প্রাচীন ও অপরূপ মনোমুগ্ধকর এক শহর by জাহিদ কবীর হিমন
দুহাতে দুজন পুরুষের মূতি হাতে ঘূর্ণমান নারীমূর্তি |
কন্সট্যাঞ্জ শহরের রাতের দৃশ্য |
লেখক : জাহিদ কবীর হিমন |
প্রথম রোমান সম্রাট অগাস্টাস যখন ক্ষমতায় ঠিক সেই সময়টায় এ অঞ্চলের দক্ষিণে বাস করত প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইউরোপিয়ানরা। এদের হটিয়ে রোমানরা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে ৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। রাইন নদীর তীরে অবস্থিত এই অঞ্চলটির পূর্ব নাম যদিও ছিল ‘ড্রুসোম্যাগাস’ তবে রোমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট কন্সটানশিয়াস ক্লোরাসের নামানুসারে তা হয়ে যায় ‘কন্সটান্সিয়া’। কেউ কেউ বলে থাকে এই নাম এসেছে ক্লোরাসের নাতি সম্রাট দ্বিতীয় কন্সটান্সিয়াসের নাম থেকে, যিনি এই অঞ্চলে প্রথম আসেন ৩৫৪ খ্রিষ্টাব্দে। সুইজারল্যান্ডের সীমানা ঘেঁষে থাকা জার্মানির একমাত্র শহর কন্সট্যাঞ্জ৷ যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়েছে। এ শহর থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে সুইজারল্যান্ড যাওয়া যায়। প্রাগৈতিহাসিক নানা চিহ্ন বহনকারী ঐতিহাসিক এই শহরের কেন্দ্র দিয়ে হেঁটে গেলে চোখে পড়ে মধ্যযুগের গোড়ার দিকের গির্জা, চিত্রিত রেনেসাঁ ভিলাস, মনোমুগ্ধকর ডিজাইন ও শিল্পকলা। সৌন্দর্যের দিক থেকে অবশ্যই এই শহরের নাটুকে স্থাপত্য উপভোগ করার মতোই ব্যাপার।
ইউরোপের হৃদপিন্ডে বিখ্যাত রাইন নদী। যার এক প্রান্তে অস্ট্রিয়া হয়ে ছুঁয়ে এসেছে সুইজারল্যান্ড। আর দুই ভাগ হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে জার্মানিতে ঢুকে চলে গেছে একেবারে উত্তর প্রান্ত অবধি। কন্সটাঞ্জে রাইন নদী আর কন্সট্যাঞ্জ লেক মিলিত হয়েছে। লেকের ওপার আর এপার মিলে এই শহর দুটি ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের সীমানা। সত্তর-আশির দশকের দিকে এই লেকের পানি কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়লে এ অঞ্চলের প্রাণী-বৈচিত্র্য বিশেষ করে মাছের জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের ফলে সেই অবস্থা আর নেই। লোকের মুখে শুনেছি, এই লেকের পানি এতই স্বচ্ছ যে তা পান করা যায়। স্বচ্ছ পানি আমি নিজ চোখেও দেখেছি। এই লেকের পানিই প্রায় ১২২ কিলোমিটার বেয়ে চলে গেছে স্টুটগার্টে এবং সেখানকার প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ পরিশোধিত জল পান করে জীবনধারণ করে।
মূল শহরের সঙ্গে লেকের যে অংশটি আছে, তার তীরে রয়েছে নয় মিটার দৈর্ঘ্য আর ১৮ টন ওজনের বিশাল কনক্রিটের এক নারীমূর্তি। এই নারীমূর্তি দুহাতে দুজন পুরুষের মূর্তি নিয়ে শ্লথ গতিতে নিয়ত ঘূর্ণমান। এই নারীর নাম লা বেলে ইম্পেরিয়া আর যে দুজন পুরুষের মূর্তি তার হাতে তাঁরা হলেন ওই সময়ের পোপ মার্টিন ভি আর তৎকালীন রাজা সিগিসমুন্ড। কথিত আছে, ১৪৮৫ সালে ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী এই সুন্দরী ইম্পেরিয়ার রূপযৌবনে মুগ্ধ ছিলেন পোপ ও রাজা উভয়েই। তাঁদের ওপর ইম্পেরিয়ার প্রভাব ছিল সীমাহীন।
শহরের এক প্রান্তে ঘন বনজঙ্গলে ঘেরা সুবিশাল এলাকাজুড়ে আছে এ অঞ্চলের গর্ব স্বনামধন্য কন্সট্যাঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১০ হাজার ছাত্র নিয়ে সুনামের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা বিস্তারে এ অঞ্চলে ভূমিকা রেখে আসছে সেই ১৯৬৬ সাল থেকে। ইউরোপের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। এখানে প্রায় দুই মিলিয়ন বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী যারা ভবিষ্যতে জার্মানিতে পড়তে আগ্রহী তারা এখানে চেষ্টা করতে পারে। এখানে ভর্তিপ্রক্রিয়া অন্য অনেক নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপেক্ষাকৃত সহজ। আর সবই ইন্টানেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। তবে এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন, এই সিটিতে টাকা ব্লক করে রাখতে হয়। আর এক বছরের ভিসা পাওয়া যায় মাত্র। বছর বছর টাকা রেখে তা হালনাগাদ করে নিতে হয়।
ঝকঝকে তকতকে রাস্তার এই শহরে তরুণ-যুবক-বুড়ো প্রায় সবাই সাইকেলে যাতায়াত করে। গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। হইচই ও কোলাহল নেই। যানজটের তো প্রশ্নই আসে না। অল্পবিস্তর গাড়ির যাই চলুক না কেন কোনো ভেঁপুর (হর্ন) শব্দ কানে আসে না। শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে আপেলগাছ। আমি এই শহরে কিছুদিন ছিলাম। তখন আমি অযাচিতভাবে গাছ থেকে আপেল পেড়েও খেয়েছি। পরে শুনেছি ওসব ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। তাই সাবধান হয়েছি। এই শহরে সর্বমোট মানুষ প্রায় ৮৫ হাজার। উন্নত জীবনমান, উচ্চ মূল্যবোধ আর নিরাপদ জীবনধারা এই শহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নিকট অতীতেও ঘটার কথা শোনা যায়নি। এক পাশে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম কন্সট্যাঞ্জ লেক অপর পাশে সুবিশাল রাইন নদী। এর সঙ্গে সৌন্দর্যের অন্যতম অলংকার যুক্ত হয়েছে দূরের আলপস পর্বতমালা। অপরূপ এই ছোট্ট শহরে যেদিকেই নয়ন মেলে তাকানো যায় নির্মল সুশীতল স্পর্শে হৃদয়াঙ্গন নেচে ওঠে।
জাহিদ কবীর হিমন
হ্যানোভার, জার্মানি
ইউরোপের হৃদপিন্ডে বিখ্যাত রাইন নদী। যার এক প্রান্তে অস্ট্রিয়া হয়ে ছুঁয়ে এসেছে সুইজারল্যান্ড। আর দুই ভাগ হয়ে দক্ষিণ দিক থেকে জার্মানিতে ঢুকে চলে গেছে একেবারে উত্তর প্রান্ত অবধি। কন্সটাঞ্জে রাইন নদী আর কন্সট্যাঞ্জ লেক মিলিত হয়েছে। লেকের ওপার আর এপার মিলে এই শহর দুটি ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডের সীমানা। সত্তর-আশির দশকের দিকে এই লেকের পানি কলকারখানার বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়লে এ অঞ্চলের প্রাণী-বৈচিত্র্য বিশেষ করে মাছের জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের ফলে সেই অবস্থা আর নেই। লোকের মুখে শুনেছি, এই লেকের পানি এতই স্বচ্ছ যে তা পান করা যায়। স্বচ্ছ পানি আমি নিজ চোখেও দেখেছি। এই লেকের পানিই প্রায় ১২২ কিলোমিটার বেয়ে চলে গেছে স্টুটগার্টে এবং সেখানকার প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ পরিশোধিত জল পান করে জীবনধারণ করে।
মূল শহরের সঙ্গে লেকের যে অংশটি আছে, তার তীরে রয়েছে নয় মিটার দৈর্ঘ্য আর ১৮ টন ওজনের বিশাল কনক্রিটের এক নারীমূর্তি। এই নারীমূর্তি দুহাতে দুজন পুরুষের মূর্তি নিয়ে শ্লথ গতিতে নিয়ত ঘূর্ণমান। এই নারীর নাম লা বেলে ইম্পেরিয়া আর যে দুজন পুরুষের মূর্তি তার হাতে তাঁরা হলেন ওই সময়ের পোপ মার্টিন ভি আর তৎকালীন রাজা সিগিসমুন্ড। কথিত আছে, ১৪৮৫ সালে ইতালিতে জন্মগ্রহণকারী এই সুন্দরী ইম্পেরিয়ার রূপযৌবনে মুগ্ধ ছিলেন পোপ ও রাজা উভয়েই। তাঁদের ওপর ইম্পেরিয়ার প্রভাব ছিল সীমাহীন।
শহরের এক প্রান্তে ঘন বনজঙ্গলে ঘেরা সুবিশাল এলাকাজুড়ে আছে এ অঞ্চলের গর্ব স্বনামধন্য কন্সট্যাঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ১০ হাজার ছাত্র নিয়ে সুনামের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষা বিস্তারে এ অঞ্চলে ভূমিকা রেখে আসছে সেই ১৯৬৬ সাল থেকে। ইউরোপের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। এখানে প্রায় দুই মিলিয়ন বইয়ের বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী যারা ভবিষ্যতে জার্মানিতে পড়তে আগ্রহী তারা এখানে চেষ্টা করতে পারে। এখানে ভর্তিপ্রক্রিয়া অন্য অনেক নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপেক্ষাকৃত সহজ। আর সবই ইন্টানেটের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায়। তবে এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের জানা প্রয়োজন, এই সিটিতে টাকা ব্লক করে রাখতে হয়। আর এক বছরের ভিসা পাওয়া যায় মাত্র। বছর বছর টাকা রেখে তা হালনাগাদ করে নিতে হয়।
ঝকঝকে তকতকে রাস্তার এই শহরে তরুণ-যুবক-বুড়ো প্রায় সবাই সাইকেলে যাতায়াত করে। গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। হইচই ও কোলাহল নেই। যানজটের তো প্রশ্নই আসে না। অল্পবিস্তর গাড়ির যাই চলুক না কেন কোনো ভেঁপুর (হর্ন) শব্দ কানে আসে না। শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে আপেলগাছ। আমি এই শহরে কিছুদিন ছিলাম। তখন আমি অযাচিতভাবে গাছ থেকে আপেল পেড়েও খেয়েছি। পরে শুনেছি ওসব ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। তাই সাবধান হয়েছি। এই শহরে সর্বমোট মানুষ প্রায় ৮৫ হাজার। উন্নত জীবনমান, উচ্চ মূল্যবোধ আর নিরাপদ জীবনধারা এই শহরের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এখানে কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নিকট অতীতেও ঘটার কথা শোনা যায়নি। এক পাশে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম কন্সট্যাঞ্জ লেক অপর পাশে সুবিশাল রাইন নদী। এর সঙ্গে সৌন্দর্যের অন্যতম অলংকার যুক্ত হয়েছে দূরের আলপস পর্বতমালা। অপরূপ এই ছোট্ট শহরে যেদিকেই নয়ন মেলে তাকানো যায় নির্মল সুশীতল স্পর্শে হৃদয়াঙ্গন নেচে ওঠে।
জাহিদ কবীর হিমন
হ্যানোভার, জার্মানি
No comments