পুরস্কার পেলেও লিখব না পেলেও লিখে যাব -জাকির তালুকদার by জুননু রাইন
(বিভিন্ন শাখায় এ বছর বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়েছে ৭ জনকে। কবিতায় শিহাব সরকার, কথাসাহিত্যে জাকির তালুকদার,
শিশুসাহিত্যে খালেক বিন জয়েনউদদীন, প্রবন্ধে শান্তনু কায়সার, গবেষণায়
ভূঁইয়া ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাহিত্যে আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এবং
ভ্রমণ সাহিত্যে মঈনুস সুলতানকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এদের মধ্যে থেকে
সৃজনশীল শাখায় পুরস্কারপ্রাপ্ত তিনজনের সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার পাঠকদের জন্য
পত্রস্থ হল) পুরস্কার দেয়া এবং পুরস্কারপ্রাপ্তি এ দুটো বিষয়
আপনাকে কীভাবে নাড়া দেয়? আপনার মতে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার কখন কতটা
ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে?
: এ বিষয়ে কোনো স্বতঃসিদ্ধ সূত্র আমার জানা নেই। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি যে কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তিই আমার ওপর বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। পুরস্কার পেলেও লিখব, না পেলেও লিখে যাব। তবে অপ্রত্যক্ষ একটি ভালো প্রভাব রয়েছে পুরস্কার পাওয়ার। আমার লেখালেখির কারণে পরিবার এবং স্বজনরা অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে। তারা এই পুরস্কারটাকে নিজেদের প্রাপ্য বলে মনে করে খুশি হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী কথাসাহিত্যে মৌলিক পার্থক্য বা বৈচিত্র্য যদি ভাবা হয়, আপনি কোন বিষয়টি বেশি প্রাধান্য দেবেন এবং কেন?
: বাংলাদেশের স্বাধীনতা এই বাণী পৌঁছে দিয়েছে যে, বাংলা সম্পর্কিত সবকিছুর দায়দায়িত্ব এই ভূখণ্ডের মানুষদেরই নিতে হবে। কারণ হাজার বছর পরে বাঙালি প্রথম নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বাংলাদেশ নামে। কাজেই বাঙালির মানসিকতাতে পরিবর্তন আসতেই হবে। পরিবর্তন আসবে উপন্যাসেও। তবে মনে রাখতে হবে যে রাতারাতি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসে না। চোখে পড়ার মতো যে পরিবর্তনটা হয়েছে, তা হচ্ছে একরৈখিক উপন্যাসের ছক থেকে বেরিয়ে আসছেন আমাদের অনেক লেখক। লিখছেন নন-ফিকশক ফিকশন, লিখছেন মধ্যযুগের কথকতা এবং পাঁচালির আঙ্গিকের উপন্যাস।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। লেখা হচ্ছে এই বিষয়ে অনেক সাহিত্য দরকার বলে, নাকি এই বিষয়ে প্রকৃত সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠছে না বলে?
: অনেক লেখা হচ্ছে বটে, তবে তা কেবল সংখ্যাতেই। গুণগতমানে শিখর স্পর্শী লেখার সংখ্যা খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন অবশ্যই। কিন্তু যেভাবে লেখা হচ্ছে তার পেছনের প্রবণতা খুবই বিরক্তিকর। যে না, আমারও এই বিষয়ে একটা লেখা থাকা দরকার। বিষয়টি বাজারচলতি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাঠকের কাছে কোনো মহৎ বার্তা এসব লেখা পৌঁছে দিতে পারে না।
সাইফাই’-এর এই সময়ে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোন পর্যায়ে?
: সাহিত্যকে চিরকালই অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পথ চলতে হয়েছে। এখন আপনার ভাষায় ‘সাইফাই’ নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তবে এর ফলে বেকায়দায় পড়েছেন মূলত বিনোদন লেখকরা। কারণ বিনোদনের নানা উপায় বেরিয়ে যাওয়ায় এখন আর সাহিত্য থেকে বিনোদন কেউ খোঁজে না। তার জন্য নানা মাধ্যম তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু সিরিয়াস সাহিত্য বা প্রকৃত সাহিত্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত এখন পর্যন্ত হয়নি।
মানবিক সাহিত্যের তুলনায় নান্দনিক সাহিত্যের পরিমাণ কি পর্যাপ্ত? এর চাহিদা মেটানোর সম্ভাবনা কি দেখছেন?
: নান্দনিক সাহিত্য চাহিদার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে লেখকের যোগ্যতা, মানসিকতা, শিল্পবোধ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ ইত্যাদির ওপর। তেমন লেখক যত আবির্ভূত হবেন, নান্দনিক সাহিত্যের সৃষ্টি তত বাড়বে। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই।
সাহিত্যে আপনার অনুজদের জন্য কিছু বলার আছে?
: অনুজদের জন্য আমার বলার কথা হচ্ছে সাহিত্যে কোনো শর্টকাট পথ নেই। সবাইকে বুকে হেঁটে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েই এগোতে হবে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ভালো সাহিত্য সৃষ্টি করার জন্য কোনো ভিন্ন নেশা ধরার দরকার নেই। বরং সুস্থ শরীর এবং মন দরকার।
কোনো সৃষ্টিই পুরস্কারের মানদণ্ড হওয়া উচিত নয়
খালেক বিন জয়েনউদদীন
পুরস্কার দেয়া এবং পুরস্কার প্রাপ্তি এ দুটো বিষয় আপনাকে কিভাবে নাড়া দেয়? আপনার মতে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার কখন কতোটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে?
: আমি শিশু সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পুরস্কার পেয়েছি। কোনো সৃষ্টিই এই পুরস্কারের মানদণ্ড হওয়া উচিত নয়। পাঠকের কাছে লেখা আদৃত হলেই লেখকের খুশি হওয়ার কথা। ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়টি এখানে গৌণ।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের বর্তমান গতিপ্রকৃতি নিয়ে আপনার মুগ্ধতা উদ্বেগ বা নতুন চিন্তা থাকলে তা জানতে চাই।
: দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি স্বল্প পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শিশু সাহিত্য গত ৪০ বছরে অনেক বাঁক পেরিয়ে বর্তমান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা এবং বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়টি শিশু সাহিত্য রচনায় প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছে। এ কারণেই আমাদের শিশু সাহিত্যের বড় অংশটি মুক্তিযুদ্ধের।
কল্পকাহিনীর বদলে জীবন কাহিনী এখানে বারবার বিধৃত করা হয়েছে। গত ৪ দশকের ছড়া কবিতা আপন বৈভবে সমুজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিভ্রান্তি গত কয়েক বছরে অনেকটা সুধরেছে। আমাদের শিশুসাহিত্যে এই বিষয়টি অনেকেই তুলে ধরেছেন।
আপনি তো বর্তমানে কচিকাঁচার আসর সম্পাদনা করেন। এই পাতাটি আমৃত্যু সম্পাদনা করেছেন প্রখ্যাত শিশু সংগঠক ও সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত শিশু পাতাগুলো কি বাগবান ভাই,দাদাভাই, দাদুভাই, আফলাতুন ভাই অথবা ভাইয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত সে সময়কার শিশুপাতাগুলোর মান, ঐতিহ্য ও আন্তরিকতা ধরে রাখতে পেরেছে?
এর সাফল্য অথবা ব্যর্থতার কথা বলুন।
: না, বাগবান ভাই, দাদাভাই, হাবীব ভাই, এখলাস ভাই, আফলাতুন, বজলু ভাই ও সেলিনা হোসেন কিংবা দাদুভাই ছোটদের যেসব পাতা সম্পাদনা করতেন, তার চেয়ে অনেক নিুমানের পাতা আমরা সম্পাদনা করছি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও আমরা সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারিনি। সাফল্য নেই, ব্যর্থতা হল যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। আজকাল বেশিরভাগ দৈনিকের শিশু বিভাগের সম্পাদককে চেনাই যায় না, তাদের কোন সাহিত্যিক পরিচয় নেই।
সাহিত্যে রাজনীতি বা বর্তমান সময়ের অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান কতটা প্রখর? যদি প্রখর না হয় তবে এর কারণ এবং উপায় কি?
: এটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। অবশ্য জীবন ও সাহিত্য রাজনীতির বাইরে নয়। আমাদের সমাজ বিভক্ত। যারা অনিয়ম করছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সৃষ্টিশীল মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ ও উপায় খুঁজতে গেলে নীতির প্রশ্ন আসবে। আমাদের সমাজে ক’জন নীতিবান মানুষ মেলে।
সাহিত্যে আপনার অনুজদের জন্য কিছু বলার আছে?
: অগ্রজ ও অনুজ বিষয়টি আমি বিশ্বাস করি না। একজন কনিষ্ঠ লেখকও আমার চেয়ে ভালো লিখতে পারে, আবার বেশি জানতেও পারে। আমি বলব লেখার আগে জানা এবং পড়াশোনা করা উচিত, সাহিত্য বাণিজ্য নয়, সাধনার পাশাপাশি এক্ষেত্রে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করা উচিত। আমি লেখালেখির ৪৯ বছর পর আপনাদের দেয়া সম্মান লাভ করেছি।
দেশপ্রেম হচ্ছে চারপাশের বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকা
শিহাব সরকার
পুরস্কার দেয়া এবং পুরস্কার প্রাপ্তি এ দুটো বিষয় আপনাকে কিভাবে নাড়া দেয়? আপনার মতে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার কখন কতোটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে?
: পুরস্কার দেয়ার রীতি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। আমি সদ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি- ফলে আমার অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি তরতাজা। পুরস্কার পেলে ভালো লাগে, সবাই যেরকম আনন্দিত হয় আমিও তাই। পুরস্কার কোনো লেখকের জন্য অবশ্যই উদ্দীপনামূলক। আমি এতে নেতিবাচক কিছু দেখি না। তবে অনেক লেখক যেমন- আমি এসব ব্যাপারে এক ধরনের নিস্পৃহই বরাবর। তবুও যেহেতু বাংলা একাডেমি পুরস্কার, দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার এটা আমার জন্য, আমার লেখার জন্য ইতিবাচক, আমি তাই মনে করি।
এক অর্থে বাংলাদেশের প্রথম সময়ের কবি আপনি। ৭১-এর পরের বাংলাদেশের সাহিত্য আর বাংলা সাহিত্যের মধ্যকার কোন কোন প্রধান পার্থক্য বা বৈচিত্র্য আপনার মতে আলোচ্য হতে পারে? এবং কেন?
: বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্য এত দ্রুত পার্থক্য শনাক্ত করা যাবে না বলেই মনে হয়। এটার জন্যও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তবে যেহেতু একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পর স্বাধীন বাংলাদেশের তরুণ কবিদের নিয়ে কথা হচ্ছে- আমার মনে হয় ওই সময়ের সাহিত্যে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল। ওই সময়ে একসঙ্গে বহু কবি আবির্ভূত হয়েছিলেন। অনেকে হয়তো পরে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেনুং। এরপরও বেশ ক’জন সত্তরের কবি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। গুণগত বিচার করবেন সৎ সমালোচক। তবে একসঙ্গে এত কবি সক্রিয় থাকা। এ ব্যাপারটি অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আপনার কবিতা লেখার শুরুর দিকে সাহিত্যে দেশপ্রেম যেভাবে এসেছিলো আপনার পরবর্তীদের মধ্যে সেটা কী পরিমাণে দেখতে পান? যদি কম বা ভিন্নতা থাকে- তবে এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
: সাহিত্যে দেশপ্রেম যেভাবে বুদ্ধদেব বসু দেখেছেন, তাতে খুব ভালো মানের লেখা জন্ম দেয় না। এটা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দীজেন্দ্রনাথ রায় এ বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন। ওই সময়ের কবিতার ধরনটাই ছিল ওরকম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলের কবিতায় দেশপ্রেম আক্ষরিক অর্থে ছিল না। যুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু দেশের জন্য আবেগময় কবিতা খুব একটা লেখা হয়নি। তার মানে এই নয় যে, আমি সাহিত্যে দেশপ্রেম থাকার বিরোধী। আসলে এখন দেশপ্রেম হচ্ছে দেশ, সচেতনতা, সময় সচেতনতা অর্থাৎ চারপাশের বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকা।
সাহিত্যে রাজনীতি বা বর্তমান সময়ের অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান কতটা প্রখর? যদি প্রখর না হয় তবে এর কারণ এবং উপায় কী?
: সাহিত্যে রাজনীতির প্রতিফলন তো বাংলাদেশে আছেই, বিশেষ করে আমাদের সবার কবিতাতেই। কারও লেখায় এটা প্রত্যক্ষ অতি সরাসরি। কারও লেখায় পরোক্ষ। আমি এ পরোক্ষ ভঙ্গিটাতেই স্বচ্ছন্দবোধ করি। স্লোগান কিন্তু কবিতা নয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিশ্ব প্রেক্ষাপটের রাজনীতির উল্লেখ আছে। সেগুলো কিন্তু পড়তে গিয়ে মানুষ মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ে না। আসলে এরকমই হওয়া উচিত।
সাহিত্যে আপনার অনুজদের জন্য কিছু বলার আছে?
: অনেক তরুণ কবি লিখছেন। অনেকেই আমার সন্তানের বয়সী। এরা সারাক্ষণ কিছু করার জন্য টগবগ করছে। এক সময় আমরাও তাই করেছি। তবে সময় পাল্টেছে। কাগজের পাশাপাশি এসেছে ই-পোয়েট্রি বা ফেসবুক কবিতা। আমি পক্ষে-বিপক্ষে বলছি না কিছুই। তবে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি শেষ পর্যন্ত কি ফল বয়ে আনবে এটা নিয়ে ভাববার ব্যাপার আছে।
: এ বিষয়ে কোনো স্বতঃসিদ্ধ সূত্র আমার জানা নেই। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি যে কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তিই আমার ওপর বিশেষ কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। পুরস্কার পেলেও লিখব, না পেলেও লিখে যাব। তবে অপ্রত্যক্ষ একটি ভালো প্রভাব রয়েছে পুরস্কার পাওয়ার। আমার লেখালেখির কারণে পরিবার এবং স্বজনরা অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়েছে। তারা এই পুরস্কারটাকে নিজেদের প্রাপ্য বলে মনে করে খুশি হয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী কথাসাহিত্যে মৌলিক পার্থক্য বা বৈচিত্র্য যদি ভাবা হয়, আপনি কোন বিষয়টি বেশি প্রাধান্য দেবেন এবং কেন?
: বাংলাদেশের স্বাধীনতা এই বাণী পৌঁছে দিয়েছে যে, বাংলা সম্পর্কিত সবকিছুর দায়দায়িত্ব এই ভূখণ্ডের মানুষদেরই নিতে হবে। কারণ হাজার বছর পরে বাঙালি প্রথম নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে বাংলাদেশ নামে। কাজেই বাঙালির মানসিকতাতে পরিবর্তন আসতেই হবে। পরিবর্তন আসবে উপন্যাসেও। তবে মনে রাখতে হবে যে রাতারাতি কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসে না। চোখে পড়ার মতো যে পরিবর্তনটা হয়েছে, তা হচ্ছে একরৈখিক উপন্যাসের ছক থেকে বেরিয়ে আসছেন আমাদের অনেক লেখক। লিখছেন নন-ফিকশক ফিকশন, লিখছেন মধ্যযুগের কথকতা এবং পাঁচালির আঙ্গিকের উপন্যাস।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। এখনও হচ্ছে। লেখা হচ্ছে এই বিষয়ে অনেক সাহিত্য দরকার বলে, নাকি এই বিষয়ে প্রকৃত সাহিত্যকর্ম হয়ে উঠছে না বলে?
: অনেক লেখা হচ্ছে বটে, তবে তা কেবল সংখ্যাতেই। গুণগতমানে শিখর স্পর্শী লেখার সংখ্যা খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অনেক সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন অবশ্যই। কিন্তু যেভাবে লেখা হচ্ছে তার পেছনের প্রবণতা খুবই বিরক্তিকর। যে না, আমারও এই বিষয়ে একটা লেখা থাকা দরকার। বিষয়টি বাজারচলতি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাঠকের কাছে কোনো মহৎ বার্তা এসব লেখা পৌঁছে দিতে পারে না।
সাইফাই’-এর এই সময়ে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোন পর্যায়ে?
: সাহিত্যকে চিরকালই অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পথ চলতে হয়েছে। এখন আপনার ভাষায় ‘সাইফাই’ নতুন আরেকটি চ্যালেঞ্জ। তবে এর ফলে বেকায়দায় পড়েছেন মূলত বিনোদন লেখকরা। কারণ বিনোদনের নানা উপায় বেরিয়ে যাওয়ায় এখন আর সাহিত্য থেকে বিনোদন কেউ খোঁজে না। তার জন্য নানা মাধ্যম তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু সিরিয়াস সাহিত্য বা প্রকৃত সাহিত্য খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত এখন পর্যন্ত হয়নি।
মানবিক সাহিত্যের তুলনায় নান্দনিক সাহিত্যের পরিমাণ কি পর্যাপ্ত? এর চাহিদা মেটানোর সম্ভাবনা কি দেখছেন?
: নান্দনিক সাহিত্য চাহিদার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে লেখকের যোগ্যতা, মানসিকতা, শিল্পবোধ, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ ইত্যাদির ওপর। তেমন লেখক যত আবির্ভূত হবেন, নান্দনিক সাহিত্যের সৃষ্টি তত বাড়বে। তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই।
সাহিত্যে আপনার অনুজদের জন্য কিছু বলার আছে?
: অনুজদের জন্য আমার বলার কথা হচ্ছে সাহিত্যে কোনো শর্টকাট পথ নেই। সবাইকে বুকে হেঁটে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েই এগোতে হবে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ভালো সাহিত্য সৃষ্টি করার জন্য কোনো ভিন্ন নেশা ধরার দরকার নেই। বরং সুস্থ শরীর এবং মন দরকার।
কোনো সৃষ্টিই পুরস্কারের মানদণ্ড হওয়া উচিত নয়
খালেক বিন জয়েনউদদীন
পুরস্কার দেয়া এবং পুরস্কার প্রাপ্তি এ দুটো বিষয় আপনাকে কিভাবে নাড়া দেয়? আপনার মতে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার কখন কতোটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে?
: আমি শিশু সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য পুরস্কার পেয়েছি। কোনো সৃষ্টিই এই পুরস্কারের মানদণ্ড হওয়া উচিত নয়। পাঠকের কাছে লেখা আদৃত হলেই লেখকের খুশি হওয়ার কথা। ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়টি এখানে গৌণ।
বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের বর্তমান গতিপ্রকৃতি নিয়ে আপনার মুগ্ধতা উদ্বেগ বা নতুন চিন্তা থাকলে তা জানতে চাই।
: দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি স্বল্প পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শিশু সাহিত্য গত ৪০ বছরে অনেক বাঁক পেরিয়ে বর্তমান আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যা এবং বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের বিষয়টি শিশু সাহিত্য রচনায় প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছে। এ কারণেই আমাদের শিশু সাহিত্যের বড় অংশটি মুক্তিযুদ্ধের।
কল্পকাহিনীর বদলে জীবন কাহিনী এখানে বারবার বিধৃত করা হয়েছে। গত ৪ দশকের ছড়া কবিতা আপন বৈভবে সমুজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিভ্রান্তি গত কয়েক বছরে অনেকটা সুধরেছে। আমাদের শিশুসাহিত্যে এই বিষয়টি অনেকেই তুলে ধরেছেন।
আপনি তো বর্তমানে কচিকাঁচার আসর সম্পাদনা করেন। এই পাতাটি আমৃত্যু সম্পাদনা করেছেন প্রখ্যাত শিশু সংগঠক ও সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাই। বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত শিশু পাতাগুলো কি বাগবান ভাই,দাদাভাই, দাদুভাই, আফলাতুন ভাই অথবা ভাইয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত সে সময়কার শিশুপাতাগুলোর মান, ঐতিহ্য ও আন্তরিকতা ধরে রাখতে পেরেছে?
এর সাফল্য অথবা ব্যর্থতার কথা বলুন।
: না, বাগবান ভাই, দাদাভাই, হাবীব ভাই, এখলাস ভাই, আফলাতুন, বজলু ভাই ও সেলিনা হোসেন কিংবা দাদুভাই ছোটদের যেসব পাতা সম্পাদনা করতেন, তার চেয়ে অনেক নিুমানের পাতা আমরা সম্পাদনা করছি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও আমরা সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারিনি। সাফল্য নেই, ব্যর্থতা হল যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। আজকাল বেশিরভাগ দৈনিকের শিশু বিভাগের সম্পাদককে চেনাই যায় না, তাদের কোন সাহিত্যিক পরিচয় নেই।
সাহিত্যে রাজনীতি বা বর্তমান সময়ের অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান কতটা প্রখর? যদি প্রখর না হয় তবে এর কারণ এবং উপায় কি?
: এটি রাজনৈতিক প্রশ্ন। অবশ্য জীবন ও সাহিত্য রাজনীতির বাইরে নয়। আমাদের সমাজ বিভক্ত। যারা অনিয়ম করছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সৃষ্টিশীল মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত বলে মনে করি। কারণ ও উপায় খুঁজতে গেলে নীতির প্রশ্ন আসবে। আমাদের সমাজে ক’জন নীতিবান মানুষ মেলে।
সাহিত্যে আপনার অনুজদের জন্য কিছু বলার আছে?
: অগ্রজ ও অনুজ বিষয়টি আমি বিশ্বাস করি না। একজন কনিষ্ঠ লেখকও আমার চেয়ে ভালো লিখতে পারে, আবার বেশি জানতেও পারে। আমি বলব লেখার আগে জানা এবং পড়াশোনা করা উচিত, সাহিত্য বাণিজ্য নয়, সাধনার পাশাপাশি এক্ষেত্রে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করা উচিত। আমি লেখালেখির ৪৯ বছর পর আপনাদের দেয়া সম্মান লাভ করেছি।
দেশপ্রেম হচ্ছে চারপাশের বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকা
শিহাব সরকার
পুরস্কার দেয়া এবং পুরস্কার প্রাপ্তি এ দুটো বিষয় আপনাকে কিভাবে নাড়া দেয়? আপনার মতে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার কখন কতোটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে?
: পুরস্কার দেয়ার রীতি বহুকাল থেকেই চলে আসছে। আমি সদ্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছি- ফলে আমার অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি তরতাজা। পুরস্কার পেলে ভালো লাগে, সবাই যেরকম আনন্দিত হয় আমিও তাই। পুরস্কার কোনো লেখকের জন্য অবশ্যই উদ্দীপনামূলক। আমি এতে নেতিবাচক কিছু দেখি না। তবে অনেক লেখক যেমন- আমি এসব ব্যাপারে এক ধরনের নিস্পৃহই বরাবর। তবুও যেহেতু বাংলা একাডেমি পুরস্কার, দেশের সবচেয়ে বড় পুরস্কার এটা আমার জন্য, আমার লেখার জন্য ইতিবাচক, আমি তাই মনে করি।
এক অর্থে বাংলাদেশের প্রথম সময়ের কবি আপনি। ৭১-এর পরের বাংলাদেশের সাহিত্য আর বাংলা সাহিত্যের মধ্যকার কোন কোন প্রধান পার্থক্য বা বৈচিত্র্য আপনার মতে আলোচ্য হতে পারে? এবং কেন?
: বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সাহিত্য এত দ্রুত পার্থক্য শনাক্ত করা যাবে না বলেই মনে হয়। এটার জন্যও দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তবে যেহেতু একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর পর স্বাধীন বাংলাদেশের তরুণ কবিদের নিয়ে কথা হচ্ছে- আমার মনে হয় ওই সময়ের সাহিত্যে কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য ছিল। ওই সময়ে একসঙ্গে বহু কবি আবির্ভূত হয়েছিলেন। অনেকে হয়তো পরে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেনুং। এরপরও বেশ ক’জন সত্তরের কবি নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। গুণগত বিচার করবেন সৎ সমালোচক। তবে একসঙ্গে এত কবি সক্রিয় থাকা। এ ব্যাপারটি অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আপনার কবিতা লেখার শুরুর দিকে সাহিত্যে দেশপ্রেম যেভাবে এসেছিলো আপনার পরবর্তীদের মধ্যে সেটা কী পরিমাণে দেখতে পান? যদি কম বা ভিন্নতা থাকে- তবে এর কারণ কী বলে আপনার মনে হয়?
: সাহিত্যে দেশপ্রেম যেভাবে বুদ্ধদেব বসু দেখেছেন, তাতে খুব ভালো মানের লেখা জন্ম দেয় না। এটা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দীজেন্দ্রনাথ রায় এ বিষয়ে প্রচুর লিখেছেন। ওই সময়ের কবিতার ধরনটাই ছিল ওরকম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ-আমেরিকা অঞ্চলের কবিতায় দেশপ্রেম আক্ষরিক অর্থে ছিল না। যুদ্ধ নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু দেশের জন্য আবেগময় কবিতা খুব একটা লেখা হয়নি। তার মানে এই নয় যে, আমি সাহিত্যে দেশপ্রেম থাকার বিরোধী। আসলে এখন দেশপ্রেম হচ্ছে দেশ, সচেতনতা, সময় সচেতনতা অর্থাৎ চারপাশের বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত থাকা।
সাহিত্যে রাজনীতি বা বর্তমান সময়ের অন্যায় অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান কতটা প্রখর? যদি প্রখর না হয় তবে এর কারণ এবং উপায় কী?
: সাহিত্যে রাজনীতির প্রতিফলন তো বাংলাদেশে আছেই, বিশেষ করে আমাদের সবার কবিতাতেই। কারও লেখায় এটা প্রত্যক্ষ অতি সরাসরি। কারও লেখায় পরোক্ষ। আমি এ পরোক্ষ ভঙ্গিটাতেই স্বচ্ছন্দবোধ করি। স্লোগান কিন্তু কবিতা নয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিশ্ব প্রেক্ষাপটের রাজনীতির উল্লেখ আছে। সেগুলো কিন্তু পড়তে গিয়ে মানুষ মুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে পড়ে না। আসলে এরকমই হওয়া উচিত।
সাহিত্যে আপনার অনুজদের জন্য কিছু বলার আছে?
: অনেক তরুণ কবি লিখছেন। অনেকেই আমার সন্তানের বয়সী। এরা সারাক্ষণ কিছু করার জন্য টগবগ করছে। এক সময় আমরাও তাই করেছি। তবে সময় পাল্টেছে। কাগজের পাশাপাশি এসেছে ই-পোয়েট্রি বা ফেসবুক কবিতা। আমি পক্ষে-বিপক্ষে বলছি না কিছুই। তবে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সাহিত্য নিয়ে মাতামাতি শেষ পর্যন্ত কি ফল বয়ে আনবে এটা নিয়ে ভাববার ব্যাপার আছে।
No comments