সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন থেকেই গেল by তারেক শামসুর রেহমান

তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে ২৮ এপ্রিল। ১ ও ২ এপ্রিল প্রার্থিতা বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। ৯ এপ্রিল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এরপর বোঝা যাবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কারা কারা থাকছেন। চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়রপ্রার্থী মোটামুটি নিশ্চিত। ২০ দল ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুজন প্রার্থী আছেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা এদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদ্বয় নিশ্চিত থাকলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এখনও নিশ্চিত হয়নি। একাধিক প্রার্থী রয়েছেন মাঠে। কোনো কোনো হেভিওয়েট প্রার্থীর শেষ মুহূর্তে প্রার্থীপদ 'নানা কারণে' বাতিল হয়েছে। উপরন্তু বিএনপি শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বয়কটও করতে পারে! নির্বাচন নিয়ে এখন নানা 'অঙ্ক কষা' শুরু হয়েছে। সরকারের ভূমিকা, নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা, বিএনপির ভবিষ্যৎ রাজনীতি- নানা প্রশ্ন এখন এ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে আবর্তিত হচ্ছে। তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই, ঢাকায় দুটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। আট বছর নির্বাচন হয়নি এখানে। সর্বশেষ মেয়র ছিলেন বিএনপির। তার মেয়াদ শেষের পরও নির্বাচন হয়নি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনসেবা নিশ্চিত করা যায়। আমলা দিয়ে জনসেবা নিশ্চিত করা যায় না। ঢাকা শহরের মানুষ এ জনসেবা পাচ্ছে না বেশকিছু দিন ধরে। মশক নিধন কর্মসূচিসহ অনেক জনসেবামূলক কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এ মশক নিধন কর্মসূচিতে। তাহলে এ টাকা কোথায় যাচ্ছে? কে এ থেকে সুবিধা নিচ্ছে? জনপ্রতিনিধিরা থাকলে, তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু আমলারা থাকলে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। সে জন্যই আসন্ন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি প্রশংসার যোগ্য। নিঃসন্দেহে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকারের নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছেন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়ে 'সব রাজনৈতিক দল'কে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার একটি সুযোগ দেয়া। কিন্তু যে প্রশ্ন এখনও অনেকেই করেন, তা হচ্ছে বিএনপি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবে তো! ঢাকা উত্তরের বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী আবদুল আউয়াল মিন্টুর প্রার্থী পদ বাতিল হয়েছে। এখানে বিএনপির 'শক্ত' কোনো প্রার্থী নেই। আউয়াল মিন্টু শক্ত প্রার্থী ছিলেন। মুক্ত ঢাকার মেয়র তিনি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি খোদ বিএনপির হাইকমান্ডের সমর্থনের অভাবে। এখন তার ছেলে তাবিদ আউয়াল প্রার্থী। কিন্তু তাবিদ বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। যে যুক্তিতে তার প্রার্থী পদ বাতিল হয়েছে, আইনগতভাবে তা সঠিক। তাহলে প্রশ্ন এসে যায়, তিনি জেনেশুনে এই 'ভুল' করেছেন, নাকি সরকারের কোনো কোনো মহলকে খুশি করার জন্যই তিনি এ 'ভুল'টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার সঙ্গে তিনি আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এ প্রশ্নও অনেকে করেছেন। তাহলে উত্তরে বিএনপির অবস্থান কী হবে? বিএনপি কী তাহলে তাবিদ আউয়ালকে সমর্থন করবে, নাকি মাহী বি চৌধুরীকে সমর্থন করবে? যদিও মাহী চৌধুরীর বিকল্পধারা ২০ দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ঢাকার দক্ষিণে ঘটেছে ঠিক উল্টোটি। মির্জা আব্বাস, সালাম ও আসাদুজ্জামান রিপনের মনোনয়ন বৈধ হয়েছে। অথচ আব্বাসের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে একাধিক। অনেক মামলায় জামিন না নেয়ায় তিনি আইনের দৃষ্টিতে 'ফেরারি'। প্রশ্নটা এখানেই। বিএনপি আবারও হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি একদিকে আন্দোলনেও থাকবে, অন্যদিকে নির্বাচনেও অংশ নেবে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি তার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার পরীক্ষা করে ফেলতে চায়।
তবে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটি সুযোগ এসেছে। নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং সন্ত্রাসমুক্ত হবে- এটা ইসিকে নিশ্চিত করতে হবে। এমনিতেই ইসি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক হারিয়েছে। এখন সুযোগ এসেছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। এটা তো সত্য, সরকার যদি ইসিকে সহযোগিতা না করে তাহলে ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব নয়। সরকার সমর্থকরা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। ইসি এক্ষেত্রে কতটুকু শক্তিশালী হতে পারবে, এ প্রশ্ন থাকলই। নির্বাচনী এলাকায় কর্মকর্তাদের বদলির বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসি এ ব্যাপারে সরকারকে চিঠি দিয়েছে। এখন সরকার ইসির পরামর্শ কতটুকু গ্রহণ করে, সেটি দেখার বিষয়। একটি জটিলতা আছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) ওয়ার্ড সংখ্যা নিয়ে। উত্তরের লোকসংখ্যা ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৩, আর ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩৬। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লোকসংখ্যা কম; কিন্তু ওয়ার্ড সংখ্যা বেশি। লোকসংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬৩, আর ওয়ার্ড ৫৭টি। ফলে এখানে এক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। নির্বাচনের আগে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভবও হবে না। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। নির্বাচনের জন্য যে বিষয়টি বেশ জরুরি, তা হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি 'লেভেলপ্লেয়িং ফিল্ড' তৈরি করা। ইসি কি এটা পারবে? বিএনপির অনেক স্থানীয় নেতা, সাবেক কাউন্সিলর হয় পলাতক, নতুবা মামলার আসামি। কেউবা আবার গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। এদের কেউ যদি প্রার্থী হনও তারা তো ভয়ে প্রচারণা চালাতে পারবেন না। তাহলে কী নির্বাচনটা একপক্ষীয় হয়ে যাবে না? তাদের জন্য নূ্যনতম যে সুযোগ, সেটি নিশ্চিত হবে কীভাবে? সরকারি দলের ঘোষিত প্রার্থীরা এরই মধ্যে নির্বাচন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। একজন ব্যবসায়ী, একজন সংসদ সদস্য, একজন সাবেক মেয়রপুত্র- এদের বিলবোর্ডে নির্বাচনের আগেই ঢাকা শহরে ছেয়ে গিয়েছিল। তারা এটা পারেন না। নির্বাচনে 'জয়ী' হওয়ার আগেই যদি আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়, তাতে ইসির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি! শুধু তাই নয়, প্রার্থীরা আদৌ ঋণখেলাপি কিনা, এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। একজন প্রার্থীর কাছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পাওনা ছিল ১১৮ কোটি টাকা। তিনি বাড়ি বিক্রি করে টাকার কিছুটা পরিশোধ করেছেন, এমন তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মাঠে আছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রার্থীর খবর কী? তিনি আদৌ ঋণখেলাপি কিনা, ঋণ রিশিডিউল করেছেন কিনা, আমরা জানি না। এমন ধনী ব্যক্তিরা, ব্যবসায়ীরা যখন প্রার্থী হন এবং তাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা থাকে ১০০ কোটি টাকার উপরে, তারা যখন 'নগরপিতা' হতে চান, তখন আমাদের দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। সিটি করপোরেশনের মতো জায়গাতে, ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করাই মঙ্গল। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক 'স্বার্থ' থাকে। হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ হয় সিটি করপোরেশনগুলোতে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকাটাই স্বাভাবিক।
এ তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, আমরা জানি না। বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর না নিলে সরকারি দলের প্রার্থীরা 'খালি মাঠে' গোল দেবে! এখন এখানেই বিএনপি এ সুযোগটি দেবে কিনা? বিএনপির ব্যাপক সমর্থক রয়েছে। আন্দোলনের পরিণতি যাই হোক না কেন, একটা নৈতিক সমর্থন তো বিএনপির জন্য আছে। ফলে বিএনপি কি এ সুযোগটি কাজে লাগাবে না? বিএনপি আন্দোলনের বিকল্প হিসেবেও এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। সেটা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষ হোক। দীর্ঘদিন ধরে দেশে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। খালেদা জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে তিন দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলেও কোনো একটি দাবিও সরকার মানেনি। ফলে নির্বাচনকে সামনে রেখে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা একরকম 'ভেস্তে' গেছে! তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই। যদিও জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতো সিনিয়র নেতারা বলেছেন, বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে। ২০ দলীয় জোটে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এমন কথাও আমাদের জানিয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান। তাই ৯ এপ্রিলের পরই বোঝা যাবে বিএনপি মাঠে আছে কী নেই।
তবে চূড়ান্ত মুহূর্তে বিএনপি যদি নির্বাচন বয়কট করে, আমি অবাক হব না(?) নির্বাচন বয়কটের জন্য যথেষ্ট যুক্তি বিএনপির আছে। প্রথমত, বিএনপি সমর্থিত শত নাগরিক কমিটি মনোনয়নপত্র তথা নির্বাচনের তারিখ পেছানোর দাবি করলেও নির্বাচন কমিশন তাতে রাজি হয়নি। নির্বাচন কমিশন খুব দ্রুত নির্বাচনটি করতে চায়। দ্বিতীয়ত, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা মাঠে যেতে পারছেন না। প্রচারণা চালাতে পারছেন না- এমন খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি তাদের অনেক কাউন্সিলর প্রার্থী (যাদের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ রয়েছে) গ্রেফতার হতে পারেন, এমন কথা আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা। ফলে বিএনপি একটি দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে। তৃতীয়ত, খালেদা জিয়া স্থায়ী পরিষদ কিংবা ২০ দলীয় জোট কারও সঙ্গেই কোনো মিটিং করছেন না বা মিটিং করতে পারছেন না। ফলে দল কোনো সুস্পষ্ট নীতিও গ্রহণ করতে পারছে না। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ মূলত পরিচালিত হচ্ছে শত নাগরিক কমিটির মাধ্যমে, যেখানে স্থায়ী পরিষদের সদস্যরা থাকছেন উপেক্ষিত। চতুর্থত, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন তার দলের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন, তখন এটা বুঝতে কারও বাকি থাকে না, সরকারপ্রধান কত সিরিয়াস। এটা দল তথা সরকারের জন্য একটা প্রেস্টিজ ইস্যু। নির্বাচনে 'বিজয়ী' হয়ে সরকার দেখাতে চাইবে বিএনপির কোনো জনপ্রিয়তা নেই! এজন্যই বিএনপির নির্বাচনে মাঠে থাকা উচিত। ডজন ডজন মিডিয়াকর্মী ও ক্যামেরার উপস্থিতিতে নির্বাচনে জালিয়াতি ও কারচুপির সুযোগ থাকবে কম।
তাই সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকেই গেল। কিছু 'কিন্তু' কিছু 'যদি'র মধ্য দিয়ে সামনের দিনগুলো যাবে। বিএনপি আবারও হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়েছিল। শুধু নির্বাচনের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামকে হরতালমুক্ত রাখা হয়েছিল। এর অর্থ পরিষ্কার, বিএনপি সরকারকে চাপে রাখতে চায়। নতুন করে আবারও হরতালের ডাক দেয়ার অর্থ হচ্ছে আগামীতেও এ হরতাল আসতে পারে! যদিও বলতে দ্বিধা নেই, হরতালের তেমন একটা 'প্রভাব' এখন আর নেই। হরতালের 'ধার' কমে গেছে। তাই অনেক জল্পনাকল্পনার মধ্য দিয়ে তিনটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সারা জাতির দৃষ্টি এখন এদিকে। ৯ এপ্রিলের পরই বোঝা যাবে নির্বাচনটি আদৌ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, নাকি একতরফাভাবে হবে! এ নির্বাচন পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে যেমনি বদলে দিতে পারে, ঠিক তেমনি এ নির্বাচন সঙ্কটকে আরও গভীরতর করতে পারে।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.