নির্বাচনী গণতন্ত্র থেকে সরে এসেছে বাংলাদেশ by মুবাশার হাসান
বাংলাদেশ সম্প্রতি নির্বাচনী গণতন্ত্র থেকে সরে এসেছে। বছরের শুরুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলীয় দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ওই নির্বাচন বর্জন করে। তাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি ছিল নির্বাচনটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হচ্ছে না আর পক্ষপাতমূলক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। ৯০-এর দশকের শুরুতে এরশাদ শাসনের অবসান হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশী রাজনৈতিক দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত হয়। সূত্রপাত হয় বহুদলীয় গণতন্ত্রের। ২০১৪ সালের নির্বাচন এ সংস্কৃতির স্পষ্ট ব্যত্যয় নির্দেশ করে। বিদেশী সহায়তা, পশ্চিমা এনজিও, বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য খাতে উল্লেখযোগ্য প্রগতি অর্জনে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন যেমনটা বলেছেন, বাংলাদেশ যে মাত্রায় সামাজিক প্রগতি অর্জন করেছে তাতে দেশটি পার্শ্ববর্তী অধিকতর বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের সমস্যা তাদের রাজনীতি যা সহিংসতা, দুর্নীতি আর তোষামোদিতে জর্জরিত। এ রাজনীতি দেশটির সামাজিক প্রগতির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি হলো উগ্র ইসলামিজমও দেশটিতে শক্ত ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছে। দেশব্যাপী দরিদ্র আর ধনীদের মধ্যে পার্থক্য যেখানে বেড়েছে, রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ইসলামÑ এ ধারণা তত জনপ্রিয় হয়েছে। ২০১৩ সালের একটি পিউ গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৭ শতাংশ বলেছেন, এটা খারাপ যে বাংলাদেশ পুরোপুরি শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করে না। ইউরোপ আর আমেরিকার ইতিহাস থেকে দেখা গেছে, ধর্মীয় একটি সমাজের মধ্যেও উদারমনা গণতন্ত্র সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে। বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট সমস্যা উভয় প্রধান রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় নীতিমালা হিসেবে ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। যেমন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আর রাষ্ট্র পরিচালিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এছাড়াও রয়েছে নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেমন স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়। আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যের ধনী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় আর্থিক সহায়তার সঙ্গে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামিকরণ প্রক্রিয়া। একপর্যায়ে বিএনপি, আওয়ামী লীগ উভয়ই তা সমর্থন করে। ৭০-এর দশকে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ওই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পরাজয় এবং ইসরাইলের প্রতি পশ্চিমা সমর্থনে তাদের বিদ্বেষের কারণে তারা বিশ্বব্যাপী ইসলামিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে। এ প্রক্রিয়ার লক্ষ্য ছিল, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী দরিদ্র মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমাকরণ থেকে প্রতিহত করা। বাংলাদেশীদের বড় একটি সংখ্যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকগুলোর সঙ্গে গণতন্ত্রকে এক করে দেখেন। একদিকে এতে প্রতীয়মান হয়, যারা গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে থাকেন তারা এ বিষয়টা কি এবং কিভাবে তা বাংলাদেশীদের উপকারে আসছে সে ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ। একই সঙ্গে সহজেই বোধগম্য হয় কেন অনেকে রাজনীতির তুলনায় বাস্তবতায় বেশি মনোযোগী। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সহ গণতন্ত্রের উপকারগুলো নিয়ে সাধারণ জনগণকে সচেতন করতে বাংলাদেশ সরকার ও দেশের এনজিওগুলোকে আরও কঠোর পরিশ্রম করা প্রয়োজন। উভয় জাতীয় রাজনৈতিক দলের রাজতন্ত্রের ধরন আর দুর্নীতির মধ্য দিয়ে নিজে সমৃদ্ধ হওয়ার যে দীর্ঘদিনের প্রবণতা দলের নেতৃবৃন্দের রয়েছে তা আংশিক ব্যাখ্যা দেয় কেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি উভয়ই একটি ধর্মীয় পরিচয় প্রচার করে নাগরিকদের মনোযোগ ভিন্নমুখী করতে চায়। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের আদলে সংগঠিত ডানপন্থি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির জোট রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ভারত সরকার অভিযোগ তুলেছিল, ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ভারতে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে দেয়ার পেছনে দায়ী ছিল জামায়াত। এ কারণে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগে ছিল ভারতের সমর্থন। ভারত ছাড়া সব পশ্চিমা রাষ্ট্র নতুন নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে। পক্ষপাতমূলক সরকারের অধীনে নির্বাচন না করতে আওয়ামী লীগকে বোঝানোর প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন তার বিশেষ প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে বাংলাদেশে পাঠান। ২০১৩ সালে রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব তারানকো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মধ্যস্থতা করানোর চেষ্টা করেন। এতে ব্যর্থ হয়ে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। রাজনীতিতে ইসলামের সমন্বয় সাধনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আর প্রথাগত ইসলামী দলগুলোর পার্থক্য খুবই সামান্য। প্রধান দলগুলো উভয়ই এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যেখানে বাংলাদেশী সমাজে ধর্মের ক্রমবর্ধমান শক্ত প্রভাব রয়েছে। রাজনৈতিক ইসলাম দিয়েই বাংলাদেশের রাজনীতির অবকাঠামো। আর অদূর ভবিষ্যতেও তেমনটাই থাকার সম্ভাবনা।
মুবাশার হাসান- গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি’র স্কুল অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড আইআর-এ একজন পিএইচডি প্রার্থী। এছাড়াও তিনি ‘আলোচনা’ নামক ধর্মনিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতমুক্ত প্লাটফরমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
ইস্ট এশিয়া ফোরামে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ
মুবাশার হাসান- গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটি’র স্কুল অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড আইআর-এ একজন পিএইচডি প্রার্থী। এছাড়াও তিনি ‘আলোচনা’ নামক ধর্মনিরপেক্ষ এবং পক্ষপাতমুক্ত প্লাটফরমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।
ইস্ট এশিয়া ফোরামে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ
No comments