বনানী-গুলশানে ৪০ মিনি বার
রাজধানীর
অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান-বনানীর বেশিরভাগ হোটেল-রেস্তোরাঁ পরিণত
হয়েছে মিনি বারে। অনুমোদন ছাড়া বেআইনিভাবে এসব হোটেল রেস্তোরাঁয় প্রকাশ্যে
দেদার বিক্রি হচ্ছে বিদেশী ব্র্যান্ডের মদ ও বিয়ার। কিন্তু এসব অপরাধ দমনে
যাদের এগিয়ে আসার কথা তারা একরকম নির্বিকার। শুধু মাসোয়ারা তোলার জন্য
হোটেলগুলোর তালিকা করেই দায়িত্ব শেষ করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
অধিদফতরসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তালিকা ধরে ৪০টি হোটেল থেকে প্রতি মাসে এ
চক্রের অলিখিত ঘুষের পরিমাণ অন্তত অর্ধ কোটি টাকা। আর এতে সরকারকে বিপুল
পরিমাণ রাজস্ব হারাতে হচ্ছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে সরেজমিন অনুসন্ধান
চালিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, বনানীর ৬০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সুইট ড্রিম হোটেলে মদের বারের অনুমোদন নেই। আইনত তারা কোনো ধরনের মদ বিক্রি করতে পারে না। অনুমোদন ছাড়া হোটেলে মদ রাখা ও বিপণন সম্পূর্ণ দণ্ডনীয় অপরাধ। অবৈধভাবে মদের বার চালানো আরও বড় অপরাধ। কিন্তু এই হোটেলের ১৫ তলায় বিশাল সুসজ্জিত বার স্থাপন করেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। এই বারে রাজকীয় স্টাইলে নানা ব্র্যান্ডের বিদেশী মদ ও বিয়ার সর্বক্ষণ সাজিয়ে রাখা হয়। প্রতি রাতেই শত শত বিশেষ গ্রাহক এখানে মদ পান করতে আসেন। তবে এখানকার বারের আকর্ষণের পেছনে রয়েছে আরও ভিন্ন কারণ। রাজধানীতে শুধু এই বারেই মিনি স্কার্ট পরিহিত সুন্দরী যুবতীরা গ্রাহকদের মদ পরিবেশন করে থাকেন। যাদের সান্নিধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মদ পান। বিষয়টি সরেজমিন দেখতে ২০ নভেম্বর সুইট ড্রিম হোটেলে হাজির হয় যুগান্তরের অনুসন্ধান সেলের সদস্যরা। সঙ্গে গোপন ক্যামেরা। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুই সদস্যকে সাদা পোশাকে সঙ্গে নেয়া হয়। পুলিশ জানায়, পূর্ব পরিচয় ছাড়া হোটেলের বারে প্রবেশ অসম্ভব। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১১টা ছুঁই ছুঁই। হোটেলের অভ্যর্থনা কর্মীরা জানতে চান, কোথায় যাবেন? তাদের হোটেলের একজন নিয়মিত গ্রাহকের নাম বলার পর লিফটে ওঠার অনুমতি পাওয়া গেল। লিফটে উঠে ১৫ তলার সুইচ চাপলেন লিফটম্যান। তবে লিফটম্যান জানিয়ে দিলেন, বারের ছবি তোলা বা ভিডিও করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৫ তলায় উঠতেই উচ্চ শব্দে গান আর নাচের শব্দ ভেসে এলো। এই হোটেল বারের ইনচার্জ বাপ্পি এগিয়ে এলেন। তিনি জানালেন, বারে প্রতি ঘণ্টা অবস্থানের জন্য ১ হাজার ৮০০ টাকা দিতে হবে। তিনি বিদেশী মদ ও বিয়ারের রেট কার্ড ধরিয়ে দিলেন। দেখা গেল, এখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি ক্যান অবৈধ বিদেশী বিয়ার বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশী মদের বোতলের দাম ১৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এত দাম কেন জানতে চাইলে বাপ্পি জানালেন, এই হোটেল ও বারকে নিরাপদ করতে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিতে হয়। তাই দাম একটু বেশি হবেই। বাপ্পি আরও জানালেন, এখানে যারা আসেন তারা আগে থেকেই ফোন করে রুম বুক দিয়ে রাখেন। আগে না জানালে এখানে রুম পাওয়া তো দূরের কথা একটা চেয়ারও পাবেন না।
এরপর শুরু হল বাস্তব অনুসন্ধান। গোপন ক্যামেরা সচল করা হল। ঘুরে ঘুরে দর্শনার্থীদের সামাজিক অবস্থান জানার পালা। দেখা গেল, প্রচুর গ্রাহক মদ পান করে মাতাল অবস্থায় উচ্চস্বরে কথা বলছেন। যাদের বেশিরভাগের বেশভূষা সম্ভ্রান্ত পরিবারের। বয়সে অনেকেই তরুণ। একটু সামনে এগোতে চমক। দেখা গেল ষাটোর্ধ্ব কয়েকজন। অর্ধনগ্ন সুন্দরীদের নিয়ে নাচে বেপরোয়া মাতাল। স্বল্পবসনা যুবতীদের নাচের সঙ্গে বড় টিভি পর্দায় যৌন উত্তেজক ভিডিও দেখানো হচ্ছে। অবৈধ মদ-বিয়ার ব্যবসার এই রঙ্গ আয়োজনের পুরো চিত্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরে যুগান্তরের গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। যার অনেক কিছুই এখানে প্রকাশযোগ্য নয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই হোটেলে অবৈধ মদ-বিয়ারের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন গাজীপুর পুলিশ লাইনের রিজার্ভ অফিসার (আরও) সফিক। প্রতি রাতে এই হোটেলে তিনি নিজেও অতিথি হন। সফিক সম্প্রতি পিবিআইতে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) বদলি হয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তার এক পূর্ব পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তিনি নিয়মিত সুইট ড্রিম হোটেলে যান। তবে তার বিরুদ্ধে এই হোটেলে অবৈধ মদের ব্যবসা চালাতে সহায়তা করার অভিযোগ সঠিক নয়।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুইট ড্রিম হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, তার হোটেলে মদ-বিয়ার বিক্রি করা হয় না। যদি কেউ বিক্রি করে তবে সেটা তার জানার বাইরে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি একদিন হোটেলে এসে মদ-বিয়ার বিক্রির বিষয়টি ধরিয়ে দিন। তাহলে আমি ব্যবস্থা নিতে পারব।’
সরেজমিন অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, শুধু সুইট ড্রিম হোটেল নয় গুলশান-বনানীর অর্ধশতাধিক হোটেল ও রেস্তোরাঁতে প্রকাশ্যেই অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রি হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা শাখার তৈরি করা এ সংক্রান্ত তালিকাটি সম্প্রতি যুগান্তরের হাতে আসে। এতে ৪০টি হোটেল রেস্তোরাঁকে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য এবার তালিকাভুক্ত একটি রেস্তোরাঁয় (রেস্টুরেন্ট) সরেজমিন অনুসন্ধান চালানো হয়। তালিকায় বনানী ৪৩ নম্বর (বনানী ব্রিজসংলগ্ন) রোডের স্ট্রিট কাবাব রেস্টুরেন্টকে অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রির আখড়া বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২১ নভেম্বর রাত ১০টায় স্ট্রিট কাবাব রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, হোটেলের ভেতরে নানা রঙের আলো-আঁধারির ছায়া। দূর থেকে কাউকে ভালোভাবে চেনা যায় না। এখানেও টিভি পর্দায় উচ্চ শব্দে ইংরেজি গান বাজছে। আর গানের তালে তালে চলছে অর্ধবসনা তরুণীদের বেসামাল নাচ। সিনেম্যাটিক রাজ দরবারের ন্যায় নাচের আসরের পাশে রয়েছে রাজকীয় ঢঙের বালিশ ও সোফা। সেখানে বসে আছেন এ কালের এক শ্রেণীর রাজা অথবা বাদশা। বাস্তবে যারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনেক চেনামুখ। যারা দেদার গিলছেন বিদেশী মদ ও বিয়ার। সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন নানা বয়সী তরুণ-তরুণী। তাদের সামনের ছোট ছোট টেবিলে রাখা বিদেশী মদ, বিয়ার, গ্লাস ও বরফের টুকরো। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই আছে সিসা সেবনের যন্ত্র (এক ধরনের হুক্কা)। তরুণ-তরুণীরা মদ পান করছেন, আর মাঝে মাঝে সিসার নল মুখে নিয়ে গাঢ় ধোঁয়া টেনে নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে হোটেলের পুরো পরিবেশ মাদকতায় পূর্ণ এক অন্য রাজ্য। সূত্র জানায়, এই হোটেলটি আগে চালাতেন রাজধানীর একজন প্রভাবশালী সরকারদলীয় নেতার ছেলে। এখন এটি চালাচ্ছেন রাজধানীর কুখ্যাত ডিজে পার্টির আয়োজক জামিল হোসেন ও তার কথিত স্ত্রী লেমন। অবৈধ মদ-বিয়ারের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে জামিল হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তার হোটেলে মদ-বিয়ার বিক্রি করা হয় না। তাকে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় আরও যেসব হোটেল-রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো হল- গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের তিন নম্বর প্লটের স্প্যাঘেটি জাজ, ৫৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ির স্টিক হাউস, ৫৫ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ির খাজানা, ৩৭ নম্বর রোডের অলিভ গার্ডেন, ১০৯ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ির হেরিটেজ রেস্টুরেন্ট, ১১৮ নম্বর রোডের ১৫/বি নম্বর বাড়ির সাকুরা গোল্ডেন রাইস রেস্টুরেন্ট, ৭১ নম্বর রোডের কফি ম্যাঙ্গো, এক্সিট লাউঞ্জ, ৩৫ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়ির সামদাদ লি., ৭১ নম্বর রোডের ক্যাফে অ্যারাবিয়ান, ৫০ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির ফ্লেমবি, ৫০ নম্বর রোডের ডি জ্যাং জিম রেস্টুরেন্ট, দি ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট, অফ ট্র্যাক, গুলশান নর্থ এভিনিউর ৮ নম্বর বাড়ির স্প্রিট ফায়ার, ৭১ নম্বর রোডের থাই রেস্তোরাঁ সই-৭১, ৬৮ নম্বর রোডের কফি ওয়েগা, ৭১ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির ক্যাপিটাল ক্লাব, ৮৩ নম্বর রোডের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব, গুলশানের হোটেল ওয়াশিংটন, হোটেল রোজহুড, জায়ীকা রেস্টুরেন্ট, ১৩ গুলশান এভিনিউর ইফিজ, ৩৩ গুলশান এভিনিউর ফুড ভিলেজ, গুলশান ১৩৪-এর তোপ কাফি, গুলশান-১ এর ৬০/বি নম্বরের খুশবু রেস্টুরেন্ট, গুলশান-১ এর ৪৩ নম্বর বাড়ির এক্স লাউঞ্জ, বনানী ২৩ নম্বর রোডের মি লাউঞ্জ, বনানীর ফ্লোর সিক্স, সাংহাই, আলগিরা, হুক্কা লাউঞ্জ, বনানী ১১ নম্বর রোডের মিন্ট রেস্টুরেন্ট, রক রেস্টুরেন্ট, ডু মি ওকে রেস্টুরেন্ট, পেং ইয়াং রেস্টুরেন্ট, গুলশান-২ এর ৪৩ নম্বর রোডের সুরা রেস্টুরেন্ট, ৭১ নম্বর রোডের সুরা অন, নিউ কিংস কিচেন ও কোরিয়ানা রেস্টুরেন্ট।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছর নভেম্বরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তরফ থেকে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রির সঙ্গে যুক্ত এসব হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিককে ডেকে অবিলম্বে মদ-বিয়ার বিক্রি বন্ধ করতে বলা হয়। একই সঙ্গে রেস্টুরেন্টের প্রকাশ্য স্থানে ‘মদ-বিয়ার বিক্রি করা হয় না’ মর্মে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে বলা হয়। মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগে বেশ কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
কিন্তু তালিকাভুক্ত এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ ঘুরে ‘মদ-বিয়ার বিক্রি হয় না মর্মে’ কোথাও কোনো নোটিশ দেখা যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত এসব হোটেল-রেস্টুরেন্টের অনেকগুলো চলছে বিদেশী মালিকানার ভাঁওতাবাজির মধ্য দিয়ে।
অভিযোগ রয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক হিসেবে যখন যিনি দায়িত্ব পালন করেন তিনিই হোটেল রেস্টুরেন্ট নামধারী এসব মদের আখড়া থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেন। অনেক হোটেল মালিক গুলশান সার্কেলের পরিদর্শককে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোয়ারা দেয়ার কথা যুগান্তরের কাছে স্বীকারও করেন। এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের বর্তমান পরিদর্শক লায়েকুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। তাদের নিয়মিত নজরদারির কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর অনেকগুলোতে মদ ও বিয়ার বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) প্রণব কুমার নিয়োগী যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিমাসেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। আমরা একটি যৌথ দল গঠন করে এ বিষয়ে খুব শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালাব।’
জানা যায়, বনানীর ৬০ কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সুইট ড্রিম হোটেলে মদের বারের অনুমোদন নেই। আইনত তারা কোনো ধরনের মদ বিক্রি করতে পারে না। অনুমোদন ছাড়া হোটেলে মদ রাখা ও বিপণন সম্পূর্ণ দণ্ডনীয় অপরাধ। অবৈধভাবে মদের বার চালানো আরও বড় অপরাধ। কিন্তু এই হোটেলের ১৫ তলায় বিশাল সুসজ্জিত বার স্থাপন করেছে হোটেল কর্তৃপক্ষ। এই বারে রাজকীয় স্টাইলে নানা ব্র্যান্ডের বিদেশী মদ ও বিয়ার সর্বক্ষণ সাজিয়ে রাখা হয়। প্রতি রাতেই শত শত বিশেষ গ্রাহক এখানে মদ পান করতে আসেন। তবে এখানকার বারের আকর্ষণের পেছনে রয়েছে আরও ভিন্ন কারণ। রাজধানীতে শুধু এই বারেই মিনি স্কার্ট পরিহিত সুন্দরী যুবতীরা গ্রাহকদের মদ পরিবেশন করে থাকেন। যাদের সান্নিধ্যে গভীর রাত পর্যন্ত চলে মদ পান। বিষয়টি সরেজমিন দেখতে ২০ নভেম্বর সুইট ড্রিম হোটেলে হাজির হয় যুগান্তরের অনুসন্ধান সেলের সদস্যরা। সঙ্গে গোপন ক্যামেরা। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুই সদস্যকে সাদা পোশাকে সঙ্গে নেয়া হয়। পুলিশ জানায়, পূর্ব পরিচয় ছাড়া হোটেলের বারে প্রবেশ অসম্ভব। ঘড়ির কাটায় তখন রাত ১১টা ছুঁই ছুঁই। হোটেলের অভ্যর্থনা কর্মীরা জানতে চান, কোথায় যাবেন? তাদের হোটেলের একজন নিয়মিত গ্রাহকের নাম বলার পর লিফটে ওঠার অনুমতি পাওয়া গেল। লিফটে উঠে ১৫ তলার সুইচ চাপলেন লিফটম্যান। তবে লিফটম্যান জানিয়ে দিলেন, বারের ছবি তোলা বা ভিডিও করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৫ তলায় উঠতেই উচ্চ শব্দে গান আর নাচের শব্দ ভেসে এলো। এই হোটেল বারের ইনচার্জ বাপ্পি এগিয়ে এলেন। তিনি জানালেন, বারে প্রতি ঘণ্টা অবস্থানের জন্য ১ হাজার ৮০০ টাকা দিতে হবে। তিনি বিদেশী মদ ও বিয়ারের রেট কার্ড ধরিয়ে দিলেন। দেখা গেল, এখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি ক্যান অবৈধ বিদেশী বিয়ার বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশী মদের বোতলের দাম ১৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এত দাম কেন জানতে চাইলে বাপ্পি জানালেন, এই হোটেল ও বারকে নিরাপদ করতে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিতে হয়। তাই দাম একটু বেশি হবেই। বাপ্পি আরও জানালেন, এখানে যারা আসেন তারা আগে থেকেই ফোন করে রুম বুক দিয়ে রাখেন। আগে না জানালে এখানে রুম পাওয়া তো দূরের কথা একটা চেয়ারও পাবেন না।
এরপর শুরু হল বাস্তব অনুসন্ধান। গোপন ক্যামেরা সচল করা হল। ঘুরে ঘুরে দর্শনার্থীদের সামাজিক অবস্থান জানার পালা। দেখা গেল, প্রচুর গ্রাহক মদ পান করে মাতাল অবস্থায় উচ্চস্বরে কথা বলছেন। যাদের বেশিরভাগের বেশভূষা সম্ভ্রান্ত পরিবারের। বয়সে অনেকেই তরুণ। একটু সামনে এগোতে চমক। দেখা গেল ষাটোর্ধ্ব কয়েকজন। অর্ধনগ্ন সুন্দরীদের নিয়ে নাচে বেপরোয়া মাতাল। স্বল্পবসনা যুবতীদের নাচের সঙ্গে বড় টিভি পর্দায় যৌন উত্তেজক ভিডিও দেখানো হচ্ছে। অবৈধ মদ-বিয়ার ব্যবসার এই রঙ্গ আয়োজনের পুরো চিত্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরে যুগান্তরের গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। যার অনেক কিছুই এখানে প্রকাশযোগ্য নয়।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, এই হোটেলে অবৈধ মদ-বিয়ারের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পেছনে শক্তি হিসেবে কাজ করছেন গাজীপুর পুলিশ লাইনের রিজার্ভ অফিসার (আরও) সফিক। প্রতি রাতে এই হোটেলে তিনি নিজেও অতিথি হন। সফিক সম্প্রতি পিবিআইতে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) বদলি হয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তার এক পূর্ব পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে তিনি নিয়মিত সুইট ড্রিম হোটেলে যান। তবে তার বিরুদ্ধে এই হোটেলে অবৈধ মদের ব্যবসা চালাতে সহায়তা করার অভিযোগ সঠিক নয়।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুইট ড্রিম হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল যুগান্তরকে বলেন, তার হোটেলে মদ-বিয়ার বিক্রি করা হয় না। যদি কেউ বিক্রি করে তবে সেটা তার জানার বাইরে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি একদিন হোটেলে এসে মদ-বিয়ার বিক্রির বিষয়টি ধরিয়ে দিন। তাহলে আমি ব্যবস্থা নিতে পারব।’
সরেজমিন অনুসন্ধানের তথ্য বলছে, শুধু সুইট ড্রিম হোটেল নয় গুলশান-বনানীর অর্ধশতাধিক হোটেল ও রেস্তোরাঁতে প্রকাশ্যেই অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রি হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা শাখার তৈরি করা এ সংক্রান্ত তালিকাটি সম্প্রতি যুগান্তরের হাতে আসে। এতে ৪০টি হোটেল রেস্তোরাঁকে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য এবার তালিকাভুক্ত একটি রেস্তোরাঁয় (রেস্টুরেন্ট) সরেজমিন অনুসন্ধান চালানো হয়। তালিকায় বনানী ৪৩ নম্বর (বনানী ব্রিজসংলগ্ন) রোডের স্ট্রিট কাবাব রেস্টুরেন্টকে অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রির আখড়া বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২১ নভেম্বর রাত ১০টায় স্ট্রিট কাবাব রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, হোটেলের ভেতরে নানা রঙের আলো-আঁধারির ছায়া। দূর থেকে কাউকে ভালোভাবে চেনা যায় না। এখানেও টিভি পর্দায় উচ্চ শব্দে ইংরেজি গান বাজছে। আর গানের তালে তালে চলছে অর্ধবসনা তরুণীদের বেসামাল নাচ। সিনেম্যাটিক রাজ দরবারের ন্যায় নাচের আসরের পাশে রয়েছে রাজকীয় ঢঙের বালিশ ও সোফা। সেখানে বসে আছেন এ কালের এক শ্রেণীর রাজা অথবা বাদশা। বাস্তবে যারা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অনেক চেনামুখ। যারা দেদার গিলছেন বিদেশী মদ ও বিয়ার। সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন নানা বয়সী তরুণ-তরুণী। তাদের সামনের ছোট ছোট টেবিলে রাখা বিদেশী মদ, বিয়ার, গ্লাস ও বরফের টুকরো। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই আছে সিসা সেবনের যন্ত্র (এক ধরনের হুক্কা)। তরুণ-তরুণীরা মদ পান করছেন, আর মাঝে মাঝে সিসার নল মুখে নিয়ে গাঢ় ধোঁয়া টেনে নিচ্ছেন। সব মিলিয়ে হোটেলের পুরো পরিবেশ মাদকতায় পূর্ণ এক অন্য রাজ্য। সূত্র জানায়, এই হোটেলটি আগে চালাতেন রাজধানীর একজন প্রভাবশালী সরকারদলীয় নেতার ছেলে। এখন এটি চালাচ্ছেন রাজধানীর কুখ্যাত ডিজে পার্টির আয়োজক জামিল হোসেন ও তার কথিত স্ত্রী লেমন। অবৈধ মদ-বিয়ারের ব্যবসা সম্পর্কে জানতে চাইলে জামিল হোসেন শনিবার যুগান্তরকে বলেন, তার হোটেলে মদ-বিয়ার বিক্রি করা হয় না। তাকে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য মিথ্যা অভিযোগ ছড়ানো হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকায় আরও যেসব হোটেল-রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ বিদেশী মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো হল- গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের তিন নম্বর প্লটের স্প্যাঘেটি জাজ, ৫৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়ির স্টিক হাউস, ৫৫ নম্বর রোডের ৯ নম্বর বাড়ির খাজানা, ৩৭ নম্বর রোডের অলিভ গার্ডেন, ১০৯ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ির হেরিটেজ রেস্টুরেন্ট, ১১৮ নম্বর রোডের ১৫/বি নম্বর বাড়ির সাকুরা গোল্ডেন রাইস রেস্টুরেন্ট, ৭১ নম্বর রোডের কফি ম্যাঙ্গো, এক্সিট লাউঞ্জ, ৩৫ নম্বর রোডের ২৭ নম্বর বাড়ির সামদাদ লি., ৭১ নম্বর রোডের ক্যাফে অ্যারাবিয়ান, ৫০ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাড়ির ফ্লেমবি, ৫০ নম্বর রোডের ডি জ্যাং জিম রেস্টুরেন্ট, দি ক্যাসেল রেস্টুরেন্ট, অফ ট্র্যাক, গুলশান নর্থ এভিনিউর ৮ নম্বর বাড়ির স্প্রিট ফায়ার, ৭১ নম্বর রোডের থাই রেস্তোরাঁ সই-৭১, ৬৮ নম্বর রোডের কফি ওয়েগা, ৭১ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির ক্যাপিটাল ক্লাব, ৮৩ নম্বর রোডের ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব, গুলশানের হোটেল ওয়াশিংটন, হোটেল রোজহুড, জায়ীকা রেস্টুরেন্ট, ১৩ গুলশান এভিনিউর ইফিজ, ৩৩ গুলশান এভিনিউর ফুড ভিলেজ, গুলশান ১৩৪-এর তোপ কাফি, গুলশান-১ এর ৬০/বি নম্বরের খুশবু রেস্টুরেন্ট, গুলশান-১ এর ৪৩ নম্বর বাড়ির এক্স লাউঞ্জ, বনানী ২৩ নম্বর রোডের মি লাউঞ্জ, বনানীর ফ্লোর সিক্স, সাংহাই, আলগিরা, হুক্কা লাউঞ্জ, বনানী ১১ নম্বর রোডের মিন্ট রেস্টুরেন্ট, রক রেস্টুরেন্ট, ডু মি ওকে রেস্টুরেন্ট, পেং ইয়াং রেস্টুরেন্ট, গুলশান-২ এর ৪৩ নম্বর রোডের সুরা রেস্টুরেন্ট, ৭১ নম্বর রোডের সুরা অন, নিউ কিংস কিচেন ও কোরিয়ানা রেস্টুরেন্ট।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছর নভেম্বরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তরফ থেকে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রির সঙ্গে যুক্ত এসব হোটেল ও রেস্টুরেন্ট মালিককে ডেকে অবিলম্বে মদ-বিয়ার বিক্রি বন্ধ করতে বলা হয়। একই সঙ্গে রেস্টুরেন্টের প্রকাশ্য স্থানে ‘মদ-বিয়ার বিক্রি করা হয় না’ মর্মে নোটিশ টাঙিয়ে দিতে বলা হয়। মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগে বেশ কিছু হোটেল-রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
কিন্তু তালিকাভুক্ত এসব হোটেল-রেস্তোরাঁ ঘুরে ‘মদ-বিয়ার বিক্রি হয় না মর্মে’ কোথাও কোনো নোটিশ দেখা যায়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত এসব হোটেল-রেস্টুরেন্টের অনেকগুলো চলছে বিদেশী মালিকানার ভাঁওতাবাজির মধ্য দিয়ে।
অভিযোগ রয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের পরিদর্শক হিসেবে যখন যিনি দায়িত্ব পালন করেন তিনিই হোটেল রেস্টুরেন্ট নামধারী এসব মদের আখড়া থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেন। অনেক হোটেল মালিক গুলশান সার্কেলের পরিদর্শককে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোয়ারা দেয়ার কথা যুগান্তরের কাছে স্বীকারও করেন। এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গুলশান সার্কেলের বর্তমান পরিদর্শক লায়েকুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, মাসোয়ারা নেয়ার অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। তাদের নিয়মিত নজরদারির কারণে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোর অনেকগুলোতে মদ ও বিয়ার বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে।
বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অবৈধ মদ-বিয়ার বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) প্রণব কুমার নিয়োগী যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিমাসেই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। আমরা একটি যৌথ দল গঠন করে এ বিষয়ে খুব শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান চালাব।’
No comments