আদালত কি এই হরতালকেই বৈধতা দিয়েছিলেন? by আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব
জীবনটা
ফের হরতালময় হয়ে উঠেছে। ২০১৫-এর যাত্রাই হরতাল দিয়ে। এর পর প্রায় প্রতি
দিনই হরতাল বা অবরোধ_ কখনও দেশব্যাপী, কখনও আঞ্চলিকভাবে। এক সময় হরতাল ছিল
আন্দোলন বা দাবি আদায়ের শেষ অস্ত্র। আর এখন 'ডেইলি সোপ'_ চুন থেকে পান
খসলেই হরতাল। ২০১৩ সালেই ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২১৫ দিন হরতালে কেটেছে। তার
কোনোটা দেশব্যাপী, কোনোটা নির্দিষ্ট অঞ্চলজুড়ে (সূত্র :'অধিকার')। ২০০৫
সালে পরিচালিত ইউএনডিপির এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত
এই ৫৫ বছরে বাংলাদেশে সর্বমোট ১,১৭২ দিন হরতাল হয়েছে। তন্মধ্যে ১৯৯১ সালে
সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরবর্তী ১১ বছরেই (১৯৯১-২০০২) হরতাল হয়েছে
৮২৭ দিন। সেখানে ১৯৯১-১৯৯৪ সালে ২১৬ দিন, ১৯৯৫-১৯৯৮ সালে ২৭৯ দিন এবং
১৯৯৯-২০০২ সালে ৩৩২ দিন। অথচ হরতাল-অবরোধে দৈনিক আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২
হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, যা দৈনিক জিডিপির ৬১ দশমিক ৫৪ শতাংশ (সমকাল, ২৩
জানুয়ারি, ২০১৫)। সঙ্গে জ্বালাও-পোড়াও, আহত-নিহতসহ ১৬ কোটি মানুষের অন্তহীন
ক্ষয়ক্ষতি আর ভোগান্তি তো আছেই। তারপরও দুর্বার গতিতে 'হরতাল-গাড়ি' চলছেই।
এটা ঠিক, আমাদের উচ্চ আদালতের চোখে হরতাল 'গণতান্ত্রিক অধিকার'। তবে কি হরতালের নামে চলমান সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানুষ হত্যাও অধিকার? ঘটনা কিন্তু ভিন্ন।
১৯৯৯ সাল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির হরতাল, ঘেরাও আর অবরোধে দেশ তখন কার্যত অচল। পত্রিকায় হররোজ সহিংসতার ছবি ও সংবাদ। এরূপ কিছু সংবাদকে আমলে নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি মো. লতিফুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) রুল জারি করেন। রুলে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষের কার্যক্রমকে আমলযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফৌজদারি আদালত ও পুলিশকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না_ জানতে চাওয়া হয়। রুলে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুুর রহমান ও বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে বিবাদী করা হয়।
কাজ হলো না রুলে। ১৮ এপ্রিল ফের হরতাল ডাকল বিএনপি। ওই হরতালকে 'বেআইনি' ও 'অসাংবিধানিক' ঘোষণার দাবি নিয়ে খন্দকার মোদারেস ইলাহী নামে এক আইনজীবী তখন হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটে আদালত পৃথক রুল দেন। আর রায় হয় ২৫ অক্টোবর, ২০০০ তারিখে। খন্দকার মোদারেস ইলাহী বনাম বাংলাদেশ [২১ বিএলডি (হাইকোর্ট বিভাগ) ২০০১, পাতা-৩৫২] নামে পরিচিত ওই মামলার রায়ে হরতালের বৈধতা প্রসঙ্গে বিচারপতি মাইনুুর রেজা চৌধুরী বলেন, কেবল হরতাল ডাকাটা অবৈধ নয়। তবে তা হবে হুমকি-ধমকি বা ভয়-ভীতিমুক্ত। কিন্তু হরতালটা যদি জোরপূর্বক কার্যকরের চেষ্টা হয় বা পালনে বাধ্য করা হয়, তাহলে ওই হরতাল ডাকাটা হবে অবৈধ। একই সঙ্গে জনগণের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ (প্যারা-১৬)।
হরতাল ডাকার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সর্বসাধারণকে বা একটি নির্দিষ্ট দল বা শ্রেণীকে উদাত্তভাবে আহ্বান বা দাওয়াত দিয়ে হরতালের ডাক দিতে পারে। সংবিধান এক্ষেত্রে কাউকে সহিংসতা বা অপরাধ সংঘটনে উস্কানি বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেয়নি (প্যারা-২৬)।
হরতাল পালনের ধরন সম্পর্কে ওই রায়ে বলা হয়, হরতাল ডাকাটাই কেবল গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তার পালন হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ। তাতে কোনো বেআইনি কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। একই সঙ্গে হরতালবিরোধীরাও এক্ষেত্রে কোনোরূপ উস্কানি, প্ররোচনা, হামলা বা আগ্রাসন চালাবে না। হরতালকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের সুযোগ দিতে হবে (প্যারা-৩০)।
হরতাল মতপ্রকাশের একটা মাধ্যম। যার সাংবিধানিক ভিত সংবিধানের ৩৯(২)(ক)। হরতালের সঙ্গে এই অনুচ্ছেদের সীমারেখা টেনে রায়ে বলা হয়, এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। তবে তার উপভোগ আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে। তা ছাড়া বল প্রয়োগ বা হুমকি-ধমকি দিয়ে কাউকে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে বিরত রাখা প্রচলিত ফৌজদারি আইনে অপরাধজনক কাজ (প্যারা-৪৯)।
এবার সুয়োমোটো রুল পর্বে ফেরা যাক। হরতাল বিষয়ে প্রচলিত ধারণার মূল ভিত কিন্তু এই মামলার রায়। ১৯৯৯ সালের ১৩ মে হাইকোর্ট ওই রায় দেন। রায়ে আদালত হরতালকারী ও হরতালবিরোধীদের অপতৎপরতাকে 'আমলযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ' ঘোষণা করেন। আদালতের যুক্তি ছিল, হরতালকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষে বিচিত্র সহিংস কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাতে জনগণের সাধারণ নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন প্রচণ্ডভাবে বিঘি্নত হয়। তাই ওই সব কাজকে অপরাধ গণ্য করে শাস্তির আওতায় আনা দরকার। রায়ে আদালত ওই সব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ওই দিনই বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আপিল করেন। পরে আরেকটি আপিলও করা হয়। প্রায় আট বছর পর শুনানি শেষে ২৭ নভেম্বর ২০০৭ সালে আপিল বিভাগ ওই দুই আপিল বিষয়ে রায় দেন। রায়ে প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। এবার আদালতের যুক্তি, জোর করে কাউকে হরতাল পালনে বাধ্য করা বা হরতালে বাধা সৃষ্টি করা, ভাংচুর করা, মারামারি করা ইত্যাদি প্রচলিত আইনেই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য রয়েছে। দণ্ডবিধিসহ অন্যান্য আইনে ওইসব অপরাধের শাস্তির সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। তাই এরূপ কাজকে নতুনভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে নতুনভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দানের প্রয়োজন নেই। ২৮ বিএলডি (আপিল বিভাগ) ২০০৮, পাতা ৫৪-৬০-এ রায়টি সনি্নবেশিত আছে। হরতালের বৈধতা বিষয়ে আপিল বিভাগের ওই রায়ের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়_ 'বল প্রয়োগে পালিত যে হরতাল সহিংসতা ছড়ায়, মৃত্যু ঘটায় এবং নাগরিকের জানমালের ক্ষতিসাধন করে, সে হরতাল কেবল অবৈধই নয়, তা ঘৃণিত এবং প্রচলিত আইনে দণ্ডযোগ্য। ৪৫ অনুচ্ছেদে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট_ বল প্রয়োগ বা বল প্রয়োগের ভয় কিংবা সহিংসতা বা সহিংসতার ভয় দেখিয়ে কার্যকর হরতাল কেবল অবৈধ নয়, দণ্ডবিধিসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য ফৌজদারি আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে জনগণের সুরক্ষায় ওই অপরাধীদের_ তা সে যে দলেরই হোক না কেন, শাস্তি দিতে সরকার বাধ্য।
এই রায়ও হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বটে। কিন্তু সেটা বেশ কিছু পূর্বশর্ত পূরণসাপেক্ষে। যেমন হরতালে যোগ দিতে কাউকে কোনোরূপ জোর-জবরদস্তি বা বাধ্য করা যাবে না। হরতাল পালনে কাউকে ভয় দেখানো বা কোথাও ত্রাস সৃষ্টি করা যাবে না। হরতাল হবে অহিংস। এ কাজে শুধু উদ্বুদ্ধ বা প্রলুব্ধকরণ (persuasion) চলবে। বুঝিয়ে-সুজিয়ে যাদের নেওয়া যাবে, কেবল তাদের নিয়েই চুকাতে হবে হরতালের পাট। (But Hartal or strike per se enforced through persuasion unaccompanied by threat, intimidation, force or violence is a democratically recognized right of citizens guaranteed under the constitution, para-35)| । দেখুন কেবল persuasion প্রসূত হরতালকেই আদালত 'গণতান্ত্রিক অধিকার'-এর সনদ দিচ্ছে।
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে চলাফেরার স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, যোগাযোগের স্বাধীনতাসহ ১৮টি মৌলিক অধিকারের (শিরোনাম হিসেবে) কথা বলা আছে। তার মধ্যে এক হরতালের অধিকার চর্চায় জনজীবন যেভাবে পঙ্গু হয় তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় সব মৌলিক অধিকারই কমবেশি লঙ্ঘিত হয়। এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলছেন, কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীবিশেষের মৌলিক অধিকারের দাবির কাছে সর্বসাধারণের মৌলিক অধিকার নতজানু হতে পারে না [এআইআর ১৯৯৮, সুপ্রিম কোর্ট ১৮৪]।
অন্যদিকে সংবিধানে বর্ণিত সমাবেশের স্বাধীনতা (অনু :৩৭) এবং সংগঠনের স্বাধীনতাও (অনু : ৩৮) নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ প্রকৃতির অধিকার, যার আইনানুগ উপভোগের সঙ্গে হরতালের অনাচার কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কার, চলমান সহিংস ও আরোপিত হরতালকে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত বৈধতা দেননি। বৈধতার এ মুকুট কেবল 'অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্টম্ফূর্ত হরতালে'র জন্য প্রযোজ্য। প্রয়োজনে 'হরতাল ডাকা'কে আদালত অধিকার বলেছেন বটে; অধিকারটা এখানে 'ডাকা' পর্যন্ত। কিন্তু ওই অধিকার উপভোগে সহিংসতা বা আইন-অনুমোদিত কোনো কিছুর প্রবেশ মাত্রই তা অধিকারের পরিবর্তে 'শাস্তিযোগ্য অপরাধ'-এর মুকুট পরবে। অতএব, গণতান্ত্রিক অধিকারের মুখোশে যে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যময় হরতাল পালনের সংস্কৃতি এ দেশে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে চলছে, তা সংবিধান বা উচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে কোনোভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আইনমন্ত্রী সম্প্র্রতি হরতাল বন্ধে 'জনগণ চাইলে আলাদা আইন' প্রণয়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার এই সিদ্ধান্ত কি আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? কারণ আপিল বিভাগ তার রায়ে প্রচলিত আইনেই 'হরতালের সহিংসতা রোধ' সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
aftabragib@yahoo.com
এটা ঠিক, আমাদের উচ্চ আদালতের চোখে হরতাল 'গণতান্ত্রিক অধিকার'। তবে কি হরতালের নামে চলমান সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানুষ হত্যাও অধিকার? ঘটনা কিন্তু ভিন্ন।
১৯৯৯ সাল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির হরতাল, ঘেরাও আর অবরোধে দেশ তখন কার্যত অচল। পত্রিকায় হররোজ সহিংসতার ছবি ও সংবাদ। এরূপ কিছু সংবাদকে আমলে নিয়ে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. গোলাম রাব্বানী ও বিচারপতি মো. লতিফুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ একটি স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) রুল জারি করেন। রুলে হরতালের পক্ষে-বিপক্ষের কার্যক্রমকে আমলযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ফৌজদারি আদালত ও পুলিশকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না_ জানতে চাওয়া হয়। রুলে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুুর রহমান ও বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াকে বিবাদী করা হয়।
কাজ হলো না রুলে। ১৮ এপ্রিল ফের হরতাল ডাকল বিএনপি। ওই হরতালকে 'বেআইনি' ও 'অসাংবিধানিক' ঘোষণার দাবি নিয়ে খন্দকার মোদারেস ইলাহী নামে এক আইনজীবী তখন হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটে আদালত পৃথক রুল দেন। আর রায় হয় ২৫ অক্টোবর, ২০০০ তারিখে। খন্দকার মোদারেস ইলাহী বনাম বাংলাদেশ [২১ বিএলডি (হাইকোর্ট বিভাগ) ২০০১, পাতা-৩৫২] নামে পরিচিত ওই মামলার রায়ে হরতালের বৈধতা প্রসঙ্গে বিচারপতি মাইনুুর রেজা চৌধুরী বলেন, কেবল হরতাল ডাকাটা অবৈধ নয়। তবে তা হবে হুমকি-ধমকি বা ভয়-ভীতিমুক্ত। কিন্তু হরতালটা যদি জোরপূর্বক কার্যকরের চেষ্টা হয় বা পালনে বাধ্য করা হয়, তাহলে ওই হরতাল ডাকাটা হবে অবৈধ। একই সঙ্গে জনগণের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ (প্যারা-১৬)।
হরতাল ডাকার পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সর্বসাধারণকে বা একটি নির্দিষ্ট দল বা শ্রেণীকে উদাত্তভাবে আহ্বান বা দাওয়াত দিয়ে হরতালের ডাক দিতে পারে। সংবিধান এক্ষেত্রে কাউকে সহিংসতা বা অপরাধ সংঘটনে উস্কানি বা বেআইনি কর্মকাণ্ডের অনুমতি দেয়নি (প্যারা-২৬)।
হরতাল পালনের ধরন সম্পর্কে ওই রায়ে বলা হয়, হরতাল ডাকাটাই কেবল গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তার পালন হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ। তাতে কোনো বেআইনি কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। একই সঙ্গে হরতালবিরোধীরাও এক্ষেত্রে কোনোরূপ উস্কানি, প্ররোচনা, হামলা বা আগ্রাসন চালাবে না। হরতালকারীদের শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালনের সুযোগ দিতে হবে (প্যারা-৩০)।
হরতাল মতপ্রকাশের একটা মাধ্যম। যার সাংবিধানিক ভিত সংবিধানের ৩৯(২)(ক)। হরতালের সঙ্গে এই অনুচ্ছেদের সীমারেখা টেনে রায়ে বলা হয়, এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। তবে তার উপভোগ আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে। তা ছাড়া বল প্রয়োগ বা হুমকি-ধমকি দিয়ে কাউকে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম থেকে বিরত রাখা প্রচলিত ফৌজদারি আইনে অপরাধজনক কাজ (প্যারা-৪৯)।
এবার সুয়োমোটো রুল পর্বে ফেরা যাক। হরতাল বিষয়ে প্রচলিত ধারণার মূল ভিত কিন্তু এই মামলার রায়। ১৯৯৯ সালের ১৩ মে হাইকোর্ট ওই রায় দেন। রায়ে আদালত হরতালকারী ও হরতালবিরোধীদের অপতৎপরতাকে 'আমলযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ' ঘোষণা করেন। আদালতের যুক্তি ছিল, হরতালকে কেন্দ্র করে পক্ষে-বিপক্ষে বিচিত্র সহিংস কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাতে জনগণের সাধারণ নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন প্রচণ্ডভাবে বিঘি্নত হয়। তাই ওই সব কাজকে অপরাধ গণ্য করে শাস্তির আওতায় আনা দরকার। রায়ে আদালত ওই সব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ওই দিনই বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া আপিল করেন। পরে আরেকটি আপিলও করা হয়। প্রায় আট বছর পর শুনানি শেষে ২৭ নভেম্বর ২০০৭ সালে আপিল বিভাগ ওই দুই আপিল বিষয়ে রায় দেন। রায়ে প্রধান বিচারপতি মো. রুহুল আমিনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। এবার আদালতের যুক্তি, জোর করে কাউকে হরতাল পালনে বাধ্য করা বা হরতালে বাধা সৃষ্টি করা, ভাংচুর করা, মারামারি করা ইত্যাদি প্রচলিত আইনেই ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য রয়েছে। দণ্ডবিধিসহ অন্যান্য আইনে ওইসব অপরাধের শাস্তির সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। তাই এরূপ কাজকে নতুনভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে নতুনভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দানের প্রয়োজন নেই। ২৮ বিএলডি (আপিল বিভাগ) ২০০৮, পাতা ৫৪-৬০-এ রায়টি সনি্নবেশিত আছে। হরতালের বৈধতা বিষয়ে আপিল বিভাগের ওই রায়ের ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়_ 'বল প্রয়োগে পালিত যে হরতাল সহিংসতা ছড়ায়, মৃত্যু ঘটায় এবং নাগরিকের জানমালের ক্ষতিসাধন করে, সে হরতাল কেবল অবৈধই নয়, তা ঘৃণিত এবং প্রচলিত আইনে দণ্ডযোগ্য। ৪৫ অনুচ্ছেদে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট_ বল প্রয়োগ বা বল প্রয়োগের ভয় কিংবা সহিংসতা বা সহিংসতার ভয় দেখিয়ে কার্যকর হরতাল কেবল অবৈধ নয়, দণ্ডবিধিসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য ফৌজদারি আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এক্ষেত্রে জনগণের সুরক্ষায় ওই অপরাধীদের_ তা সে যে দলেরই হোক না কেন, শাস্তি দিতে সরকার বাধ্য।
এই রায়ও হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে বটে। কিন্তু সেটা বেশ কিছু পূর্বশর্ত পূরণসাপেক্ষে। যেমন হরতালে যোগ দিতে কাউকে কোনোরূপ জোর-জবরদস্তি বা বাধ্য করা যাবে না। হরতাল পালনে কাউকে ভয় দেখানো বা কোথাও ত্রাস সৃষ্টি করা যাবে না। হরতাল হবে অহিংস। এ কাজে শুধু উদ্বুদ্ধ বা প্রলুব্ধকরণ (persuasion) চলবে। বুঝিয়ে-সুজিয়ে যাদের নেওয়া যাবে, কেবল তাদের নিয়েই চুকাতে হবে হরতালের পাট। (But Hartal or strike per se enforced through persuasion unaccompanied by threat, intimidation, force or violence is a democratically recognized right of citizens guaranteed under the constitution, para-35)| । দেখুন কেবল persuasion প্রসূত হরতালকেই আদালত 'গণতান্ত্রিক অধিকার'-এর সনদ দিচ্ছে।
আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে চলাফেরার স্বাধীনতা, পেশার স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, যোগাযোগের স্বাধীনতাসহ ১৮টি মৌলিক অধিকারের (শিরোনাম হিসেবে) কথা বলা আছে। তার মধ্যে এক হরতালের অধিকার চর্চায় জনজীবন যেভাবে পঙ্গু হয় তাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় সব মৌলিক অধিকারই কমবেশি লঙ্ঘিত হয়। এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলছেন, কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীবিশেষের মৌলিক অধিকারের দাবির কাছে সর্বসাধারণের মৌলিক অধিকার নতজানু হতে পারে না [এআইআর ১৯৯৮, সুপ্রিম কোর্ট ১৮৪]।
অন্যদিকে সংবিধানে বর্ণিত সমাবেশের স্বাধীনতা (অনু :৩৭) এবং সংগঠনের স্বাধীনতাও (অনু : ৩৮) নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ প্রকৃতির অধিকার, যার আইনানুগ উপভোগের সঙ্গে হরতালের অনাচার কোনোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিষ্কার, চলমান সহিংস ও আরোপিত হরতালকে আমাদের সর্বোচ্চ আদালত বৈধতা দেননি। বৈধতার এ মুকুট কেবল 'অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও স্বতঃস্টম্ফূর্ত হরতালে'র জন্য প্রযোজ্য। প্রয়োজনে 'হরতাল ডাকা'কে আদালত অধিকার বলেছেন বটে; অধিকারটা এখানে 'ডাকা' পর্যন্ত। কিন্তু ওই অধিকার উপভোগে সহিংসতা বা আইন-অনুমোদিত কোনো কিছুর প্রবেশ মাত্রই তা অধিকারের পরিবর্তে 'শাস্তিযোগ্য অপরাধ'-এর মুকুট পরবে। অতএব, গণতান্ত্রিক অধিকারের মুখোশে যে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যময় হরতাল পালনের সংস্কৃতি এ দেশে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তে চলছে, তা সংবিধান বা উচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে কোনোভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আইনমন্ত্রী সম্প্র্রতি হরতাল বন্ধে 'জনগণ চাইলে আলাদা আইন' প্রণয়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তার এই সিদ্ধান্ত কি আপিল বিভাগের রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? কারণ আপিল বিভাগ তার রায়ে প্রচলিত আইনেই 'হরতালের সহিংসতা রোধ' সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
aftabragib@yahoo.com
No comments