অর্থনীতি- নতুনভাবে শুরু করতে দিতে হবে by জোসেফ ই স্টিগলিৎজ
বছর
পাঁচেক আগে ইউরোসংকট যখন শুরু হলো, তখন কেইনসীয় অর্থনীতিবিদেরা
ভবিষ্যদ্বাণী করেন, গ্রিস ও অন্য যেসব দেশে কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি আরোপ করা
হয়েছে, তারা শেষমেশ ব্যর্থ হবে। এটা প্রবৃদ্ধির টুঁটি চেপে ধরবে, বেকারত্ব
বাড়াবে। এমনকি তা ঋণ-জিডিপি অনুপাতও কমাতে ব্যর্থ হবে। ইউরোপীয় কমিশন,
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রসারণশীল
সংকোচনের কথা বলেছে। কিন্তু এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
ভিন্নমত পোষণ করে বলেছে, সরকারি ব্যয় হ্রাসের ব্যাপারটিও ঠিক ও
রকম—সংকোচনমুখী।
আমাদের আর কোনো পরীক্ষার দরকার ছিল না বললেই চলে। কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের আমলে স্টক বাজারের ধস শেষমেশ মহামন্দায় মোড় নেয়। আবার আইএমএফ যে পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় সাম্প্রতিক সময়ে যে ‘কর্মসূচি’ আরোপ করেছিল, সেটাও যথারীতি ব্যর্থ হয়েছে। আর এরপর যখন গ্রিসও সেই সংকটে পড়ল, তখন আবারও এর পরীক্ষা হয়ে গেল।
গ্রিস ‘ট্রয়কার’ (ইউরোপীয় কমিশন, ইসিবি ও আইএমএফ) নীতি অনুসরণ করে অনেকাংশে সফল হয়েছে। এর ফলে প্রাথমিক বাজেট-ঘাটতি প্রাথমিক উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যয় হ্রাসের পরিণতি হয়েছে বিপর্যয়কর, যেটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল: ২৫ শতাংশ বেকারত্ব, ২০০৯ সাল থেকে ২২ শতাংশ জিডিপি হ্রাস, ঋণ-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি। আর এখন কৃচ্ছ্রসাধনবিরোধী সিরিজা পার্টির ব্যাপক বিজয়ের সঙ্গে গ্রিকরা ঘোষণা দিয়েছে, তারা অনেক দেখে ফেলেছে।
তাহলে কী করতে হবে? প্রথমত, এটা পরিষ্কার করা দরকার: ট্রয়কার ওষুধ যদি শুধু গ্রিসেই চরমভাবে ব্যর্থ হতো, তাহলে এই গোলমালের জন্য গ্রিসকে দোষ দেওয়া যেত। কিন্তু সংকটের আগে স্পেনের উদ্বৃত্ত ছিল, তার ঋণের অনুপাতও ছিল কম। সেই স্পেনও এখন সংকটে পড়েছে। গ্রিস ও স্পেনের কাঠামোগত সংস্কারের দরকার নেই। ইউরোজোনের ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের যতটা দরকার, সে তুলনায়। নীতিকাঠামো সম্পর্কেও মৌলিকভাবে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। যে কারণে মুদ্রা ইউনিয়ন এ রকম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
গ্রিস আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে ঋণব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য নতুন কাঠামো কতটা দরকার। অতিরিক্ত ঋণের জন্য শুধু ২০০৮ সালের সৃষ্টি হয়নি, ১৯৯০ সালে পূর্ব এশিয়া সংকটও এর কারণে সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকের লাতিন আমেরিকা সংকটও এ কারণেই সৃষ্টি হয়। এর কারণে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে, যেখানে লাখ লাখ বাড়িওয়ালা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। আর যাঁরা পোল্যান্ডসহ অন্যান্য স্থানে সুইস ফ্রাঁয় ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁরাও হুমকির মুখে পড়ে গেছেন।
অতিরিক্ত ঋণের কারণে যে পরিমাণে ভুগতে হয়েছে, তাতে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এত এত মানুষ ও দেশ কেন এই পরিস্থিতিতে বারবার নিপতিত হয়েছে। যাহোক, এসব ঋণ তো আসলে একধরনের চুক্তি। অর্থাৎ স্বেচ্ছাকৃত মতৈক্য। ফলে ঋণদাতারাও ঋণগ্রহীতাদের মতো সমান অপরাধী। বস্তুত, ঋণদাতারা আরও বেশি দায়ী। এগুলো অত্যন্ত আধুনিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে ঋণগ্রহীতারা বাজারের উত্থান-পতন ও ঝুঁকি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয়। কিন্তু বাস্তবে মার্কিন ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের আর্থিক খাতসংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবকে কাজে লাগিয়ে তাদের বোকা বানিয়েছে।
প্রত্যেক অগ্রগামী দেশই অনুধাবন করেছে, পুঁজিবাদকে কার্যকর করতে হলে সব দেশকে নতুন করে শুরু করতে দিতে হবে। ১৯ শতকের ঋণদাতারা যে কারাগার বানাতেন, তা ব্যর্থ হয়েছে, এটা অমানবিক ছিল। সেটা ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করতে পারত না। ভালো ঋণের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হলে তা বরং কার্যকর হতো। ঋণদাতাদের তাদের সিদ্ধান্তের জন্য আরও দায়িত্বশীল করা গেলে তা কাজের হতো।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনো একটি দেশকে নতুন করে শুরু করতে দেওয়ার মতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালের সংকটের আগে থেকেই জাতিসংঘ উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সহযোগিতায় তেমন একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে খুব জোরেশোরে বাগড়া দিয়েছে। সম্ভবত সে চায়, বেশি ঋণে জর্জরিত দেশগুলোর কর্মকর্তাদের ঋণগ্রহীতা কারাগার আবার নতুন করে বানানোর চেষ্টা করছে (সেটা হলে গুয়ানতানামো কারাগারে হয়তো জায়গা খালি করা হচ্ছে)।
ঋণগ্রহীতা কারাগারের ব্যাপারটি হয়তো সদূরপরাহত। কিন্তু সম্প্রতি যে নৈতিক ঝুঁকি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে কথা হচ্ছে, তার সঙ্গে এর কোথায় যেন মিল রয়েছে। বাজারে ভয় রয়েছে, গ্রিস যদি তার ঋণ পুনর্গঠন করে, তাহলে সে আবারও সংকটে পড়বে। একইভাবে তা অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এটা একদম বাজে কথা। কেউ কি সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বেচ্ছায় নিজেদের গ্রিসের অবস্থায় ফেলতে চাইবে, শুধু ঋণদাতাদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য? কোনো নৈতিক ঝুঁকি থাকলে, তা ঋণদাতাদের ঘাড়েই বর্তায়—বিশেষ করে বেসরকারি খাতে। যাঁদের বারবার বেইল আউট করা হয়েছে। ইউরোপ যদি এসব ঋণকে বেসরকারি খাত থেকে সরকারি খাতে স্থানান্তর করে, তাহলে তাকেই এর পরিণতি সইতে হবে, গ্রিসকে নয়। এটা গত অর্ধ শতাব্দীর রীতিতে পরিণত হয়েছে। গ্রিসের এই বিরাজমান বেহাল দশার কারণ হচ্ছে ট্রয়কা কর্মসূচি, যেটা তার ওপর আসলে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মানে এটা ঋণ পুনর্গঠন নয়, বরং সেটা না থাকাটাই ‘অনৈতিক’। গ্রিস যে উভয় সংকটে পড়েছে, তা কোনো বিশেষ ব্যাপার নয়। অনেক দেশই এ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। ইউরোজোনের কাঠামোর কারণে গ্রিসের সমস্যা মোকাবিলা করা আরও কঠিন পড়েছে। তার পরও এই নীতিগত স্থিতিস্থাপকতা হানির সঙ্গে যে ন্যূনতম ইউরোপীয় সংহতি থাকা উচিত ছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই।
আজ থেকে ৭০ বছর আগে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্র শক্তি ঠিক করেছিল, জার্মানিকে নতুন করে শুরু করতে দিতে হবে। তারা বুঝতে পারে, হিটলারের উত্থানের সঙ্গে সে দেশের বেকারত্বের (মূল্যস্ফীতি নয়) সম্পর্ক আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ওপর অধিক হারে ঋণ আরোপ করার কারণে এটা ঘটেছিল। কিন্তু এই ঋণ যে কী বোকামির সঙ্গে জড়ো হয়েছিল, তা তারা কখনো আমলে নেয়নি। বা জার্মানি অন্যদের ওপর যে মূল্য চাপিয়ে দিয়েছিল, সেটাও খতিয়ে দেখেনি। সেটা না করে তারা শুধু ঋণই মওকুফ করেনি, তারা আদতে তাদের সহযোগিতা করেছে। জার্মানিতে যে মিত্র সেনারা অবস্থান করছিল, তারা আর্থিক প্রণোদনাও দিয়েছে।
কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেলে ঋণ ও ইকুইটিসমেত তা বিক্রি করে দেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও দক্ষ সমাধান। গ্রিসের যে সমধর্মী অ্যাপ্রোচ নেওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে, তার বর্তমান বন্ডকে জিডিপি-সংযুক্ত বন্ডে রূপান্তরিত করা। গ্রিস ভালো করলে তার ঋণদাতারা তাদের বেশির ভাগ অর্থ ফেরত পাবে। তা না হলে কম পাবে। তখন দুই পক্ষই প্রবৃদ্ধিমুখিন নীতি গ্রহণে শক্তিশালী প্রণোদনা লাভ করবে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন সাধারণত এত পরিষ্কার বার্তা দেয় না, গ্রিসের নির্বাচন যা দিয়েছে। ইউরোপ যদি গ্রিক ভোটারদের পরিবর্তনের দাবিকে না বলে, তাহলে তারা গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে, অন্তত অর্থনীতির ক্ষেত্রে। কেন গণতন্ত্রকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নিউফাউন্ডল্যান্ড গ্রহীতার ভূমিকায় গেলে যেটা তারা করেছিল।
মানুষ আশা করে, যারা ঋণ ও কৃচ্ছ্র অর্থনীতি বোঝে এবং গণতন্ত্র ও মানবীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, তারাই টিকে থাকবে। সেটা হয় কি না, তা-ই দেখার বিষয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ।
আমাদের আর কোনো পরীক্ষার দরকার ছিল না বললেই চলে। কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভারের আমলে স্টক বাজারের ধস শেষমেশ মহামন্দায় মোড় নেয়। আবার আইএমএফ যে পূর্ব এশিয়া ও লাতিন আমেরিকায় সাম্প্রতিক সময়ে যে ‘কর্মসূচি’ আরোপ করেছিল, সেটাও যথারীতি ব্যর্থ হয়েছে। আর এরপর যখন গ্রিসও সেই সংকটে পড়ল, তখন আবারও এর পরীক্ষা হয়ে গেল।
গ্রিস ‘ট্রয়কার’ (ইউরোপীয় কমিশন, ইসিবি ও আইএমএফ) নীতি অনুসরণ করে অনেকাংশে সফল হয়েছে। এর ফলে প্রাথমিক বাজেট-ঘাটতি প্রাথমিক উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সরকারি ব্যয় হ্রাসের পরিণতি হয়েছে বিপর্যয়কর, যেটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল: ২৫ শতাংশ বেকারত্ব, ২০০৯ সাল থেকে ২২ শতাংশ জিডিপি হ্রাস, ঋণ-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি। আর এখন কৃচ্ছ্রসাধনবিরোধী সিরিজা পার্টির ব্যাপক বিজয়ের সঙ্গে গ্রিকরা ঘোষণা দিয়েছে, তারা অনেক দেখে ফেলেছে।
তাহলে কী করতে হবে? প্রথমত, এটা পরিষ্কার করা দরকার: ট্রয়কার ওষুধ যদি শুধু গ্রিসেই চরমভাবে ব্যর্থ হতো, তাহলে এই গোলমালের জন্য গ্রিসকে দোষ দেওয়া যেত। কিন্তু সংকটের আগে স্পেনের উদ্বৃত্ত ছিল, তার ঋণের অনুপাতও ছিল কম। সেই স্পেনও এখন সংকটে পড়েছে। গ্রিস ও স্পেনের কাঠামোগত সংস্কারের দরকার নেই। ইউরোজোনের ধরনের কাঠামোগত সংস্কারের যতটা দরকার, সে তুলনায়। নীতিকাঠামো সম্পর্কেও মৌলিকভাবে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। যে কারণে মুদ্রা ইউনিয়ন এ রকম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
গ্রিস আমাদের আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে ঋণব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য নতুন কাঠামো কতটা দরকার। অতিরিক্ত ঋণের জন্য শুধু ২০০৮ সালের সৃষ্টি হয়নি, ১৯৯০ সালে পূর্ব এশিয়া সংকটও এর কারণে সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকের লাতিন আমেরিকা সংকটও এ কারণেই সৃষ্টি হয়। এর কারণে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে, যেখানে লাখ লাখ বাড়িওয়ালা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। আর যাঁরা পোল্যান্ডসহ অন্যান্য স্থানে সুইস ফ্রাঁয় ঋণ নিয়েছিলেন, তাঁরাও হুমকির মুখে পড়ে গেছেন।
অতিরিক্ত ঋণের কারণে যে পরিমাণে ভুগতে হয়েছে, তাতে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এত এত মানুষ ও দেশ কেন এই পরিস্থিতিতে বারবার নিপতিত হয়েছে। যাহোক, এসব ঋণ তো আসলে একধরনের চুক্তি। অর্থাৎ স্বেচ্ছাকৃত মতৈক্য। ফলে ঋণদাতারাও ঋণগ্রহীতাদের মতো সমান অপরাধী। বস্তুত, ঋণদাতারা আরও বেশি দায়ী। এগুলো অত্যন্ত আধুনিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে ঋণগ্রহীতারা বাজারের উত্থান-পতন ও ঝুঁকি সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নয়। কিন্তু বাস্তবে মার্কিন ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের আর্থিক খাতসংক্রান্ত জ্ঞানের অভাবকে কাজে লাগিয়ে তাদের বোকা বানিয়েছে।
প্রত্যেক অগ্রগামী দেশই অনুধাবন করেছে, পুঁজিবাদকে কার্যকর করতে হলে সব দেশকে নতুন করে শুরু করতে দিতে হবে। ১৯ শতকের ঋণদাতারা যে কারাগার বানাতেন, তা ব্যর্থ হয়েছে, এটা অমানবিক ছিল। সেটা ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করতে পারত না। ভালো ঋণের জন্য প্রণোদনা দেওয়া হলে তা বরং কার্যকর হতো। ঋণদাতাদের তাদের সিদ্ধান্তের জন্য আরও দায়িত্বশীল করা গেলে তা কাজের হতো।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনো একটি দেশকে নতুন করে শুরু করতে দেওয়ার মতো সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ২০০৮ সালের সংকটের আগে থেকেই জাতিসংঘ উন্নয়নশীল ও উদীয়মান দেশগুলোর সহযোগিতায় তেমন একটি কাঠামো তৈরির চেষ্টা করছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাতে খুব জোরেশোরে বাগড়া দিয়েছে। সম্ভবত সে চায়, বেশি ঋণে জর্জরিত দেশগুলোর কর্মকর্তাদের ঋণগ্রহীতা কারাগার আবার নতুন করে বানানোর চেষ্টা করছে (সেটা হলে গুয়ানতানামো কারাগারে হয়তো জায়গা খালি করা হচ্ছে)।
ঋণগ্রহীতা কারাগারের ব্যাপারটি হয়তো সদূরপরাহত। কিন্তু সম্প্রতি যে নৈতিক ঝুঁকি ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে কথা হচ্ছে, তার সঙ্গে এর কোথায় যেন মিল রয়েছে। বাজারে ভয় রয়েছে, গ্রিস যদি তার ঋণ পুনর্গঠন করে, তাহলে সে আবারও সংকটে পড়বে। একইভাবে তা অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
এটা একদম বাজে কথা। কেউ কি সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বেচ্ছায় নিজেদের গ্রিসের অবস্থায় ফেলতে চাইবে, শুধু ঋণদাতাদের কাছ থেকে বাঁচার জন্য? কোনো নৈতিক ঝুঁকি থাকলে, তা ঋণদাতাদের ঘাড়েই বর্তায়—বিশেষ করে বেসরকারি খাতে। যাঁদের বারবার বেইল আউট করা হয়েছে। ইউরোপ যদি এসব ঋণকে বেসরকারি খাত থেকে সরকারি খাতে স্থানান্তর করে, তাহলে তাকেই এর পরিণতি সইতে হবে, গ্রিসকে নয়। এটা গত অর্ধ শতাব্দীর রীতিতে পরিণত হয়েছে। গ্রিসের এই বিরাজমান বেহাল দশার কারণ হচ্ছে ট্রয়কা কর্মসূচি, যেটা তার ওপর আসলে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মানে এটা ঋণ পুনর্গঠন নয়, বরং সেটা না থাকাটাই ‘অনৈতিক’। গ্রিস যে উভয় সংকটে পড়েছে, তা কোনো বিশেষ ব্যাপার নয়। অনেক দেশই এ অবস্থায় নিপতিত হয়েছে। ইউরোজোনের কাঠামোর কারণে গ্রিসের সমস্যা মোকাবিলা করা আরও কঠিন পড়েছে। তার পরও এই নীতিগত স্থিতিস্থাপকতা হানির সঙ্গে যে ন্যূনতম ইউরোপীয় সংহতি থাকা উচিত ছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই।
আজ থেকে ৭০ বছর আগে, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্র শক্তি ঠিক করেছিল, জার্মানিকে নতুন করে শুরু করতে দিতে হবে। তারা বুঝতে পারে, হিটলারের উত্থানের সঙ্গে সে দেশের বেকারত্বের (মূল্যস্ফীতি নয়) সম্পর্ক আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ওপর অধিক হারে ঋণ আরোপ করার কারণে এটা ঘটেছিল। কিন্তু এই ঋণ যে কী বোকামির সঙ্গে জড়ো হয়েছিল, তা তারা কখনো আমলে নেয়নি। বা জার্মানি অন্যদের ওপর যে মূল্য চাপিয়ে দিয়েছিল, সেটাও খতিয়ে দেখেনি। সেটা না করে তারা শুধু ঋণই মওকুফ করেনি, তারা আদতে তাদের সহযোগিতা করেছে। জার্মানিতে যে মিত্র সেনারা অবস্থান করছিল, তারা আর্থিক প্রণোদনাও দিয়েছে।
কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে গেলে ঋণ ও ইকুইটিসমেত তা বিক্রি করে দেওয়াই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর ও দক্ষ সমাধান। গ্রিসের যে সমধর্মী অ্যাপ্রোচ নেওয়া দরকার, সেটা হচ্ছে, তার বর্তমান বন্ডকে জিডিপি-সংযুক্ত বন্ডে রূপান্তরিত করা। গ্রিস ভালো করলে তার ঋণদাতারা তাদের বেশির ভাগ অর্থ ফেরত পাবে। তা না হলে কম পাবে। তখন দুই পক্ষই প্রবৃদ্ধিমুখিন নীতি গ্রহণে শক্তিশালী প্রণোদনা লাভ করবে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন সাধারণত এত পরিষ্কার বার্তা দেয় না, গ্রিসের নির্বাচন যা দিয়েছে। ইউরোপ যদি গ্রিক ভোটারদের পরিবর্তনের দাবিকে না বলে, তাহলে তারা গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবে, অন্তত অর্থনীতির ক্ষেত্রে। কেন গণতন্ত্রকেই বন্ধ করে দেওয়া হয় না? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নিউফাউন্ডল্যান্ড গ্রহীতার ভূমিকায় গেলে যেটা তারা করেছিল।
মানুষ আশা করে, যারা ঋণ ও কৃচ্ছ্র অর্থনীতি বোঝে এবং গণতন্ত্র ও মানবীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, তারাই টিকে থাকবে। সেটা হয় কি না, তা-ই দেখার বিষয়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ।
No comments