সাংবাদিকেরাই যখন বিপন্ন মানুষের বড় ভরসা by মহিউদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশে
জনপ্রতিনিধিদের এমন ছড়াছড়ি; সর্বনিম্ন পর্যায়ে ওয়ার্ডের সদস্য থেকে ওপরে
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের দুই ভাইস চেয়ারম্যান, তারপর
চেয়ারম্যান এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে জাতীয় সংসদের সদস্য। এই পাঁচজন নির্বাচিত
প্রতিনিধি আছেন দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য। প্রত্যেক নাগরিকের সংবিধান
এবং আইন ও বিধিবিধানে প্রদত্ত অধিকার, সুযোগ-সুবিধা কেউ ক্ষুণ্ন বা লঙ্ঘন
করলে এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংক্ষুব্ধ নাগরিকদের পক্ষ নিয়ে সরকার বা
কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেনদরবার করবেন, দরকার হলে লড়বেন—এটাই প্রত্যাশিত
প্রকৃত গণতন্ত্রে। পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখেছি, সংক্ষুব্ধ নাগরিক ‘রিলিফ’ বা
প্রতিকার পেতে তাঁর এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করে
থাকেন।
স্পষ্ট মনে আছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর ব্রিটিশ আইনজীবী টম উইলিয়ামস কিউসি সেই ’৭২-এর প্রথম দিকে মরহুম তসদ্দক আহমেদের গঙ্গা রেস্টুরেন্টে এক লাঞ্চে আমাকে তাঁর নির্বাচনী এলাকার এক মধ্যবয়সী ব্রিটিশ নারীকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। ওই নারীর সিলেটি স্বামী তাঁদের একমাত্র শিশুসন্তানকে নিয়ে চলে এসেছেন সিলেটে, স্ত্রীকে না জানিয়ে। টম উইলিয়ামস কিউসি, এমপি আমাকে জানালেন, তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমকেও লিখেছেন, ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনকে অপহৃত শিশুটিকে উদ্ধারকাজে সক্রিয় হতে। তিনি আরও বললেন, ঢাকায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছেও তিনি আইনগত পরামর্শের জন্য চিঠি লিখেছেন। উল্লেখ্য, আগরতলা মামলায় টম উইলিয়ামসকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যাপারে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, জাকারিয়া খান চৌধুরীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে বিহিত চাইতে সাংসদদের কাছে সাহায্য চাওয়ার সংস্কৃতি একেবারে নেই বললেই চলে। তার বিপরীতে, আমাদের দেশের বিপদগ্রস্ত মানুষ সাহায্য চাইতে একজন সাংবাদিককেই খোঁজে, তারা পত্রিকা বা টিভি অফিসেই ধরনা দেয়।
১৫ বছর আগের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, পাকিস্তান পোস্টাল ক্যাডারের এক কর্মকর্তা রফিকুল আলম জাহাঙ্গীরকে পোস্টিং দেওয়া হলো বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে, কিন্তু তাঁকে নতুন দায়িত্বে যোগ দিতে দিচ্ছিলেন না এই মন্ত্রণালয়ের ‘গদিনশিন’ সচিব। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আমাকে জানাল। আমি তখন সদ্য অবসরে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করায় সাংবাদিক মহলে কিছুটা পরিচিত। আমি টেলিফোন করলাম তখন ইত্তেফাক-এর এক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককে। পরদিন ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় রফিকুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের বিপন্ন অবস্থার কথা প্রকাশিত হলো। আর সেদিনই তাঁর নতুন বদলির আদেশ জারি হলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে। এ রকম হাজার হাজার উদাহরণ আছে।
তো কথাটি আবার বলি, বাংলাদেশের বিপন্ন বিপদগ্রস্ত মানুষজন বিপদ থেকে প্রতিকার চাইতে একজন সাংবাদিককেই খোঁজে। গ্রাম, শহর, বন্দরের যেকোনো বয়সের মানুষ গণমাধ্যমকেই তাদের ভরসা হিসেবে দেখে। বস্তুত, দেশের মানুষজনের নাগরিক অধিকার রক্ষায় প্রায় ‘অকার্যকর’ জাতীয় সংসদের চাইতে অনেক বেশি কার্যকর আমাদের গণমাধ্যম। একজন মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ বয়সেও রিকশা চালিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন—এই খবর তো আমি পত্রিকায়, টিভিতেই দেখি। সাত-আট বছর আগে দৈনিক জনকণ্ঠ-এ প্রবীণ রিকশাচালক মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ারের একটি সচিত্র খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমি মেডোনা গ্রুপের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানকে অনুরোধ করলে মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ারের জন্য তিনি আমাকে এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন। ওই টাকাটা তখন রিকশাচালক সরোয়ারকে পাঠিয়ে দিই, যেন তিনি তাঁর প্রত্যাশামতো যশোরের একটি গ্রামে একটি ছোট বাড়ি বানাতে পারেন। এখানেও সরোয়ারের পাঁচ–পাঁচজন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। তাঁরা তো কেউ কিছু করলেন না।
‘হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার’ হিসেবে দুনিয়ার প্রতিটি দেশেই সাংবাদিকদের একটি আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও কালো মানুষগুলোর অধিকার রক্ষায় বেশি সোচ্চার-সক্রিয় সাংবাদিকেরা।
গত আগস্ট মাসে মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ফার্গুসনে ১৮ বছরের কালো নিরপরাধ মাইকেল ব্রাউন নামের একজনকে গুলি করে মেরে ফেলার প্রতিবাদে যেসব বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং-সমাবেশ হয় মার্কিন মুলুকে, তা সম্ভব হয়েছিল সে দেশেরই টিভি ও প্রিন্ট সাংবাদিকদের প্রবল ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। জনমতের চাপে সেই অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসন কয়েক দিন আগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
---দুই
এই পটভূমিতেই প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমানের ওপর পুলিশি হেফাজতে অত্যাচার-নির্যাতনের খবরে সাংঘাতিকভাবে বিচলিত বোধ করছি। এই পর্যায়ে আমাকে বলতেই হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওপর আওয়ামী লীগের কিছু সংসদ সদস্যের মারধরের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আমি যে পরিমাণ লেখালেখি করেছি, তেমনটি বোধ হয় আর কেউ করেননি।
মিরপুরের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ প্রকাশ্যে দিনের বেলায় মারলেন এক পুলিশ সার্জেন্টকে। কারণ, ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া এমপি সাহেবকে পুলিশ সার্জেন্ট দ্রুত বের করে আনলেন না কেন। পুলিশ সার্জেন্ট যখন এমপির বিরুদ্ধে মামলা করলেন, তখন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এই বলে, ‘পুলিশ সার্জেন্ট মামলা করতে গেল কেন? আমাদের বললেই তো আমরাই মিটমাট করে দিতাম।’ পুলিশকে থানা থেকে ডেকে এনে তাঁর অফিসে মারধর করেছেন যশোরের শেখ আফিলউদ্দিন এমপি। আর কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদি যে কত সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর করেছেন, তার তালিকা দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। আমাদের পুলিশ-র্যা ব বাহিনীর টু-স্টার, থ্রি-স্টার বিশিষ্ট কোনো কর্মকর্তা এঁদের কারও বিরুদ্ধে সামান্যতম ব্যবস্থা নিতে সাহস করেননি।
এই সাংসদদের এমন গর্হিত আচরণের প্রতিবাদে লেখা আমার কলামের প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন তখনকার আইজিপি নূর মোহাম্মদ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরকারি কর্মকর্তাদের মারধরের প্রতিবাদ করতে আমি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি কয়েকবার। বিধি মোতাবেক রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভালোমন্দ দেখভাল করাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অধিকার রক্ষায় আমি যেমন সোচ্চার, তেমনি সোচ্চার পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধেও।
বাউফলের মিজানুর রহমানের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় তাঁর যে ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। পুলিশের এমন অত্যাচার-নির্যাতনের সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ; আশঙ্কা হয় এটি সর্বশেষ উদাহরণ নয়।
পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা প্রথম শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম দিকে, প্রায় চুয়ান্ন বছর আগে। কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্রের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে এবং পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থানায়। তার বর্ণনা আছে মালেকা বেগমের লেখা ইলা মিত্র বইটিতে। এখনো আমি ওখানে গেলে থানাটির সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চরম নির্যাতন চালানো হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ওপর: তার বর্ণনা আছে তাঁর নোটস ফ্রম প্রিজন এবং জেলের কথা মানুষের কথা বই দুটিতে। নির্যাতন চালানো হয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ওপর। নির্যাতন চালানো হয় এরশাদের স্ত্রী বিদিশার ওপর। নারী বলে তাঁকে এতটুকু ছাড় দেওয়া হয়নি। তখন খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত জমানা।
সাংবাদিকদের মধ্যে হালজামানায় অনেক ধান্ধাবাজ আছে। তাদের বিরুদ্ধেও আমার লড়াই। নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা, বাংলাদেশের ইনকিলাব ও দিনকাল আমার ওপর লম্বা লম্বা প্রতিবেদন ছাপলেও একটিবারও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাংবাদিকতার অবশ্যপালনীয় নিয়ম হলো, খবর তৈরির সময় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের ভাষ্যও রিপোর্টে রাখতে হবে। আমাদের অনেক পত্রিকায় গায়েবি-আসমানি সোর্সের বরাতে রচনা থাকে বেশি। প্রকৃত খবর থাকে কম। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও ইত্তেফাক-এর মতো পত্রিকাগুলোতে ধান্ধাবাজদের স্থান থাকার কথা নয়। কারণ, সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় এবং অবশ্যপালনীয় নিয়মনীতি, নৈতিকতা পত্রিকা তিনটি প্রয়োগ করে থাকে বলে জানি।
আমার আশঙ্কা, দেশের সর্বাধিক প্রচারসংখ্যার পাঠকপ্রিয় প্রথম আলোর একজন সাংবাদিককে যদি এমন নিষ্ঠুরভাবে দমন করার অপচেষ্টা চলে, তাহলে অন্য সব পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিওর সাংবাদিকেরা তো নিজেদের গুটিয়ে নেবেন। দেশে যখন সন্ত্রাস, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, দখল, টেন্ডার ছিনতাই ব্যাপক ও বেপরোয়াভাবেই চলছে, তার প্রতিকার চাইতে দেশের সংক্ষুব্ধ মানুষজন তাহলে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে?
ঢাকা জেলা পরিষদ প্রশাসক হাসিনাদৌলাহর লুণ্ঠনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে চ্যানেল ৭১ গত ৮ ডিসেম্বর। এই আওয়ামী লীগ নেতা ধামরাইয়ের বোয়াইন গ্রামের একটি বটগাছকে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। কারণ, ওই গাছের নিচে পূজা হয়। তো এমন লুণ্ঠন দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনেরই বা ভূমিকা কী? এটি তো এখন দুর্নীতি অব্যাহতি কমিশন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই লুণ্ঠনের খবর তো আমরা পাচ্ছি একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের কারণে। আল-জাজিরা টিভিতে এখন একটি স্লোগান প্রায়ই দেখি—জার্নালিজম ইজ নট অ্যা ক্রাইম।
বিচারব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তাতে এর প্রতিও মানুষের আস্থা কমে আসছে। পুলিশ-র্যা বের ব্যর্থতার তালিকাও দীর্ঘ। লিমনের কথা আমাদের মনে আছে। পুলিশ-র্যা ব সাগর-রুনি দম্পতির হত্যারহস্য তিন বছরেও উদ্ঘাটন করতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি কোথায়? ত্বকী হত্যার চার্জশিট দুই বছরেও দেওয়া হয়নি। অভিজিৎ হত্যার তদন্তে ব্যর্থতায় প্রতিবাদী, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন তাঁর বাবা ৮০ বছর বয়সী সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অজয় রায়। রানা প্লাজায় ১১৩৯ নিরপরাধ মানুষকে হত্যার দুই বছরে তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু?
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে সেদিন একটি সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের পুলিশ-র্যা বের সমালোচনামূলক কিছু কথার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, পুলিশকে এখানে-ওখানে যে এমন আক্রমণ করা হচ্ছে, কোথাও কোথাও থানা ঘেরাও করে, কোথাও কোথাও থানায় ঢুকেই তার বিরুদ্ধে কখন, কোথায় পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের কে কী করছেন, কয়টা প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন?
তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথাগুলোও গণমাধ্যমেই তুলে ধরতে হবে। আমরা জানি পুলিশ বাহিনীও কখনো কখনো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেসব খবর গণমাধ্যমে এলে তারাও তখন রিলিফ পাবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
স্পষ্ট মনে আছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর ব্রিটিশ আইনজীবী টম উইলিয়ামস কিউসি সেই ’৭২-এর প্রথম দিকে মরহুম তসদ্দক আহমেদের গঙ্গা রেস্টুরেন্টে এক লাঞ্চে আমাকে তাঁর নির্বাচনী এলাকার এক মধ্যবয়সী ব্রিটিশ নারীকে সাহায্য করতে অনুরোধ করলেন। ওই নারীর সিলেটি স্বামী তাঁদের একমাত্র শিশুসন্তানকে নিয়ে চলে এসেছেন সিলেটে, স্ত্রীকে না জানিয়ে। টম উইলিয়ামস কিউসি, এমপি আমাকে জানালেন, তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমকেও লিখেছেন, ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনকে অপহৃত শিশুটিকে উদ্ধারকাজে সক্রিয় হতে। তিনি আরও বললেন, ঢাকায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছেও তিনি আইনগত পরামর্শের জন্য চিঠি লিখেছেন। উল্লেখ্য, আগরতলা মামলায় টম উইলিয়ামসকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যাপারে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, জাকারিয়া খান চৌধুরীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশে বিহিত চাইতে সাংসদদের কাছে সাহায্য চাওয়ার সংস্কৃতি একেবারে নেই বললেই চলে। তার বিপরীতে, আমাদের দেশের বিপদগ্রস্ত মানুষ সাহায্য চাইতে একজন সাংবাদিককেই খোঁজে, তারা পত্রিকা বা টিভি অফিসেই ধরনা দেয়।
১৫ বছর আগের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটি উদাহরণ দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, পাকিস্তান পোস্টাল ক্যাডারের এক কর্মকর্তা রফিকুল আলম জাহাঙ্গীরকে পোস্টিং দেওয়া হলো বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে, কিন্তু তাঁকে নতুন দায়িত্বে যোগ দিতে দিচ্ছিলেন না এই মন্ত্রণালয়ের ‘গদিনশিন’ সচিব। জাহাঙ্গীর বিষয়টি আমাকে জানাল। আমি তখন সদ্য অবসরে, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করায় সাংবাদিক মহলে কিছুটা পরিচিত। আমি টেলিফোন করলাম তখন ইত্তেফাক-এর এক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককে। পরদিন ইত্তেফাক-এর প্রথম পৃষ্ঠায় রফিকুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের বিপন্ন অবস্থার কথা প্রকাশিত হলো। আর সেদিনই তাঁর নতুন বদলির আদেশ জারি হলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে। এ রকম হাজার হাজার উদাহরণ আছে।
তো কথাটি আবার বলি, বাংলাদেশের বিপন্ন বিপদগ্রস্ত মানুষজন বিপদ থেকে প্রতিকার চাইতে একজন সাংবাদিককেই খোঁজে। গ্রাম, শহর, বন্দরের যেকোনো বয়সের মানুষ গণমাধ্যমকেই তাদের ভরসা হিসেবে দেখে। বস্তুত, দেশের মানুষজনের নাগরিক অধিকার রক্ষায় প্রায় ‘অকার্যকর’ জাতীয় সংসদের চাইতে অনেক বেশি কার্যকর আমাদের গণমাধ্যম। একজন মুক্তিযোদ্ধা বৃদ্ধ বয়সেও রিকশা চালিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন—এই খবর তো আমি পত্রিকায়, টিভিতেই দেখি। সাত-আট বছর আগে দৈনিক জনকণ্ঠ-এ প্রবীণ রিকশাচালক মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ারের একটি সচিত্র খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমি মেডোনা গ্রুপের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামানকে অনুরোধ করলে মুক্তিযোদ্ধা সরোয়ারের জন্য তিনি আমাকে এক লাখ টাকা পাঠিয়ে দেন। ওই টাকাটা তখন রিকশাচালক সরোয়ারকে পাঠিয়ে দিই, যেন তিনি তাঁর প্রত্যাশামতো যশোরের একটি গ্রামে একটি ছোট বাড়ি বানাতে পারেন। এখানেও সরোয়ারের পাঁচ–পাঁচজন নির্বাচিত প্রতিনিধি আছেন। তাঁরা তো কেউ কিছু করলেন না।
‘হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার’ হিসেবে দুনিয়ার প্রতিটি দেশেই সাংবাদিকদের একটি আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও কালো মানুষগুলোর অধিকার রক্ষায় বেশি সোচ্চার-সক্রিয় সাংবাদিকেরা।
গত আগস্ট মাসে মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ফার্গুসনে ১৮ বছরের কালো নিরপরাধ মাইকেল ব্রাউন নামের একজনকে গুলি করে মেরে ফেলার প্রতিবাদে যেসব বিক্ষোভ, মিছিল-মিটিং-সমাবেশ হয় মার্কিন মুলুকে, তা সম্ভব হয়েছিল সে দেশেরই টিভি ও প্রিন্ট সাংবাদিকদের প্রবল ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। জনমতের চাপে সেই অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ড্যারেন উইলসন কয়েক দিন আগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
---দুই
এই পটভূমিতেই প্রথম আলোর বাউফল প্রতিনিধি মিজানুর রহমানের ওপর পুলিশি হেফাজতে অত্যাচার-নির্যাতনের খবরে সাংঘাতিকভাবে বিচলিত বোধ করছি। এই পর্যায়ে আমাকে বলতেই হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ওপর আওয়ামী লীগের কিছু সংসদ সদস্যের মারধরের ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আমি যে পরিমাণ লেখালেখি করেছি, তেমনটি বোধ হয় আর কেউ করেননি।
মিরপুরের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ্ প্রকাশ্যে দিনের বেলায় মারলেন এক পুলিশ সার্জেন্টকে। কারণ, ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়া এমপি সাহেবকে পুলিশ সার্জেন্ট দ্রুত বের করে আনলেন না কেন। পুলিশ সার্জেন্ট যখন এমপির বিরুদ্ধে মামলা করলেন, তখন তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এই বলে, ‘পুলিশ সার্জেন্ট মামলা করতে গেল কেন? আমাদের বললেই তো আমরাই মিটমাট করে দিতাম।’ পুলিশকে থানা থেকে ডেকে এনে তাঁর অফিসে মারধর করেছেন যশোরের শেখ আফিলউদ্দিন এমপি। আর কক্সবাজারের এমপি আবদুর রহমান বদি যে কত সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর করেছেন, তার তালিকা দেওয়া এখানে সম্ভব নয়। আমাদের পুলিশ-র্যা ব বাহিনীর টু-স্টার, থ্রি-স্টার বিশিষ্ট কোনো কর্মকর্তা এঁদের কারও বিরুদ্ধে সামান্যতম ব্যবস্থা নিতে সাহস করেননি।
এই সাংসদদের এমন গর্হিত আচরণের প্রতিবাদে লেখা আমার কলামের প্রশংসা করে চিঠি লিখেছিলেন তখনকার আইজিপি নূর মোহাম্মদ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরকারি কর্মকর্তাদের মারধরের প্রতিবাদ করতে আমি মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি কয়েকবার। বিধি মোতাবেক রাষ্ট্রের বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভালোমন্দ দেখভাল করাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেকোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অধিকার রক্ষায় আমি যেমন সোচ্চার, তেমনি সোচ্চার পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধেও।
বাউফলের মিজানুর রহমানের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পাতায় তাঁর যে ছবি ছাপা হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি দাঁড়াতে পারছেন না। পুলিশের এমন অত্যাচার-নির্যাতনের সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ; আশঙ্কা হয় এটি সর্বশেষ উদাহরণ নয়।
পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা প্রথম শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম দিকে, প্রায় চুয়ান্ন বছর আগে। কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্রের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে এবং পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থানায়। তার বর্ণনা আছে মালেকা বেগমের লেখা ইলা মিত্র বইটিতে। এখনো আমি ওখানে গেলে থানাটির সামনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি। সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চরম নির্যাতন চালানো হয় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ওপর: তার বর্ণনা আছে তাঁর নোটস ফ্রম প্রিজন এবং জেলের কথা মানুষের কথা বই দুটিতে। নির্যাতন চালানো হয় মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ওপর। নির্যাতন চালানো হয় এরশাদের স্ত্রী বিদিশার ওপর। নারী বলে তাঁকে এতটুকু ছাড় দেওয়া হয়নি। তখন খালেদা জিয়ার বিএনপি-জামায়াত জমানা।
সাংবাদিকদের মধ্যে হালজামানায় অনেক ধান্ধাবাজ আছে। তাদের বিরুদ্ধেও আমার লড়াই। নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক ঠিকানা, বাংলাদেশের ইনকিলাব ও দিনকাল আমার ওপর লম্বা লম্বা প্রতিবেদন ছাপলেও একটিবারও আমার সঙ্গে কথা বলেনি। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সাংবাদিকতার অবশ্যপালনীয় নিয়ম হলো, খবর তৈরির সময় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাদের ভাষ্যও রিপোর্টে রাখতে হবে। আমাদের অনেক পত্রিকায় গায়েবি-আসমানি সোর্সের বরাতে রচনা থাকে বেশি। প্রকৃত খবর থাকে কম। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও ইত্তেফাক-এর মতো পত্রিকাগুলোতে ধান্ধাবাজদের স্থান থাকার কথা নয়। কারণ, সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় এবং অবশ্যপালনীয় নিয়মনীতি, নৈতিকতা পত্রিকা তিনটি প্রয়োগ করে থাকে বলে জানি।
আমার আশঙ্কা, দেশের সর্বাধিক প্রচারসংখ্যার পাঠকপ্রিয় প্রথম আলোর একজন সাংবাদিককে যদি এমন নিষ্ঠুরভাবে দমন করার অপচেষ্টা চলে, তাহলে অন্য সব পত্রপত্রিকা, টিভি, রেডিওর সাংবাদিকেরা তো নিজেদের গুটিয়ে নেবেন। দেশে যখন সন্ত্রাস, গুম, খুন, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, দখল, টেন্ডার ছিনতাই ব্যাপক ও বেপরোয়াভাবেই চলছে, তার প্রতিকার চাইতে দেশের সংক্ষুব্ধ মানুষজন তাহলে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে?
ঢাকা জেলা পরিষদ প্রশাসক হাসিনাদৌলাহর লুণ্ঠনের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে চ্যানেল ৭১ গত ৮ ডিসেম্বর। এই আওয়ামী লীগ নেতা ধামরাইয়ের বোয়াইন গ্রামের একটি বটগাছকে দুই লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। কারণ, ওই গাছের নিচে পূজা হয়। তো এমন লুণ্ঠন দমনে দুর্নীতি দমন কমিশনেরই বা ভূমিকা কী? এটি তো এখন দুর্নীতি অব্যাহতি কমিশন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই লুণ্ঠনের খবর তো আমরা পাচ্ছি একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকদের কারণে। আল-জাজিরা টিভিতে এখন একটি স্লোগান প্রায়ই দেখি—জার্নালিজম ইজ নট অ্যা ক্রাইম।
বিচারব্যবস্থা যেভাবে চলছে, তাতে এর প্রতিও মানুষের আস্থা কমে আসছে। পুলিশ-র্যা বের ব্যর্থতার তালিকাও দীর্ঘ। লিমনের কথা আমাদের মনে আছে। পুলিশ-র্যা ব সাগর-রুনি দম্পতির হত্যারহস্য তিন বছরেও উদ্ঘাটন করতে পারেনি। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি কোথায়? ত্বকী হত্যার চার্জশিট দুই বছরেও দেওয়া হয়নি। অভিজিৎ হত্যার তদন্তে ব্যর্থতায় প্রতিবাদী, ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন তাঁর বাবা ৮০ বছর বয়সী সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অজয় রায়। রানা প্লাজায় ১১৩৯ নিরপরাধ মানুষকে হত্যার দুই বছরে তদন্তের অগ্রগতি কতটুকু?
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে সেদিন একটি সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের পুলিশ-র্যা বের সমালোচনামূলক কিছু কথার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করছে, পুলিশকে এখানে-ওখানে যে এমন আক্রমণ করা হচ্ছে, কোথাও কোথাও থানা ঘেরাও করে, কোথাও কোথাও থানায় ঢুকেই তার বিরুদ্ধে কখন, কোথায় পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের কে কী করছেন, কয়টা প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন?
তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথাগুলোও গণমাধ্যমেই তুলে ধরতে হবে। আমরা জানি পুলিশ বাহিনীও কখনো কখনো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেসব খবর গণমাধ্যমে এলে তারাও তখন রিলিফ পাবে।
মহিউদ্দিন আহমদ: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, কলাম লেখক।
No comments