অনন্য আত্মজীবনীর অপূর্ব পর্যবেক্ষণ' by ড. ফজলুল হক সৈকত
এমনটা হবে ভাবেনি শৈবাল। তবুও তাই ঘটল। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। সে ভেবেছে এক। হয়েছে আরেক।
আগের রাতে শৈবালের মা ফোন করে শৈবালকে বলেছে, ‘ওদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে
ফোনে। আমি বলেছি, ‘সামনের সপ্তাহে ঢাকায় আসব। এসে সমস্যার সমাধান করব।
আপাতত বিষয়টার মীমাংসা করে দিতে বলেছি ওদেরকে। ওরা তোকে ডাকলে, তুই যাস।’
শৈবালের মা ফোন রাখার ঘণ্টাখানেক পর তাপসীর বাবা ফোন করলেন শৈবালকে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আগামীকাল ফ্রি আছ’?
আগামীকাল কখন?
সকালে...
হুম, আছি। ফ্রি আছি।
তাহলে সকাল দশটার দিকে আমাদের বাসায় চলে এসো।
ঠিক আছে- বলে ফোন রেখে মনে মনে একটু আশান্বিত হল শৈবাল। হয়তো কাল একটা সমাধান পাওয়া যাবে সমস্যার। যেহেতু শৈবালের মা ও তাপসীর আম্মুর ফোনালাপ হয়েছে সেহেতু বিষয়টা এখন মীসাংসার পর্যায়ে চলে এসেছে বলে ভাবা যায়।
আশায় বুক বাঁধে শৈবাল। চোখে নতুন স্বপ্ন ঝলমল করে যায়। পরদিন কিছুটা খুশি মনে তাপসীদের বাসায় হাজির হয় শৈবাল। কলিং বেল বাজার পর কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। ড্রইয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসল শৈবাল। টিভি চলছিল। একাকীত্ব ও টেলিভিশনের মাঝে একটা নিরেট জোগসাজশ রয়েছে। খালি রুমে একা একজন মানুষের সামনে টিভি চলতে থাকলে তাদের মাঝে একটা ভালো লাগা জন্মায়। যে কারণে তখন টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না দেখালেও তাকিয়ে দেখে থাকার অনাগ্রহ জন্মায় না একা মানুষটির।
শৈবালও তাই তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে। একটু পর তাপসীর বাবা এলেন এখানে। শৈবাল সালাম দিয়ে কুশলাদী জানতে চাইল। এক কথা, দুই কথা হল তাদের। দু’জনেই কাছাকাছি সোফায় বসেছে এখন। দু’জনেরই নজর এখন টিভির দিকে।
টেলিভিশনের পর্দায় নজর রেখেও ভেতরে একটা শংকা কাজ করছে শৈবালের। একটু পরে কি ঘটবে এখানে? কবকিছু কি স্বাভাবিক থাকবে? নাকি ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হবে?
একটু পরেই তাপসীর ছোট ফুপু এলেন। শৈবালের সঙ্গে সৌজন্য আলাপ করে পাশেই বসলেন। এর মাঝে কাজের মেয়ে ট্রেতে করে চা-বিস্কুট নিয়ে এলো।
সবাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে। কার মনে কী ঘুরপাক খাচ্ছে জানে না শৈবাল। সে শুধু নিজেরটা জানে। একটা চাপা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কী হবে কে জানে? নিজেকে শান্ত রাখার প্রতিজ্ঞা শৈবালের।
চা পান শেষ করে ফুপুই মুখ খুললেন। বললেন, আমরা তাহলে আসল বিষয়ে আলাপে আসি। কি বলেন বড় ভাইয়া?
এ কথা শুনে শৈবাল মুখ তুলে তাকাল তাপসীর ফুপুর দিকে। তাপসীর বাবা একবার শৈবালের চোখে চোখ রাখল, তারপর চোখ ঘুরিয়ে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ... শুরু কর।
তাপসীর ফুপু এবার শুরু করলেন। শৈবালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত আছ। তারপরও তোমার কিছু বলার থাকলে বল। মানে, তাপসীর ব্যাপারে তোমার কি কি অভিযোগ আছে শুনি আগে?
শৈবাল বলল, আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাছাড়া যাকে আমি ভালোবাসি। যাকে নিয়ে আমার সংসার করার বাসনা রয়েছে তার নামে অভিযোগ করব কেন? আমি এসেছি আমার স্ত্রীকে সংসারে ফিরিয়ে নিতে।
কিন্তু তোমার স্ত্রী যদি ফিরতে না চায় তখন তো আর কিছু করার নেই, বলল তাপসীর ফুপু।
কেন? তাপসী কি আমার সঙ্গে সংসার করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? প্রশ্ন করল শৈবাল।
তাপসীর বাবা কোনো কথা না বলে চুপ করে আছেন। কথা চলছে শৈবাল ও তাপসীর ছোট ফুপুর সঙ্গে। ফুপু বললেন, তাপসী আর ফিরতে চায় না তোমার সংসারে।
তাহলে সে কি চায়?
সে ডিভোর্স চায়।
ডিভোর্স! শৈবালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। কী এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে ডিভোর্সের মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাপসী?
ঘটনা তোমার কাছে হয়তো বড় কিছু নয়। তাপসীর কাছে হয়তো অনেক বড় ব্যাপার। তুমি প্রায়শ তার গায়ে হাত তোলো...
ফুপুর কথা থামিয়ে দিয়ে শৈবাল বলল, প্রায়শ এ ঘটনা ঘটেনি। গত সাত বছরে সর্বোচ্চ সাত বার ঘটেছে হয়তো। এখন সে ব্যাপারে কথা উঠছে কেন? ওর সঙ্গে আমার শেষ ঝগড়া হয়েছে তিন মাস আগে। তখন তো আমাদের মারামারি হয়নি। আমাদের ঝগড়া হয়েছে অন্য এক প্রসঙ্গে। আমাকে অযথাই অপমান করেছিলেন তাপসীর মা।
তোমার শেষ ঝগড়া যা নিয়েই হোক না কেন, এখন তাপসীর কাছে বড় ইস্যু হল- তুমি তার গায়ে হাত তোলো।
শৈবাল বুঝে গেছে, এরা আসল ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে বিষয়টাকে অন্যদিকে মোড় নেওয়ানোর ফন্দি করেছে। ভেতরে ভেতরে অনেক রাগ জন্মাচ্ছে শেবালের। তবুও সে নিজেকে আয়ত্তে রাখছে বারবার।
না, আজকে ঝগড়ার দিন নয়। আজকে মীমাংসার দিন। গত রাতে মায়ের ফোনালাপে শৈবাল ভেবেছিল, বিষয়টা পজেটিভ হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, ওরা গায়ের জোরে নেগেটিভ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে হয়তো। যা হওয়ার হবে। ভাগ্যকে মেনে নেবে। এ ভেবে শৈবাল বলল, আপনারা আমার শ্রদ্ধেয়। আপনাদের সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব। তবে আপনাদের জানানো ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি তাপসীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
এমন সময় তাপসীর মা এখানে এলেন।
ফুপু তখন তাকে বললেন, ভাবী... তাপসীকে একটু ডেকে আনবেন প্লিজ?
এ কথা শুনে তাপসীর মা ড্রইয়িংরুম ছেড়ে ভেতরে গেলেন। এ সময়টায় সবাই চুপ করে রইল। একটু পর তাপসীকে সঙ্গে নিয়ে এলো তার মা। ওরা মা-মেয়ে ড্রইয়িংরুমের ডিভানে বসল। তাপসী তার ফুপুকে জিজ্ঞেস করল, আমাকে এখানে ডেকেছ কেন?
ফুপু বললেন, তোর সিদ্ধান্ত জানতে। তাপসী বলল, তোমরা আমার অভিভাবক। তোমরা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমার সিদ্ধান্ত।
ফুপু বললেন, আমরা তো ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি শৈবালকে। তবুও সে তোর মুখে শুনতে চায় ডিভোর্সের ব্যাপারে।
তোমরা যা সিদ্ধান্ত দিয়েছ সেটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, বলল তাপসী।
তখন তাপসীর দিকে তাকিয়ে শৈবাল প্রশ্ন করল, তুমি কি ডিভোর্স চাও?
হ্যাঁ। এটাই ফাইনাল।
কিন্তু কেন?
কারণ তুমি প্রতিদিন আমার গায়ে হাত তোলো মদ্যপ হয়ে। অনেক মেয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে। এসব আমি আর মেনে নিতে পারছি না।
বেশ অবাক হয়ে শৈবাল প্রশ্ন করল, আমি প্রতিদিন কি তোমার গায়ে হাত তুলি? আমি কি প্রতিদিন মদ খাই?
শৈবালের চোখে তাকিয়ে জ্বলজ্বলে মিথ্যা সাক্ষ্য দিল তাপসী, হ্যাঁ... তুমি প্রতিদিন তাই কর।
ঠিক আছে, আমি ধরে নিলাম তোমার কথাই সত্য। এ জন্য আমি তোমার কাছে মাফ চাই। তোমার পরিবারের কাছেও ক্ষমা প্রার্থী। ক্ষমা পাওয়ার জন্য তুমি যা যা শর্ত দেবে আমি মাথা পেতে নেব, বলল শৈবাল।
তাপসী বলল, এখন এসব করে কোনো লাভ হবে না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।
আর তুমি যে আমার ব্যাপারে নারীঘটিত মিথ্যে স্ক্যান্ডাল দিচ্ছ তার একটা প্রমাণ দাও। একটা প্রমাণ দিতে পারলে আমি তোমার সব কথা মেনে নেব।
তাপসী প্রমাণ দিতে পারেনি। তবে শৈবালের চোখে চোখ রেখে সে আরও অনেক মিথ্যে অপবাদ দিল। শৈবাল চুপচাপ শুনল। সে বুঝে গেছে, আর কোনো কথায় কোনো লাভ হবে না। ওরা ডিভোর্সের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে এসে তাপসীর ছোট ফুপু বললেন, আর তো কথা বাকি নেই। তাহলে ডিভোর্সের বিষয়টা চূড়ান্ত। কাগজপত্র রেডি করা হোক। একটা দিন ঠিক করে তোমরা স্বাক্ষর করে ফেল। কি বল শৈবাল?
শৈবাল বলল, আমার তো আর কিছু বলার নেই। আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা যদি উভয়ের জন্য মঙ্গল হয়, তবে তাই হোক।
তাপসীর বাবা বললেন, আমি আজকে অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথা বলব। ডিভোর্সের কাগজপত্র রেডি করে তোমাকে খবর দেব। তুমি তখন এসো।
শৈবাল আবারও তাপসীকে জিজ্ঞেস করল, তাহলে ডিভোর্সটাই ফাইনাল?
তাপসী বলল, হুম, ফাইনাল।
শৈবাল এবার তাপসীর বাবা ও ছোট ফুপুর দিকে তাকাল। আবার প্রশ্ন করল, এটাই তাহলে ফাইনাল?
তাপসীর বাবা বললেন, ফাইনাল ডিসিশান তো হয়ে গেল।
তাপসীর ছোট ফুপুও তার ভাইয়ের কথার সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করল। ফুপুর দিকে তাকিয়ে শৈবাল বলল, ডিভোর্স যখন চূড়ান্ত তখন আমার একটা কথা না বললেই নয়।
এ কথা শুনে তাপসী ভেতরে ভেতরে একটু আঁতকে উঠল। তার বাবা মুখ তুলে তাকাল শৈবালের দিকে। ছোট ফুপু বললেন শৈবালকে, বল... কি বলতে চাও?
শৈবাল পকেট থেকে মোবাইল বের করল। মোবাইলের ভিডিও অপশনে গিয়ে একটা ফুটেজ চালু করে তাপসীর ছোট ফুপুর হাতে দিল। তাপসীর বাবা গলা বাড়িয়ে ভিডিও ফুটেজ দেখলেন কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে তিনি লজ্জা পেয়ে উঠে চলে যান। ছোট ফুপু এবার ভিডিও ফুটেজটা তাপসীকে দেখিয়ে বললেন, এসব কী?
তাপসী ফুটেজটা দেখেই বুঝে ফেলেছে এটা কবেকার ঘটনা। এ দৃশ্য যে গোপন ক্যামেরায় ধারণ হতে পারে তা কল্পনাও করেনি তাপসী। সে অপমান বোধে কেঁদে উঠল।
ছোট ফুপু মোবাইলটা শৈবালের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার আর দেখার দরকার নেই। আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।
তাপসীর মা মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। একটু আগে তিনিও ওই ভিডিও ফুটেজের যৎসামান্য দেখেছিলেন। তাপসীর মার দিকে তাকিয়ে ছোট ফুপু বললেন, এখন তো দেখছি সব দোষ শৈবালের নয়। তাপসীও কম অপকর্ম করেনি। আমি বুঝতে পারি না, আমাদের পরিবারের একটা মেয়ে কি করে এত নীচে নামতে পারে! ছিঃ
তাপসী অঝোর ধারায় কাঁদছে। তার কান্না দেখে শৈবালেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু শৈবালের আর কিছু করার ছিল না। তাপসী সব সময় শৈবালের নামে মিথ্যে অপবাদ দিত। নানা অভিযোগ করত বাপের বাড়িতে। এসব কারণে শ্বশুড়বাড়িতে অনেক হেনস্থা হয়েছে শৈবাল। তবুও সে কোনোদিন তাপসীর বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। কারও কাছে তাপসীর বদনাম করেনি। স্ত্রীকে কখনও ছোট করতে চায়নি শৈবাল। সে সব সময় চাইত, সংসারটা টিকে থাকুক। শৈবাল তার স্ত্রীকে শুধরাতে চাইত। এ নিয়েই সংসারে অশান্তি করত তাপসী। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিলকে তাল করত তাপসীর বাবা-মাও। বাবা-মা হিসেবে তারা কখনও সঠিক ঘটনার খোঁজ করেনি। তারা মেয়ের কথাতেই পরিচালিত হয়েছে। আজ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত না হলে, শৈবাল প্রমাণ উপস্থাপন না করলে হয়তো তারা আজীবনই তাপসীর এসব কর্মকাণ্ডের কথা জানত না। বা বুঝত না।
আমাদের সমাজে কিছু অভিবাবক আছেন যারা নিজের সন্তানকে ভাবেন পুতপবিত্র। আর অন্যের সন্তানকে খারাপ বানাতে পারলেই খুশি হন।
যাই হোক, সেদিন নিজের বাসায় ফিরে এসে একটুও মন খারাপ করেনি শৈবাল। বরং তার ভেতরটা হাল্কা হয়ে গেছে অনেকাংশে। এতগুলো বছর সে স্ত্রীর এসব কাজকর্ম হজম করে গেছে নীরবে। কাউকে বলতে পারেনি। তবুও সে স্ত্রীকে মনে-প্রাণে ভালোবাসত বলে সংসারটা ধরে রাখতে চেয়েছিল। সেটাও আর হল না।
দুইদিন পর শৈবাল ফোন দিল তাপসীকে। জিজ্ঞেস করল, আমার বাসা থেকে তোমার জিনিসপত্র কবে নিয়ে যাবে?
তাপসী বলল, বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে জানাব।
আরও দুইদিন পার হয়ে গেল। তাপসী কিছু জানায়নি। এর মাঝে শৈবাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ বাসা পরিবর্তন করে ফেলবে। বাড়িওয়ালাকে বলে দিয়েছে। আগামী মাসে নতুন বাসায় উঠবে। পুরনো স্মৃতি আগলে রাখার পক্ষপাতি নয় শৈবাল। এখন সে চায়, তাপসীর জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যাক তাপসী। বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজও দ্রুত স্বাক্ষর হয়ে যাক। শৈবালের মাও তাই চান। কিন্তু তাপসী কিংবা তার পরিবার একদম চুপ হয়ে গেছে। কারণটা বুঝতে পারছে না শৈবাল। তাই সে এক সন্ধ্যায় তাপসীর বাবাকে ফোন দিল। প্রথমে জানতে চাইল, তাপসীর জিনিসপত্রগুলো কবে নিয়ে যাওয়া হবে? তারপর জানতে চাইল, বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজে স্বাক্ষর হবে কবে?
তাপসীর বাবা জানালেন, তাপসীর সঙ্গে আলাপ করে তোমাকে সব জানানো হবে।
কিছুদিন পার হল। শৈবালকে কিছুই জানায় না তাপসী কিংবা তার পরিবার। শৈবাল অস্থিরতায় পড়ে গেল। এ মানসিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তি চায় সে। তাই তাপসীকে আবারও ফোন দিল শৈবাল।
ফোনে তাপসী সুন্দর করে কথা বলল শৈবালের সঙ্গে। দেখা করে বিস্তারিত আলাপের আগ্রহ প্রকাশ করল তাপসী। শৈবাল প্রথমে অনাগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে রাজি হল।
পরদিন বিকালে তারা দেখা করল। তাপসীর আলাপে মায়াবী টান। শৈবাল কোনো মায়া দেখাচ্ছে না। শৈবাল জানে, ডিভোর্স যখন হয়ে যাচ্ছে তখন আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?
কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাপসী ‘স্যরি’ চাইল। দু’চোখ বেয়ে অশ্র“ধারা ঝড়ছে তার। ধীরে ধীরে আকাশ গুমোট মেঘে কালো হয়ে গেল। সেদিকে খেয়াল নেই কারও। তারা তাদের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ কিংবা যুক্তি খণ্ডনে ব্যস্ত। লোকজনের জেনে যাওয়ার আশংকায় তারা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বসে আলাপ করছে না। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাদের আলাপচারিতা চলছে। হঠাৎ আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। শৈবাল তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ছাতা বের করল। বৃষ্টিতে এক ছাতার নিচে পাশাপাশি পথ চলতে লাগল শৈবাল ও তাপসী। কথায় কথায় তারা একটা মীমাংসায় এলো। ভাঙন নয়, তারা অতীতের ভুল-ভ্রান্তি শুধরে আরও শক্ত-পোক্ত করে গড়ে তুলবে নিজেদের সংসার।
শৈবালের মা ফোন রাখার ঘণ্টাখানেক পর তাপসীর বাবা ফোন করলেন শৈবালকে। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আগামীকাল ফ্রি আছ’?
আগামীকাল কখন?
সকালে...
হুম, আছি। ফ্রি আছি।
তাহলে সকাল দশটার দিকে আমাদের বাসায় চলে এসো।
ঠিক আছে- বলে ফোন রেখে মনে মনে একটু আশান্বিত হল শৈবাল। হয়তো কাল একটা সমাধান পাওয়া যাবে সমস্যার। যেহেতু শৈবালের মা ও তাপসীর আম্মুর ফোনালাপ হয়েছে সেহেতু বিষয়টা এখন মীসাংসার পর্যায়ে চলে এসেছে বলে ভাবা যায়।
আশায় বুক বাঁধে শৈবাল। চোখে নতুন স্বপ্ন ঝলমল করে যায়। পরদিন কিছুটা খুশি মনে তাপসীদের বাসায় হাজির হয় শৈবাল। কলিং বেল বাজার পর কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। ড্রইয়িংরুমে গিয়ে সোফায় বসল শৈবাল। টিভি চলছিল। একাকীত্ব ও টেলিভিশনের মাঝে একটা নিরেট জোগসাজশ রয়েছে। খালি রুমে একা একজন মানুষের সামনে টিভি চলতে থাকলে তাদের মাঝে একটা ভালো লাগা জন্মায়। যে কারণে তখন টিভিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না দেখালেও তাকিয়ে দেখে থাকার অনাগ্রহ জন্মায় না একা মানুষটির।
শৈবালও তাই তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে। একটু পর তাপসীর বাবা এলেন এখানে। শৈবাল সালাম দিয়ে কুশলাদী জানতে চাইল। এক কথা, দুই কথা হল তাদের। দু’জনেই কাছাকাছি সোফায় বসেছে এখন। দু’জনেরই নজর এখন টিভির দিকে।
টেলিভিশনের পর্দায় নজর রেখেও ভেতরে একটা শংকা কাজ করছে শৈবালের। একটু পরে কি ঘটবে এখানে? কবকিছু কি স্বাভাবিক থাকবে? নাকি ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি হবে?
একটু পরেই তাপসীর ছোট ফুপু এলেন। শৈবালের সঙ্গে সৌজন্য আলাপ করে পাশেই বসলেন। এর মাঝে কাজের মেয়ে ট্রেতে করে চা-বিস্কুট নিয়ে এলো।
সবাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে। কার মনে কী ঘুরপাক খাচ্ছে জানে না শৈবাল। সে শুধু নিজেরটা জানে। একটা চাপা উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। কী হবে কে জানে? নিজেকে শান্ত রাখার প্রতিজ্ঞা শৈবালের।
চা পান শেষ করে ফুপুই মুখ খুললেন। বললেন, আমরা তাহলে আসল বিষয়ে আলাপে আসি। কি বলেন বড় ভাইয়া?
এ কথা শুনে শৈবাল মুখ তুলে তাকাল তাপসীর ফুপুর দিকে। তাপসীর বাবা একবার শৈবালের চোখে চোখ রাখল, তারপর চোখ ঘুরিয়ে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ... শুরু কর।
তাপসীর ফুপু এবার শুরু করলেন। শৈবালের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে অবগত আছ। তারপরও তোমার কিছু বলার থাকলে বল। মানে, তাপসীর ব্যাপারে তোমার কি কি অভিযোগ আছে শুনি আগে?
শৈবাল বলল, আমার কোনো অভিযোগ নেই। তাছাড়া যাকে আমি ভালোবাসি। যাকে নিয়ে আমার সংসার করার বাসনা রয়েছে তার নামে অভিযোগ করব কেন? আমি এসেছি আমার স্ত্রীকে সংসারে ফিরিয়ে নিতে।
কিন্তু তোমার স্ত্রী যদি ফিরতে না চায় তখন তো আর কিছু করার নেই, বলল তাপসীর ফুপু।
কেন? তাপসী কি আমার সঙ্গে সংসার করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? প্রশ্ন করল শৈবাল।
তাপসীর বাবা কোনো কথা না বলে চুপ করে আছেন। কথা চলছে শৈবাল ও তাপসীর ছোট ফুপুর সঙ্গে। ফুপু বললেন, তাপসী আর ফিরতে চায় না তোমার সংসারে।
তাহলে সে কি চায়?
সে ডিভোর্স চায়।
ডিভোর্স! শৈবালের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। কী এমন ঘটনা ঘটেছে যার কারণে ডিভোর্সের মতো এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাপসী?
ঘটনা তোমার কাছে হয়তো বড় কিছু নয়। তাপসীর কাছে হয়তো অনেক বড় ব্যাপার। তুমি প্রায়শ তার গায়ে হাত তোলো...
ফুপুর কথা থামিয়ে দিয়ে শৈবাল বলল, প্রায়শ এ ঘটনা ঘটেনি। গত সাত বছরে সর্বোচ্চ সাত বার ঘটেছে হয়তো। এখন সে ব্যাপারে কথা উঠছে কেন? ওর সঙ্গে আমার শেষ ঝগড়া হয়েছে তিন মাস আগে। তখন তো আমাদের মারামারি হয়নি। আমাদের ঝগড়া হয়েছে অন্য এক প্রসঙ্গে। আমাকে অযথাই অপমান করেছিলেন তাপসীর মা।
তোমার শেষ ঝগড়া যা নিয়েই হোক না কেন, এখন তাপসীর কাছে বড় ইস্যু হল- তুমি তার গায়ে হাত তোলো।
শৈবাল বুঝে গেছে, এরা আসল ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে বিষয়টাকে অন্যদিকে মোড় নেওয়ানোর ফন্দি করেছে। ভেতরে ভেতরে অনেক রাগ জন্মাচ্ছে শেবালের। তবুও সে নিজেকে আয়ত্তে রাখছে বারবার।
না, আজকে ঝগড়ার দিন নয়। আজকে মীমাংসার দিন। গত রাতে মায়ের ফোনালাপে শৈবাল ভেবেছিল, বিষয়টা পজেটিভ হবে। এখন দেখা যাচ্ছে, ওরা গায়ের জোরে নেগেটিভ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে হয়তো। যা হওয়ার হবে। ভাগ্যকে মেনে নেবে। এ ভেবে শৈবাল বলল, আপনারা আমার শ্রদ্ধেয়। আপনাদের সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব। তবে আপনাদের জানানো ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি তাপসীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
এমন সময় তাপসীর মা এখানে এলেন।
ফুপু তখন তাকে বললেন, ভাবী... তাপসীকে একটু ডেকে আনবেন প্লিজ?
এ কথা শুনে তাপসীর মা ড্রইয়িংরুম ছেড়ে ভেতরে গেলেন। এ সময়টায় সবাই চুপ করে রইল। একটু পর তাপসীকে সঙ্গে নিয়ে এলো তার মা। ওরা মা-মেয়ে ড্রইয়িংরুমের ডিভানে বসল। তাপসী তার ফুপুকে জিজ্ঞেস করল, আমাকে এখানে ডেকেছ কেন?
ফুপু বললেন, তোর সিদ্ধান্ত জানতে। তাপসী বলল, তোমরা আমার অভিভাবক। তোমরা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমার সিদ্ধান্ত।
ফুপু বললেন, আমরা তো ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি শৈবালকে। তবুও সে তোর মুখে শুনতে চায় ডিভোর্সের ব্যাপারে।
তোমরা যা সিদ্ধান্ত দিয়েছ সেটাই আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, বলল তাপসী।
তখন তাপসীর দিকে তাকিয়ে শৈবাল প্রশ্ন করল, তুমি কি ডিভোর্স চাও?
হ্যাঁ। এটাই ফাইনাল।
কিন্তু কেন?
কারণ তুমি প্রতিদিন আমার গায়ে হাত তোলো মদ্যপ হয়ে। অনেক মেয়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আছে। এসব আমি আর মেনে নিতে পারছি না।
বেশ অবাক হয়ে শৈবাল প্রশ্ন করল, আমি প্রতিদিন কি তোমার গায়ে হাত তুলি? আমি কি প্রতিদিন মদ খাই?
শৈবালের চোখে তাকিয়ে জ্বলজ্বলে মিথ্যা সাক্ষ্য দিল তাপসী, হ্যাঁ... তুমি প্রতিদিন তাই কর।
ঠিক আছে, আমি ধরে নিলাম তোমার কথাই সত্য। এ জন্য আমি তোমার কাছে মাফ চাই। তোমার পরিবারের কাছেও ক্ষমা প্রার্থী। ক্ষমা পাওয়ার জন্য তুমি যা যা শর্ত দেবে আমি মাথা পেতে নেব, বলল শৈবাল।
তাপসী বলল, এখন এসব করে কোনো লাভ হবে না। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল।
আর তুমি যে আমার ব্যাপারে নারীঘটিত মিথ্যে স্ক্যান্ডাল দিচ্ছ তার একটা প্রমাণ দাও। একটা প্রমাণ দিতে পারলে আমি তোমার সব কথা মেনে নেব।
তাপসী প্রমাণ দিতে পারেনি। তবে শৈবালের চোখে চোখ রেখে সে আরও অনেক মিথ্যে অপবাদ দিল। শৈবাল চুপচাপ শুনল। সে বুঝে গেছে, আর কোনো কথায় কোনো লাভ হবে না। ওরা ডিভোর্সের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে এসে তাপসীর ছোট ফুপু বললেন, আর তো কথা বাকি নেই। তাহলে ডিভোর্সের বিষয়টা চূড়ান্ত। কাগজপত্র রেডি করা হোক। একটা দিন ঠিক করে তোমরা স্বাক্ষর করে ফেল। কি বল শৈবাল?
শৈবাল বলল, আমার তো আর কিছু বলার নেই। আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা যদি উভয়ের জন্য মঙ্গল হয়, তবে তাই হোক।
তাপসীর বাবা বললেন, আমি আজকে অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথা বলব। ডিভোর্সের কাগজপত্র রেডি করে তোমাকে খবর দেব। তুমি তখন এসো।
শৈবাল আবারও তাপসীকে জিজ্ঞেস করল, তাহলে ডিভোর্সটাই ফাইনাল?
তাপসী বলল, হুম, ফাইনাল।
শৈবাল এবার তাপসীর বাবা ও ছোট ফুপুর দিকে তাকাল। আবার প্রশ্ন করল, এটাই তাহলে ফাইনাল?
তাপসীর বাবা বললেন, ফাইনাল ডিসিশান তো হয়ে গেল।
তাপসীর ছোট ফুপুও তার ভাইয়ের কথার সঙ্গে সম্মতি জ্ঞাপন করল। ফুপুর দিকে তাকিয়ে শৈবাল বলল, ডিভোর্স যখন চূড়ান্ত তখন আমার একটা কথা না বললেই নয়।
এ কথা শুনে তাপসী ভেতরে ভেতরে একটু আঁতকে উঠল। তার বাবা মুখ তুলে তাকাল শৈবালের দিকে। ছোট ফুপু বললেন শৈবালকে, বল... কি বলতে চাও?
শৈবাল পকেট থেকে মোবাইল বের করল। মোবাইলের ভিডিও অপশনে গিয়ে একটা ফুটেজ চালু করে তাপসীর ছোট ফুপুর হাতে দিল। তাপসীর বাবা গলা বাড়িয়ে ভিডিও ফুটেজ দেখলেন কিছুক্ষণ। এক পর্যায়ে তিনি লজ্জা পেয়ে উঠে চলে যান। ছোট ফুপু এবার ভিডিও ফুটেজটা তাপসীকে দেখিয়ে বললেন, এসব কী?
তাপসী ফুটেজটা দেখেই বুঝে ফেলেছে এটা কবেকার ঘটনা। এ দৃশ্য যে গোপন ক্যামেরায় ধারণ হতে পারে তা কল্পনাও করেনি তাপসী। সে অপমান বোধে কেঁদে উঠল।
ছোট ফুপু মোবাইলটা শৈবালের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার আর দেখার দরকার নেই। আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।
তাপসীর মা মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। একটু আগে তিনিও ওই ভিডিও ফুটেজের যৎসামান্য দেখেছিলেন। তাপসীর মার দিকে তাকিয়ে ছোট ফুপু বললেন, এখন তো দেখছি সব দোষ শৈবালের নয়। তাপসীও কম অপকর্ম করেনি। আমি বুঝতে পারি না, আমাদের পরিবারের একটা মেয়ে কি করে এত নীচে নামতে পারে! ছিঃ
তাপসী অঝোর ধারায় কাঁদছে। তার কান্না দেখে শৈবালেরও খারাপ লাগছে। কিন্তু শৈবালের আর কিছু করার ছিল না। তাপসী সব সময় শৈবালের নামে মিথ্যে অপবাদ দিত। নানা অভিযোগ করত বাপের বাড়িতে। এসব কারণে শ্বশুড়বাড়িতে অনেক হেনস্থা হয়েছে শৈবাল। তবুও সে কোনোদিন তাপসীর বিরুদ্ধে মুখ খোলেনি। কারও কাছে তাপসীর বদনাম করেনি। স্ত্রীকে কখনও ছোট করতে চায়নি শৈবাল। সে সব সময় চাইত, সংসারটা টিকে থাকুক। শৈবাল তার স্ত্রীকে শুধরাতে চাইত। এ নিয়েই সংসারে অশান্তি করত তাপসী। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিলকে তাল করত তাপসীর বাবা-মাও। বাবা-মা হিসেবে তারা কখনও সঠিক ঘটনার খোঁজ করেনি। তারা মেয়ের কথাতেই পরিচালিত হয়েছে। আজ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত না হলে, শৈবাল প্রমাণ উপস্থাপন না করলে হয়তো তারা আজীবনই তাপসীর এসব কর্মকাণ্ডের কথা জানত না। বা বুঝত না।
আমাদের সমাজে কিছু অভিবাবক আছেন যারা নিজের সন্তানকে ভাবেন পুতপবিত্র। আর অন্যের সন্তানকে খারাপ বানাতে পারলেই খুশি হন।
যাই হোক, সেদিন নিজের বাসায় ফিরে এসে একটুও মন খারাপ করেনি শৈবাল। বরং তার ভেতরটা হাল্কা হয়ে গেছে অনেকাংশে। এতগুলো বছর সে স্ত্রীর এসব কাজকর্ম হজম করে গেছে নীরবে। কাউকে বলতে পারেনি। তবুও সে স্ত্রীকে মনে-প্রাণে ভালোবাসত বলে সংসারটা ধরে রাখতে চেয়েছিল। সেটাও আর হল না।
দুইদিন পর শৈবাল ফোন দিল তাপসীকে। জিজ্ঞেস করল, আমার বাসা থেকে তোমার জিনিসপত্র কবে নিয়ে যাবে?
তাপসী বলল, বাবা-মার সঙ্গে কথা বলে জানাব।
আরও দুইদিন পার হয়ে গেল। তাপসী কিছু জানায়নি। এর মাঝে শৈবাল সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ বাসা পরিবর্তন করে ফেলবে। বাড়িওয়ালাকে বলে দিয়েছে। আগামী মাসে নতুন বাসায় উঠবে। পুরনো স্মৃতি আগলে রাখার পক্ষপাতি নয় শৈবাল। এখন সে চায়, তাপসীর জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যাক তাপসী। বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজও দ্রুত স্বাক্ষর হয়ে যাক। শৈবালের মাও তাই চান। কিন্তু তাপসী কিংবা তার পরিবার একদম চুপ হয়ে গেছে। কারণটা বুঝতে পারছে না শৈবাল। তাই সে এক সন্ধ্যায় তাপসীর বাবাকে ফোন দিল। প্রথমে জানতে চাইল, তাপসীর জিনিসপত্রগুলো কবে নিয়ে যাওয়া হবে? তারপর জানতে চাইল, বিবাহ বিচ্ছেদের কাগজে স্বাক্ষর হবে কবে?
তাপসীর বাবা জানালেন, তাপসীর সঙ্গে আলাপ করে তোমাকে সব জানানো হবে।
কিছুদিন পার হল। শৈবালকে কিছুই জানায় না তাপসী কিংবা তার পরিবার। শৈবাল অস্থিরতায় পড়ে গেল। এ মানসিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তি চায় সে। তাই তাপসীকে আবারও ফোন দিল শৈবাল।
ফোনে তাপসী সুন্দর করে কথা বলল শৈবালের সঙ্গে। দেখা করে বিস্তারিত আলাপের আগ্রহ প্রকাশ করল তাপসী। শৈবাল প্রথমে অনাগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে রাজি হল।
পরদিন বিকালে তারা দেখা করল। তাপসীর আলাপে মায়াবী টান। শৈবাল কোনো মায়া দেখাচ্ছে না। শৈবাল জানে, ডিভোর্স যখন হয়ে যাচ্ছে তখন আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?
কথাবার্তার এক পর্যায়ে তাপসী ‘স্যরি’ চাইল। দু’চোখ বেয়ে অশ্র“ধারা ঝড়ছে তার। ধীরে ধীরে আকাশ গুমোট মেঘে কালো হয়ে গেল। সেদিকে খেয়াল নেই কারও। তারা তাদের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ কিংবা যুক্তি খণ্ডনে ব্যস্ত। লোকজনের জেনে যাওয়ার আশংকায় তারা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে বসে আলাপ করছে না। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাদের আলাপচারিতা চলছে। হঠাৎ আকাশ ভেঙে ঝুম বৃষ্টি নামল। শৈবাল তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে ছাতা বের করল। বৃষ্টিতে এক ছাতার নিচে পাশাপাশি পথ চলতে লাগল শৈবাল ও তাপসী। কথায় কথায় তারা একটা মীমাংসায় এলো। ভাঙন নয়, তারা অতীতের ভুল-ভ্রান্তি শুধরে আরও শক্ত-পোক্ত করে গড়ে তুলবে নিজেদের সংসার।
No comments