রাজনৈতিক পরিস্থিতি- কানাগলি থেকে রাজনীতিকে রাজপথে আনাই কাজ by আবুল মোমেন
বাংলাদেশের
রাজনীতি এখন কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে। বাস্তবে যেমন দেখা যায়, দুই মারমুখী
প্রতিদ্বন্দ্বী একে অন্যকে শেষ করে দেওয়ার জেদ ধরলে শেষ পর্যন্ত কানাগলিতে
এসে ঠেকে, এ-ও যেন তেমনই। আমরা কি একটা চূড়ান্ত চরম শেষ দৃশ্যের
অপেক্ষায় থাকব? দৃশ্যটা কেমন হবে; কতটা বর্বর, নিষ্ঠুর, রক্তাক্ত হতে
পারে?
চরম শেষ দৃশ্যের আগেই অনেক রক্ত ঝরছে, নিষ্ঠুরতা চলছে, ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে। তার পরও উভয় জোট, অন্তত দুই জোটের প্রধান দুই নেত্রী পরস্পরের বিরোধিতা করে চলেছেন। ফলে অবিশ্বাস্য হলেও মনে হচ্ছে, চরম কোনো পরিণতি ঘটে যাবে যেকোনো সময়। কেমন হবে তা, সেটাই ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ ভাবছে।
জনগণই যদি দেশের মালিক হয়ে থাকে, যদি সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয় তারাই এবং শেষ বিচারের অধিকার থাকে তাদের ওপরই, তাহলে এই পরিণতির দায় কি তারাও এড়াতে পারে? অন্তত চরম ও শেষ দৃশ্য ঠেকানোয় তাদের কি কিছুই করণীয় নেই?
এ দেশের জনগণ কোনোকালে, অন্তত রাজনীতির ক্ষেত্রে, ঠুঁটো জগন্নাথ ছিল না। তারা সুযোগ পেলে কেবল সঠিক রায়ই দেয়নি, যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়ে ইতিহাসের বাঁক ফিরিয়েছে। তাহলে এ ক্ষেত্রে কেন তারা পড়ে পড়ে মার খাবে?
বলা যায়, রাজনীতিবিদেরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরাই ক্ষমতার লোভে মত্ত হয়ে রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করেছেন, নিজেদের দৈন্য ঢাকতে স্বার্থমগ্ন হয়েছেন এবং দুর্বল রিক্ত মানুষে পরিণত হয়ে সতর্ক পাহারায় রাজনীতিকে টেনে এনেছেন কানাগলিতে। এ-ও বলে দেওয়া যায়, তাঁদের আর সাধ্য নেই রাজনীতিকে আবার কানাগলি থেকে রাজপথে ফিরিয়ে আনার। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের আচরণ হতে পারে দুই রকম। প্রথমত তারা নিষ্ঠুরতার পথ ধরে, যা উভয় দিক থেকেই এখন চলছে। অথবা, ভিতুর দল আপাতত ক্ষান্তি দেওয়া বা যতি টানার জন্য সম্মানজনক নিষ্ক্রমণ পথ খুঁজবে। আপাতত এই দ্বিতীয় পথটি তারা ধরলে সাধারণ মানুষ হাঁপ ছাড়বে বলে মনে হয়।
কিন্তু এ কোনো চূড়ান্ত পরিণতি হবে না, এ হবে মুষ্টিযুদ্ধ বা কুস্তির একটি রাউন্ডের বিরতির মতো। যেকোনো সময় ঘণ্টা বাজবে, এই স্থিতাবস্থা ভেঙে পড়বে এবং আবারও রাজনীতির অস্থিরতা সংঘাতের দিকে গড়িয়ে রাজনীতিকে টেনে নেবে কানাগলিতে।
রাজনীতিকে কানাগলি থেকে বের করে রাজপথে ফিরিয়ে আনার পথ হতে পারে দুটি। রাজনীতির জগৎ থেকেই কোনো নেতৃত্ব—তা দুই জোটের যে কারও কাছ থেকেও হতে পারে, পারে এর বাইরে থেকেও আসতে—যদি জনমানুষের মনের কথাগুলো তুলে ধরে তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ভাষ্য ও কর্মসূচি দিতে পারে, তবে মানুষ তা শুনবে। দ্বিতীয় পথটিও খোলা আছে। নাগরিক সমাজ থেকেই জনগণকে জাগিয়ে তুলে রাজনৈতিক ভাষ্য ও কর্মসূচি হাজির করা যায়, যেমনটা ঘটেছিল ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে।
আমরা জানি, ক্ষমতার লড়াইয়ে সর্বস্ব বাজি ধরে দুই জোট এতটাই মগ্ন ও লিপ্ত যে লড়াইয়ের রিঙের বাইরের সম্ভাবনাগুলো নিয়ে নিরীক্ষা চালানোর সাহস পায় না তারা। বরং বিকল্প শক্তিকেন্দ্রের উত্থান গণ্য করে গণজাগরণ মঞ্চকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালিয়ে সেটিকে প্রায় অকেজো করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
লড়াই জারি থাকলে তা চলবে, পরিণামে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়বে, তাতে হানাহানিও চলতে থাকবে। আমরা বুঝতে পারি সংগঠন-কর্মীর জোরে তারতম্য থাকলেও দুই জোটের ভোটার ও সমর্থকের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। তারা এতটাই কাছাকাছি যে কোনো নির্বাচনেই কেউই জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না। ফলে উভয় জোটের মধ্যে নির্বাচনভীতি কাজ করে, এবং ক্ষমতায় থাকলে তারা তা ছাড়তে ভয় পায়, অগত্যা ছাড়তে হলে ছাড়ার আগে জয়ের জন্য ক্ষমতার অপপ্রয়োগের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। ফলে গত দুই যুগে অনেক নির্বাচন, বলা যায় সুষ্ঠুভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও, কোনো জোটকে দিয়েই পরাজয় স্বীকার করানো যায়নি। জয়ী দল তো জয় নিয়ে মাতোয়ারা হবেই, কিন্তু গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার সংস্কৃতি সচল রাখা। সেটা চালুই হয়নি আমাদের দেশে।
সোজাসাপ্টা বিচারে বলা যায়, বাংলাদেশের দুই বড় দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। এ দলই পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে ধারণ ও লালন করেছে, এবং দেশকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিপরীতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস জেলহত্যার বিচার বন্ধ রাখা এবং খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কাজে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২৪টি খুন ও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা এবং তার বিচার–প্রক্রিয়া নিয়ে বর্তমান বিএনপি নেতৃত্বের ভূমিকাও তর্কাতীত নয়। পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চের মতো দেশপ্রেমিক গণজাগরণের স্বাভাবিক রাজনৈতিক সুফল তো বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের পাতে আসার সুযোগই বেশি থেকে যাবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কেবল ক্ষমতার লড়াইয়ে দৃষ্টি ও শক্তি নিবদ্ধ থাকায় নেতৃত্ব এই সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহারে ব্যর্থ হচ্ছেন। কেবল ব্যর্থ হচ্ছেন তা নয়, তাঁরা প্রতিপক্ষের কৌশলগুলোকে নিজেরাই আত্মস্থ করে নিচ্ছেন, যেমন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, র্যাব-পুলিশের অতিরিক্ত ব্যবহার, গোয়েন্দানির্ভরতা, সংগঠন ও কর্মীদের উপেক্ষা করে আমলানির্ভরতা ইত্যাদি।
এতে আখেরে তাঁদেরই ক্ষতি হয়েছে। মানুষ দুই দলের মধ্যে পার্থক্য তেমন দেখতে পায় না, দুই নেত্রীকে এক কাতারে রেখে বিচারে অভ্যস্ত হচ্ছে, এমনকি বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার মধ্যকার অসমতা-অসামঞ্জস্য বুঝেও ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছে না। সামাজিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ, ধর্মনিরপেক্ষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈসাদৃশ্য অনেক স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ আওয়ামী লীগের পার্থক্য কেবল পরিমাণগত নয়, গুণগতই।
কিন্তু ঘুরেফিরে প্রশ্ন তো উঠবে দুটো—রাজনীতিকে কানাগলি থেকে রাজপথে আনার উপায় কী? এবং আনবে কে বা কারা? কানাগলির রাজনীতি ভাড়াটে খুনি-মাস্তান-বোমাবাজদের হাতেই থাকবে।
খালেদা জিয়া ও বিএনপির জন্য এ কাজ যে অসম্ভব, তা বলব না। তবে হ্যাঁ, তাদের জন্য কাজটা বেশ কঠিন, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার সমন্বয় ছাড়া এটা সম্ভব নয়। দলকে প্রায় নবায়ন, প্রায় খোলনলচে বদলানোর মতো মহাযজ্ঞ সারতে হবে তাঁকে। এ ছাড়া শর্টকাট কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না।
আওয়ামী লীগ সরকার কি তাদের ক্রমাগত পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসারনির্ভরতা বেড়ে চলার পরিণতিটা বুঝতে পারছে? কারণ, গণতন্ত্র নয়, ফ্যাসিবাদের পথ ওটা। মনের ভয় ঝেড়ে আমলা-এজেন্সিনির্ভরতা ক্রমে বাদ দিয়ে দলের সৎ, দক্ষ নেতা-কর্মী এবং দলবহির্ভূত সম–আদর্শের দক্ষ, সৎ মানুষের মৈত্রীর পথ ক্রমেই উন্মুক্ত করে ষাটের দশকের মতো গণজাগরণের পথ তৈরি করেই জাতীয় ঐক্যের পথ রচনা করতে হবে। তাতে আপনা-আপনিই দুর্বল হয়ে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় অবিশ্বাসী দল। তাতে কর্তৃত্ববাদী পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের অপবাদের কলঙ্ক গায়ে না মেখেই বহুকালের জন্য বিজয়ী হওয়া সম্ভব।
সরকারকে সময় থাকতেই বুঝতে হবে প্রকৃত বিজয়ের এটাই পথ। আর প্রকৃত বিজয় ঘটলে ৬০ বছর আগে এ দেশে যেভাবে মুসলিম লীগ নামের অপশক্তির ভরাডুবি ঘটেছিল, চিরতরে তার পুনরাবৃত্তি হওয়া অসম্ভব নয়। বরং সেটাই বেশি সম্ভাব্য পরিণতি বলে মনে হয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
চরম শেষ দৃশ্যের আগেই অনেক রক্ত ঝরছে, নিষ্ঠুরতা চলছে, ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে। তার পরও উভয় জোট, অন্তত দুই জোটের প্রধান দুই নেত্রী পরস্পরের বিরোধিতা করে চলেছেন। ফলে অবিশ্বাস্য হলেও মনে হচ্ছে, চরম কোনো পরিণতি ঘটে যাবে যেকোনো সময়। কেমন হবে তা, সেটাই ভীতসন্ত্রস্ত জনগণ ভাবছে।
জনগণই যদি দেশের মালিক হয়ে থাকে, যদি সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয় তারাই এবং শেষ বিচারের অধিকার থাকে তাদের ওপরই, তাহলে এই পরিণতির দায় কি তারাও এড়াতে পারে? অন্তত চরম ও শেষ দৃশ্য ঠেকানোয় তাদের কি কিছুই করণীয় নেই?
এ দেশের জনগণ কোনোকালে, অন্তত রাজনীতির ক্ষেত্রে, ঠুঁটো জগন্নাথ ছিল না। তারা সুযোগ পেলে কেবল সঠিক রায়ই দেয়নি, যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়ে ইতিহাসের বাঁক ফিরিয়েছে। তাহলে এ ক্ষেত্রে কেন তারা পড়ে পড়ে মার খাবে?
বলা যায়, রাজনীতিবিদেরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরাই ক্ষমতার লোভে মত্ত হয়ে রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্ন করেছেন, নিজেদের দৈন্য ঢাকতে স্বার্থমগ্ন হয়েছেন এবং দুর্বল রিক্ত মানুষে পরিণত হয়ে সতর্ক পাহারায় রাজনীতিকে টেনে এনেছেন কানাগলিতে। এ-ও বলে দেওয়া যায়, তাঁদের আর সাধ্য নেই রাজনীতিকে আবার কানাগলি থেকে রাজপথে ফিরিয়ে আনার। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের আচরণ হতে পারে দুই রকম। প্রথমত তারা নিষ্ঠুরতার পথ ধরে, যা উভয় দিক থেকেই এখন চলছে। অথবা, ভিতুর দল আপাতত ক্ষান্তি দেওয়া বা যতি টানার জন্য সম্মানজনক নিষ্ক্রমণ পথ খুঁজবে। আপাতত এই দ্বিতীয় পথটি তারা ধরলে সাধারণ মানুষ হাঁপ ছাড়বে বলে মনে হয়।
কিন্তু এ কোনো চূড়ান্ত পরিণতি হবে না, এ হবে মুষ্টিযুদ্ধ বা কুস্তির একটি রাউন্ডের বিরতির মতো। যেকোনো সময় ঘণ্টা বাজবে, এই স্থিতাবস্থা ভেঙে পড়বে এবং আবারও রাজনীতির অস্থিরতা সংঘাতের দিকে গড়িয়ে রাজনীতিকে টেনে নেবে কানাগলিতে।
রাজনীতিকে কানাগলি থেকে বের করে রাজপথে ফিরিয়ে আনার পথ হতে পারে দুটি। রাজনীতির জগৎ থেকেই কোনো নেতৃত্ব—তা দুই জোটের যে কারও কাছ থেকেও হতে পারে, পারে এর বাইরে থেকেও আসতে—যদি জনমানুষের মনের কথাগুলো তুলে ধরে তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ভাষ্য ও কর্মসূচি দিতে পারে, তবে মানুষ তা শুনবে। দ্বিতীয় পথটিও খোলা আছে। নাগরিক সমাজ থেকেই জনগণকে জাগিয়ে তুলে রাজনৈতিক ভাষ্য ও কর্মসূচি হাজির করা যায়, যেমনটা ঘটেছিল ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে।
আমরা জানি, ক্ষমতার লড়াইয়ে সর্বস্ব বাজি ধরে দুই জোট এতটাই মগ্ন ও লিপ্ত যে লড়াইয়ের রিঙের বাইরের সম্ভাবনাগুলো নিয়ে নিরীক্ষা চালানোর সাহস পায় না তারা। বরং বিকল্প শক্তিকেন্দ্রের উত্থান গণ্য করে গণজাগরণ মঞ্চকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা চালিয়ে সেটিকে প্রায় অকেজো করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
লড়াই জারি থাকলে তা চলবে, পরিণামে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ বাড়বে, তাতে হানাহানিও চলতে থাকবে। আমরা বুঝতে পারি সংগঠন-কর্মীর জোরে তারতম্য থাকলেও দুই জোটের ভোটার ও সমর্থকের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। তারা এতটাই কাছাকাছি যে কোনো নির্বাচনেই কেউই জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না। ফলে উভয় জোটের মধ্যে নির্বাচনভীতি কাজ করে, এবং ক্ষমতায় থাকলে তারা তা ছাড়তে ভয় পায়, অগত্যা ছাড়তে হলে ছাড়ার আগে জয়ের জন্য ক্ষমতার অপপ্রয়োগের সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। ফলে গত দুই যুগে অনেক নির্বাচন, বলা যায় সুষ্ঠুভাবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও, কোনো জোটকে দিয়েই পরাজয় স্বীকার করানো যায়নি। জয়ী দল তো জয় নিয়ে মাতোয়ারা হবেই, কিন্তু গণতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরাজয় স্বীকার করে নেওয়ার সংস্কৃতি সচল রাখা। সেটা চালুই হয়নি আমাদের দেশে।
সোজাসাপ্টা বিচারে বলা যায়, বাংলাদেশের দুই বড় দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। এ দলই পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে ধারণ ও লালন করেছে, এবং দেশকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। বিপরীতে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ও নৃশংস জেলহত্যার বিচার বন্ধ রাখা এবং খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার কাজে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভূমিকা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২৪টি খুন ও শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা এবং তার বিচার–প্রক্রিয়া নিয়ে বর্তমান বিএনপি নেতৃত্বের ভূমিকাও তর্কাতীত নয়। পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চের মতো দেশপ্রেমিক গণজাগরণের স্বাভাবিক রাজনৈতিক সুফল তো বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের পাতে আসার সুযোগই বেশি থেকে যাবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কেবল ক্ষমতার লড়াইয়ে দৃষ্টি ও শক্তি নিবদ্ধ থাকায় নেতৃত্ব এই সুযোগগুলোর সদ্ব্যবহারে ব্যর্থ হচ্ছেন। কেবল ব্যর্থ হচ্ছেন তা নয়, তাঁরা প্রতিপক্ষের কৌশলগুলোকে নিজেরাই আত্মস্থ করে নিচ্ছেন, যেমন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, র্যাব-পুলিশের অতিরিক্ত ব্যবহার, গোয়েন্দানির্ভরতা, সংগঠন ও কর্মীদের উপেক্ষা করে আমলানির্ভরতা ইত্যাদি।
এতে আখেরে তাঁদেরই ক্ষতি হয়েছে। মানুষ দুই দলের মধ্যে পার্থক্য তেমন দেখতে পায় না, দুই নেত্রীকে এক কাতারে রেখে বিচারে অভ্যস্ত হচ্ছে, এমনকি বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার মধ্যকার অসমতা-অসামঞ্জস্য বুঝেও ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছে না। সামাজিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গেই সাদৃশ্যপূর্ণ, ধর্মনিরপেক্ষ দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈসাদৃশ্য অনেক স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের সঙ্গে এ আওয়ামী লীগের পার্থক্য কেবল পরিমাণগত নয়, গুণগতই।
কিন্তু ঘুরেফিরে প্রশ্ন তো উঠবে দুটো—রাজনীতিকে কানাগলি থেকে রাজপথে আনার উপায় কী? এবং আনবে কে বা কারা? কানাগলির রাজনীতি ভাড়াটে খুনি-মাস্তান-বোমাবাজদের হাতেই থাকবে।
খালেদা জিয়া ও বিএনপির জন্য এ কাজ যে অসম্ভব, তা বলব না। তবে হ্যাঁ, তাদের জন্য কাজটা বেশ কঠিন, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার সমন্বয় ছাড়া এটা সম্ভব নয়। দলকে প্রায় নবায়ন, প্রায় খোলনলচে বদলানোর মতো মহাযজ্ঞ সারতে হবে তাঁকে। এ ছাড়া শর্টকাট কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না।
আওয়ামী লীগ সরকার কি তাদের ক্রমাগত পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-আনসারনির্ভরতা বেড়ে চলার পরিণতিটা বুঝতে পারছে? কারণ, গণতন্ত্র নয়, ফ্যাসিবাদের পথ ওটা। মনের ভয় ঝেড়ে আমলা-এজেন্সিনির্ভরতা ক্রমে বাদ দিয়ে দলের সৎ, দক্ষ নেতা-কর্মী এবং দলবহির্ভূত সম–আদর্শের দক্ষ, সৎ মানুষের মৈত্রীর পথ ক্রমেই উন্মুক্ত করে ষাটের দশকের মতো গণজাগরণের পথ তৈরি করেই জাতীয় ঐক্যের পথ রচনা করতে হবে। তাতে আপনা-আপনিই দুর্বল হয়ে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় অবিশ্বাসী দল। তাতে কর্তৃত্ববাদী পুলিশি রাষ্ট্র কায়েমের অপবাদের কলঙ্ক গায়ে না মেখেই বহুকালের জন্য বিজয়ী হওয়া সম্ভব।
সরকারকে সময় থাকতেই বুঝতে হবে প্রকৃত বিজয়ের এটাই পথ। আর প্রকৃত বিজয় ঘটলে ৬০ বছর আগে এ দেশে যেভাবে মুসলিম লীগ নামের অপশক্তির ভরাডুবি ঘটেছিল, চিরতরে তার পুনরাবৃত্তি হওয়া অসম্ভব নয়। বরং সেটাই বেশি সম্ভাব্য পরিণতি বলে মনে হয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments