গল! কিন্তু তা হওয়ার নয়। বরং কয়রাবাসী ভেবে পাচ্ছেন না, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতির এই হেলিকপ্টার ভ্রমণ ও খাওয়াদাওয়ার মাজেজা কী।
মশিউল আলম: লেখক ও সাংবাদিক৷
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.