ক্যান্সার চিকিৎসাসেবা- প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধও চাই
ক্যান্সারকে আমরা 'নীরব ঘাতক' বলে থাকি; কিন্তু এই ঘাতক নীরবে-নিভৃতে কতটা দানবীয় হয়ে উঠেছে, তার খণ্ডচিত্র পাওয়া যাচ্ছে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস উপলক্ষে বুধবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার বা আইএআরসির উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী রয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর দেশে প্রায় সোয়া লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ ভাগে পেঁৗছবে। যে কোনো বিবেচনাতেই এই চিত্র ভয়াবহ হতে বাধ্য। ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার চিত্রও কম ভয়াবহ নয়। দিবসটির আগে এক সপ্তাহ ধরে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল সরেজমিন ঘুরে আক্রান্ত রোগী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে সমকাল প্রতিবেদক যে করুণ চিত্র পেয়েছেন, তা আমাদের উদ্বেগে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। রোগীর যন্ত্রণা, স্বজনের বেদনা তো রয়েছেই, প্রাণঘাতী এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অর্থের সংস্থানও বিপুল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সারের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও ওষুধের উচ্চমূল্য সামাল দিতে পারছে না সাধারণ চিকিৎসাপ্রার্থীরা। দেখা যাচ্ছে, অনেকে সর্বস্ব দিয়েও চিকিৎসা সম্পন্ন করতে পারছেন না। ওষুধের উচ্চমূল্যের পাশাপশি সক্ষমতা ও কাঠামো সংকটও প্রকট। প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক, যন্ত্রপাতি, জনবল ও শয্যাসংখ্যা যথেষ্ট অপ্রতুল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি ক্যান্সার কেন্দ্র থাকা দরকার। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৬০টি কেন্দ্রের প্রয়োজন। অথচ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মাত্র ১৪টি হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্তদের চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। আমরা মনে করি, এ বিষয়ে অবিলম্বে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। বাড়াতে হবে সেন্টার, চিকিৎসক, নার্স ও যন্ত্রপাতির সংখ্যা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সমকালকে বলেছেন, ক্যান্সার চিকিৎসার বিষয়টি সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। দেশের প্রতিটি বিভাগীয় হাসপাতালের পাশাপাশি ঘনবসতিপূর্ণ জেলা হাসপাতালগুলোতে ক্যান্সার চিকিৎসায় পৃথক ইউনিট চালুর চিন্তাভাবনা চলছে। আমরা দেখতে চাইব, কথায় এই 'গুরুত্ব দেওয়া' যেন কাজেও পরিণত হয়। আমরা মনে করি, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা থাকলে অন্তত সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে অবিলম্বে ক্যান্সার সেন্টার চালু করা কঠিন হতে পারে না। ক্যান্সার চিকিৎসার নামে জালিয়তির ঘটনাও আমাদের দেশে কম নয়। ক্যান্সার গুরুতর রোগ সন্দেহ নেই; কিন্তু রোগটির চিকিৎসার নামে যেভাবে দরিদ্র অসুস্থ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়, তা আরও গুরুতর। ধারণা করা কঠিন নয় যে, ক্যান্সার চিকিৎসার ব্যয়বাহুল্যও অনেক সময় নিম্ন আয়ের মানুষকে অপেক্ষাকৃত স্বল্প ব্যয়ের হাতুড়ে ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। পাশাপাশি ক্যান্সারের দ্রুত বিস্তৃতির কারণ নিরূপণ ও নিবারণেও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিতে বলব আমরা। মনে রাখতে হবে, রোগের প্রতিকারের পাশাপাশি প্রতিরোধ ব্যবস্থাও সমান বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা এভাবে বাড়ছে, তাও গভীরভাবে ভাবতে হবে নীতিনির্ধারকদের। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে বলে এসেছেন যে, খাদ্যে নির্বিচার ভেজাল ও পরিবেশ দূষণ ক্যান্সার বিস্তৃতির অন্যতম প্রধান কারণ। এই প্রাণঘাতী রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ভেজাল ও দূষণেও দিতে হবে লাগাম। এজন্য জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে তৎপর বেসরকারি পক্ষগুলোও এগিয়ে আসতে পারে। সবাই আন্তরিক ও সক্রিয় হলে ক্যান্সারের দানব প্রতিরোধ অসম্ভব হতে পারে না।
No comments